ভবিষ্যতে স্বাধীনতা পুরস্কারের মতো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ব্যক্তির জীবদ্দশায় দেওয়ার নিয়ম করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘আমরা যেন আগামীতে নিয়ম করতে পারি, যাঁদের মরণোত্তর পুরস্কার দেওয়ার পালা, তাঁদের দেওয়া শেষ হওয়ার পর থেকে শুধু জীবিত অবস্থায় যাঁরা আছেন, তাঁদের আমরা পুরস্কার দেব। তাঁদের প্রতি সম্মান জানাব।’

আজ মঙ্গলবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এ বছরের স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

এবার মুক্তিযুদ্ধ ও সংস্কৃতিতে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান ওরফে আজম খান (পপসম্রাট)। বাবার পক্ষে স্বাধীনতা পুরস্কার গ্রহণের পর অনুভূতি জানাতে গিয়ে আজম খানের কন্যা অরনী খান বলেন, মৃত্যুর পর স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদক দেওয়ার মাধ্যমে সরকার তাঁর বাবাকে যে সম্মান দিয়েছে, তা তাঁদের জন্য অমূল্য গর্বের বিষয়। এবার স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়ায় তাঁরা খুবই আনন্দিত। তবে তিনি যদি জীবিত অবস্থায় এই সম্মাননা পেতেন, তাহলে তাঁদের আনন্দ অনেক গুণ বেড়ে যেত।

যে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য ব্যক্তিরা এখনো বেঁচে আছেন, জীবিত অবস্থায় যেন তাঁদের যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হয়, সরকারের কাছে সেই অনুরোধ জানান অরনী খান।

অনুষ্ঠান শেষে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আজকের অনুষ্ঠানে আমাদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে মরণোত্তর পুরস্কার দেওয়ার চাইতে জীবদ্দশায় পুরস্কারটি পেলে যে আনন্দ দেশের জন্য, পরিবারের জন্য, ব্যক্তির জন্য তা মরণোত্তর পুরস্কারে পাওয়া যায় না। যাঁকে আমরা সম্মান দেখাচ্ছি, তিনি আমাদের সঙ্গে নেই। আমরা যেন আগামীতে নিয়ম করতে পারি, যাঁদের মরণোত্তর পুরস্কার দেওয়ার পালা, তাঁদের দেওয়া শেষ হওয়ার পর থেকে শুধু জীবিত অবস্থায় যাঁরা আছেন, তাঁদের আমরা পুরস্কার দেব।’

পুরস্কারের জন্য মনোনীত ব্যক্তিদের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘তাঁরা আমাদের জাতিকে এক মহান উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, পুরস্কার দিয়ে কেবল তাঁদের সম্মান করছি না, আমরা বরং জাতি হিসেবে নিজের সম্মান তাঁদের মাধ্যমে আমরা পাচ্ছি। তাঁরা প্রত্যেকেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুল পরিচিত, তাঁরা জাতির জন্য অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। আমরা চাই, যাঁদের আমরা সম্মান দিতে চাই, যথাসময়ে যেন সেটি দেই।’

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে আইনের শাসন থাকবে, মানুষের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত হবে এবং একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে এখনো ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। দীর্ঘদিন ধরে এ দেশের মানুষকে তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। দুর্নীতি, লুটপাটতন্ত্র ও গুম-খুনের রাজত্ব চালিয়ে দেশে একটি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘তাদের আত্মত্যাগের কারণে আমরা একটি “নতুন বাংলাদেশ” গড়ার স্বপ্ন দেখার সুযোগ পেয়েছি। এ সুযোগ আমরা কোনোক্রমেই বৃথা যেতে দেব না।’

এ সময় এই বছর স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ‘বাংলার সূর্যসন্তান’ উল্লেখ করে তাঁদের কর্মময় জীবনের ওপর আলোকপাত করেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘যাঁরা আজ এ সম্মাননা পেলেন, তাঁরা জীবদ্দশায় এ প্রাপ্তি দেখে যেতে পারেননি। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আজকের দিনে তাঁদের অবদানকে আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি।’

জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদান স্বরূপ এ বছর সাত বিশিষ্টজনকে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়। এর মধ্যে শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে মনোনীত লেখক ও বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন মোহাম্মদ উমর (বদরুদ্দীন উমর) ছাড়া বাকি ছয়জনই মরণোত্তর পুরস্কার পেয়েছেন। বদরুদ্দীন উমরও আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুরস্কার গ্রহণ করেননি। আজকের অনুষ্ঠানের সঞ্চালক মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আবদুর রশীদ জানিয়েছেন, বদরুদ্দীন উমরের পুরস্কারের রেপ্লিকা জাতীয় জাদুঘরে রাখা হবে।

আর মরণোত্তর পুরস্কার পাওয়া ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনের পক্ষে তাঁর পরিবারের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার হাত থেকে পুরস্কার নেন। এর মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পুরস্কারপ্রাপ্ত অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের পক্ষে তাঁর কন্যা সাদাফ সায সিদ্দিকী, সাহিত্যে মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদের (কবি আল মাহমুদ) পক্ষে তাঁর কন্যা আতিয়া মীর, সমাজসেবায় ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের পক্ষে তাঁর ছেলে শামেরান আবেদ, মুক্তিযুদ্ধ ও সংস্কৃতিতে মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান ওরফে আজম খানের (পপসম্রাট) পক্ষে তাঁর কন্যা অরনী খান এবং প্রতিবাদী তারুণ্যে স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়া বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের (তৎকালীন বুয়েট ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের নির্যাতনে নিহত) পক্ষে তাঁর মা রোকেয়া খাতুন পুরস্কার গ্রহণ করেন। এ ছাড়া সংস্কৃতিতে পুরস্কারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অন্যতম নকশাকার নভেরা আহমেদের পুরস্কার প্যারিসে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে তাঁর পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

সরকার ১৯৭৭ সাল থেকে প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে এই পুরস্কার দিয়ে আসছে। স্বাধীনতা পুরস্কারের ক্ষেত্রে পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে পাঁচ লাখ টাকা, স্বর্ণপদক, পদকের একটি রেপ্লিকা ও একটি সম্মাননাপত্র দেওয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত ৩২টি প্রতিষ্ঠান ও ৩২৪ জন ব্যক্তি এই পুরস্কার পেয়েছেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জ ব ত অবস থ য় র প রস ক র প রস ক র দ র স ব ধ নত প রস ক র প প রস ক র র বদর দ দ ন অন ষ ঠ ন র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

কুয়েট শিক্ষার্থীদের নামে মামলা এবং বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবি গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) শিক্ষার্থীদের নামে মামলা এবং বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দিয়েছে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ। আজ মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে সংবাদ সম্মেলনে এই দুই দাবিসহ পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের সদস্যসচিব জাহিদ আহসান। তিনি বলেন, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল এবং বহিরাগত বিএনপি-যুবদল ক্যাডাররা সাধারণ ছাত্রদের ওপর নির্মম হামলা চালান। সেখানে দলীয় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও ছাত্রদলের জোরপূর্বক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জের ধরেই ওই হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ মাসুদকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। সেই হামলায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। শিক্ষার্থীরা বারবার প্রশাসনের সাহায্য চেয়েও নিরাশ হন।

হামলার শিকার হওয়া শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ আছে। এরই মধ্যে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার দাবিতে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন, সেই সময়েই ১০ এপ্রিল ২২ জন শিক্ষার্থীর নামে মিথ্যা মামলা করা হয়। মামলার পরপরই ১৩ এপ্রিল রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নামে মামলা প্রত্যাহারের দাবি তোলে।

গতকাল রাতে মিরপুরে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় সদস্য মাহিন আহমদের ওপর বিএনপি ও যুবদলের নেতা–কর্মীরা নির্মম হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছে ছাত্রসংগঠনটি। সংগঠনটির ভাষ্য, হামলায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাধিক সদস্য আহত হয়েছেন বলে তারা নিশ্চিত হয়েছে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা ছিল সহিংস রাজনীতির বদলে সমাজে সৌহার্দ্যপূর্ণ রাজনৈতিক অবস্থান বজায় রাখা। কিন্তু অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে বিএনপি আগের মতোই সহিংসতা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করে সংগঠনটি।

পাঁচ দফা দাবি

১. কুয়েটে ছাত্রদল-যুবদলের হামলা, মামলা এবং শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারের বিষয়ে নিরপেক্ষ ভদন্ত করে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা। ২. আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের নামে মামলা এবং বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা। ৩. কুয়েটের ভিসি ড. মোহাম্মদ মাসুদকে আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে পদত্যাগ করা, পদত্যাগ না করলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবলে অপসারণ করা। ৪. আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কুয়েটের সব হল খুলে দেওয়া এবং সর্বশেষ দাবি হলো মাহিন আহম্মেদের ওপর হামলাকারীদের অনতিবিলম্বে গ্রেপ্তার করা।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। পরদিন প্রশাসনিক ভবনসহ সব একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। ওই দিন দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় কুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে কমিটি করা হয়। ওই দিন রাতেই খানজাহান আলী থানায় অজ্ঞাতনামা ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করে প্রশাসন। ২৫ ফেব্রুয়ারি সব আবাসিক হল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হয়। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার কুয়েটের ২২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আমলি আদালতে মামলা করেন নগরের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকার হোচেন আলী নামের এক ব্যক্তি।

আরও পড়ুন৩৭ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার, ২ মে হল খোলার সিদ্ধান্ত২০ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ