Risingbd:
2025-03-25@19:25:10 GMT

ইতিহাসের পাতায় ২৫ মার্চ ১৯৭১

Published: 25th, March 2025 GMT

ইতিহাসের পাতায় ২৫ মার্চ ১৯৭১

কালরাত ছিল অকাল মৃত্যুর রাত; মুক্তিকামী বাঙালির ওপর গুলি চালিয়ে হত্যা করে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলে স্বাধীনতার স্বপ্ন সমাধিস্থ করার অপচেষ্টার রজনী। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়েছিল। আর একাত্তরের ২৫ মার্চ তারা সংঘটিত করেছিল গণহত্যার সূচনা। আজকের তরুণ প্রজন্ম কল্পনাও করতে পারবে না যে, আচমকা এক রাতে পাকিস্তানি সশস্ত্র সৈনিকেরা কীভাবে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বাঙালিদের ওপর চড়াও হয়ে নির্বিচার গণহত্যায় মেতেছিল। 

মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সেই রাতে সাত হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেপ্তার করা হয় আরও তিন হাজার। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। এরপর পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট। লুট আর ধ্বংস যেন তাদের নেশায় পরিণত হলো। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুনতাড়িত শ্মশান ভূমি।’

১৯৭১-এর ২৫ মার্চে লে.

জেনারেল টিক্কা খান যুগপৎ গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বে ছিলেন। ১০ এপ্রিল তার কাছ থেকে সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব বুঝে নেন লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে নিয়াজি বলেন:

আরো পড়ুন:

ঢাকা বাদে ৬৩ জেলায় স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ: প্রেস উইং

ইবিতে ‘স্বাধীনতাবিরোধীর’ নামে হল, শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ

‘একাত্তর সালের ২৫/২৬ মার্চ জেনারেল টিক্কা আঘাত হানেন। সুনসান রাত বিলাপ, কান্না আর আগুনে পুড়ল। জেনারেল টিক্কা তার শক্তির সবটুকুই ব্যবহার করলেন। বিপথগামী ও বিভ্রান্ত দেশবাসীকে সামাল না দিয়ে তিনি যেন শত্রুকে আক্রমণ করলেন। সামরিক অভিযানটি ছিল নিষ্ঠুর, যা বোখারা ও বাগদাদে চেঙ্গিস খান ও হালাকু খানের অথবা জালিয়ানওয়ালাবাগে জেনারেল ডায়ারের আক্রমণের চেয়েও নৃশংস।’

বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র ও বাঙালি নেতাদের গ্রেপ্তারের দায়িত্ব ছিল তার। এটা না করে তিনি পোড়ামাটি নীতির আশ্রয় নেন। ফরমান আলী ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের মাটি লাল করে দিতে হবে।’ সৈন্যদের তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মাটি চাই, মানুষ চাই না।’

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব ব্যবস্থা চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ছেড়ে করাচি চলে যান। সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে।

কালের পরিক্রায় আজ ফিরে এসেছে সেই ভয়াল ২৫ মার্চ, জাতীয় গণহত্যা দিবস। বাঙালি জাতির জীবনে ১৯৭১ সালের এইদিন শেষে এক বিভীষিকাময় ভয়াল কালরাত নেমে এসেছিল। ওইদিন মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পূর্ব পরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চ লাইট’র নীলনকশা অনুযায়ী বাঙালি জাতির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকায় নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মার্চের শুরু থেকেই তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চট্টগ্রামে বাণিজ্যিক জাহাজযোগে এবং করাচি থেকে ঢাকায় বিমানযোগে বিপুল সংখ্যক সৈন্য ঢাকায় আসতে শুরু করে। এ ঘটনায় এটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে পাকিস্তানের সামরিকজান্তা মার্চের একেবারে শুরু থেকেই বাঙালিদের দমন পীড়নের জন্য চূড়ান্ত পন্থারই পরিকল্পনা আঁটছিল। 

অপারেশন সার্চলাইট অভিযানের নির্দেশনামা তৈরি করেন পাকিস্তানের দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। নির্দেশনামার লিখিত নথি রাখা হয়নি। গণহত্যার সেই পুরো নির্দেশ মুখে মুখে ফরমেশন কমান্ডার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়।

অনেক পরে, ২০১২ সালে, মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ‘এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ শিরোনামে আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত সেই আত্মজীবনীতে প্রথমবারের মতো ‘অপারেশন সার্চলাইট’ সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়।

‘অপারেশন সার্চলাইট’ কীভাবে পরিকল্পিত হয়, ১৯৭১ সালের সেই স্মৃতিচারণ করে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা লিখেছেন, ‘১৭ মার্চ, সকাল প্রায় ১০টা বাজে। টিক্কা খান আমাকে ও মেজর জেনারেল ফরমানকে কমান্ড হাউসে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে খবর পাঠান। খবর পেয়ে আমরা দুজন টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি, সেখানে জেনারেল আবদুল হামিদ খানও রয়েছেন। টিক্কা খান আমাদের বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের সমঝোতা আলোচনা ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট চান আমরা যেন সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা তৈরি করি। এ ছাড়া আর কোনো মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা আমরা পাইনি। আমাদের বলা হয়, পরদিন ১৮ মার্চ বিকেলে আমরা দুজন যেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ওই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করি।’ পরদিন সকালেই খাদিম হোসেন রাজা তার কার্যালয়ে রাও ফরমান আলীকে নিয়ে বসেন। তারাই গণহত্যার এ অভিযানের নাম দেন ‘অপারেশন সার্চলাইট’।

এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও আছে। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল তাতে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’

অর্ধশতাব্দীকাল আগের ইতিহাসের পাতায় ফিরে গেলে এখনও মানুষ শিহরিত হয়। সেদিন, অর্থাৎ একাত্তরের ২৫ মার্চে ঢাকার ইপিআর সদরদপ্তর পিলখানায় থাকা ২২তম বালুচ রেজিমেন্টকে পিলখানার কয়েকটি স্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়। মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাংক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাংক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে উঠে বিভীষিকাময়।
পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি বিভাগের নয় শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। সেখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত।

দীর্ঘদিন ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের দাবি ছিল সর্বস্তরের মানুষের। জাতীয় সংসদে প্রস্তাব পাসের মাধ্যমে দাবি পূরণ করা হয়েছে। দিবসটিকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্মান জানাতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে সর্বসম্মতিক্রমে। 

আন্তর্জাতিকভাবে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে কাজ করেছে বিগত সরকার। ইতোমধ্যে এই অপরাধযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জেনোসাইড ওয়াচ এবং লেমকিন ইন্সটিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন। এছাড়া সংস্থা দুটি জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। এই নৃশংস গণহত্যাকে আরও স্বীকৃতি দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলারস (আইএজিএস)। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ২৪ এপ্রিল ২০২৩ তারিখের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

২৫ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে সারাদেশে এক মিনিট ব্ল্যাক আউট বা নিষ্প্রদীপ মহড়া পালিত হয়ে থাকে শহীদদের স্মরণে। দিবসটি পালনের লক্ষ্যে আজও সারা দেশে রাত ১০টা ৩০ মিনিট থেকে ১০টা ৩১ মিনিট (১ মিনিট) প্রতীকী ব্ল্যাক আউট (কেপিআই বা জরুরি স্থাপনা ব্যতীত) পালন করা হবে। এক মিনিট অন্ধকারে থাকার পর আমরা আলো জ্বালিয়ে স্বস্তিতে ফিরব। কিন্তু এই আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে যদি আমরা মুহূর্তের জন্য হলেও একাত্তরের সেই কালরাতকে, সে রাতের সুতীব্র ভয়াবহতাকে এবং মৃত্যুসম আঘাত পেয়েও বাঙালির ঘুরে দাঁড়ানো এবং হানাদার শত্রুকে পরাস্ত করে মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার গৌরব যদি অনুভব না করতে করি, তাহলে আমাদের বীর পূর্বপুরুষদের প্রতি আমরা যথাযথ শ্রদ্ধা জানাতে ব্যর্থ হবো। তাই শুধু আনুষ্ঠানিকতার সুসংহত কর্মসূচির মধ্যে নয়, আমাদের দায়িত্ব হবে একাত্তরের অন্ধকার হটিয়ে আলোর স্বদেশ প্রতিষ্ঠার সংকল্পকে অনুভব ও অন্তরে ধারণ করা। 

তারা//

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স ব ধ নত ১৯৭১ স ল র র ২৫ ম র চ ২৫ ম র চ র গণহত য র আম দ র ফরম ন র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

মোড়ে মোড়ে চলে প্রতিরোধ

২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস, যা আমাদের গৌরব, আত্মত্যাগ এবং বিজয়ের প্রতীক। এটি শুধু একটি তারিখ নয়; এটি একটি জাতির দীর্ঘ সংগ্রামের ফল। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানের শাসন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে স্বাধীনতার সংগ্রামের সূচনা হয়। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের শুরু এখান থেকেই। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর। এই দিনটিতে তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম এবং শেষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সে নির্বাচনের পর বিজয়ী শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করে। নির্বাচিতদের কাছে শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তর না করাসহ নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট আরও প্রকট হয়। ২৫ মার্চ সারাদিন রাজশাহী শহরের মোড়ে মোড়ে চলে স্বাধীনতাকামী বাঙালির মিছিল ও সমাবেশ। দিনভর মুহুর্মুহু বিক্ষোভ চলে। এরপর দিনের সূর্য লাল আভা ছড়িয়ে পশ্চিমে অস্ত যাওয়ার পর নেমে আসে অন্ধকার। রাতের আঁধারে রাজশাহী পুলিশ লাইন্সে হামলা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এটিই ছিল রাজশাহীর মাটিতে প্রথম আঘাত। পুলিশ বাহিনীর সহযোগিতা না পাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে রাতের অন্ধকারে পুলিশ লাইন্সে হামলা করে পাকিস্তানি বাহিনী। বৃষ্টির মতো চলে অবিরাম গুলিবর্ষণ। বিধ্বংসী গোলা ফেলা হয় আকাশ থেকেও। গভীর রাতে পেছন থেকে অতর্কিতে হামলায় দিশেহারা হয়ে পড়েন ঘুমন্ত পুলিশ সদস্যরা। এ সময় পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ পুলিশকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসে। শুরু হয় গুলিবিনিময়। নিজেদের সবটুকু দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান মুক্তিকামী বাঙালি। ২৬ মার্চ সারাদিন পুলিশ লাইনসে গুলিবিনিময় হয়। তবে জীবন উৎসর্গ করে বাঙালিরা রক্ষা করেন পুলিশ লাইন্স। 
১৯৭১ সালে আমি রাজশাহী কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলাম। তখন আমি টগবগে যুবক। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র জনগণের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হামলায় বেঘোরে প্রাণ হারায় অসংখ্য মানুষ। এ সময় জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা আমাদের উজ্জীবিত করে। বাঙালির এই দুঃসময়ে জীবনবাজি রেখে প্রবল বিক্রমে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযোদ্ধারা। চট্টগ্রামে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় অনুপ্রাণিত জনগণ সাহসের সঙ্গে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আমরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করলাম। একটা বিষয় এখানে বলে রাখা ভালো, যখন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে পড়তাম, তখন আমি ডামি রাইফেল ও থ্রি নট থ্রি চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম; যা পরে যুদ্ধের সময় কাজে লেগেছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর জনসাধারণের প্রবল প্রতিরোধে অল্প কয়েক দিনের মধ্যে রাজশাহীতে দুর্বল হয়ে পড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। অবশেষে স্থানীয় ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি বাহিনী; কিন্তু ১০ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বিপুল অংশ রাজশাহী শহরে প্রবেশ করে। ১৩ এপ্রিল ভোরে পাকিস্তানি সেনারা গুলিবর্ষণ করতে করতে প্রবেশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে। জোহা হল, জিন্নাহ (বর্তমান শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক) হলসহ অন্যান্য আবাসিক হল, বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব ও অতিথি ভবন দখল করে নেয়। ধ্বংসযজ্ঞ চালায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার, গ্রন্থাগার, ল্যাবরেটরিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়।
২৬ মার্চ সকালে রাজশাহীর বাতাসে মুক্তির আনন্দ ও ভয় একসঙ্গে প্রবাহিত হচ্ছিল। ভয় ছিল যে কোনো সময় পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করতে পারে। আবার আমরা একটা স্বাধীন জাতি– এই ভেবে আনন্দও লাগছিল। ২৬ তারিখ সকাল থেকে আমরা এলাকায় মুক্তিকামী লোকজন পরামর্শ করতে থাকলাম, কীভাবে আমরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারি এবং কীভাবে দেশকে হানাদারমুক্ত করতে পারি। এভাবে ভাবতে ভাবতে আমরা আশপাশের এলাকা থেকে সবাই তালাইমারী এলাকায় একত্র হতে থাকলাম। কারণ তালাইমারী হচ্ছে রাজশাহী শহরের প্রবেশপথ। তাই শহরকে নিরাপদ করতে হলে আমাদের অবশ্যই এই স্থান নিরাপদ করে তুলতে হবে। তালাইমারীতে আমরা প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ জন মুক্তিকামী মানুষ একত্র হয়ে যাই। পরে আমরা বাঁশ, লাঠি হাতে নিয়ে সারাদিন এই পয়েন্টে অবস্থান নিই। আমরা প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ করার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। জেবর মিয়া আমাদের সংগঠক ছিল। তবে সেদিন সাধারণ লোকজন দেশের জন্য যুদ্ধ করতে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। সেদিন সারাদিন তালাইমারীতে আমরা অবস্থান করেছিলাম। পরে রাতে সবাই নিজ নিজ বাসায় চলে যাই। চাপা ভয়, আনন্দের মিশ্র অনুভূতির কারণে সেদিন রাতে ঘুমাতে পারিনি। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতেই কেটে যায় রাত। 
অনুলিখন
হাবিবুর রহমান সৌরভ
রাজশাহী ব্যুরো

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মোড়ে মোড়ে চলে প্রতিরোধ
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা দিবস পালিত
  • কালরাত্রি স্মরণে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে মোমবাতি প্রজ্বালন
  • বেরোবিতে গণহত্যা দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা
  • আজ ভয়াল ২৫ মার্চ 
  • সারাদেশে ১ মিনিটের ব্ল্যাকআউট
  • গণহত্যার দুর্লভ নির্দশন থেকে যাচ্ছে আড়ালেই
  • ভয়াল কালরাত স্মরণে মঙ্গলবার ‘ব্ল্যাকআউট’
  • ২৫ মার্চ সারা দেশে এক মিনিটের প্রতীকী ‘ব্ল্যাক আউট`