দেশের বড় শহর ছাড়িয়ে জেলা শহর, এরপর উপজেলা সদর এলাকাগুলোও এখন পুকুরশূন্য হয়ে পড়ছে। জলাশয় সুরক্ষায় দেশে কঠোর আইন আছে। ব্যক্তিগত মালিকানায় থাকা পুকুর ভরাটের ওপরে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে আইনে। দুঃখজনক হচ্ছে কেউ আইন মানছে না। যাদের আইন প্রয়োগ করার কথা, তাদেরও সে ব্যাপারে তেমন তৎপরতা নেই। আছে নানা সংকট ও সীমাবদ্ধতাও। যে কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলায় গত কয়েক মাসেই ডজনখানেক পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, বিজয়নগর উপজেলা পরিষদের নিকট দূরত্বেই কয়েক দশকের পুকুর ভরাট হয়ে গেছে সম্প্রতি। এখন সেখানে গেলে পুকুরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। বিপণিবিতান নির্মাণে পুকুরটি ভরাট করা হয়েছে। এভাবে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণসহ নানা কাজে কয়েক মাসে এই উপজেলায় ১০–১২টি বড় পুকুর ভরাট করা হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কার্যালয়ের খুব কাছে পুকুর ভরাট চললেও রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কয়েক মাসে এভাবে অবাধে একের পর এক পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। পুকুরের পাশাপাশি মাটি ফেলে ফসলি জমিও ভরাট করা হচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও ভরাটের জন্য টিলা কেটে মাটি নেওয়া হচ্ছে। এতে ফসলি জমি কমে যাওয়ার পাশাপাশি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।
বিজয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জানান, বেশির ভাগ মাটির কাটার কাজ রাতে চলে। তাঁরা পৌঁছানোর আগেই দুষ্কৃতকারীরা সংবাদ পেয়ে যান। তাঁরা শুধু ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পারেন; কিন্তু পরিবেশ বা কৃষি বিভাগ যাঁরা এই কাজের সঙ্গে জড়িত, অপরাধীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দিতে পারেন। তাঁরা এগিয়ে এলে এই সমস্যাগুলোর একটি সমাধান হবে। তবে জড়িত ব্যক্তিদের দাবি, স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করেই পুকুর ও ফসলি জমি ভরাট করা হচ্ছে, যা ইউএনওর বক্তব্যের বিপরীত বাস্তবতা এখানে হাজির করছে। তা ছাড়া এমন অভিযোগ গুরুতর।
জেলা প্রশাসকের বক্তব্য, বিজয়নগরে অনেক এলাকায় পুকুর ও ফসলি জমি ভরাটের কাজ চলছে। উপজেলায় ম্যাজিস্ট্রেট আছেন মাত্র একজন, এসি ল্যান্ড নেই। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে একজন ম্যাজিস্ট্রেট পদায়ন হয়েছেন। সমস্যাগুলো সমাধানে অভিযান চালানো হবে।
আমরা জেলা প্রশাসকের বক্তব্যে আস্থা রাখতে চাই। পরিবেশ ও কৃষি বিভাগ এ ব্যাপারে আরও সক্রিয় হবে আশা রাখছি। বিজয়নগরের স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগেরও তদন্ত করা হোক।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ক র ভর ট ব জয়নগর পর ব শ উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
সন্জীদা খাতুন—শ্রদ্ধা ও সমীহের সঙ্গে উচ্চারিত একটি নাম
বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির জগতে শ্রদ্ধা ও সমীহের সাথে উচ্চারিত একটি নাম সনজীদা খাতুন। রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশত বছরে শান্তিনিকেতন থেকে সর্বোচ্চ স্বীকৃতির জন্যে বাংলাদেশে তিনিই যোগ্যজন। সাধনা ও সংগ্রামের মিশ্রণে এ এক অনন্য জীবন। প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই বয়সেও পথচলার সুদীর্ঘ এই ধারায় কখনও ছেদ পড়েনি, বরং উত্তরোত্তর নতুন নতুন দায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনি।
সাহিত্য ও সংগীত সনজীদাআপার মূল দুই সঞ্জীবনী, সেই সূত্রে রবীন্দ্রনাথ প্রেরণার প্রধান উৎস, পথ চলার সহায় ও সঙ্গী।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিচিত্র সৃষ্টির পাশাপাশি ভাবনা ও কর্মে বাঙালিকে গ্রাম্যতার গণ্ডি কাটিয়ে নাগরিক বিশ্বপরিসরে উত্তরণের পথ দেখিয়েছেন। কবির মূল এই অভিপ্রায়ের সাথে আমাদের কৃষি-নির্ভর রক্ষণশীল সমাজের পরিচয়সাধন এবং অভীষ্ট লক্ষ্যে তার উত্তরণের পথে অচলায়তন অন্তরে-বাহিরে, এবং তা দুস্তর ও বিস্তর। রবীন্দ্র-ভাবশিষ্যা সনজীদা খাতুন আজীবন সেই বাধাসংকুল দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে চলেছেন। অন্তর্নিহিত সাধকসত্তা তাঁকে সকল বাধা তুচ্ছ করে প্রয়োজনে একাই এগিয়ে চলার শক্তি দেয়। আর তাঁর স্বোপার্জিত সংগ্রামী সত্তা দিয়েছে সমমানাদের সংঘবদ্ধ করার প্রেরণা।
তাঁর সেই শক্তি ও প্রেরণার সার্থক প্রকাশ ছায়ানট-মহীরুহ। গত শতকের ষাট দশকে জাতির জাগরণের উত্তাল সময়ে ছায়ানট হয়ে ওঠে বাঙালির সাংস্কৃতিক যাত্রার দিশারী সংগঠন। আর স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রত্যাঘাতের সময় ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামেও ছায়ানট থাকল একই অবস্থানে অবিচল প্রত্যয়ে। গোড়ায় ছিলেন অনেকের একজন, ক্রমে কঠিন থেকে কঠিনতর বাস্তবতায় যখন ছায়ানটের গুরুত্ব উত্তরোত্তর বেড়েছে, এবং যখন জাগরণে ও প্রতিরোধে বৃহত্তর সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনুঘটকের ভূমিকায় ছায়ানট তখন বা ততদিনে এ প্রতিষ্ঠানের কাণ্ডারী সনজীদা খাতুন। প্রতিষ্ঠান অনেকের ভূমিকা ও অবদানেই রূপ পায়, তবে তখনই পায় যখন নেতৃত্ব থাকে সঠিক।
বাঙালি মুসলিম সমাজের রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের প্রথম প্রজন্মের একজন তিনি, তবে তিনি কেবল সেই ভূমিকায় আবদ্ধ থাকলেন না, নিজেকে ছড়িয়ে দিলেন এবং ছাড়িয়ে উঠলেন সংগীত শিক্ষকের ও সংগঠকের দায় কাঁধে নিয়ে। সাহিত্যই তাঁর আগ্রহ ও চর্চার আদি বিষয় হওয়ায় তাঁর শিক্ষা সাঙ্গীতিক ব্যাকরণের পাঠ ছাপিয়ে জীবন, সমাজ ও সংস্কৃতি অবধি পরিব্যাপ্ত।
ছায়ানট জন্মাবধি ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীলদের হুমকির মুখেই ছিল। কিন্তু ২০০৩-এ সেটা আড়াল সরিয়ে সরাসরি যখন আঘাত হানল নববর্ষের অনুষ্ঠানে তখন অনেকেরই মনে হল শুধু সঙ্গীত ও সংস্কৃতির কাজে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, হাত দিতে হবে মানুষ গড়ার আরও মৌলিক ক্ষেত্রে—শিক্ষায়। সেই ভাবনায় ও কাজে এদেশে রবীন্দ্রসংস্কৃতি বিকাশের প্রাণপুরুষ প্রয়াত ওয়াহিদুল হক ছিলেন অগ্রণী। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানেরও ধাত্রী এবং ওয়াহিদ ভাইয়ের মৃত্যুর পর, এর অভিভাবক, সনজীদাআপাই।
আজ বিশ্বায়ন ও বাণিজ্যায়ন যেন পরিপূরক ভূমিকায় মানুষের সামনে সম্পূর্ণ জগত খুলে ধরে ক্ষান্ত নয়, মেলে ধরেছে ভোগের সীমাহীন সম্ভার এবং তা স্বভাবতই মানুষকে, বিশেষত তরুণদের, ঠেলে দিয়েছে ব্যস্ততা-অস্থিরতার এক কোলাহলময় জঙ্গম জীবনে। তোড়ের মুখে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভেসে যাচ্ছে অনেকে, কেউ পথ হাতড়ে মরছে, কেউবা ধর্মান্ধতার বিবরে আশ্রয় নিচ্ছে।
কিন্তু কবির জীবনসায়াহ্নের সাবধানবাণী শোনে নি কেউ। প্রাচ্যও, পশ্চিমেরই মত, এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি আজ। ব্যবহারিক সংস্কৃতিতে এত বিপুল পরিবর্তন ঘটে চলেছে যে তার প্রভাব মানুষের চিন্তার জগৎকেও কেবল আলোড়িত করছে না, নতুন বা ভিন্ন সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে সকলকে। তবে দেশে ও বিশ্বে অনেকেরই বিশ্বাস—এবং তা বাড়ছে, বেড়েই চলেছে—এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ থেকে নেওয়ার প্রয়োজন ও সুযোগ উভয়ই বাড়ছে।
আশি বছরের দ্বারপ্রান্তে এসে নতুন কালের সামনে দাঁড়িয়ে আজ সনজীদা আপা; তবে তাঁর হৃদয় মাঝে অভয় বাজে নিশ্চয়—কারণ চিরনূতনেরে ডাক দিয়ে যান যে কবি তিনিই তো তাঁর সহায় ও সাথী।