গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ সম্ভবত সবচেয়ে জটিল ও কঠিন সময় পার করছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার বা সেনাবাহিনী নিয়ে প্রচারিত ও প্রকাশিত নানা মন্তব্য ও মতামত দেশে অস্থিরতার পরিবেশ তৈরি করেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান মতপ্রকাশের বন্ধ দরজার অর্গল ভেঙে দিয়েছে। বর্তমান মুক্ত পরিবেশে সত্য, অসত্য, উদ্দেশ্যমূলক বা বিভ্রান্তিকর—     কোনো মত বা তথ্যের প্রকাশ ঠেকানোর সুযোগ নেই। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা নানা মত-পথের ব্লগার ও ইউটিউবাররা নাহয় এর সুযোগ নিলেন কিন্তু দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা পক্ষও যদি উত্তেজনা তৈরি ও বিভ্রান্তি ছড়াতে ভূমিকা রাখে, তবে তা বিশেষ উদ্বেগের বিষয়।

দেশ এখন যে অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা তৈরির পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে নতুন গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহর একটি ফেসবুক মন্তব্য। তিনি দাবি করেছেন, ১১ মার্চ সেনানিবাসে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগের ‘রিফাইন্ড’ অংশকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের জন্য তাঁদেরকে চাপ দেওয়া হয়েছে এবং তা পুরোপুরি ভারতের পরিকল্পনা। আসন সমঝোতার বিনিময়ে তাঁদেরকে এই প্রস্তাব মেনে নিতে বলা হয়।

ঘটনার ১০ দিন পর ২১ মার্চ তিনি এই ফেসবুক পোস্ট দেন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার একটি বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার পর। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে ড.

ইউনূস বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের পরিকল্পনা সরকারের নেই। হাসনাত তাঁর পোস্টে বলেছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে কোনো ধরনের আপস করার সুযোগ নেই। সঙ্গে যুক্ত করেছেন, ‘জুলাইয়ের দিনগুলোতে জনগণের স্রোতে ক্যান্টনমেন্ট আর এজেন্সির সকল প্রেসক্রিপশন আমরা উড়িয়ে দিয়েছিলাম। আজ আবারও যদি আপনাদের সমর্থন পাই, রাজপথে আপনাদের পাশে পাই, তবে আবারও এই আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের ভারতীয় ষড়যন্ত্রও আমরা উড়িয়ে দিতে পারব।’

এ ধরনের মন্তব্যের যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ্যে, অপ্রকাশ্যে ও জনমনে হওয়ার কথা, তা-ই হয়েছে। হাসানাতের দল এনসিপি দ্রুততার সঙ্গে তাঁর পক্ষ নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনেও করেছে। সেখানে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের নিন্দা করা হয়। লিখিত বক্তব্যে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মন্তব্য করেছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। আমরা তাঁর এ বক্তব্যের নিন্দা জানাই।’

প্রায় একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারে ছাত্রদের প্রতিনিধি উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার আগে রেকর্ড করা ভিডিওর একটি অংশও ফেসবুকে শেয়ার করেন হাসনাত আবদুল্লাহ। সেখানে আসিফ মাহমুদ এটা স্পষ্ট করেন যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার ব্যাপারে সেনাপ্রধানের আপত্তি ছিল।

হাসনাতের বক্তব্য নিয়ে সেনাবাহিনীর বক্তব্য কী—তা নিয়ে জনমনে কৌতূহল ছিল। সুইডেনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজ জানতে চাইলে সেনা সদর এক বিবৃতিতে হাসনাতের দাবিকে ‘অত্যন্ত হাস্যকর ও অপরিপক্ব গল্পের সম্ভার’ হিসেবে বর্ণনা করে। তারা সেনানিবাসে ১১ মার্চের বৈঠকের বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছে। হাসনাত আবদুল্লাহ না বললেও সেনা সদর বলেছে, সেনানিবাসে খোদ সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গেই ১১ মার্চ বৈঠকটি হয়েছিল। তবে হাসনাত আবদুল্লাহকে ‘ডেকে নিয়ে যাওয়া’ এবং ‘আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন’ বিষয়ে তাঁদেরকে প্রস্তাব বা চাপ প্রয়োগের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, হাসনাত আবদুল্লাহ ও তাঁর দলের আরেক মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলমের আগ্রহেই ওই বৈঠকটি হয়েছিল।

ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। এরপর সেই বৈঠকে উপস্থিত সারজিস আলমের কাছ থেকে যে ভাষ্য পাওয়া গেছে, হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্য বা অবস্থানের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই তার মিল নেই। হাসনাতের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে সারজিস বলেছেন, ‘যেভাবে এই কথাগুলো ফেসবুকে স্ট্যাটাসের মাধ্যমে এসেছে, এই প্রক্রিয়াটি আমার সমীচীন মনে হয়নি বরং এর ফলে পরবর্তীতে যেকোনো স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আস্থার সংকটে পড়তে পারে।’

কোনো বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থান আইনকানুন, নিয়ম বা সংবিধান মেনে হয় না। বাংলাদেশের ৫ আগস্টের পরিবর্তনও তাই। বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থানের পরের ঘটনাপ্রবাহও নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম মেনে চলে না। বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে ছাত্রদের নেতৃত্বে নানা মত ও পথের রাজনৈতিক শক্তির অংশগ্রহণে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে নানা আলোচনা ও তৎপরতার মধ্য দিয়েই একটি সমঝোতায় আসতে হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় নানা মত এসেছে, বিরোধিতা এসেছে। বাস্তবতা বিবেচনায় কোনো পক্ষ ছাড় দিয়েছে, কেউ নমনীয় হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত ঐকমত্যের ভিত্তিতেই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার গত সাড়ে সাত মাস ভালোভাবে দেশ পরিচালনা করতে পেরেছে এমন বলা যাচ্ছে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে অদক্ষতা, সিদ্ধান্তহীনতা বা কিছু বিষয়ে জোরালো অবস্থান গ্রহণে ব্যর্থতার দিকই স্পষ্ট হয়েছে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি নতুন কিছু নয়। গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকেই এই দাবি বিভিন্ন পক্ষ থেকে উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই ইস্যুতে হঠাৎ কেন মাঠ গরম হয়ে উঠল? নাকি গরম করা হলো? অন্তর্বর্তী সরকার গঠনপ্রক্রিয়ায় কে কাকে পছন্দ বা অপছন্দ করেছেন, সেই পুরোনো প্রসঙ্গই-বা কেন সামনে আনা হলো? অথবা ছাত্রদের নতুন দলটি বা তাদের দলের কেউ কেন সেনাপ্রধানকে প্রতিপক্ষ বানাতে চাইল? কোনো পক্ষ কি পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটাচ্ছে? এতে আসলে কার লাভ?

রোববার হয়ে উঠেছিল গুজবের রাত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাতভর এর চর্চা হয়েছে। গতকাল সকালে সেনা সদরে সেনাবাহিনী প্রধানের ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ নিয়েও শুরু হয় নানা জল্পনা-কল্পনা। সেনা সূত্র একে রুটিন বৈঠক বললেও সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই যে সেনাপ্রধানকে এই বৈঠকটি করতে হয়েছে, সেটা পরিষ্কার।

আগেই বলেছি, নেতৃত্বে ছাত্ররা থাকলেও গণ-অভ্যুত্থানের অনেক পক্ষ ছিল। সেই পক্ষগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ৫ আগস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে ৮ আগস্ট। মাঝের তিন দিন দেশে কোন সরকার কাজ করেছে? এ সময় কাদের ওপর ভরসা ছিল জনগণের? দেশের সেই সংকটময় সময়ে ছাত্রনেতৃত্ব, রাজনৈতিক শক্তি ও সেনাবাহিনী নানা তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে মিলেমিশে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানকে তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। সেই পর্বে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে নানা মতপার্থক্য স্বাভাবিক। এসব আলোচনায় অনেক সংবেদনশীল বিষয় থাকে, যা প্রকাশ করা যায় না। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য ছাড়া তো এই বিষয়গুলোকে এখন সামনে আনার কথা নয়।

ছাত্ররা নতুন দল করেছেন, আবার তাঁদের প্রতিনিধিরা এখনো সরকারে আছেন। মানে তাঁরা সরকারে আছেন, আবার সরকারের বাইরেও আছেন। যাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের বাইরে, তাঁরা না হয় সরকারের সমালোচনা করতে পারেন। তাঁদের দল এনসিপি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা নিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের অবস্থানের নিন্দাও করতে পারে (যদিও অনেকে মনে করেন, ‘কিংস পার্টির’ বদনাম ঘোচাতেই তারা এই কৌশল নিয়েছে)। কিন্তু যাঁরা সরকারে আছেন, তাঁরাও তো কোনো সীমা মানছেন বলে মনে হয় না।

ফেসবুকে হাসনাত ও সারজিসের বক্তব্য নিয়ে তাঁদের দল এনসিপিতে অস্বস্তি ও অসন্তোষের কথা আমরা সংবাদমাধ্যম সূত্রে জেনেছি। দলটির মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এরই মধ্যে হাসনাতের পোস্টটিকে ‘শিষ্টাচারবর্জিত’ বলে মন্তব্য করেছেন। অন্য এক সমাবেশে তিনি কোনো ক্ষেত্রে ভুল হয়ে থাকলে তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।

গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররা দল গঠন করেছেন, এটা আশাব্যঞ্জক ঘটনা। কিন্তু তাঁরা সম্ভবত এটা বুঝে উঠতে পারেননি যে আন্দোলন আর রাজনৈতিক দল গঠন করে দল পরিচালনা ভিন্ন বিষয়। হাসনাত ও সারজিস ছাত্রদের দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন, দলের অবস্থান বা সিদ্ধান্তের বাইরে সেনানিবাসে গিয়ে বৈঠক করা বা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার দায় তাই দলকেই নিতে হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হাসনাত আবদুল্লাহর ফেসবুক মন্তব্য ও এর পরের ঘটনাপ্রবাহকে আমরা কীভাবে দেখব? এটা কি নিছক রাজনৈতিক অপরিপক্বতা? হাসনাত আবদুল্লাহর ফেসবুক মন্তব্য এবং একই সঙ্গে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের আগের রেকর্ড করা সাক্ষাৎকারের ভিডিও ক্লিপ প্রকাশকে পরিকল্পিত মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কোনো শক্তি বা গোষ্ঠী পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে কি না, সেই প্রশ্ন কিন্তু জনমনে আছে। নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপির উচিত তাদের অবস্থান বিশ্বাসযোগ্যভাবে পরিষ্কার করা।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন ষ দ ধ কর র জন ত ক অবস থ ন উপদ ষ ট সরক র র দ র দল ন র পর কর ছ ন এনস প র একট আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

সংস্কৃতির ভুবন আলোকিত করে সন্‌জীদা খাতুনের বিদায়

আজীবন দেশের সংস্কৃতির ভুবন আলোকিত করার গুরুদায়িত্ব পালন করে বিদায় নিলেন সন্‌জীদা খাতুন। গতকাল মঙ্গলবার ৯২ বছর পূর্ণ করার কিছু আগে প্রয়াত হলেন দেশের এই অগ্রগণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। আগামী ৪ এপ্রিল তিনি ৯৩ বছরে পদার্পণ করতেন। জন্মদিনের পরিবর্তে সেদিনে হবে তাঁর স্মরণসভা।

রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বেলা ৩টা ১০ মিনিটে হৃৎস্পন্দন থেমে যায় সন্‌জীদা খাতুনের (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ ও পুত্রবধূ লাইসা আহমদ লিসা জানিয়েছেন, তাঁর হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ (হার্ট অ্যাটাক) হয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি সুস্থ ছিলেন না। তাঁর ছিল কিডনির জটিল রোগ। নিউমোনিয়াতেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। ১৯ মার্চ তাঁকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর নেওয়া হয় আইসিইউতে। অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি।

সন্‌জীদা খাতুনের বড় মেয়ে অপালা ফরহাদ নভেদ আগেই প্রয়াত। ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ আর মেয়ে রুচিরা তাবাসসুম নভেদসহ অনেক আত্মীয়স্বজন ও দেশ-বিদেশে অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন বহু গুণের অধিকারী অনাড়ম্বর জীবন যাপন করা এই মানুষটি। তাঁর ছেলেমেয়েরা জানিয়েছেন, মরদেহ রাতে হিমঘরে রাখা হবে।

সর্বজনের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় আনা হবে তাঁর হাতে গড়া দেশের অগ্রগণ্য সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানট সংস্কৃতি–ভবনে। সন্‌জীদা খাতুনের অনেক নাতি–নাতনি ও ঘনিষ্ঠ বহু আত্মীয় বিদেশে অবস্থান করছেন। তাঁরা শেষবিদায় জানাতে আসবেন। সে কারণে দাফনের দিনক্ষণ পরে ঠিক করা হবে। ৪ এপ্রিল সন্‌জীদা খাতুনের জন্মদিনে ছায়ানটে স্মরণসভা করার পরিকল্পনা করা হলেও সময় এখনো ঠিক হয়নি।

সন্‌জীদা খাতুনের কীর্তির ধারা বিচিত্র। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষক, গবেষক, শিল্পী, সংগীতজ্ঞ, সংগঠক ও সক্রিয় সাংস্কৃতিক নেত্রী। ছিলেন ছায়ানট ও রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সভাপতি। ব্যতিক্রমী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নালন্দার প্রতিষ্ঠাতা। জনসাধারণের সাংস্কৃতিক বোধের উন্নয়ন এবং মুক্ত–উদার মানবিক সমাজ নির্মাণের অবিরাম প্রচেষ্টাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পরে দেশের শিল্প–সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। আত্মীয়স্বজন ছাড়াও তাঁর সহযোদ্ধা, সহশিল্পী, ছাত্রছাত্রী ও গুণমুগ্ধরা শোকার্ত চিত্তে স্কয়ার হাসপাতালে ছুটে যান। অনেকেই ছিলেন অশ্রুসিক্ত।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক হাসপাতালে প্রথম আলোকে বললেন, তিনি দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন এবং জীবনকালটা মানুষের জন্য উজাড় করে দিয়েছেন। জনমানসে সংগীত, শিল্প, সাহিত্যের বোধ সৃষ্টি এবং এর সঙ্গে সামাজিক–সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতার বোধ সঞ্চার করে গেছেন। বিপুলভাবে তিনি বাঙালির জীবন সমৃদ্ধ করে তোলার কাজ করেছেন। তাঁর মতো দ্বিতীয় কেউ নেই।

রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সহসভাপতি ও শিল্পী বুলবুল ইসলাম বলেন, দেশে রবীন্দ্রসংগীতের প্রসার ও সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে ওয়াহিদুল হক, জামিল চৌধুরী ও সন্‌জীদা খাতুন—এই তিনজনের ভূমিকা পথিকৃতের মতো। তাঁরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক আন্দোলনের পথ সুগম করেছেন। দুজন আগেই প্রয়াত। এখন তৃতীয়জনও চলে গেলেন। নিজেকে অভিভাবকহীন মনে হচ্ছে।

ছায়ানটের তবলার শিক্ষক এনামুল হক ওমর বললেন, যে অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতায় তিনি সারা দেশের সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিল্পীদের সংগঠিত করেছেন, ছায়ানটকে পরিচালনা করেছেন, তার তুলনা হয় না। তাঁর প্রয়াণ জাতির জন্য অপরিমেয় ক্ষতি।

সন্‌জীদা খাতুনের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে ছায়ানট, উদীচী, চারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন।

সন্‌জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল। তাঁর বাবা কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক। মা সাজেদা খাতুন গৃহিণী। সন্‌জীদা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৪ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক, ১৯৫৫ সালে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৭৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু। দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই এতে জড়িয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতায় সংগঠিত করেন বাংলাদেশের শিল্পীদের। শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে সন্‌জীদা খাতুন ব্রতচারী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।

সন্‌জীদা খাতুনের প্রথম গানের গুরু ছিলেন সোহরাব হোসেন। তাঁর কাছে তিনি দীক্ষা নেন নজরুলসংগীত, আধুনিক বাংলা গান ও পল্লিগীতির। প্রথমে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছেন প্রখ্যাত হুসনে বানু খানমের কাছে। এরপর তালিম নেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার, আবদুল আহাদ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেনদের মতো বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীদের কাছ থেকে।

আইয়ুব খানের কঠোর শাসনকালে নানা বাধা অগ্রাহ্য করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনে তিনি ও সংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের ঐতিহ্যবাহী সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানটের যাত্রা শুরু। ১৯৬৭ সালে তাঁরা রমনার বটমূলে প্রথমবারের মতো বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখে আয়োজন করে প্রভাতি গানের আসর। ছায়ানটের এই অনুষ্ঠান থেকেই প্রাণিত হয়ে নববর্ষ উদ্‌যাপন এখন দেশজুড়ে বিপুল এক অসাম্প্রদায়িক উৎসব। ধর্মীয় উগ্রবাদীরা ছায়ানটের এই প্রভাতি গানের আসরে ২০০১ সালে ভয়াবহ বোমা হামলা চালালেও অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি।

এসব সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের বাইরে সন্‌জীদা খাতুনের গবেষণা ও রচনার কাজও কম নয়। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টির অধিক। রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ, কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, স্বাধীনতার অভিযাত্রা, সাহিত্য কথা সংস্কৃতি কথা, নজরুল মানস ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

সন্‌জীদা খাতুন দেশে একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। এ ছাড়া সম্মানিত হয়েছেন ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পদক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের দেশিকোত্তম পুরস্কার এবং কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রবীন্দ্র–তত্ত্বাচার্য উপাধিতে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ