নতুন আর্থসামাজিক বাস্তবতায় সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমকে ঢেলে সাজাতে হবে
Published: 25th, March 2025 GMT
প্রধানত কৃষি-নির্ভর গ্রামীণ জনপদের বিপন্ন জনগোষ্ঠির কল্যাণে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নে বাংলাদেশের রয়েছে সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও অনুসরণীয় সাফল্য। তবে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে এবং অল্প সময়ের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে হতে যাচ্ছে। এই নতুন আর্থসামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তাই সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমকে ঢেলে সাজানো দরকার। সোমবার উন্নয়ন সমন্বয়ের আয়োজনে ‘সামাজিক সুরক্ষায় সংস্কার প্রসঙ্গ’ শিরোনামে প্রাক-বাজেট ওয়েবিনারে এমন অভিমত ব্যক্ত করেন আলোচকরা।
ওয়েবিনারের ধারণাপত্র উপস্থাপনায় উন্নয়ন সমন্বয়ের গবেষণা পরিচালক আব্দুল্লাহ নাদভী বলেন, জাতীয় বাজেটের ১৭ শতাংশের বেশি সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ দেয়ার কথা বলা হলেও এই বরাদ্দের এক-তৃতীয়াংশ চলে যাচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অবসর ভাতা দেয়ায় এবং সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ। প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র ও বিপন্ন নাগরিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষার বরাদ্দের মাত্র ১৫ শতাংশ বিনিয়োজিত হচ্ছে বলে জানান তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জিডিপির মাত্র ০.
প্যানেল আলোচনায় বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির পাশাপাশি আয়বৈষম্য বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করেন সমাজতাত্ত্বিক এবং বিআইজিডি-এর রিসার্চ ফেলো খন্দকার সাখাওয়াত আলী। বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থায় প্রধানত কৃষি-নির্ভর পরিবারের দিকে নীতি-মনোযোগ দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সাখাওয়াত আলী বলেন, কৃষিতে এখনও শ্রমশক্তির বৃহত্তম অংশটি নিয়োজিত থাকলেও শিল্প ও সেবা খাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তি দ্রুত বাড়ছে। তাই এই দুই খাতের ওপর নির্ভরশীল প্রান্তিক পরিবারগুলোর জন্য নতুন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ওপর জোর দেন তিনি।
নদী বিশেষজ্ঞ এবং রিভারাইন পিপল-এর সংগঠক শেখ রোকন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশেষ ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠিকে সুরক্ষা দেয়ার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, চরাঞ্চলের মানুষ আর্থ-সামাজিকভাবে বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকেন। তাদের বিশেষ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সহায়ক হয় এমন সুনির্দিষ্ট সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করা একান্ত জরুরি বলে মত দেন তিনি।
সিডব্লিউসিএস-এর সভাপতি অধ্যাপক ইশরাত শামীম বলেন, শ্রমশক্তির প্রায় ৮৫ শতাংশ যেহেতু অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত, তাই অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক পরিবারগুলোর সামাজিক সুরক্ষায় নজর দিতে হবে। গ্রামাঞ্চলের অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কাছে পৌঁছানো সহজ হলেও, নগরাঞ্চলে শিল্প ও সেবা খাতে নিয়োজিতদের চিহ্নিত করায় অনেক রকম চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তাই নগরাঞ্চলের সামাজিক সুরক্ষার সম্ভাব্য উপকারভোগীদের চিহ্নিত করতে আলাদা ডাটাবেজ গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
অনুষ্ঠানে উন্মুক্ত আলোচনা পর্বে অংশ নেন চর, হাওড় ও পার্বত্য অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির প্রতিনিধি, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা। ওয়েবিনার সঞ্চালনা করেন উন্নয়ন সমন্বয়ের জ্যেষ্ঠ প্রকল্প সমন্বয়কারি এবং ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্সের সদস্য সচিব জাহিদ রহমান।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
অংশগ্রহণ বেশি স্বীকৃতি কম
মোমেনা আক্তার। ৪৫ বছর বয়সী এ নারী বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের এক প্রতিচ্ছবি। তাঁর দিন শুরু হয় ভোরে, রান্নাঘরে চুলার ধোঁয়ার মাঝে। সকালের খাবার তৈরি শেষে তিনি স্বামী ও ছেলের সঙ্গে মাঠে যান। সেখানে ধান, আলু, ভুট্টা, ডাল– এসব চাষের কঠোর পরিশ্রমে তিনি সমানভাবে অংশ নেন। মাঠের কাজ শেষ হলে ঘরে ফিরে আবার শুরু হয় রান্না, মাড়াই, পানি আনা– এমন অসংখ্য কাজের ধারাবাহিকতা। মোমেনা একজন নারী কৃষক, যাঁর জীবন-সংসার আর কৃষির শ্রমের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। তিনি বলেন, ‘স্বামী ও ছেলের সঙ্গে আমি মাঠে কাজ করি। তারপরও ঘরের কাজ, রান্না সবই করি। যদি তারা অন্য কৃষকের কাছ থেকে কাজ নিত, তাহলে তাঁকে অনেক মজুরি দিতে হতো। আমি তো প্রতিদিন মাঠে পুরুষের মতো কাজ করি। আমার কাজের মূল্য কেউ দেয় না।’
মোমেনার স্বামী ও ছেলে মাঠের কাজ শেষে আড্ডায় মেতে ওঠেন বা বাজারে চা খেতে যান। মোমেনার জন্য এমন কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী ঈদ ছাড়া কখনোই আমাকে নতুন জামাকাপড় কিনে দেয় না। শুধু পুরুষদের শ্রমকেই সম্মান করা হয়। আমাদের শ্রমের দাম নেই।’
এ অভিজ্ঞতা মোমেনার একার নয়। বাংলাদেশের লাখো নারী কৃষকের জীবনের প্রতিদিনের বাস্তবতা এমন। তারা মাঠে পুরুষের সমান কাজ করেন। মজুরি ও সম্মানে পিছিয়ে থাকেন। তবুও মোমেনার একটি স্বপ্ন আছে– একদিন নারীর কৃষি শ্রমের জন্য সমান মূল্যায়ন হবে এবং তাদের জীবনযাত্রা আরও ভালোভাবে গড়ে তুলতে পারবেন।
বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘স্ট্যাটাস অব উইমেন ইন এগ্রিকালচার সিস্টেম-২০২৩’ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণের হার ছিল ৪৫.৩ শতাংশ, যা ২০০৫ সালের ৩৬.২ শতাংশ থেকে ৯.১ শতাংশ বেড়েছে। এটি বিশ্বে নারীর কৃষিতে অংশগ্রহণের সর্বোচ্চ বাড়ার হার। বিশ্ব গড় (৪০ শতাংশ) থেকে বাংলাদেশে এ হার ৫ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, কৃষি খাতে জড়িত প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষের মধ্যে ১ কোটি ৮৪ লাখই নারী, যা মোট কৃষি শ্রমশক্তির প্রায় ৫৮ শতাংশ। নারী শুধু ধান চাষেই নয়, পোলট্রি, ডেইরি এবং বাণিজ্যিক সবজি চাষেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে প্রায় ১০ লাখ ক্ষুদ্র খামার রয়েছে, যার ৬০ শতাংশ গ্রামীণ নারীর দ্বারা পরিচালিত। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের ৯০ শতাংশ পালন নারীর হাতে, যার বড় অংশ বাংলাদেশে।
তবে এ অবদানের পরও নারী কৃষকের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষ কৃষি শ্রমিকরা দৈনিক গড়ে ৪৫০ টাকা মজুরি পান, যেখানে নারীরা একই কাজের জন্য মাত্র ৩০০ টাকা পান। এ বৈষম্যের পেছনে রয়েছে সামাজিক ধারণা, যেখানে নারীর শ্রমকে পুরুষের তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের ফলে পুরুষ শ্রমিকরা শহরমুখী হচ্ছেন। ফলে নারীর কৃষিকাজে অংশগ্রহণ আরও বেড়েছে। এ বর্ধিত অংশগ্রহণের সঙ্গে তাদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা বাড়েনি। নীতিনির্ধারণ, প্রশিক্ষণ, কৃষিঋণ বা জমির মালিকানায় নারীর অংশগ্রহণ এখনও অনেক কম। এ অবমূল্যায়ন এবং ক্ষমতায়নের অভাব তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির আন্দোলন সম্পাদক রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নারী ঘরের কাজ করে, এটা এখন পুরোনো কথায় পরিণত হয়েছে। বর্তমান গ্রামবাংলায় অধিকাংশ নারী ধান মাড়াই, বিজ রোপণসহ সব কৃষিকাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছে। তবে নারীর শ্রমের মূল্যায়ন ততক্ষণ পর্যন্ত থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের অংশগ্রহণ থাকে। যখন শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জিত হয়, তখন নারীর সেই অর্থের অধিকার বা দেখভাল করার সুযোগ থাকে না। ফলে অপ্রাপ্তি ও অসন্তুষ্টি সৃষ্টি হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘কৃষি উন্নয়নের জন্য নারীর কাজের স্বীকৃতি জরুরি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ২০১২ সাল থেকে গৃহকর্মী ও নারীর সংসারের কাজের স্বীকৃতি দাবি করছে। এ স্বীকৃতি মিললে কিষানির কাজের স্বীকৃতি আদায়ও সম্ভব হবে, যা কৃষি খাতের উন্নয়নে সহায়ক হবে।’
মোমেনা আক্তারের মতো নারী কৃষকরা বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতির মেরুদণ্ড। নারীর কৃষি শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন এবং সমান সুযোগ নিশ্চিত করা শুধু সামাজিক ন্যায়বিচার নয়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও অপরিহার্য বলে মনে করছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা।