এক চীন নীতিতে ঢাকাকে ২০০৫ সালের অবস্থানে চাইছে বেইজিং
Published: 24th, March 2025 GMT
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস চীনে তাঁর প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকের পাশাপাশি ব্যবসা ও বিনিয়োগ নিয়ে চারটি আলাদা বৈঠক করতে যাচ্ছেন। ২৮ মার্চ বেইজিংয়ে শীর্ষ বৈঠকের পাশাপাশি দেশটির শীর্ষ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ প্রতিনিধিদের সঙ্গে ব্যবসা ও বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা করবেন।
দুই দেশের কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি সামনে রেখে সামগ্রিক রাজনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হলেও অর্থনৈতিক খাতে সহযোগিতায় অগ্রাধিকার থাকবে। আর চীনের দিক থেকে জোর থাকবে সামগ্রিক রাজনৈতিক সহযোগিতায়। রাজনৈতিক সহযোগিতার কেন্দ্রে থাকবে এক চীন নীতি এবং প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগে (জিডিআই) বাংলাদেশের যুক্ততা।
কূটনৈতিক সূত্রগুলোর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বাংলাদেশ আর্থিক ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অর্থায়নের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিলেও চীন অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে দুই দেশের সম্পর্কের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে প্রাধান্য দিতে চায় না। চীন বলছে, আর্থিক সহযোগিতা সম্পর্কের একটি অংশ। ঢাকা–বেইজিং সম্পর্ককে পরবর্তী ধাপে উন্নতির স্বার্থে সহযোগিতাকে রাজনৈতিক পরিসরে দেখাটা বাঞ্ছনীয় এবং সেটাই বাস্তবসম্মত।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ২৬ মার্চ দুপুরে চীনের পাঠানো চার্টার ফ্লাইটে হাইনান প্রদেশে যাবেন প্রধান উপদেষ্টা। ২৭ মার্চ হাইনানে অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার ২৫ দেশের জোট বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার (বিএফএ) সম্মেলনে যোগ দেবেন তিনি। এরপর সেখান থেকে বেইজিং যাবেন প্রধান উপদেষ্টা।
২৮ তারিখে বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপলে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক করবেন। দুই শীর্ষ নেতার আলোচনা শেষে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের পাশাপাশি সহযোগিতার কয়েকটি বিষয়ে ঘোষণা আসার কথা রয়েছে। বৈঠকের পর একই দিনে তিনি চীনের ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের ব্যবসায়ী সংলাপে যোগ দেবেন। এরপর আলাদা তিনটি ব্যবসা ও বিনিয়োগবিষয়ক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেবেন। এই বৈঠকের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, উৎপাদন ও নতুন সম্ভাবনার বিকাশ, সামাজিক ব্যবসা ও তরুণ উদ্যোক্তা এবং টেকসই অবকাঠামো ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ। ব্যবসা ও বিনিয়োগবিষয়ক ওই চারটি আলোচনা ছাড়াও প্রধান উপদেষ্টা চীনের শীর্ষস্থানীয় টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হুয়াহুইয়ের দপ্তর পরিদর্শনে যাবেন। চীন সফরের শেষ দিনে অর্থাৎ ২৯ মার্চ তিনি পিকিং ইউনিভার্সিটিতে একটি বক্তৃতা দেবেন। ওই দিন বিকেলে তিনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন।
প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মো.
এই সফরে চীনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক বিষয়ে যে অগ্রাধিকারের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে এক চীন নীতি আর জিডিআইয়ে বাংলাদেশের যুক্ততার মতো বিষয়গুলো রয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, এবারের যৌথ বিবৃতিতে এক চীন নীতি নিয়ে বাংলাদেশ কিছুটা নমনীয় অবস্থানে থাকার নীতিতে হাঁটার বিষয়টি বিবেচনা করছিল।
কিন্তু চীন বলছে, বাংলাদেশ ২০০৫ সালে এক চীন নীতিতে যা বলেছে, সেখান থেকে কেন সরে আসবে বা সরে আসার যুক্তি কী? এ বিষয়টি উল্লেখ করে চীন সম্প্রতি বাংলাদেশের কাছে ২০০৫ সালে প্রচারিত যৌথ ইশতেহারের অনুলিপি বাংলাদেশকে দিয়েছে। ওই সময়ের ইশতেহারের অংশটি দিয়ে চীন এখন বাংলাদেশকে ২০০৫ সালের অবস্থান অনুযায়ী এক চীন এবং তাইওয়ানের ব্যাপারে বাংলাদেশের জোরালো সমর্থন চাইছে।
২০০৫ সালের ৭ এপ্রিল দুই দিনের সফরে ঢাকায় এসেছিলেন চীনের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও। ওই সফরের সময় দুই দেশের যৌথ ইশতেহারে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ স্বীকার করছে যে শুধু একটি চীন আছে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকার সমগ্র চীনের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র বৈধ সরকার। ওই যৌথ ইশতেহারে তাইওয়ান প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল, তাইওয়ান চীনা ভূখণ্ডের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বাংলাদেশ শুধু সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর জন্য উন্মুক্ত যেকোনো আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থায় তাইওয়ানের সদস্যপদ গ্রহণের বিরোধিতা করে এবং চীনের শান্তিপূর্ণ পুনর্মিলনকে পূর্ণ সমর্থন করে।
ঢাকার কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৪ সালের ১০ জুলাই বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার যৌথ ঘোষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশ এক চীন নীতির প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে, চীন সরকার সমগ্র চীনের প্রতিনিধিত্ব করে এবং তাইওয়ান চীনের অংশ। চীনের মূল স্বার্থ–সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ চীনকে সমর্থন করে। একই সঙ্গে চীনের জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার প্রচেষ্টাকেও সমর্থন করে বাংলাদেশ।
তবে সে সময় বিএনপি সরকারের আমলে ঢাকায় তাইওয়ানের মিশন খুলতে দেওয়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে চীনের। তবে বর্তমানে, বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার আর ক্ষমতায় নেই। ফলে বাংলাদেশকে আগের অবস্থানে ফিরে যেতে আহ্বান জানাবে চীন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সরকারি কর্মকর্তা বলছেন, ২০০৫ সালে তৎকালীন সরকার যেভাবে এক চীন ও তাইওয়ান নীতি নিয়ে অবস্থান নিয়েছিল, হয়তো পুরোপুরি সেটার অনুরূপ কিছু করা বাংলাদেশের জন্য সমীচীন হবে না।
এখনই জিডিআইতে যোগ দেওয়া হচ্ছে নাপ্রধান উপদেষ্টার এই সফরে চীনের অন্যতম অগ্রাধিকার জিডিআই নিয়ে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে, এখনই বাংলাদেশ এই উদ্যোগে যুক্ত না হলেও অতীতের চেয়ে এক ধাপ এগোবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জিডিআইয়ের প্রশংসা করা হতে পারে। বলা হতে পারে, এটি এসডিজি অর্জনে পরিপূরক, উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক বলে বলা হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলছেন, জিডিআইয়ে সমর্থনের অর্থ দাঁড়াবে এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ যুক্ত হতে যাচ্ছে। ফলে এবার অন্তত বাংলাদেশ জিডিআইয়ে সমর্থন করে এটি সরাসরি উল্লেখ করবে না।
আলোচনার প্রসঙ্গ ও সমঝোতার বিষয়বস্তুইউনূস–সি বৈঠকে সামগ্রিকভাবে গুরুত্ব পেতে পারে অর্থনীতি, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, ভূরাজনীতিসহ সামগ্রিক নানা প্রসঙ্গ। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শিক্ষা খাতে সহযোগিতা, বিনিয়োগ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, শিল্পকারখানা স্থানান্তর, আকাশপথে সংযুক্তি, অতীতে ঘোষিত প্রকল্পগুলোতে অর্থ ছাড় ত্বরান্বিত করার বিষয়গুলোতে অগ্রাধিকার থাকতে পারে। সেই সঙ্গে থাকবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়টি।
সূত্র জানায়, প্রধান উপদেষ্টার সফরে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতায় ১ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা, মানবসম্পদ উন্নয়নে সহায়তা, দুর্যোগ প্রশমনে সহায়তা, চীনা গ্রন্থকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, চীনের চিরায়ত সাহিত্য অনুবাদ ও প্রকাশ, ক্রীড়াক্ষেত্রে সহযোগিতা এবং দুই দেশের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার মধ্যে সহায়তাসহ বেশ কিছু সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপন, চীনের সহযোগিতায় রোবোটিক ফিজিওথেরাপি ও রিহ্যাবিলিটেশন কেন্দ্র স্থাপন, দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি সইয়ের জন্য আলোচনা শুরুর ঘোষণা, ৫ বছরে বাংলাদেশের এক হাজার তরুণের চীন সফরের আমন্ত্রণ, চীনের বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বেশ কিছু ঘোষণা আসতে পারে।
পাশাপাশি দুই দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানো, রোহিঙ্গা সংকট, পানিসংক্রান্ত সহযোগিতা ছাড়াও স্বল্প সুদে ঋণ ও অনুদান মিলিয়ে দেড় বিলিয়ন ডলারের সহায়তার বিষয়গুলো আলোচনায় আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
সামরিক স্থাপনার আধুনিকায়ন বা সমরাস্ত্র সংগ্রহের মতো বিষয়গুলো উঠে আসতে পারে বৈঠকে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র কর মকর ত এক চ ন ন ত ক টন ত ক স সহয গ ত য় ক সহয গ ত পরর ষ ট র র অবস থ ন ২০০৫ স ল র জন ত ক ত ইওয় ন জ ড আইয় ইশত হ র ব ষয়গ ল র জন য সফর র সরক র ব যবস ব ষয়ট
এছাড়াও পড়ুন:
আপিল বিভাগে দুই বিচারপতির নিয়োগ
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের দুই বিচারপতিকে আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। আজ সোমবার নিয়োগসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়।
আপিল বিভাগে নিয়োগ পাওয়া দুই বিচারপতি হলেন বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান এবং বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। দুই বিচারপতির নিয়োগের মধ্য দিয়ে আপিল বিভাগে বিচারপতির সংখ্যা সাতে দাঁড়াবে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৫ (১) অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান এবং বিচারপতি ফারাহ মাহবুবকে আপিল বিভাগের বিচারপতি পদে নিয়োগ দিয়েছেন। এই নিয়োগ শপথ গ্রহণের তারিখ থেকে কার্যকর হবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।
প্রধান বিচারপতি নবনিযুক্ত দুই বিচারপতিকে আগামীকাল সকাল সাড়ে ১০টায় শপথবাক্য পাঠ করাবেন বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম।
১৯৬৯ সালের ১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর ১৯৮৩ সালে তিনি জেলা আদালতের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ১৯৮৫ সালে হাইকোর্ট বিভাগের এবং ২০০১ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী তালিকাভুক্ত হন তিনি। ২০০৩ সালের ২৭ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান। ২০০৫ সালের ২৭ আগস্ট হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে স্থায়ী হন তিনি।
১৯৬৬ সালের ২৭ মে জন্মগ্রহণ করেন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর ১৯৯২ সালে জেলা আদালতের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ১৯৯৪ সালে হাইকোর্ট বিভাগের এবং ২০০২ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন তিনি। ২০০৪ সালের ২৩ আগস্ট হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান বিচারপতি ফারাহ মাহবুব; এক বছর পর ২০০৫ সালের ২৭ আগস্ট হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে স্থায়ী হন। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব চতুর্থ নারী বিচারপতি, যিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেলেন।