বাংলাদেশ যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ে অনেক সাফল্য অর্জন করিলেও প্রাণঘাতী এই রোগ অদ্যাবধি নির্মূল করিতে পারে নাই। এহেন পরিস্থিতির মধ্যে যখন যক্ষ্মা নির্মূলে গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচিতে অর্থায়ন বন্ধ হইয়া যায় তখন নূতন উদ্বেগ সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। সোমবার সমকাল জানাইয়াছে, গত জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে নূতন সরকার ক্ষমতাসীন হইবার পর অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও বন্ধ হইয়া গিয়াছে ইউএসএআইডির অর্থায়ন। ইহার নেতিবাচক প্রভাব পড়িয়াছে যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়, প্রতিরোধ ও চিকিৎসায়। বন্ধ হইয়া গিয়াছে বেসরকারিভাবে পরিচালিত রোগ শনাক্তকরণ, গবেষণা ও সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড। হাসপাতালে মিলিতেছে না ঔষধপ্রতিরোধী যক্ষ্মার সেবা। ইহাতে যক্ষ্মার নূতন ঝুঁকিতে পড়িতে যাইতেছে বাংলাদেশ। এহেন উদ্বেগের কারণ হইল, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে এখনও শনাক্তের বাহিরে ১৭ শতাংশ যক্ষ্মা রোগী। এই সকল রোগী নিজেদের অজান্তেই অতি সংক্রামক যক্ষ্মার জীবাণু প্রসারে ভূমিকা রাখিতে পারেন। অন্যদিকে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বন্ধের কারণে নূতন রোগী শনাক্ত কার্যক্রমও এক প্রকার বন্ধ। যক্ষ্মা নির্মূল কর্মসূচির বাস্তবায়ন সংকট এমন সময়ে শুরু হইল যখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলিতেছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মা নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করিতে হইলে শনাক্তের বাহিরে থাকা রোগীদের চিহ্নিত করিয়া দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনিতে হইবে। তদুপরি মানুষের মধ্যে যক্ষ্মা সম্পর্কে সচেতনতারও অভাব রহিয়াছে। যক্ষ্মার চিকিৎসা বিনামূল্যে পাওয়া
যাইবার তথ্যও যখন অনেকের রোগটির বিপদ সম্পর্কে হুঁশ ফিরাইতে পারে নাই, তখন বিনামূল্যের চিকিৎসা বন্ধ হইবার পরিণাম কী হইতে পারে, উহা কল্পনা করা কঠিন নহে।
আমরা জানি, যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ছয় মাস নিয়মিত ঔষধ সেবন করিতে হয়। নির্দিষ্ট মাত্রায় নিয়মিত এবং পূর্ণ মেয়াদে ঔষধ না খাইলে যক্ষ্মার জীবাণু ওই ঔষধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়িয়া তোলে। বাংলাদেশে যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীদের অবহেলা ও অসচেতনতায় এই ঔষধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বা এমডিআর টিবি ক্রমবর্ধমান বলিয়া সরকারি-বেসরকারি উৎসের সকল তথ্যই বলিতেছে। বিদেশি সহায়তা বন্ধের ফলে ঔষধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগী বৃদ্ধি পাইলে পরিস্থিতি ভয়ংকর রূপ গ্রহণ করা বিচিত্র কিছু নহে। কারণ তখন প্রচলিত ঔষধে সচেতন রোগীদেরও যক্ষ্মা নিরাময় কঠিন হইতে পারে।
শুধু উহা নহে, সামগ্রিক জনস্বাস্থ্যক্ষেত্রে উহার প্রভাব ব্যাপক উদ্বেগের কারণ হইতে পারে। দেশের অর্থনীতির জন্যও যে ইহা সুখকর কোনো সংবাদ নহে– এই কথাও বলা প্রয়োজন। স্বীকার করিতে হইবে, শারীরিক পুষ্টিহীনতার সহিত যক্ষ্মার একটা নিবিড় সংযোগ রহিয়াছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসও এই রোগ সম্প্রসারণের অন্যতম কারণ। এই কারণে সাধারণত সমাজের নিম্নআয়ের মানুষদের মধ্যে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়, যাহাদের উপর শিল্প-কৃষিসহ রাষ্ট্রের প্রায় সকল উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ড নির্ভরশীল। অতএব যক্ষ্মা হইতে বিশেষত শ্রমজীবী মানুষদের রক্ষার্থে কার্যকর পন্থা উদ্ভাবন জরুরি।
যদিও জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (এনটিপি) প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা.
নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সেবা জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাইবার বিষয়ও
নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জনস ব স থ য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সিএসআর ব্যয়ে মার্কেন্টাইল শীর্ষে
চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস জুলাই–ডিসেম্বরে দেশি–বিদেশি ব্যাংকগুলো সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সিএসআর খাতে প্রায় ৩০৭ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এ ব্যয়ের বড় অংশই গেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাতে। এ খাতের আওতায় ব্যাংকগুলো শীতার্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কম্বল এবং বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণে সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করেছে। সাধারণ ব্যাংকগুলো তাদের মুনাফার একটি অংশই সিএসআর খাতে ব্যয় করে। আর শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো মুনাফার পাশাপাশি সন্দেহজনক আয় ও জাকাত তহবিলের অর্থ সিএসআর খাতে ব্যয় করে থাকে।
দেশের সরকারি, বেসরকারি, বিশেষায়িত ও বিদেশি ব্যাংকের সিএসআর কার্যক্রম নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটিতে ২০২৪ সালের শেষ ছয় মাসের (জুলাই–ডিসেম্বর) সিএসআর ব্যয়ের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর সামগ্রিক সিএসআর ব্যয় যেমন তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি ব্যাংকভিত্তিক আলাদা আলাদা খরচের তথ্যও প্রকাশ করা হয়েছে।
গত বছরের শেষার্ধে বন্যার কারণে কিছু এলাকায় সহায়তা বেড়েছিল। এর ফলে খরচ বেড়েছে। সিএসআর ব্যয়ের পুরো অংশ প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা পেয়েছেন। মতিউল হাসান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মার্কেন্টাইল ব্যাংকব্যাংকগুলোর সিএসআর–সংক্রান্ত খরচের গত কয়েক বছরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২১ সালের জুলাই–ডিসেম্বরের পর সিএসআর খাতে ব্যাংকগুলো সবচেয়ে কম অর্থ খরচ করেছে গত বছরের শেষ ছয় মাসে। ২০২১ সালের শেষ ছয় মাসে এই খাতে ব্যাংকগুলো খরচ করেছিল প্রায় ২৯৮ কোটি টাকা। এরপর ২০২২ সালের একই সময়ে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫১৪ কোটি টাকা। আর ২০২৩ সালের জুলাই–ডিসেম্বরে সিএসআর খাতে ব্যাংকগুলোর খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩৫৩ কোটি টাকা। তা গত বছরের শেষ ছয় মাসে কমে ৩০৭ কোটি টাকায় নেমেছে।
সিএসআর কার্যক্রমে গত বছরের শেষ ছয় মাসে খরচ কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে ব্যাংকাররা বলছেন, সাধারণত রাজনৈতিক সরকারের সময়ে এ খাতে অর্থ খরচে ব্যাংকগুলোর ওপর নানামুখী চাপ থাকে। এ কারণে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য হয়ে বেশি খরচ করতে হয়। কিন্তু গত বছরের জুলাই আন্দোলন ও আগস্টে সরকার বদলের পর সিএসআরের অর্থ খরচে রাজনৈতিক চাপ কমে যায়। ফলে সিএসআর ব্যয়ও কমে। তবে গত বছরের আগস্টে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার ফলে ব্যাংকগুলো বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়ায়। এ কারণে সিএসআর ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেনি।
সিএসআর ব্যয়ের শীর্ষে মার্কেন্টাইল ব্যাংকবাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের শেষ ছয় মাসে দেশে সিএসআর ব্যয়ের শীর্ষে ছিল বেসরকারি মার্কেন্টাইল ব্যাংক। বেসরকারি ব্যাংকটি এ খাতে প্রায় ৩১ কোটি টাকা খরচ করেছে। এই তালিকায় ডাচ্–বাংলা ব্যাংক দ্বিতীয়, এক্সিম ব্যাংক তৃতীয়, ব্র্যাক ব্যাংক চতুর্থ ও যমুনা ব্যাংক পঞ্চম স্থানে ছিল। এ ছাড়া ষষ্ঠ থেকে দশম অবস্থানে ছিল যথাক্রমে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। এর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডই শুধু বিদেশি ব্যাংক, বাকিগুলো দেশি। ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কিছু ব্যাংকের সিএসআর খাতে অতীতে বড় ধরনের অনিয়ম ঘটেছে। সিএসআরের অর্থ লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। ফলে সিএসআরের অর্থ ব্যয় নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে।
একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছরের শেষ ছয় মাসে নতুন করে কিছু ব্যাংক সিএসআর ব্যয়ে ওপরের দিকে উঠে এসেছে। সাধারণত এসব ব্যাংক নিয়মিতভাবে তালিকার প্রথম দিকে থাকে না। আগে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো সিএসআর ব্যয়ে এগিয়ে ছিল। তাদের মাধ্যমে আগের সরকারের সুবিধাভোগীরা এ খাতের অর্থ হাতিয়ে নেন। ফলে অন্য ব্যাংকগুলো এখন শীর্ষ তালিকায় উঠে এসেছে। হঠাৎ এসব ব্যাংকের তালিকার শুরু দিকে উঠে আসার কারণ হলো, ডলারের অতিরিক্ত মুনাফার অর্থ সিএসআর খাতে ব্যয়ের বাধ্যবাধকতা। আবার ব্যাংকারদের উদ্যোগে হাসপাতাল নির্মাণেও অর্থ জোগান দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মতিউল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের শেষার্ধে বন্যার কারণে কিছু এলাকায় সহায়তা বেড়েছিল। এর ফলে খরচ বেড়েছে। সিএসআর ব্যয়ের পুরো অংশ প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা পেয়েছেন।
শর্ত মানেনি নতুন ব্যাংকব্যাংকগুলোকে প্রকৃত মুনাফার ১০ শতাংশ অর্থ সিএসআর খাতে খরচ করার নির্দেশনা দেওয়া আছে। কিন্তু সে শর্ত ২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়া নতুন ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগই মানেনি। এ রকম ব্যাংকগুলো হলো এসবিএসি, মধুমতি, মিডল্যান্ড, সীমান্ত, এনআরবি কমার্শিয়াল, ইউনিয়ন, মেঘনা, গ্লোবাল ইসলামী ও সিটিজেনস ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে অনুযায়ী, শর্ত মেনে শুধু এনআরবি ও কমিউনিটি ব্যাংক মুনাফার ১০ শতাংশ সিএসআর খাতে খরচ করেছে। পদ্মা ও সিটিজেনস ব্যাংক মুনাফা না করায় সিএসআর ব্যয় করেনি।
দুটি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানান, ২০২৪ সালের বেশির ভাগ ব্যাংকের মুনাফায় বড় ধাক্কা এসেছে। পর্ষদ পুনর্গঠন হওয়া ইসলামি ও প্রচলিত ধারার অনেক ব্যাংকই লোকসানে পড়েছে। ফলে এসব ব্যাংক সিএসআর খাতে খরচ করতে পারেনি। এ জন্য সামনে অনেক ব্যাংকের সিএসআর ব্যয় কমতে পারে।