প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কবি ফয়েজ আহ্‌মদ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে জাতীয় প্রেস ক্লাব ভবনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কামানের গোলায় আহত হয়ে প্রথমে তাঁর গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুরে, পরে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলায় চলে যান। সেখান থেকে কলকাতায় গিয়ে চেষ্টা করেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে। কিন্তু তাঁর ‘চীনপন্থি’ তকমা এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি চলে যান জলপাইগুড়ি। পরে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের আহ্বানে কলকাতায় এলে তাঁকে বলা হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দিতে। ফয়েজ আহ্‌মদ প্রধানমন্ত্রীকে জানান, তিনি সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা হতে চান। তাজউদ্দীন তখন তাঁকে বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের যে ফ্রন্টেই আপনি অংশ নেন, আপনার পরিচয় হবে মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করলেও আপনি সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সমান সম্মানই পাবেন।’ ফয়েজ আহ্‌মদ তাঁর স্মৃতিকথা ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’তে এসব কথা তুলে ধরেছেন।  

কথাটি মনে পড়ল গত ২১ মার্চ সমকালের একটি প্রতিবেদন পড়ে। সেখানে বলা হয়েছে, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল-জামুকার সাম্প্রতিক এক সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী চার শতাধিক এমএনএ ও এমপিএর বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় থাকছে না। তাদের পরিচয় হবে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’। একই পরিচয় পাবেন ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী-কলাকুশলী, ফুটবল দলের খেলোয়াড়, বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠকরা। জামুকার সিদ্ধান্তটি উপদেষ্টা পরিষদ পাস করলেই তারা সবাই ‘মুক্তিযোদ্ধা’ থেকে হয়ে যাবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেছেন, এতে নাকি কারও মর্যাদা বা সুনাম ক্ষুণ্ন হবে না। মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁকে সহায়তাকারীর মধ্যে পার্থক্য কী– উপদেষ্টার হয়তো তা বোধে আসছে না। যদি আসত, তাহলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তিনি অন্তত দশবার ভাবতেন। 

দেশে অতীতে অনেকে রাষ্ট্রপতি-মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন, ভবিষ্যতেও হবেন। তবে  মুক্তিযোদ্ধার সম্মান তারাই পেয়েছেন, যারা একাত্তরে জীবনের মায়া ত্যাগ করে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক জনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আজ দেখা যাচ্ছে, তাদের অনেকের স্বীকৃত মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। যে মানুষটি ছিলেন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণপুরুষ, যাঁকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ, সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও নাকি এখন থেকে আখ্যায়িত হবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে! আমি কখনও আওয়ামী লীগ করিনি। শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শেও বিশ্বাসী নই। তবে একটি কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করতে দ্বিধা করি না যে, বঙ্গবন্ধু না হলে আমরা হয়তো এই স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের নাগরিক হতে পারতাম না। তা ছাড়া একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে যারা সফল করে তুলেছিলেন, সেই মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী-কর্মকর্তা, সাংবাদিক, সেক্টর কমান্ডারসহ যারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রেখেছেন, তারা সবাই ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে সম্মানীয়। সে সম্মানের আসন থেকে তাদের নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। 

১৯৭১-এ প্রবাসী বাঙালিরাও অবদান রেখেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তাঁর ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ গ্রন্থে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের শান্তি সম্মেলনে অংশ নিতে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর আবু সাঈদ চৌধুরী দেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার খবর পেয়ে লন্ডনে এসে আত্মনিয়োগ করেছিলেন স্বদেশের স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধে। বিবিসিতে সে সময় কর্মরত প্রখ্যাত সাংবাদিক সিরাজুর রহমান তাঁর বই ‘ইতিহাস কথা কয় ও নির্বাচিত প্রবন্ধ’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসীদের অবদানের কথা। বিএনপি নেতা ড.

খন্দকার মোশাররফ হোসেন সে সময়ে লন্ডনে পিএইচডি গবেষণা করছিলেন। তিনিও শামিল হয়েছিলেন সেই সংগ্রামে। তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান’ বইয়েও রয়েছে এর বর্ণনা। ওই সময়ে যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য নিঃস্বার্থ অবদান রেখেছেন তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। ৫৪ বছর তারা এ অভিধায়ই অভিষিক্ত হয়ে আসছিলেন। হঠাৎ কেন তাদের পরিচয় নিয়ে টানাটানির দরকার পড়ল, অনেকের মতো তা আমারও বোধের অগম্য। 

এ প্রসঙ্গে অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। সমকালকে তিনি বলেছেন, “আমরা ইতিহাসের সত্যটা জানি। কোনো আইন বদল করে কারও অবদান বদলে দেওয়া যাবে না। এটি করার প্রয়োজন নেই। এগুলো ‘অপ্রয়োজনীয় কাজ’।” তিনি বলেছেন, ‘যারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত, তাদের পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা ঠিক হবে না।’ জাতির এই বিবেকের বক্তব্যের সঙ্গে এতটুকু দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ নেই। 

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্বাধীনতার ইতিহাস ইচ্ছামতো সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ফল ভালো হয়নি। তারা মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক জিয়াউর রহমানকে ‘পাকিস্তানের চর’ আখ্যা দিয়ে হেয় প্রতিপন্ন করতে চেয়েছে। সে অপপ্রচার সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জিয়ার অবস্থান অম্লান হয়ে আছে। তেমনি বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, তাঁর শাসনামলের শত সমালোচনা থাকলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে তাঁর অবদান কখনোই মুছে ফেলা যাবে না।
একটি কথা বলতেই হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রতিক কিছু কাজকর্ম ‘নেই কাজ, তো খই ভাজ’ প্রবাদকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। তারা আসল কাজ বাদ দিয়ে এমন সব কাজে হাত দিচ্ছে, যেগুলো তাদের করার কথা নয়। তাদের প্রধান দায়িত্ব সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। কিন্তু তা না করে তারা নানা বিষয়ে এমন সব উদ্ভট সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যা নতুন নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় সংক্রান্ত সিদ্ধান্তটিও তেমনি একটি অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্ত। সরকারের উচিত দ্রুত এই হঠকারী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা।

মহিউদ্দিন খান মোহন: সাংবাদিক 
ও রাজনীতি বিশ্লেষক  

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সমক ল ন প রসঙ গ র স ব ধ নত র রহম ন সরক র র প রব স মন ত র অবদ ন সহয গ

এছাড়াও পড়ুন:

নববর্ষে মেয়ের জন্ম, ডাক্তার খুশি হয়ে নাম রেখেছেন বৈশাখী

পহেলা বৈশাখে তৃতীয় সন্তান এসেছে চাঁদপুরের শাহাদাত হোসেন ও রিনা আক্তারের পরিবারে। বৈশাখের স্নিগ্ধ সকালে চাঁদপুর মা ও শিশু স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে মেয়ে সন্তান জন্ম নেয় তাদের ঘরে।

তাদের চরম এক টানাপড়েনের সংসারে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে মেয়ের আগমনে বেশ খুশি শাহাদাত-রিনা দম্পতি। সকালে মেয়ের মিষ্টিমুখ দেখে চিকিৎসক এবং নার্স হাসপাতালে নবজাতকের নাম তালিকাভুক্ত করার সময় পরিবারের সদস্যদের ডেকে বলেন, ‘আজ বাংলা নববর্ষ এবং পহেলা বৈশাখ। তাই মেয়ের নামটি আমরা তালিকায় বৈশাখী দিয়ে দিলাম। খুশি তো?’  নবজাতকের মা-বাবা মাথা নেড়ে সায়ও দেন।

তবে চিকিৎসক আবার সঙ্গে সঙ্গে এটাও বললেন, ইচ্ছে করলে আপনারা এই বিশেষ দিনের নামটার সঙ্গে নিজেদের পছন্দের আরও নাম জড়িয়ে রাখতেই পারেন। সেটা আপনাদের বিষয়।

নবজাতকের বাবা শাহাদাত হোসেন পেশায় একজন রিকশাচালক। ৮ বছর আগে দুই ছেলে- ৫ম শ্রেণির ছাত্র রহমত আর ছোট ছেলে মাদরাসায় পড়ুয়া ইসমাইলকে নিয়ে চলে আসেন চাঁদপুর জেলা শহরের রহমতপুর কলোনিতে। এখানে সেমিপাকা ছোট্ট এক রুমের ভাড়া বাসা নেন। তার মূল বাড়ি ফরিদগঞ্জ উপজেলার সকদী রামপুর গ্রামে। স্ত্রী রিনা আক্তারের বাড়িও একই উপজেলার পাশের গ্রামে।

শহরে এসে ভাড়ায় রিকশা চালান শাহাদাত। ৩'শ টাকা রিকশা মালিককে দেন আর এক দেড়-দুইশ টাকায় চলে সংসার।

বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখে জন্ম নেওয়া মেয়ে সন্তানটিকে নিয়ে কথা হয় শাহাদাত হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাত তিনটায় স্ত্রী রিনার প্রসব ব্যথা উঠে। ক্রমেই ব্যথা বাড়তে থাকলে একটা অটো ডেকে আমার এক ভাবীসহ বাসা থেকে আধা কিলোমিটার দূরে সরকারি মা ও শিশু স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে (মাতৃমঙ্গল নামে পরিচিত) নিয়ে যাই। সঙ্গে সঙ্গে দারোয়ান হাসপাতালের গেট খুলে দেয় এবং নার্স এসে আমার স্ত্রীকে বেডে নিয়ে যায়। পর পরই ডিউটি ডাক্তার আসেন।

তিনি বলেন, হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী আমাকে গেটের বাহিরে অপেক্ষা করতে বলে। তবে চিকিৎসক নার্সরা আমার ভাবীকে বলেন, চিন্তা করবেন না, সব কিছু ঠিক আছে। ইনশাআল্লাহ, উনার নরমাল ডেলিভারিই হবে এবং মা আর গর্ভের সন্তান ভালো আছে।

শাহাদাত হোসেন বলেন, হাসপাতালের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভোরের আলো ফুটে যায়। আর সে সময়ই হাসপাতালের পাশের অফিসার্স ক্লাব থেকে ভেসে আসছিল নববর্ষের গান। ঠিক তখনই গেট খুলে দিয়ে দারোয়ান বলেন ভেতরে আসেন আপনি মেয়ের বাবা হয়েছেন। তখন আল্লার কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। ডাক্তার এবং নার্স বললেন- সকাল সাড়ে আটটায় আপনার মেয়ে জন্ম নিয়েছে। একটা স্যালাইন আর সামান্য কিছু ওষুধ দেওয়া হয়েছে। স্যালাইন শেষ হলেই ১০টার মধ্যেই বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন। আর বাচ্চার ওজন ২ কেজি ৯ শ গ্রাম।

পহেলা বৈশাখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আপনার মেয়েকে কি উপহার দিলো, এমন প্রশ্নের জবাবে সরল হাসি দিয়ে রিকশাচালক শাহাদাত হোসেন বলেন, এই ভোররাতে তারা আমার বউ আর সন্তানের সেবায় একটুও হেলা করেনি। এটাই আমার মতো গরীব বাবার কাছে অনেক বড় উপহার। এর আগেও এই হাসপাতালে দুই-একবার গিয়েছিলাম। তারা তখনও অনেক যত্ন নিয়ে চিকিৎসা দিয়েছিলেন।

মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের চিকিৎসক মেহেদী আল মাসুদ জানান, নববর্ষের প্রথম প্রহরের রোগী রিনা আক্তার। তার চিকিৎসার কোনরূপ হেলা করিনি আমরা। আর এখানে আগে থেকেই আমরা গর্ভবতী মায়েদের প্রসব এবং অন্যান্য চিকিৎসাগুলো দিয়ে থাকি।

শাহাদাত হোসেন বলেন, গরীব ঘরের মেয়েকে কতদিন নিজের কাছে আগলে রাখতে পারবো আল্লাহই ভালো জানেন। তবে যথাসম্ভব চেষ্টা করবো মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মনুষ করার।

তিনি আরও বলেন, আমার মেয়ে যেন সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেচে থাকে সবাই এই দোয়া করবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ