হিমাগারে ‘আলু রাখার জায়গা নেই’ লিখে ভেতরে রাখা হচ্ছে ডিম
Published: 24th, March 2025 GMT
রাজশাহীতে হিমাগারে ‘আলু রাখার জায়গা নেই’ সাইনবোর্ড লাগিয়ে ভেতরে ডিম রাখা হচ্ছে। গত শুক্রবার স্থানীয় প্রশাসন দুটি হিমাগারে গিয়ে ডিম দেখতে পায়। তারপর তারা ডিম সরানো শুরু করলেও পরবর্তী সময়ে সেখানে আবার ডিম রাখা হয়েছে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে, বিশেষায়িত হিমাগার ছাড়া সাধারণ হিমাগারে ডিম রাখা যাবে না। রাজশাহীতে কোনো বিশেষায়িত হিমাগার নেই। এদিকে রাজশাহীতে হিমাগারে আলু রাখার জায়গা না পেয়ে চাষিরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। অনেক চাষি এখনো তাঁদের জমি থেকে আলু তুলতে পারছেন না। আবার কেউ স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে দুই মাসের জন্য স্তূপ করে আলু সংরক্ষণ করছেন।
গত শুক্রবার রাজশাহীতে বৃষ্টির মধ্যে হিমাগারের সামনে আলুর গাড়ির সারি দাঁড়িয়ে যায়। কোনো কোনো গাড়ির আলু বাইরে ২৪ ঘণ্টা ধরে ভিজেছে, কিন্তু হিমাগারের ভেতরে ঢোকার সিরিয়াল পায়নি। খবর পেয়ে পবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরাফাত আমান আজিজ উপজেলার উত্তরা কোল্ডস্টোরেজে ও আসমা কোল্ডস্টোরেজে গিয়ে দেখেন, আলুর জায়গায় ডিম সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ডিমগুলো এসেছে বগুড়ার সান্তাহারের মা-বাবার ডিমের আড়ত, ঢাকার কাপ্তান বাজারের মেসার্স তৌফিক ট্রেডার্স, রাজশাহীর বিসমিল্লাহ ডিম ভান্ডার, মেসার্স শুকরিয়া পোলট্রি শপসহ ঢাকার আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে। এসব ডিমের খাঁচির সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের ভিজিটিং কার্ড লাগানো রয়েছে। সোমবার দুপুরে গিয়েও আসমা কোল্ডস্টোরেজে ডিম পাওয়া যায়। অথচ এই হিমাগারের বাইরে লেখা রয়েছে, আলু রাখার জায়গা নেই, হিমাগার বন্ধ। ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, তারা আলুর পরিবর্তে ঠিকই ডিম সংরক্ষণ করছে।
মা-বাবার ডিমের আড়তের ভিজিটিং কার্ডে আরিফ নামের একজনের ফোন নম্বর আছে। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তাঁরা আলুর মতোই সেখানে ডিম রেখে দিয়েছেন। কত ভাড়া জানতে চাইলে তিনি বলতে পারেননি। তিনি বলেন, তাঁর বড় ভাই এসব হিসাব রাখেন। তিনি বলতে পারবেন।
এই হিমাগারের ডিম সংরক্ষণ করা যাবে কি না, জানতে চাইলে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের রাজশাহীর উপপরিচালক শাহানা আক্তার জাহান বলেন, বিশেষায়িত হিমাগারগুলোতে ডিম রাখার জন্য বিশেষ চেম্বার থাকে। তাঁরা সেখানে ডিম সংরক্ষণ করতে পারেন। রাজশাহীতে কোনো বিশেষায়িত হিমাগার নেই। বগুড়ায় এ–জাতীয় দুটি হিমাগার আছে।
জানতে চাইলে হিমাগার দুটির মালিক আওলিয়া রাজীব প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত গরমের সময় ডিম পচে নষ্ট হয়ে যায়। এ সময় ডিমের ক্ষতি হলে দাম বেড়ে যাবে। ভোক্তাসাধারণই ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। সেই জন্য মানবিক কারণে রাখা হয়। ডিমে খুব বেশি ‘টেম্পারেচার’ লাগে না। তিনি বলেন, গত শুক্রবার জেলা প্রশাসক ও পবার ইউএনও এসে দেখে গেছেন।
পবার ইউএনও আরাফাত আমান আজিজ সোমবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি গত শুক্রবার গিয়ে দেখে এসেছেন। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরকে তাদের সতর্ক করতে বলা হয়েছে। তারা সতর্ক না হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জায়গা না পেয়ে আলুচাষিরা দিশাহারাএদিকে হিমাগারে আলু রাখার জায়গা না পেয়ে চাষিরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। রাজশাহীর তানোরের ইলামদোহী গ্রামের আলুচাষি আবদুর রাজ্জাক (৫৫) এবার সাত বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। আলুর দাম কম। বিক্রি করে উৎপাদন খরচ উঠছে না। আবার কোনো হিমাগারেও তিনি আলু রাখার সুযোগ পাননি। দেড় বিঘা জমির আলু মাত্র ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন। তার আলু বাড়ির উঠানে ও মাঠে পড়ে আছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে হঠাৎ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শুক্রবার ভোরে তাঁর মৃত্যু হয়। এখন তাঁর পরিবার আলু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।
আবদুর রাজ্জাকের মেয়ের স্বামী শরীফ উদ্দিন বলেন, সাত বিঘা জমিতে তাঁর শ্বশুর এবার আলু চাষ করেছিলেন। কোনো হিমাগারে তিনি আলু রাখার সুযোগ পাননি। মাঠে আলুর দাম একেবারেই কম। তবু দেড় বিঘা জমির আলু মাত্র ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন। এক কেজির আলুর উৎপাদন খরচ পড়েছে ২২ থেকে ২৫ টাকা। এই অবস্থায় বাকি আলু বাড়িতে স্তূপ করে রাখা হয়েছে আর জমিতে পড়ে আছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলায় ৩৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। বাস্তবে আরও সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমিতে বেশি আলু চাষ হয়েছে। উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে ১০ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর আলুর উৎপাদন হয়েছিল ৯ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন। সেই হিসাবে এবার ৯০ হাজার টন আলু বেশি উৎপাদন হওয়ার আশা করা হচ্ছে।
শুক্রবার সকালে রাজশাহীর পবা উপজেলার বায়া এলাকায় সরকার কোল্ডস্টোরেজের সামনে আলুবোঝাই গাড়ির দীর্ঘ সারি বৃষ্টিতে ভিজতে দেখা যায়। টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে এই সারিতে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছেন নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার বাসিন্দা মো.
রাজশাহী কোল্ডস্টোরেজ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, রাজশাহীর হিমাগারগুলোর ধারণক্ষমতার ৯০ ভাগ পূরণ হয়ে গেছে। আর এক সপ্তাহের মধ্যে সব হিমাগার বন্ধ হয়ে যাবে। বাকি আলু বাইরে থেকে যাবে। প্রতিবছরই কিছু আলু বাইরে থাকে। এবার উৎপাদনে একটু বেশি হয়েছে, এবার একটু বেশি থাকবে। বাইরের আলু দিয়েই পরবর্তী দুই মাস বাজার চালু থাকে। এবারও তাই থাকবে। তারপর হিমাগারের আলু বের করতে হবে। সোমবার বিকেলে তাঁর মুঠোফোন বন্ধ থাকার কারণে তাঁর সঙ্গে আর যোগাযোগ করা যায়নি।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
মাদারীপুরে ধারাবাহিক সংষর্ঘস্থলে ১৪৪ ধারা জারি
মাদারীপুরের রাজৈরে ধারাবাহিকভাবে চলে আসা সংঘর্ষস্থলে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। সোমবার (১৪ এপ্রিল) দুপুরে লিখিত আদেশনামার মাধ্যমে এ আইন জারি করেন রাজৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাহফুজুল হক।
ইউএনও’র স্বাক্ষরিত আদেশ নামায় বলা হয়, “প্রায় সাতদিন যাবত রাজৈর বাজার সংলগ্ন পশ্চিম রাজৈর ও বদরপাশা গ্রামের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিয়মিত বিরতিতে দেশীয় অস্ত্রসহ মারামারি, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও অস্ত্র প্রদর্শনী বিভিন্ন দাঙ্গা হাঙ্গামা চলছে। এ সকল আইনশৃঙ্খলা বিনষ্টকারী এবং শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রয়োজনে ফৌজদারী কার্যবিধি মতে ১৪৪ ধারা জারি করা হলো। এ মোতাবেক রাজৈর বাজার, পশ্চিম রাজৈর, বদরপাশা এবং গোপালগঞ্জ এলাকায় এক বা একাধিক ব্যক্তি চলাফেরা, সভা-সমাবেশ, শোভাযাত্রা, মাইকের ব্যবহার, লাঠিসোঁটা বা যেকোন প্রকারের আগ্নেয়াস্ত্র বহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।”
“সোমবার (১৪ এপ্রিল) দুপুর ১টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টা এ আদেশ বহাল থাকবে। দায়িত্ব পালনরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জরুরি সেবা প্রদানে নিয়োজিতদের ক্ষেত্রে এ আদেশ শিথিল থাকবে।”
আরো পড়ুন:
টাঙ্গাইলে ঈদের মাঠে সংঘর্ষ এড়াতে ১৪৪ ধারা জারি
নান্দাইলে বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষ, ১৪৪ ধারা জারি
ইউএনও মাহফুজুল হক বলেন, “যেকোন সময় আবার দুই গ্রামের মধ্যে সংঘর্ষ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এরপরও যদি কেউ আইন লঙ্ঘন করার চেষ্টা করেন, তাহলে ১৪৪ ধারা অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এলাকাবাসী জানান, পূর্ব শত্রুতার জেরে দুইদিন যাবত বদরপাশা ও পশ্চিম রাজৈর দুই গ্রামের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। কয়েক দফা সংঘর্ষে দুইপক্ষের অন্তত শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। সংঘর্ষ বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায় পুলিশ।
রবিবার (১৩ এপ্রিল) রাত সাড়ে ১১টার দিকে চতুর্থ ধাপের সংঘর্ষ শেষে রাজৈর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মিটিং করছিল পশ্চিম রাজৈর পক্ষ নেওয়া মজুমদার কান্দি গ্রামের লোকজন। খবর পেয়ে রাজৈর থানার পুলিশ এসে লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালায় তাদের। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশের দুইটি গাড়ি ইট নিয়ে ভাঙচুর করে বিক্ষুব্ধরা। এ ঘটনায় রাজৈর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোস্তফা ও পুলিশের গাড়ির ড্রাইভার শাহাবুদ্দিনের মাথা ফেটে আহত হন। পরে তাদের রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
এর আগে, একইদিন দুপুরে বদরপাশা ও পশ্চিম রাজৈর গ্রামের দুই পক্ষের লোকজনকে ডেকে মিমাংসার জন্য রাজি করান রাজৈর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ওহাব আলী মিয়াসহ স্থানীয় কয়েকজন বিএনপি নেতা। সোমবার (১৪ এপ্রিল) সকাল ১০টার দিকে শালিস মীমাংসার জন্য বসার কথা ছিল। এরই মধ্যে গতকাল সন্ধ্যায় উস্কানিমূলক কথাবার্তায় উত্তেজিত হয়ে আবারো সংঘর্ষে জড়ায় দুই পক্ষ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এসময় বদরপাশা গ্রামের লোকজন কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটান। ১২টি দোকান ভাঙচুর ও লুটপাট করে বদরপাশা গ্রামের বিক্ষুব্ধরা। একপর্যায়ে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয় পুলিশ। পরে সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি শান্ত হয়। ঘটনাস্থালে র্যাব মোতায়েন করা হয়। এ ঘটনায় মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম, রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও কয়েকজন পুলিশ সদস্যসহ উভয় পক্ষের অর্ধশত লোকজন আহত হন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলমের পায়ে মাদারীপুর সদর হাসপাতালে অপারেশন করা হয়।
ঈদ পরবর্তী গত ২ এপ্রিল রাজৈর উপজেলার পশ্চিম রাজৈর গ্রামের ফুচকা ব্রিজ এলাকায় বাজি ফোটান বদরপাশা গ্রামের আতিয়ার আকনের ছেলে জুনায়েদ আকন ও তার বন্ধুরা। এতে বাধা দেন একই গ্রামের মোয়াজ্জেম খানের ছেলে জোবায়ের খান ও তার বন্ধুরা। এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়।
এরই জেরে গত ৩ এপ্রিল সকালে রাজৈর বেপারিপাড়া মোড়ে জোবায়েরকে একা পেয়ে পিটিয়ে তার ডান পা ভেঙে দেন জুনায়েদ ও তার লোকজন। পরে আহত জোবায়েরের বড় ভাই অনিক খান (৩১) বাদী হয়ে জুনায়েদসহ ৬ জনের নাম উলেখ ও নাম না জানা আরো ৪-৫ জনকে আসামি করে রাজৈর থানায় মামলা করেন।
শনিবার (১২ এপ্রিল) রাতে পশ্চিম রাজৈর ও বদরপাশার লোকজন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। কয়েক ঘণ্টাব্যাপী চলে সংঘর্ষ। ওই ঘটনায় দুই ওসি ও অন্তত ১০ পুলিশ সদস্যসহ ২৫ জন আহত হন।
ঢাকা/নূরুজ্জামান/মাসুদ