কলেজ শিক্ষার্থীদের চোখে ঈদের আনন্দ
Published: 24th, March 2025 GMT
ঈদ মানে খুশি। নতুন জামা, সুস্বাদু খাবার আর পরিবার-প্রিয়জনদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি। তবে সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে তরুণদের ঈদ উদযাপনের ধরণ ও ভাবনা। শৈশবের চাঁদ দেখা, ঈদ কার্ড, মেহেদি রাঙানো- এসব স্মৃতি পেছনে ফেলে তরুণদের ঈদে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়, অনলাইন শপিংয়ে নতুন পোশাক কেনা- এগুলোই যেন নতুনত্ব। বর্তমান তরুণদের কাছে ঈদের আনন্দটা ঠিক কেমন তা জানার চেষ্টা করেছে রাইজিংবিডি ডটকম। এতে মতামত দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা।
একালের ঈদ প্রযুক্তি নির্ভর
আরো পড়ুন:
‘যিনি সন্তানের জন্য দুইটা জামা কিনতেন, এখন কেনেন একটা’
ঈদযাত্রায় ভোগাতে পারে বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়ক
ঈদ মানেই আনন্দ, উৎসব, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে মিলিত হওয়া। তবে সময়ের পরিবর্তনে ঈদ পালনের ধরণেও এসেছে বেশ পরিবর্তন। এক সময় ঈদের যে আবেগ-উচ্ছ্বাস ছিল, প্রযুক্তির ছোঁয়ায় তা আজ অনেকটাই বদলে গেছে। আগে আমরা ঈদের জামা কেনার জন্য দোকানে গিয়ে সারাদিন ঘুরতাম। নতুন কাপড়ের ঘ্রাণ ছিল ঈদের আগের রাতের আনন্দের বড় অংশ। মেহেদি পরা, ঈদের দিন খুব ভোরে গোসল করে আতর মাখা ছিল এক অন্যরকম অনুভূতি।
এখন অনলাইনে কেনাকাটা বেশি জনপ্রিয়। ঘরে বসেই ঈদের জামা, জুতো কেনা যায়। ঈদের সাজগোজও অনেক আধুনিক হয়েছে। মেকআপ ও ফ্যাশন ট্রেন্ড বদলেছে। ঈদের দিনের আগের রাত ‘চাঁদ রাত’ হয়ে গেছে ট্রেন্ডি, বন্ধুদের সঙ্গে শপিং ও হ্যাং আউট বেশি। ছোটবেলায় সবাই মিলে ঈদের নামাজের জন্য খুব সকালে উঠতাম। পাঞ্জাবি-পায়জামা বা নতুন শাড়ি পরে খোলা মাঠের ঈদগাহে যাওয়াই ছিল রীতি।
ঈদের নামাজ শেষে সবাই একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করতাম। ছোটরা বড়দের সালাম করত, বড়রা ছোটদের সালামি হিসেবে চকচকে টাকার নোট দিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ রীতি পরিবর্তন হয়েছে, এখন সালামি ডিজিটাল মাধ্যমে দেওয়া হয়। আত্মীয়দের বাড়িতে দাওয়াত ছিল আবশ্যিক, মেহমানদারি ছিল অন্যতম আকর্ষণ।
ঈদের শুভেচ্ছা এখন এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার বা ভিডিও কলে জানানো হয়। ব্যস্ত জীবনের কারণে অনেকেই আর আত্মীয়দের বাড়ি গিয়ে দেখা করতে পারে না, ভার্চুয়াল শুভেচ্ছাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। ছোটবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া, মাঠে খেলাধুলা, ঘুড়ি ওড়ানো ছিল ঈদের আনন্দের অন্যতম অংশ। বড়দের জন্য ছিল গল্পগুজব, টেলিভিশনের বিশেষ অনুষ্ঠান আর পারিবারিক মিলনমেলা।
কত পরিবর্তন! ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ঈদের বিনোদন চলে সারাদিন। ঈদের মজার মুহূর্তগুলো স্ন্যাপচ্যাট, ইনস্টাগ্রাম, টিকটকে আপলোড করা। তবুও ঈদের আনন্দ একটাই- পরিবার, বন্ধু-বান্ধব আর আনন্দঘন মুহূর্ত।
(লেখক: মো.
বয়সের সঙ্গে রূপ বদলায় ঈদ আনন্দ
ঈদ মানে আনন্দ। তবে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এ আনন্দের রূপও পরিবর্তিত হয়ে থাকে। যেমন, শৈশবে ঈদের আগমনী বার্তা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে এক ভিন্ন আনন্দ শুরু হত। তার সঙ্গে ঈদের সালামি, নতুন জামা, নতুন খেলনা, ঈদ কার্ড কেনা ইত্যাদি আনন্দটা আরো বাড়িয়ে দেয়। আর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ আনন্দের রূপও অনেকটা পাল্টাতে শুরু করে। যে মনটা এক সময় ঈদে নতুন জামা, খেলনা, সালামি পেয়ে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হত, সেই মনই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনজনদের নতুন জামা, সালামি, খেলনা ইত্যাদি দিতে পেরে আনন্দিত হয়। এক সময় বাবার হাত ধরে ঈদের নামাজে যাওয়াই ছিল আনন্দ। পরে নিজের সন্তানকে হাতে ধরে ঈদের নামাজে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে এক ভিন্ন আনন্দ খুঁজে নেয়।
আসলে জীবন এমনই বৈচিত্র্যময়। সময় ও দায়িত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের একই বিষয়ে আনন্দ পাওয়া বা প্রকাশের রূপটি নিরবে পরিবর্তিত হয়ে যায়।
(লেখক: ইমরান মাহমুদ, শিক্ষার্থী, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ, গাজীপুর)
পরিবর্তনের ছোঁয়ায় নতুন রূপে ঈদ
ঈদ মানেই মিলন আর খুশির জোয়ার। দূরে থাকা পরিবারের সদস্যরা এ দিনে ফিরে আসেন আপনজনদের কাছে, শিশুরা মেতে ওঠে উচ্ছ্বাসে। চাঁদ দেখা, নতুন জামাকাপড় কেনা, হাতে মেহেদি লাগানো, টিভির বিশেষ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দেখা, সেমাই খাওয়ার মধ্যে ছিল ঈদের এক আলাদা আনন্দ। একসঙ্গে ঈদের নামাজ পড়া, বড়দের কাছ থেকে সালামি পাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া এবং আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়ানো—এসবই ঈদের ঐতিহ্যের অংশ ছিল।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের ধরনেও এসেছে পরিবর্তন। ঈদ কার্ডে শুভেচ্ছা জানানোর জায়গা নিয়েছে মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপের ডিজিটাল বার্তা। আগে মার্কেটে গিয়ে পছন্দের টুপি, পাঞ্জাবি কেনার যে উত্তেজনা ছিল, তা অনেকটাই অনলাইন কেনাকাটায় রূপ নিয়েছে।
পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী, তবে ঈদের আসল সৌন্দর্য পরিবার ও প্রিয়জনদের সঙ্গে কাটানো সময়েই। প্রযুক্তির সুবিধা নেওয়া প্রয়োজন। তবে যেন তা আমাদের আন্তরিকতার জায়গাটা দখল করে না নেয়। ঈদ মানে শুধু ডিজিটাল শুভেচ্ছা নয়, বরং একসঙ্গে হাসি-আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার অনুভূতি ধরে রাখাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
(লেখক: মো. সাকিব উদ্দিন, শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা)
হারিয়ে যাচ্ছে ঈদ কার্ড
ঈদ মানে হাসি-খুশি আর আনন্দ। কিন্তু পুরনো দিনের ঈদের সেই হাসি-খুশি আমেজের ছোঁয়া এখন আর নেই বললেই চলে। বাঙালির ঈদ-আনন্দের সঙ্গে একসময় জড়িয়ে ছিল ঈদ কার্ডের প্রচলন। ঈদকে সামনে রেখে গ্রাম বা শহর, একসময় সবখানেই ছিল ঈদ কার্ডের রমরমা ব্যবসা।
নানা রঙে বর্ণিল সুদৃশ্য কার্ডের ওপর লেখা থাকত ‘ঈদ মোবারক’। শুধু দোকানগুলোতেই নয়, পাড়ার ছেলেরা শামিয়ানা টাঙিয়ে তার নিচে টেবিল সাজিয়ে বসত ঈদ কার্ড বিক্রির জন্য। কয়েক বছর আগেও ঈদের নিমন্ত্রণ বা শুভেচ্ছা বিনিময়ের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ছিল ঈদ কার্ড। বাহারী রঙ আকর্ষণীয় ডিজাইন আর মন ভোলানো ভাষা সমৃদ্ধ এ কার্ডের প্রচলন এখন প্রায় নেই বললে চলে।
ঈদ কার্ডের পরিবর্তে মানুষ এখন অভিনব পদ্ধতিতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। কেউ মোবাইল ফোনের ক্ষুদে বার্তায়, কেউ ফেসবুকে, কেউ টুইটারে, আবার কেউ ইমেইলের মাধ্যমে জানাচ্ছে ঈদের আমন্ত্রণ। কম্পিউটার গ্রাফিক্স ডিজাইনে কৃত্রিম আন্তরিকতার বাক্য বা দৃশ্য সম্বলিত কার্ডগুলো দেখলেই মনে হয়, এগুলো নিতান্তই দায় সারার জন্য।
অথচ সুন্দর ভাষা সমৃদ্ধ আকর্ষণীয় কার্ড অনেক দোকানে পাওয়া যায়। এমনকি অর্ডার দিয়েও তৈরি করাতে পারেন শুভেচ্ছা বিনিময়কারীরা। কিন্তু আমাদের প্রত্যাহিক জীবন-যাত্রা এত যান্ত্রিক হয়ে উঠছে যে, সেখানে আবেগ অনুভূতি দিন দিন ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
(লেখক: উম্মে সালমা, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ)
সর্ম্পকগুলো মেকি হয়ে যাচ্ছে
ঈদ মানে আনন্দ। এক ঝাঁক কচি-কাঁচার উৎসব। ঈদকে কেন্দ্র করে থাকে নানা আয়োজন। যেমন- সেমাই, মিষ্টান্ন খাওয়া, মেহেদি দেওয়া, সালামি আদান-প্রদান, শুভেচ্ছা বিনিময় ইত্যাদি। দিনের পরিক্রমায় ঈদের আনন্দ ফিকে হচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে যতটা সহজ করেছে, ঠিক ততটাই দূরে ঠেলে দিচ্ছে।
এক সময় ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ এর মতো জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল না। প্রিয়মানুষের সঙ্গে কথা বলার জন্য নোকিয়া বা সিম্পনির মতো বাটন ফোন ব্যবহৃত হত। শুভেচ্ছা কার্ড তৈরি করে বাড়িতে গিয়ে ঈদের দাওয়াত না দিলে বিশেষ দিনটি জমত না। রাত জেগে চিঠি বা কার্ড লিখে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়দের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া। প্রতিটি কলমের ছোঁয়ায় ছিল ভালোবাসা।
এখন দিনের পর দিন আমরা অনলাইনে থাকলেও, দীর্ঘক্ষণ নামের পাশে সবুজ বাতি জ্বললেও কেউ কারো খোঁজ নেই না। সবকিছু হাতের মুঠোয় থেকেও যেন অনেক দূরে। যান্ত্রিকতার মায়াজালে আটকে যেন সর্ম্পকগুলো মেকি হয়ে যাচ্ছে। সবার মধ্যে অদৃশ্য এক দূরত্ব, ছায়াদের যেমন কাছে পেয়েও আমরা ছুতে পারি না।
(লেখক: খাদিজা আক্তার সায়মা, শিক্ষার্থী, সরকারি তোলারাম কলেজ, নারায়ণগঞ্জ)
বাঁকা চাঁদের ঈদ আনন্দ
পবিত্র মাহে রমজানের সিয়াম সাধনার পর ঈদুল ফিতর আনন্দধারা বয়ে আনে। শৈশবে ঈদের যে গাঢ় আনন্দের স্বাদ পেয়েছি, তার স্মৃতি এখনো হৃদয়ে অমলিন। ঈদ মানেই আনন্দ ভাগাভাগি, সৌহার্দ্য আর ভালোবাসার এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন।
শৈশবের ঈদ স্মৃতির পাতায় এখনো আঁকা আছে চাঁদ রাতের বিশেষ আয়োজন। মায়ের হাতে বানানো ফিরনি-মিষ্টান্ন, নতুন জামা পরে বড়দের কাছ থেকে ঈদ সালামি আদায় করার সেই মজার খুঁনসুটি। সময় বদলেছে, আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেক রীতিরই রূপান্তর ঘটেছে। এখন মেহেদি সন্ধ্যা, ঈদ কার্ডের জায়গা নিয়েছে ভার্চুয়াল আড্ডা আর মুঠোফোনে সালাম বিনিময়।
তবুও আমি চেষ্টা করি আমার পরিবারের ছোট্ট সদস্যদের জন্য মধুর স্মৃতি তৈরি করতে। অনলাইন থেকে কারুকাজ খচিত ঈদ কার্ড আর সালামি কার্ড এনে তাদের হাতে তুলে দিই। দিন শেষে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়ে, আনন্দ ভাগাভাগি করে ঈদুল ফিতরের প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করাই আমার কাছে ঈদের আসল স্বার্থকতা।
(লেখক: মোছা. জেরিন ফেরদৌস, শিক্ষার্থী, পাইজার-বিইউপি)
ঢাকা/মেহেদী
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ঈদ ঈদ র আনন দ ঈদ ক র ড র ঈদ র ন ম জ আনন দ ভ গ নত ন জ ম আনন দ র এক সময় ছ ল ঈদ ঈদ ম ন র জন য র পর ব পর ব র বড়দ র
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কৃতির ভুবন আলোকিত করে সন্জীদা খাতুনের বিদায়
আজীবন দেশের সংস্কৃতির ভুবন আলোকিত করার গুরুদায়িত্ব পালন করে বিদায় নিলেন সন্জীদা খাতুন। গতকাল মঙ্গলবার ৯২ বছর পূর্ণ করার কিছু আগে প্রয়াত হলেন দেশের এই অগ্রগণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। আগামী ৪ এপ্রিল তিনি ৯৩ বছরে পদার্পণ করতেন। জন্মদিনের পরিবর্তে সেদিনে হবে তাঁর স্মরণসভা।
রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বেলা ৩টা ১০ মিনিটে হৃৎস্পন্দন থেমে যায় সন্জীদা খাতুনের (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ ও পুত্রবধূ লাইসা আহমদ লিসা জানিয়েছেন, তাঁর হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ (হার্ট অ্যাটাক) হয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি সুস্থ ছিলেন না। তাঁর ছিল কিডনির জটিল রোগ। নিউমোনিয়াতেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। ১৯ মার্চ তাঁকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর নেওয়া হয় আইসিইউতে। অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি।
সন্জীদা খাতুনের বড় মেয়ে অপালা ফরহাদ নভেদ আগেই প্রয়াত। ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ আর মেয়ে রুচিরা তাবাসসুম নভেদসহ অনেক আত্মীয়স্বজন ও দেশ-বিদেশে অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন বহু গুণের অধিকারী অনাড়ম্বর জীবন যাপন করা এই মানুষটি। তাঁর ছেলেমেয়েরা জানিয়েছেন, মরদেহ রাতে হিমঘরে রাখা হবে।
সর্বজনের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় আনা হবে তাঁর হাতে গড়া দেশের অগ্রগণ্য সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানট সংস্কৃতি–ভবনে। সন্জীদা খাতুনের অনেক নাতি–নাতনি ও ঘনিষ্ঠ বহু আত্মীয় বিদেশে অবস্থান করছেন। তাঁরা শেষবিদায় জানাতে আসবেন। সে কারণে দাফনের দিনক্ষণ পরে ঠিক করা হবে। ৪ এপ্রিল সন্জীদা খাতুনের জন্মদিনে ছায়ানটে স্মরণসভা করার পরিকল্পনা করা হলেও সময় এখনো ঠিক হয়নি।
সন্জীদা খাতুনের কীর্তির ধারা বিচিত্র। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষক, গবেষক, শিল্পী, সংগীতজ্ঞ, সংগঠক ও সক্রিয় সাংস্কৃতিক নেত্রী। ছিলেন ছায়ানট ও রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সভাপতি। ব্যতিক্রমী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নালন্দার প্রতিষ্ঠাতা। জনসাধারণের সাংস্কৃতিক বোধের উন্নয়ন এবং মুক্ত–উদার মানবিক সমাজ নির্মাণের অবিরাম প্রচেষ্টাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পরে দেশের শিল্প–সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। আত্মীয়স্বজন ছাড়াও তাঁর সহযোদ্ধা, সহশিল্পী, ছাত্রছাত্রী ও গুণমুগ্ধরা শোকার্ত চিত্তে স্কয়ার হাসপাতালে ছুটে যান। অনেকেই ছিলেন অশ্রুসিক্ত।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক হাসপাতালে প্রথম আলোকে বললেন, তিনি দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন এবং জীবনকালটা মানুষের জন্য উজাড় করে দিয়েছেন। জনমানসে সংগীত, শিল্প, সাহিত্যের বোধ সৃষ্টি এবং এর সঙ্গে সামাজিক–সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতার বোধ সঞ্চার করে গেছেন। বিপুলভাবে তিনি বাঙালির জীবন সমৃদ্ধ করে তোলার কাজ করেছেন। তাঁর মতো দ্বিতীয় কেউ নেই।
রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সহসভাপতি ও শিল্পী বুলবুল ইসলাম বলেন, দেশে রবীন্দ্রসংগীতের প্রসার ও সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে ওয়াহিদুল হক, জামিল চৌধুরী ও সন্জীদা খাতুন—এই তিনজনের ভূমিকা পথিকৃতের মতো। তাঁরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক আন্দোলনের পথ সুগম করেছেন। দুজন আগেই প্রয়াত। এখন তৃতীয়জনও চলে গেলেন। নিজেকে অভিভাবকহীন মনে হচ্ছে।
ছায়ানটের তবলার শিক্ষক এনামুল হক ওমর বললেন, যে অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতায় তিনি সারা দেশের সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিল্পীদের সংগঠিত করেছেন, ছায়ানটকে পরিচালনা করেছেন, তার তুলনা হয় না। তাঁর প্রয়াণ জাতির জন্য অপরিমেয় ক্ষতি।
সন্জীদা খাতুনের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে ছায়ানট, উদীচী, চারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন।
সন্জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল। তাঁর বাবা কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক। মা সাজেদা খাতুন গৃহিণী। সন্জীদা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৪ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক, ১৯৫৫ সালে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৭৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু। দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই এতে জড়িয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতায় সংগঠিত করেন বাংলাদেশের শিল্পীদের। শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে সন্জীদা খাতুন ব্রতচারী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।
সন্জীদা খাতুনের প্রথম গানের গুরু ছিলেন সোহরাব হোসেন। তাঁর কাছে তিনি দীক্ষা নেন নজরুলসংগীত, আধুনিক বাংলা গান ও পল্লিগীতির। প্রথমে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছেন প্রখ্যাত হুসনে বানু খানমের কাছে। এরপর তালিম নেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার, আবদুল আহাদ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেনদের মতো বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীদের কাছ থেকে।
আইয়ুব খানের কঠোর শাসনকালে নানা বাধা অগ্রাহ্য করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনে তিনি ও সংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের ঐতিহ্যবাহী সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানটের যাত্রা শুরু। ১৯৬৭ সালে তাঁরা রমনার বটমূলে প্রথমবারের মতো বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখে আয়োজন করে প্রভাতি গানের আসর। ছায়ানটের এই অনুষ্ঠান থেকেই প্রাণিত হয়ে নববর্ষ উদ্যাপন এখন দেশজুড়ে বিপুল এক অসাম্প্রদায়িক উৎসব। ধর্মীয় উগ্রবাদীরা ছায়ানটের এই প্রভাতি গানের আসরে ২০০১ সালে ভয়াবহ বোমা হামলা চালালেও অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি।
এসব সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের বাইরে সন্জীদা খাতুনের গবেষণা ও রচনার কাজও কম নয়। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টির অধিক। রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ, কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, স্বাধীনতার অভিযাত্রা, সাহিত্য কথা সংস্কৃতি কথা, নজরুল মানস ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
সন্জীদা খাতুন দেশে একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। এ ছাড়া সম্মানিত হয়েছেন ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পদক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের দেশিকোত্তম পুরস্কার এবং কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রবীন্দ্র–তত্ত্বাচার্য উপাধিতে।