ইমানে মুজমাল অর্থ

ইমান মানে বিশ্বাস, মুজমাল অর্থ সংক্ষিপ্ত বা সারমর্ম, সারাংশ, সারবস্তু, মর্মকথা। ইমানে মুজমাল অর্থ হলো ইমান বা বিশ্বাস এবং ইসলামের আনুগত্যের মোদ্দা কথা।

এটি হলো:আমানতু বিল্লাহি, কামা হুওয়া বিআছমায়ি হি, ওয়া ছিফাতি হি, ওয়া কাবিলতু জামিআ আহকামি হি, ওয়া আরকানি হি।’

অর্থাৎ: আমি ইমান আনলাম সর্বসুন্দর নামধারী ও সর্ববিদ গুণের অধিকারী আল্লাহ তাআলার প্রতি এবং মেনে নিলাম তাঁর সকল আদেশ ও বিধানাবলি। (‘ওয়া আরকানি হি’ মূলত ‘আহকামি হি’ এরই ব্যাখ্যা বা বিবরণ)। (শুআবুল ইমান)।

ইমানে মুজমাল এর তাৎপর্য

ইমানে মুজমাল-এর বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দুটি দিক রয়েছে।

প্রথম অংশে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের সত্তা ও অস্তিত্বে বিশ্বাসের ঘোষণা রয়েছে এবং বলা হয়েছে, ‘বিশ্বাস করলাম যেমন রয়েছেন তিনি স্বীয় সত্তায়, নামাবলি ও গুণাবলিসহ।’

কোরআনে এসেছে, ‘যে জন স্বর্গে ও পৃথিবীতে আছে সে–ই তাঁহার নিকটে প্রার্থনা করে, প্রতিদিন তিনি একাবস্থায় আছেন।’ (আর রহমান, আয়াত: ২৯)

দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলার প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য ও তাঁর সকল হুকুম-আহকাম বা বিধিবিধান নিঃশর্তভাবে মানার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে, ‘আরও মেনে নিলাম তাঁর সকল আদেশ-নিষেধ ও বিধানাবলি।’ কোরআন মজিদে বলা হয়েছে: ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণরূপে প্রবেশ করো, শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না; নিশ্চয়ই সে তোমার প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২০৮)

ইমান  অর্থ বিশ্বাস। ইসলামি পরিভাষায় এর অর্থ সত্য বলে বিশ্বাস করা ও তার স্বীকৃতি দেওয়া। যে ব্যক্তি ইসলাম ধর্মে ইমান এনে বিশ্বাসের সকল দিক পূর্ণভাবে উপলব্ধি করে ও সৎকর্ম করে তাকে মোমিন বলে। সাধারণত চারটি অঙ্গীকারের মাধ্যমে একজন মুসলমান তার এই আন্তরিক বিশ্বাস ও মৌখিক স্বীকৃতিকে প্রকাশ করে।

প্রথম: কলেমা তৈয়ব—‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’, যার অর্থ ‘আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো মাবুদ (উপাস্য) নেই এবং মোহাম্মদ আল্লাহর প্রেরিত রাসুল।’ দ্বিতীয় হলো কলেমা শাহাদাত বা সাক্ষ্যবাক্য—‘আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াদাহু লা-শারিকালাহু ওয়া আশহাদু আন্না মোহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।’ যার অর্থ ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই, তিনি এক, তাঁর কোনো শরিক নেই; এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মোহাম্মদ আল্লাহর বান্দা ও রাসুল।’

তৃতীয় হলো ইমানে মুজমাল বা সংক্ষিপ্ত ইমান-বাক্য—‘আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস ও মৌখিকভাবে স্বীকার করে আল্লাহর নাম ও গুণাবলিসহ তাঁর ওপর ইমান আনলাম এবং তাঁর সকল আদেশ মেনে নিলাম।’  

চতুর্থ হলো ইমানে মুফাসসাল বা বিশদ ইমান-বাক্য—‘আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসুলগণ, রোজ কিয়ামত, আল্লাহর নির্ধারিত তকদিরের ভালোমন্দ এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের ওপর ইমান আনলাম।’ এই সাতটি বিষয়ে ইমান রাখার ওপর ইসলাম ধর্মে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এগুলোই ইমামের ভিত্তি।

কালিমার বিবরণ

ইসলামের মূল কালিমা হলো ‘কালিমা তইয়্যেবা’ বা পবিত্র বাক্য। ইমানের কালিমা হলো ‘কালিমাহ শাহাদাত’ বা সাক্ষ্যবাণী। এরপর রয়েছে ‘কালিমা তামজিদ’ (মর্যাদার বাণী) ও ‘কালিমা তাওহিদ’ (একত্বের বাণী)। এগুলোকে চার কালিমা বলা হয়। এর সঙ্গে ‘ইমানে মুজমাল’ ও ‘ইমানে মুফাছছাল’ যোগ করে ছয় কালিমা বলা হয়।

আবার প্রথম দুই কালিমা এবং ‘ইমানে মুজমাল’ ও ‘ইমানে মুফাছছাল’-সহযোগে চার কালিমা বলতেও দেখা যায়। কালিমা ‘রদ্দে কুফর’ ধরে প্রথম চারটিসহ পাঁচ কালিমা বলা হয়ে থাকে এবং এর সঙ্গে ‘ইমানে মুজমাল’ ও ‘ইমানে মুফাছছাল’-সহকারে সাত কালিমা হয়ে থাকে।

অনেকে পাঁচ কালিমার সঙ্গে ‘কালিমা রদ্দে শিরক ’ যোগ করে ছয় কালিমা বলেন এবং ইমানে মুজমাল ও ইমানে মুফাছছালকে ইমানের কালিমাদ্বয় নামে স্বতন্ত্ররূপে অভিহিত করেন। এই আট কালিমার মধ্যে কালিমা তইয়্যেবার পরই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ কালিমা হলো ‘ইমানে মুজমাল’ বা ইমানের মর্মকথা।

কূটতর্ক সমাধানে ইমানে মুজমাল

অনেক সময় মানুষ বিভিন্ন জটিল বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যা পেয়ে থাকে। আবার কখনো শয়তানের কুমন্ত্রণায় বিভিন্ন বিষয়ের কুটিল ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। এসব বিষয়ের শিরোভাগে রয়েছে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের সত্তা ও তাঁর পবিত্র গুণাবলি এবং তাঁর অবস্থা ও অবস্থান ইত্যাদি। ইমানে মুজমালে ছোট্ট দুটি শব্দ ‘কামা হুওয়া’, অর্থাৎ ‘যেমন বা যেরূপ আছেন তিনি’ প্রয়োগ দ্বারা কুতর্কে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে এবং এ ধরনের যাবতীয় বিতর্ক এড়ানোর প্রতি সতর্ক ইঙ্গিত করা হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা কোরআন করিমে বলেছেন: ‘তোমাদের সামান্য জ্ঞানই দেওয়া হয়েছে।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ৮৫)

মানুষের সসীম জ্ঞানে অসীম আল্লাহকে ধারণ করা বা যথার্থরূপে বোঝা দুরূহ ব্যাপার। ইমানে মুজমাল আমাদের শেখায় বিতর্ক পরিহার করে, অসীম কুদরতের অধিকারী মহান আল্লাহর সমীপে নিজের সসীম সত্তাকে সমর্পণ করতে।

ইমানে মুফাসসাল বিশ্বাসের বিস্তার ও বিস্তৃতি

সর্বোপরি আল্লাহ তাআলার সর্বোত্তম গুণাবলি ও তাঁর সুন্দরতম গুণসম্পন্ন নামসমূহের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর সত্তা সাধারণ মানুষের জন্য দুর্বোধ্য বিষয় বিধায় তাঁর কুদরতি ক্ষমতাসম্পন্ন গুণবিশিষ্ট নামসমূহ চর্চার কথা বলা হয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে: ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলার নিরানব্বইটি নাম রয়েছে, যে এগুলো আত্মস্থ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (তিরমিজি শরিফ)।

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘তোমরা আল্লাহর সত্তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা, আলোচনা-পর্যালোচনা কোরো না; বরং তাঁর গুণাবলি এবং তাঁর সৃষ্টি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা, আলোচনা-পর্যালোচনা করো।’ (বুখারি শরিফ ও মুসলিম শরিফ)।

ইমাম আযম আবু হানিফা (রা.

) বলেন: যে সকল বিষয়ে কোরআন ও হাদিসে অস্পষ্টতা রয়েছে এবং তার কোনো দৃশ্যমান যৌক্তিক ও নিশ্চিত ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই, সে বিষয়ে নীরবতাই সমাধান। (শারহুল আকায়িদ আন নাসাফি)। সুতরাং ‘মুতাশাবিহাত’ বা অস্পষ্ট বিষয়গুলোর যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা না থাকলে মোমিনের অবস্থান হবে।

‘যেমন আছেন তিনি, যেরূপে আছেন তিনি; তেমন ও সেরূপেই বিশ্বাস করি।’ (তানজিমুল আশতাত)। এই বিশ্বাস হলো গায়েব বা অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। যা কোরআনে বলা হয়েছে: ‘তারা মুত্তাকিন মোমিন, যারা গায়েব তথা না দেখা বিষয়ে ইমান আনে বা বিশ্বাস করে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ৩)

ইমান ও আমলের পূর্ণতায় ইমানে মুজমালের ভূমিকা

ইমানে মুজমাল নামের এ কালিমা দ্বারা একটিমাত্র বাক্যের মাধ্যমে ইমানের পরিপূর্ণতা সাধিত হয় ও ইসলামের সম্পূর্ণতা বিধান হয়। কারণ, ইমান হলো মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক আনীত আল্লাহ তাআলার সকল আদেশ-নিষেধ ও বিবরণ বিশ্বাস করা এবং ইসলাম হলো সে অনুসারে জীবনযাপন বা আমল তথা কর্ম করা।

এ কালিমায় উক্ত উভয়টি ব্যাপক অর্থে ঘোষণা করা ও স্বীকার করা হয়েছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, বিশ্বাস করলাম আর দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, মেনে নিলাম। শর্তহীন ও সরল এ বাক্য ইমান ও ইসলামের ষোলো আনা পরিপূর্ণ করে।

নবীজি (সা.)–এর উম্মত হিসেবে আমাদের করণীয়

এর বিপরীত হলে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক আনীত আল্লাহ তাআলার কোনো একটি আদেশ বা নিষেধ অমান্য বা অস্বীকার করলে ও কোনো বিবরণ অবিশ্বাস করা হলে, তা হবে কুফর; যা ইমানের পরিপন্থী এবং সে অনুসারে আমল বা কর্ম না করলে তা হবে ফাসিকি বা পাপাচার।

মহাগ্রন্থ আল কোরআনে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন: ‘তোমরা কি এ গ্রন্থের কিছু বিশ্বাস করো আর কিছু অবিশ্বাস করো? তবে যারা এরূপ করে তাদের দুনিয়াতে লাঞ্ছনা ও কিয়ামত দিবসে কঠিনতম সাজা পাওয়া ব্যতীত আর কোনো বিনিময় নেই; তোমরা যা করো সে বিষয়ে আল্লাহ বেখবর নন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ৮৫)

ইমানের কালিমাসমূহ আমাদের জীবনে মূল সূত্রের মতো কাজ করে। আমরা যদি এগুলো বুঝে, সে অনুপাতে জীবন পরিচালনা করি; তবেই আমাদের জীবনে ইমান বিকশিত হবে, ইসলাম পত্রপল্লবে সুশোভিত হবে। আমরা ইমানের স্বাদ পাব এবং ইসলামের সুফল উপভোগ করতে পারব।

তাই আমাদের উচিত কালিমাগুলো পূর্ণরূপে জানা এবং তার মর্মার্থ অবগত হওয়া ও তার মূল ভাব অনুধাবন করে সে চেতনা স্বীয় জীবন ও কর্মে রূপায়ণ ও বাস্তবায়ন করা। এটাই ইমানের দাবি, এটাই মোমিনের কর্তব্য।

আরও পড়ুননামাজ বিশ্বাসীদের কাছে মিরাজ ২৭ জানুয়ারি ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আল ল হ ত আল র ব শ ব স কর ইসল ম র আম দ র গ ণ বল হ ম মদ ক রআন প রথম ব বরণ

এছাড়াও পড়ুন:

‘সংস্কার ও বিচার ছাড়া ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা হলে জনগণ প্রতিরোধ করবে’

সংস্কার ও বিচার ছাড়া কোনো দলকে ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা হলে তা মেনে নেওয়া হবে না এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তা প্রতিহত করবে বলে জানিয়েছেন দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।

বুধবার (২৬ মার্চ) মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে ৭১-এর বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান।

নাহিদ ইসলাম বলেন, “আগামীতে আর যেন রক্ত দিতে না হয়, আমরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই। ৭১ এবং ২৪-এর স্বাধীনতা পরস্পর বিরোধী নয়। একাত্তরে যা চেয়েছিলাম, চব্বিশে তা অর্জন হয়েছে। যারা ৭১ এবং ২৪ এর মধ্যে বিরোধিতার সৃষ্টি করছে, তাদের উদ্দেশ্য অসৎ “

সংস্কার এবং বিচারবিহীন নির্বাচন মেনে নেওয়া হবে না জানিয়ে তিনি দাবি করেন, “এখন পুরানো সংবিধান চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসন করার ষড়যন্ত্রও চলছে।”

কোনো দলকে সংস্কার ও বিচার ছাড়াই ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা হলে তা জনগণ প্রতিরোধ করবে, এবং এনসিপি এ ধরনের চেষ্টাকে প্রতিহত করতে প্রস্তুত থাকবে বলেও তিনি জানান।

ঢাকা/সাব্বির/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ