রাতে শুনি ‘গেম ওভার’, সকালে শুনি কী
Published: 24th, March 2025 GMT
শেক্সপিয়ারের ‘হেনরি দ্য ফোর্থ’ নাটকের একটি চরিত্র হলো ‘গুজব’।
সেখানে গুজব নিজের সম্পর্কে বলে, ‘হাওয়া আমার ঘোড়া, হাওয়াই ঘোড়ায় চড়ে পুবের আকাশ থেকে আমি পশ্চিমেতে যাই। সব ঘটনা, সব রটনা ছড়িয়ে দিই তাবৎ বিশ্বময়। মিথ্যা-বিষে পূর্ণ করি সব মানুষের কান।’
আজকের দিনে গুজব হাওয়াই ঘোড়া থেকে নেমে ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ নামের ঘোড়ায় চেপেছে। সে ঘোড়া আরও জোরে ছোটে।
তবে কিনা এই ভাটির দেশে খাঁটি গুজব বলে কিছু নেই; এখানে সব গুজবেই সত্যের মিশেল থাকে। এখানে হিউমারাসলি সব রিউমারই ফ্যাক্ট।
এখানে যা রটে, তার অনেকটাই ঘটে। সে কারণে এখানে শুধু মানুষের ওপর নয়, গুজবের ওপরও বিশ্বাস হারানো পাপ।
কিন্তু সাত-আট মাস ধরে কিছু লোক গুজব ছড়ানোর নামে দেশে যে গজবের পরিবেশ তৈরি করেছে, তাতে সত্যিকারের গুজবের ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে।
আরও পড়ুনসবখানে গুজব ও অপতথ্যের বিষ, প্রতিষেধক কোথায়৩০ জানুয়ারি ২০২৫কাল (২৩ মার্চ দিবাগত রাত) সারা রাত ছিল গুজবের রাত। রাতদুপুরে এক বন্ধুর ফোনে ঘুম ভাঙল। সে বলল, ‘ঘটনা যা শুনলাম সত্যি নাকি? সকালে নাকি ইমার্জেন্সি দিচ্ছে? ঢাকা নাকি ফাঁকা হয়ে গেছে?’
আমি আধা ঘুম আধা জাগরণের কণ্ঠে বললাম, ‘তোরে এই কথা “সোর্স চালাই দেন” বলল?’
সে বলল, ‘না, খুবই রিলায়েবল সোর্স জানাইছে। ঘটনা সত্য।’
রাত দুইটায় ঘুমের বারোটা বাজল। ফেসবুকে ঢুকলাম। দেখলাম, আওয়ামী সমর্থক এক বন্ধু লিখেছেন, ‘গেম ওভার!’
তাঁর মন্তব্যের ঘরে একজন লিখেছেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’; একজন লিখেছেন, ‘জয় বাংলা’; একজন লিখেছেন, ‘এই সরকারের সব কয়টার হিসাব নেওয়া হবে’।
একজন আবার আনন্দের চোটে আবেগ দমন করতে না পেরে এমন অশ্রাব্য ভাষায় সম্ভাব্য ‘বিজয়’কে উদ্যাপন করেছেন, যা এখানে উল্লেখ করাটা ঠিক হবে না।
আরও পড়ুনকানে গুজব, হাতে আইন২৩ জুলাই ২০১৯৫ আগস্টের পর থেকে পলাতক আছেন, এমন এক বন্ধু লিখেছেন, ‘একটাকেও পালাতে দেওয়া হবে না। সকালে সবাই এয়ারপোর্টে যান।’
তাঁর মন্তব্যের ঘরে একজন লিখেছেন, ‘ইনশা আল্লাহ ভাই, জয় বাংলা!’; একজন লিখেছেন, ‘ভোরেই বিমানবন্দরে থাকব ভাই। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’
একজন লিখেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত সকালেই সুখবর আসছে!’; একজন ছাত্র-জনতা আন্দোলনের নেতাদের উদ্দেশে লিখেছেন, ‘সুরা-কালাম যা পড়ার পড়ে নে, সময় শেষ!’
একজন লিখেছেন, ‘কাল সকালে ঢাকা শহরের মিষ্টির দোকান খালি হয়ে যাবে। সকাল দশটার আগে মিষ্টির অর্ডার দিয়ে রাখেন।’
সরকারি কিছু নথিপত্র এবং চিঠিজাতীয় কাগজের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে একজন আবার জানিয়ে দিয়েছেন, আজ ২৪ মার্চই অন্তর্বর্তী সরকারের শেষ দিন। সেই স্ট্যাটাস কয়েক শ জন শেয়ার করেছেন।
আরও পড়ুন১৩ তারিখ গেল, বাংলাদেশে তো কিছু ওল্টাল না!১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫একজন হোয়াটসঅ্যাপে ভারতের ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র একটি খবরের লিংক পাঠিয়েছেন। সেই খবরের হেডিং, ‘থমথমে ঢাকা, ইউনূস উচ্ছেদ ও সেনাশাসন চেয়ে মিছিল’।
আরেকজন ভারতের আরেকটি নিউজ পোর্টালের লিংক পাঠিয়েছেন। সেই খবরের হেডিং—‘গৃহযুদ্ধে গোটা বাংলাদেশ; হাসিনাকে ঢোকাতে আর্মি নামালেন সেনাপ্রধান ওয়াকার।’
কেউ কেউ আবার সকাল হওয়ার পর কয়টা কত মিনিটে কোন কর্মকর্তা কী ঘোষণা দেবেন, ঠিক কয়টায় কী ঘটনা ঘটবে, সুনির্দিষ্ট করে তা ঘণ্টা–মিনিট উল্লেখ করে বলে দিয়েছেন।
আগের দিন হলে এসব দেখার পর উদ্বেগে-চিন্তায় ঘুম আসত না। কাল রাতেও ঘুম আসেনি। তবে উদ্বেগে বা চিন্তায় না; ঘুম আসেনি মেজাজ খারাপ হওয়ার কারণে।
ফেসবুকের কারণে গোটা দেশটাই যেহেতু সত্যোত্তর—‘পোস্টট্রুথ’, সেহেতু এখানে কোনো গুজবকে ‘সত্য’ হয়ে উঠতে শুধু কিছু ফেসবুক পোস্টের হাজার কয়েক শেয়ারের দরকার হয়। কটাকট কিছু ছবি ফটোশপে মেরে দিয়ে কায়দামতো একটা ক্যাপশন লিখে ফেসবুকে আপলোড করে দিলেই হলো। এই ছবিসংবলিত বয়ানগুলোই বাস্তব। ইনফো-হাইওয়েতে সেগুলো ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু একই ধরনের গুজব একই কায়দায় ছড়ানো হলে তা যে একসময় আর কাজে দেয় না; এই আনস্মার্ট গুজববাজদের কে বোঝাবে?মেজাজ খারাপ হয়েছে এই ভেবে যে গুজব ছড়ানোরও তো একটা আদবকায়দা আছে; একটা ‘গোল্ডেন রুল’ আছে। এরা তো সেই নিয়ম কানুনের ধারেকাছেই থাকছে না।
পাবলিক যাতে গুজবটা গেলে, তার জন্য মিনিমাম ‘ফ্যাক্ট’ তো মেশাতে হবে!
কয়দিন পরপর নিঝুম রাতে শিয়ালের মতো কেউ একজন ‘গেম ওভার, কেউ যেন পালাতে না পারে’ মার্কা হুক্কা হুয়া দিচ্ছে। বাদ বাকিরা ‘হুয়া হুয়া’ বলে ‘ধুয়া’ দিচ্ছে।
পরে যখন সকাল হচ্ছে, তখন দেখা যাচ্ছে, নিঝুম রাত উধাও, শিয়ালের হুক্কা হুয়াও নেই।
ফেসবুকভিত্তিক এই গুজবগুলো সাধারণত সূক্ষ্মভাবে একটি পক্ষকে লক্ষ্য করে রাতে ছড়ানো হয়। তখন সেই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে তুমুল জোশ আসে।
এটা অনেকটা এনার্জি ড্রিংকের মতো কাজ করে। গুজব-জুসের পীযূষ পান করে হুঁশ হারিয়ে তাঁরা বিপুল বিক্রমে রাজা-উজির মেরে ফেলেন।
অমুকের পতন আর তমুকের প্রত্যাবর্তনে তাঁরা দিনক্ষণ ঠিক করে দিয়ে সমানে স্ট্যাটাস দিতে থাকেন।
পরে যখন সকাল হয়; পরে যখন ‘ঘটনা ঘটার’ সময় পার হয়ে যায়, তখন জুসের ঘোর কাটে। তাঁরা তখন বেহুঁশ থেকে হুঁশে আসা শুরু করেন।
আবার কয়েক দিন পর নতুন করে নতুন এনার্জি ড্রিংক খাওয়ানো হয়। আবার ভাঙা মন চাঙা করা হয়।
কিন্তু বারবার একই জিনিস একই কায়দায় খাওয়ানোর কারণে নেতা-কর্মীরা আর আগের মতো চাঙা হচ্ছেন না।
গুজবমতো পাশের দেশ থেকে কেউ চট করে ঢুকে পড়ছেন না বা অবস্থা জরুরির দখলে যাচ্ছে না দেখে তাঁদের অনেকে বিরক্ত হচ্ছেন।
ইন্টারনেট আসার আগে হুইসপারিং ক্যাম্পেইনের চল ছিল। ‘ওয়ার্ডস অব মাউথ’ বা মুখে মুখে ফিসফাস করে গুজব ছড়ানোর ধারা ছিল।
ফেসবুক সেই ধারায় বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। এখন কারেন্টের গতিতে ভুয়া খবর ভাইরাল হয়ে তা খবরের মর্যাদা পেয়ে যাচ্ছে।
ঘটনা সত্যি নাকি ভুয়া, তা যাচাই করার আগ্রহ বা সময় কোনোটাই বেশির ভাগ মানুষের থাকছে না।
ফেসবুকের কারণে গোটা দেশটাই যেহেতু সত্যোত্তর—‘পোস্টট্রুথ’, সেহেতু এখানে কোনো গুজবকে ‘সত্য’ হয়ে উঠতে শুধু কিছু ফেসবুক পোস্টের হাজার কয়েক শেয়ারের দরকার হয়।
কটাকট কিছু ছবি ফটোশপে মেরে দিয়ে কায়দামতো একটা ক্যাপশন লিখে ফেসবুকে আপলোড করে দিলেই হলো। এই ছবিসংবলিত বয়ানগুলোই বাস্তব। ইনফো-হাইওয়েতে সেগুলো ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু একই ধরনের গুজব একই কায়দায় ছড়ানো হলে তা যে একসময় আর কাজে দেয় না; এই আনস্মার্ট গুজববাজদের কে বোঝাবে?
দুই দিন পর পর গুজবসেবীরা রাতভর গুজব ছড়াচ্ছেন, আর রাজনীতি সচেতন বন্ধুরা ফোন করে ‘ঘটনা সত্যি নাকি?’ বলে কাঁচাঘুম ভাঙাচ্ছেন, ব্যাপারটা কি ভালো হচ্ছে?
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: একজন ল খ ছ ন ফ সব ক খবর র
এছাড়াও পড়ুন:
গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই বস হিসেবে আদর্শ কেন
সেটিই করুন, যা করতে ভালোবাসেন
সুন্দর পিচাইয়ের মতে, যে কাজে আপনার সবচেয়ে বেশি আনন্দ হয়, সেটিই বেছে নেওয়া উচিত পেশা হিসেবে। সেই কাজটা খুঁজে বের করতে একটু সময় লেগে গেলেও ক্ষতি নেই। বাস্তবতা হলো পরিবার বা সমাজের চাপে নিজের পছন্দের কাজ করতে পারেন না অনেকেই; কিন্তু যে কাজ আপনার পছন্দ নয়, সেই কাজের সামাজিক কিংবা আর্থিক মর্যাদা যত বেশিই হোক না কেন, তাতে সত্যিকার অর্থে সাফল্য পাওয়া নিঃসন্দেহে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে; বরং নিজের ভালো লাগার কাজকে পেশা হিসেবে নিতে পারলে সফল হওয়া তুলনামূলক সহজ। কর্মজীবনের আনন্দও খুঁজে পাবেন এতে। কাজকে বোঝা মনে হবে না।
আরও পড়ুনঅফিসে আপনি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, বুঝুন ১০ লক্ষণ দেখে০২ ডিসেম্বর ২০২৪নতুনকে গ্রহণ করুন সহজেভিন্নধারার কিছু শুরু করতে সাহস করে উঠতে পারেন না অনেকেই। কিন্তু সুন্দর পিচাই বিশ্বাস করেন, নতুন যেকোনো ভাবনাকেই ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করা উচিত। অপ্রচলিত বিষয় বলে কোনো কিছুকে শুরুতেই নাকচ করে দেওয়া ঠিক নয়।
শিখতে থাকুন, বাড়তে থাকুনক্যারিয়ারের প্রতিটি পর্যায়েই শেখার চর্চা ধরে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করেন গুগলের সিইও। ক্যারিয়ারের কোনো পর্যায়েই একজন ব্যক্তি হিসেবে বেড়ে ওঠার পালা কিন্তু শেষ হয়ে যায় না। মানুষ হিসেবে নিজের সেরা ভার্সন হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা আপনার ক্যারিয়ারের জন্যও ইতিবাচক।
আরও পড়ুনআদর্শ বস কর্মীদের যে ৫টি কথা প্রতিদিন বলেন২৫ মার্চ ২০২৪চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুনজীবনে বড় কিছু করতে হলে চ্যালেঞ্জ নিতেই হবে আপনাকে। ঝড়ঝাপটা সামলে এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে। নিজের কমফোর্ট জোন বা স্বস্তির জায়গায় পড়ে থাকলে কিন্তু উন্নতি করা কঠিন। সুন্দর পিচাইয়ের ক্যারিয়ার থেকে আপনি তা অনায়াসেই অনুধাবন করবেন। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং নতুন কিছু উদ্ভাবনের প্রতি গুরুত্ব দেন সুন্দর পিচাই।
নেতৃত্ব দিন সমমর্মী হয়েনেতৃত্ব মানে কেবল কর্তৃত্বই নয়; বরং অধীনদের মতামত গ্রহণ করার মানসিকতা এবং তাঁদের ভাবনাগুলোকে তাঁদের জায়গা থেকে বিবেচনার চেষ্টা করাই একজন ভালো দলনেতার বৈশিষ্ট্য। সুন্দর পিচাই তাঁর নম্র কিন্তু কার্যকর নেতৃত্বের জন্য জনপ্রিয়।
সূত্র: এমএসএন
আরও পড়ুনবিখ্যাত মনোবিজ্ঞানীর মতে, অফিসের যে ৪টি নিয়ম বাতিল করার এখনই সময় ০৬ মার্চ ২০২৫