কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বিএনপির সাংগঠনিক সভাকে কেন্দ্র করে দলটির স্থানীয় বিবদমান দুটি গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছে।

সোমবার দুপুরে চৌদ্দগ্রাম বাজারে একটি মিলনায়তনে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় বেশ কিছুক্ষণ ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর উপজেলা সদরে স্থানীয় সাবেক এমপি মুজিবুল হকের ব্যক্তিগত কার্যালয়টি দখলে নিয়ে অফিস করে স্থানীয় বিএনপি। এ উপজেলায় স্থানীয় বিএনপিতে দুটি গ্রুপ রয়েছে। ওই কার্যালয়ে সোমবার বিএনপি’র সাংগঠনিক সভা চলাকালে কামরুল হুদা গ্রুপ ও হিরণ মোল্লা-জুয়েল গ্রুপের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। কামরুল হুদা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং সাজেদুর রহমান মোল্লা হিরণ কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র সদস্য। 

জানা যায়, কামরুল হুদা গ্রুপের হামলায় জেলা বিএনপির সদস্য হিরণ মোল্লাসহ অন্তত ২০ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। অপর আহতরা হচ্ছেন, পৌর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি কাজী জোবায়ের, চিওড়া ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, মুন্সীরহাট ইউনিয়ন যুবদল কর্মী সবুজ, শ্রীপুর ইউনিয়নের বাইকগ্রামের সাইফুল, একই ইউনিয়নের ছাত্রদল কর্মী ইউসুফ, জনি, যুবদল কর্মী ইকবাল, উজিরপুরের আইয়ুব, কালিকাপুর ইউনিয়ন শ্রমিকদলের সভাপতি মো.

জাকির হোসেন, যুবদল কর্মী মহিনসহ অন্তত ২০জন নেতাকর্মী। আহতরা সবাই হিরন গ্রুপের অনুসারী। আহতদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। 

কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক তোফায়েল হোসেন জুয়েল বলেন, উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সভায় কামরুল হুদা গ্রুপ ব্যতিত যাতে অন্য ডেলিকেট প্রবেশ করতে না পারে তাই তারা গেইটে পাহারা বসায়। আমরা নেতাকর্মীদের নিয়ে প্রবেশের চেষ্টা করলে হকিস্টিক, চাইনিজ কুড়ালসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করে। এতে আমাদের অন্তত ২০জন নেতাকর্মী আহত হয়েছে। হামলায় আমরা সভাস্থলে প্রবেশ করতে না পেরে চলে আসি।

কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সাজেদুর রহমান মোল্লা হিরণ বলেন, নেতাকর্মীদের নিয়ে আমি সভাস্থলে প্রবেশের চেষ্টা করলে কামরুল হুদার লোকজন আমাকে লাঞ্ছিত করে এবং নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করে। আমি মিলনায়তনে প্রবেশ করতে না পেরে আবুল খায়ের মার্কেটের সামনে এসে নেতাকর্মীদের নিয়ে অবস্থান নেই। কিছুক্ষণ পর সেখানেও আমার ওপর হামলা করে।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি কামরুল হুদা বলেন, আমাদের সভা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। বাহিরে হিরন মোল্লার লোকজন ইচ্ছে করেই ঝামেলা করতে এসে আমাদের লোকজনের সঙ্গে মারামারিতে লিপ্ত হয়। 

চৌদ্দগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিলাল উদ্দিন জানান, বিএনপির সাংগঠনিক সভায় দুই পক্ষের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে। তবে সেখানে পুলিশ মুভ করেনি। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত আছে। এ ঘটনায় কোন পক্ষ অভিযোগ দায়ের করে নাই।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব এনপ স ঘর ষ ন ত কর ম দ র ব এনপ র স আম দ র প রব শ য বদল উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

সংস্কৃতির ভুবন আলোকিত করে সন্‌জীদা খাতুনের বিদায়

আজীবন দেশের সংস্কৃতির ভুবন আলোকিত করার গুরুদায়িত্ব পালন করে বিদায় নিলেন সন্‌জীদা খাতুন। গতকাল মঙ্গলবার ৯২ বছর পূর্ণ করার কিছু আগে প্রয়াত হলেন দেশের এই অগ্রগণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। আগামী ৪ এপ্রিল তিনি ৯৩ বছরে পদার্পণ করতেন। জন্মদিনের পরিবর্তে সেদিনে হবে তাঁর স্মরণসভা।

রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বেলা ৩টা ১০ মিনিটে হৃৎস্পন্দন থেমে যায় সন্‌জীদা খাতুনের (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ ও পুত্রবধূ লাইসা আহমদ লিসা জানিয়েছেন, তাঁর হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ (হার্ট অ্যাটাক) হয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি সুস্থ ছিলেন না। তাঁর ছিল কিডনির জটিল রোগ। নিউমোনিয়াতেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। ১৯ মার্চ তাঁকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর নেওয়া হয় আইসিইউতে। অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি।

সন্‌জীদা খাতুনের বড় মেয়ে অপালা ফরহাদ নভেদ আগেই প্রয়াত। ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ আর মেয়ে রুচিরা তাবাসসুম নভেদসহ অনেক আত্মীয়স্বজন ও দেশ-বিদেশে অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন বহু গুণের অধিকারী অনাড়ম্বর জীবন যাপন করা এই মানুষটি। তাঁর ছেলেমেয়েরা জানিয়েছেন, মরদেহ রাতে হিমঘরে রাখা হবে।

সর্বজনের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় আনা হবে তাঁর হাতে গড়া দেশের অগ্রগণ্য সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানট সংস্কৃতি–ভবনে। সন্‌জীদা খাতুনের অনেক নাতি–নাতনি ও ঘনিষ্ঠ বহু আত্মীয় বিদেশে অবস্থান করছেন। তাঁরা শেষবিদায় জানাতে আসবেন। সে কারণে দাফনের দিনক্ষণ পরে ঠিক করা হবে। ৪ এপ্রিল সন্‌জীদা খাতুনের জন্মদিনে ছায়ানটে স্মরণসভা করার পরিকল্পনা করা হলেও সময় এখনো ঠিক হয়নি।

সন্‌জীদা খাতুনের কীর্তির ধারা বিচিত্র। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষক, গবেষক, শিল্পী, সংগীতজ্ঞ, সংগঠক ও সক্রিয় সাংস্কৃতিক নেত্রী। ছিলেন ছায়ানট ও রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সভাপতি। ব্যতিক্রমী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নালন্দার প্রতিষ্ঠাতা। জনসাধারণের সাংস্কৃতিক বোধের উন্নয়ন এবং মুক্ত–উদার মানবিক সমাজ নির্মাণের অবিরাম প্রচেষ্টাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পরে দেশের শিল্প–সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। আত্মীয়স্বজন ছাড়াও তাঁর সহযোদ্ধা, সহশিল্পী, ছাত্রছাত্রী ও গুণমুগ্ধরা শোকার্ত চিত্তে স্কয়ার হাসপাতালে ছুটে যান। অনেকেই ছিলেন অশ্রুসিক্ত।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক হাসপাতালে প্রথম আলোকে বললেন, তিনি দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন এবং জীবনকালটা মানুষের জন্য উজাড় করে দিয়েছেন। জনমানসে সংগীত, শিল্প, সাহিত্যের বোধ সৃষ্টি এবং এর সঙ্গে সামাজিক–সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতার বোধ সঞ্চার করে গেছেন। বিপুলভাবে তিনি বাঙালির জীবন সমৃদ্ধ করে তোলার কাজ করেছেন। তাঁর মতো দ্বিতীয় কেউ নেই।

রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সহসভাপতি ও শিল্পী বুলবুল ইসলাম বলেন, দেশে রবীন্দ্রসংগীতের প্রসার ও সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে ওয়াহিদুল হক, জামিল চৌধুরী ও সন্‌জীদা খাতুন—এই তিনজনের ভূমিকা পথিকৃতের মতো। তাঁরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক আন্দোলনের পথ সুগম করেছেন। দুজন আগেই প্রয়াত। এখন তৃতীয়জনও চলে গেলেন। নিজেকে অভিভাবকহীন মনে হচ্ছে।

ছায়ানটের তবলার শিক্ষক এনামুল হক ওমর বললেন, যে অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতায় তিনি সারা দেশের সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিল্পীদের সংগঠিত করেছেন, ছায়ানটকে পরিচালনা করেছেন, তার তুলনা হয় না। তাঁর প্রয়াণ জাতির জন্য অপরিমেয় ক্ষতি।

সন্‌জীদা খাতুনের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে ছায়ানট, উদীচী, চারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন।

সন্‌জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল। তাঁর বাবা কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক। মা সাজেদা খাতুন গৃহিণী। সন্‌জীদা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৪ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক, ১৯৫৫ সালে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৭৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু। দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই এতে জড়িয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতায় সংগঠিত করেন বাংলাদেশের শিল্পীদের। শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে সন্‌জীদা খাতুন ব্রতচারী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।

সন্‌জীদা খাতুনের প্রথম গানের গুরু ছিলেন সোহরাব হোসেন। তাঁর কাছে তিনি দীক্ষা নেন নজরুলসংগীত, আধুনিক বাংলা গান ও পল্লিগীতির। প্রথমে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছেন প্রখ্যাত হুসনে বানু খানমের কাছে। এরপর তালিম নেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার, আবদুল আহাদ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেনদের মতো বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীদের কাছ থেকে।

আইয়ুব খানের কঠোর শাসনকালে নানা বাধা অগ্রাহ্য করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনে তিনি ও সংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের ঐতিহ্যবাহী সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানটের যাত্রা শুরু। ১৯৬৭ সালে তাঁরা রমনার বটমূলে প্রথমবারের মতো বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখে আয়োজন করে প্রভাতি গানের আসর। ছায়ানটের এই অনুষ্ঠান থেকেই প্রাণিত হয়ে নববর্ষ উদ্‌যাপন এখন দেশজুড়ে বিপুল এক অসাম্প্রদায়িক উৎসব। ধর্মীয় উগ্রবাদীরা ছায়ানটের এই প্রভাতি গানের আসরে ২০০১ সালে ভয়াবহ বোমা হামলা চালালেও অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি।

এসব সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের বাইরে সন্‌জীদা খাতুনের গবেষণা ও রচনার কাজও কম নয়। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টির অধিক। রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ, কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, স্বাধীনতার অভিযাত্রা, সাহিত্য কথা সংস্কৃতি কথা, নজরুল মানস ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

সন্‌জীদা খাতুন দেশে একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। এ ছাড়া সম্মানিত হয়েছেন ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পদক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের দেশিকোত্তম পুরস্কার এবং কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রবীন্দ্র–তত্ত্বাচার্য উপাধিতে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ