বিদেশিদের তাড়ানোর নীতি মন্দা যুক্তরাষ্ট্রে বাড়াবে
Published: 24th, March 2025 GMT
ডোনাল্ড ট্রাম্প চলতি বছরের জানুয়ারিতে তাঁর অভিষেক ভাষণে অভিবাসনকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে তুলে ধরেন। তিনি ঘোষণা দেন, ‘আমি আমাদের দেশের ওপর এই ভয়াবহ আগ্রাসন প্রতিহত করতে দক্ষিণ সীমান্তে সেনা মোতায়েন করব।’ এরপর তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে সীমান্ত বন্ধ করার জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে নির্দেশ দেন। সে নির্দেশে অবৈধ গণ-অভিবাসন, মাদক পাচার, মানব পাচার এবং অন্যান্য অনুপ্রবেশ ঠেকানোর ওপর জোর দেওয়া হয়।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২১টির বেশি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসনব্যবস্থার বিভিন্ন দিক পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন। এর মধ্যে অভিবাসীদের প্রসেসিং ও বহিষ্কারের নিয়মকানুন কঠোর করা অন্যতম। তবে ট্রাম্পের সবচেয়ে চরম আদেশ, জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের নির্দেশ—ইতিমধ্যে একজন ফেডারেল বিচারক স্থগিত করেছেন; কারণ, এটি স্পষ্টতই অসাংবিধানিক। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীতে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, যদি কেউ যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ বা নাগরিকত্ব লাভ করেন এবং এখানকার আইনের অধীন থাকেন, তাহলে তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও তার অঙ্গরাজ্যের নাগরিক।
ট্রাম্প অভিবাসনবিরোধী যতই কঠোর ভাষা ব্যবহার করুন না কেন, বাস্তবে অবৈধ অভিবাসীদের আটক ও বহিষ্কারের সংখ্যা তার প্রতিশ্রুতির চেয়ে অনেক কম। এর আগে বাইডেন প্রশাসন গড়ে প্রতি মাসে যে সংখ্যক অভিবাসী বহিষ্কার করেছে, তা ট্রাম্পের প্রশাসনের চেয়ে অনেক বেশি। ট্রাম্প খুব ব্যয়বহুল সামরিক বিমান ব্যবহার করে অভিবাসীদের তাঁদের দেশে ফেরত পাঠাচ্ছেন এবং ভয় দেখানোর কৌশল হিসেবে অভিবাসীদের গুয়ানতানামো বে বন্দিশিবিরে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে আমেরিকানদের জানা উচিত, অভিবাসীরা সাম্প্রতিক দুই বছরে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সাফল্যের প্রধান কারণ। অভিবাসীরা দেশীয় শ্রমিকদের চাকরি কেড়ে নেননি, বরং মোট শ্রমশক্তি বাড়িয়ে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করেছেন।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে অভিবাসীদের অবদান, এমনকি অবৈধ অভিবাসীদেরও অবদান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ক্যালিফোর্নিয়ার জনসংখ্যার ২৭ শতাংশই অভিবাসী, যা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গড় ১৪ শতাংশের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি।
ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতিশ্রুত বৃহৎ আকারের অভিবাসী বহিষ্কারের অর্থনৈতিক প্রভাব ব্যাপক হতে পারে। আমেরিকান ইমিগ্রেশন কাউন্সিলের হিসাব অনুযায়ী, এটি যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক জিডিপির ৪ দশমিক ২ থেকে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে। এর আর্থিক ক্ষতি ১ দশমিক ১ থেকে ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের মধ্যে হতে পারে। তুলনামূলকভাবে ২০০৭-০৯ সালের মন্দার সময় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ৪ দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হয়েছিল। অর্থাৎ ট্রাম্পের পরিকল্পিত অভিবাসন নীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে সেই সময়ের মন্দার চেয়েও বড় ধাক্কা দিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্যাপকভাবে অভিবাসী বহিষ্কারের ফলে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে, তার প্রায় অর্ধেকই বহন করবে ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস ও ফ্লোরিডা। টেক্সাস ও ফ্লোরিডা রিপাবলিকান-সমর্থিত রাজ্য। প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্পের এই নীতি যদি বাস্তবায়িত হয় এবং এর ফলে তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়তে থাকে, তাহলে তারা কি ট্রাম্প ও তার নীতিকে সমর্থন করা চালিয়ে যাবে?
ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসন নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। এক পক্ষ সব ধরনের অভিবাসনের বিরোধী, অন্য পক্ষ কিছু অভিবাসন সমর্থন করে। যেমন ইলন মাস্ক এইচ-ওয়ানবি ভিসা কর্মসূচিকে সমর্থন করেন। এর মাধ্যমে ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে হাজারো দক্ষ প্রকৌশলী ও পেশাদার কর্মী যুক্তরাষ্ট্রে কাজের সুযোগ পান। তবে এই নীতি ট্রাম্পের আমেরিকা ফার্স্ট মতাদর্শের সমর্থক স্টিভ ব্যাননের মতো কট্টর অভিবাসনবিরোধীদের তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়েছে। যদিও অভিবাসন নীতি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের দায়িত্ব, তবু কিছু অঙ্গরাজ্য ও শহর ট্রাম্পের বহিষ্কার নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। উদাহরণ হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়া ২০১৭ সালে ক্যালিফোর্নিয়া ভ্যালুজ অ্যাক্ট পাস করে, যা কিনা রাজ্যের সম্পদ ও স্থানীয় সংস্থাগুলোকে ফেডারেল অভিবাসন আইন বাস্তবায়নে সহায়তা করা থেকে বিরত রাখে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসনব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কারের প্রয়োজন অনেক আগে থেকেই। কংগ্রেস সর্বশেষ ৩৮ বছর আগে বেশির ভাগ অনথিভুক্ত অভিবাসীদের জন্য স্থায়ী আইনি অবস্থার পথ তৈরি করেছিল। অথচ বর্তমানে অধিকাংশ অনথিভুক্ত অভিবাসী কমপক্ষে এক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন, পরিবার গড়েছেন এবং জীবন গড়ে তুলেছেন। তাঁরা উচ্চবিদ্যালয় থেকে স্নাতক হচ্ছেন, কলেজে ভর্তি হচ্ছেন, কিন্তু তাঁদের অভিবাসনের অনিশ্চয়তার কারণে পুরোপুরি দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারছেন না।
অন্যদিকে কানাডার অভিবাসন নীতিকে অনেকে মডেল হিসেবে দেখতে চান। কানাডায় মোট জনসংখ্যার প্রায় এক–চতুর্থাংশই অভিবাসী এবং দেশটি চারটি মূল পথের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে নতুন স্থায়ী বাসিন্দাদের গ্রহণ করে। ২০২২ সালে ৫৮ শতাংশ অভিবাসী অর্থনৈতিক ভিত্তিতে, ২২ শতাংশ পারিবারিক পুনর্মিলনের মাধ্যমে, ১৭ শতাংশ শরণার্থী ও সুরক্ষিত ব্যক্তির মর্যাদায় এবং ২ শতাংশ মানবিক বা অন্যান্য কারণে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পেয়েছে। কানাডার প্রাদেশিক মনোনয়ন কর্মসূচি ২০২২ সালে দেশটির অর্থনৈতিক অভিবাসনের প্রায় ৩৫ শতাংশ নিশ্চিত করেছে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট প্রদেশে আবেদন করেন এবং সংশ্লিষ্ট প্রদেশ তাঁদের অর্থনৈতিক চাহিদার ভিত্তিতে অভিবাসীদের বাছাই করে।
ট্রাম্পের ব্যাপক অভিবাসী বহিষ্কারের পরিকল্পনা নৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভুল। রাজ্য ও শহরগুলো স্বল্প মেয়াদে এই নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, তবে এটি যথেষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্রের এখনই একটি আধুনিক অভিবাসন নীতি দরকার, যা দেশের অর্থনৈতিক চাহিদার সঙ্গে মানানসই হবে এবং বাস্তব পরিস্থিতির প্রতিফলন ঘটাবে।
আমাদের এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, যা একদিকে সীমান্ত সুরক্ষিত রাখবে, অন্যদিকে নির্দিষ্ট বার্ষিক লক্ষ্য অনুসারে অভিবাসীদের বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে আসার সুযোগ দেবে। একসময় এটি দ্বিদলীয় লক্ষ্য ছিল, এখন এটি আবার হওয়া উচিত।
● লরা টাইসন ক্লিনটন প্রশাসনের সময় প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের সাবেক চেয়ার
● লেনি মেনডোনসা ম্যাকিনজি অ্যান্ড কোম্পানির সিনিয়র পার্টনার ইমেরিটাস এবং ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউজমের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক উপদেষ্টা
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
শ্যালো মেশিনে তৈরি মজাদার ‘ঝুড়ি’
২ / ৯ঝুড়ির জন্য চাল নিয়ে অপেক্ষায় এক শিশু