‘বিয়ের চাপ দেওয়ায়’ নারীকে খুন, সহকর্মী গ্রেপ্তার
Published: 24th, March 2025 GMT
দুজনই একই পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। গড়ে উঠে সম্পর্ক। নিবন্ধন ছাড়া স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে দুজনে বসবাস করতে থাকেন এক মাস ধরে। বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও বিয়ের নিবন্ধন করতে রাজি হচ্ছিলেন না স্বামী পরিচয়ে বসবাস করা যুবক। তাই মামলা ও লোকজনকে বলে দেওয়ার হুমকি দেন তাঁর সঙ্গে বসবাসকারী নারী। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে গলাটিপে খুন করা হয় ওই নারীকে।
চট্টগ্রামে জোসনা আক্তার (৩০) নামের এক নারীকে হত্যার ঘটনায় তাঁর এক সহকর্মীকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পক্ষ থেকে জানানো হয় এ তথ্য। গতকাল রোববার নগরের চান্দগাঁওয়ের মোহরা এলাকা থেকে নয়ন বড়ুয়া (২৯) নামের ওই যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এর আগে গত শনিবার বিকেলে নগরের লালখান উড়ালসড়কের নিচে বস্তাবন্দী কম্বল মোড়ানো অবস্থায় অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে জোসনার লাশ উদ্ধার হয়। পরে ওই দিনই লাশটি আঙুলের ছাপ যাচাইয়ের মাধ্যমে জোসনা আক্তারের বলে শনাক্ত করে পিবিআই। এরপর নিহত জোসনার বড় বোন তৈয়বা বেগম বাদী হয়ে খুলশী থানায় মামলা করেন। সূত্রবিহীন এই মামলার ছায়া তদন্ত শুরু করে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো।
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা বলেন, বিয়ের জন্য চাপ দেওয়ায় খুনের ঘটনাটি ঘটেছে। এই ঘটনায় নিহত নারীর সহকর্মী নয়ন বড়ুয়া জড়িত। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নিহত নারীর হাতের আঙুলের ছাপ নিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকা তথ্যভান্ডারের মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত করা হয়। সেখানে একটি মুঠোফোন নম্বরও পাওয়া যায়। সেই নম্বরের কলের তালিকা দেখে নয়ন বড়ুয়াকে শনাক্ত করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি খুন করার কথা স্বীকার করেছেন।
সামনে একটি বস্তা রাখা। রিকশায় করে যাচ্ছেন নয়ন বড়ুয়া.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ব আই
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র থেকে
রমনা পার্কের বধ্যভূমি
দৈনিক বাংলা
৮ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২
ক্ষয়ে যাওয়া পোষাক দেখে কি
তাদের সনাক্ত করা যাবে?
। হাসিনা আশরাফ।
রমনা পার্কের উত্তর পূর্ব কোণটা কি পাক সামরিক চক্রের কোন বধ্যভূমি সমাধিস্থল? রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত রমনা পার্কের উত্তর কোণটার যেদিকে ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট হাউসের সীমানা শুরু হয়েছে, তার থেকে কিছুটা ভেতরের দিকেই এটি অবস্থিত। পুরো জায়গাটাই প্রায় জুড়ে রয়েছে বেগুনী বর্ণের বোগেন ভিলা বা বাগান বিলাসের রঙিন কুঞ্জ।
এই ঝোপটির নীচে বড় বড় কয়েকটি গর্তে এবং পাশের উঁচু স্থানে ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে নরকংকালের অস্থি এবং মাথার খুলি। মাটির সাথে সমান হয়ে ছড়িয়ে আছে, হঠাৎ দেখলে বোঝা যায় না। জায়গাটা যে সত্যিকার কতখানি বিস্তৃত বার থেকে তা আজ বোঝার উপায় নেই। তবে এখানকার অনেকেই জানিয়েছে যে, পশুরা অসংখ্য মানুষকে ট্রাকে করে প্রেসিডেন্ট হাউসের মধ্যে নিয়ে হত্যা করার পর গর্তের মধ্যে পুঁতে রাখতো।
বৃষ্টির পানিতে গর্তগুলো যখন ভরে যায় তখন পানির সাথে সাথে কতকগুলো আধপচা লাশ এবং সঙ্গে অসংখ্য স্কুল, কলেজের বই ভেসে উঠতো। এসব লাশের মধ্যে কয়েকটি লাশের লম্বা চুল এবং দেহের গঠন দেখে মহিলা বলে চেনা গিয়েছিল। রমনা পার্কের নিভৃত এই প্রান্তে কোন হতভাগা ভাইবোনদের সমাধিস্থল যে রচিত হয়েছিল কংকালের অস্তি আর ভগ্ন খুলির মাঝে, আজ তা জানা যাবে না।
তবে প্রশ্ন জাগে মনে, এরা কি সেই হতভাগা পুলিশ ভাইদের কেউ, যারা অসহযোগ আন্দোলনের সময় দস্যু ইয়াহিয়াকে পাহারা দেবার জন্য প্রেসিডেন্ট হাউসে নিযুক্ত হয়েছিল? প্রশ্ন জাগে মনে, এরা কি সেই ছাত্র ভাইদের কেউ, যারা শুধু দেশপ্রেমের শপথ নিয়ে জীবন্ত আত্মার তাগিদে শূন্য হাতে রুখে দাঁড়িয়েছিল জল্লাদ পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে?
রংপুর জেলাটাই যেন বধ্যভূমি
তারিখ
দৈনিক বাংলা
১৯ জানুয়ারী, ১৯৭২
রংপুর জেলাটাই যেন বধ্যভূমি: শিক্ষক শ্রমিক ছাত্র কিষান-কিষানির অতলান্ত
সেই রক্তস্রোত
‘আবার গোলযোগ হলে আমাদের পালানোর জায়গা আছে। ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেবো, বেঁচে যাবো। ভাই, আপনারা যাবেন কোথায়? আপনাদের যে আর কোন পথ রইলো না।’ প্রিয় মুসলিম সহকর্মীদের জন্য অকৃত্রিম সমবেদনায় সহকারী অধ্যাপক রেজাউল হককে এই কথাগুলো বলেছিলেন বরিশাল জেলার অধিবাসী অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী। ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে। আইয়ুবের যোগ্যতর উত্তরসূরি রক্তপিপাসু নয়া সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন জারীকে কেন্দ্র করেই তাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল।
কিন্তু না। অধ্যাপক অধিকারী পালাতে পারেননি। বাঁচাতেও পারেননি তার প্রাণ। তার এই তাৎপর্যবহ মন্তব্যের সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সৌভাগ্যক্রমে অধ্যাপক রেজাউল হক আজও বেঁচে আছেন। ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীর আক্রমণ শুরুর পর অধ্যাপক অধিকারী পালিয়েছিলেন। গাইবান্ধা মহকুমার সুন্দরগঞ্জে গিয়েছিলেন। যাওয়ার সময় অপর সহকর্মী অধ্যাপক আবুল কাশেমকে বলেছেন, টাকা-পয়সা নেওয়ার জন্য কেউ যদি মেরে ফেলে তাদের হাতে মরতেও রাজী আছি। কিন্তু বর্বর খানসেনাদের হাতে নয়। বেতন নেয়ার জন্য রংপুরে এসেছিলেন। কিন্তু বেতন নিয়ে আর ফিরে যেতে পারেননি।
১৯৭১ সালের ৩০শে এপ্রিল। রপুর কারমাইকেল কলেজের ২ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে দমদমার পুলের নীচে তার অপর তিন সহকর্মী রসায়নের লেকচারার কুমিল্লার শ্রী কালিচাঁদ রায় ও তার পিতা, দর্শনের লেকচারার বরিশালের শ্রী শুনেল বরণ চক্রবর্তী ও গণিতের লেকচারার বরিশালের শ্রী চিত্তরঞ্জন রায়ের সাথে খুনি পাক সেনাদের গুলিতে প্রাণ হারান।
বাড়ী গিয়েও রেহাই নেই
রংপুর কারমাইকেল কলেজের উর্দু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শাহ মোহাম্মদ সোলায়মান দিনাজপুরে তার গ্রামের বাড়ীতে গিয়েছিলেন। গ্রামের বাড়ী থেকেই সেনাবাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাঁর আর কোন খোঁজখবর পাওয়া যায়নি।
তিনি কাজে যোগ দিতে পারেননি
রসায়নের লেকচারার কুড়িগ্রাম মহকুমার নাগেশ্বরীর অধিবাসী জনাব আব্দুর রহমান মে মাসের শেষদিকে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু তার কাজে যোগ দেওয়া আর হয়নি। তখন হয়ত এ দু’জন অধ্যাপককে হত্যা করেছে। খান সেনাদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হয়েছেন রংপুর শহরের বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক নেতা জনাব ইয়াকুব মাহফুজ আলী।
মৃতের মিছিলে জীবন্ত
-দৈনিক পূর্বদেশ, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২
মৃতের মিছিলে জীবন্ত সুরেস। আত্মরক্ষার জন্য আশ্রয় নিতে গিয়েও সবাই মৃত্যুর কোলে আত্মসমর্পণ করলেন; মৃত্যুকে ফাঁকি দিতে পারলেন না। কিন্তু শুধু বেঁচে রয়েছেন তিনি। বেঁচে রয়েছেন তিনি এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের জীবন্ত সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে। পরিমল বললেন, সুরেসের কাঁধের মাংস উড়ে গেছে মেশিনগানের শক্তিশালী গুলিতে। অবিরাম ধারায় ঝরছিল; ক্ষতস্থানে গায়ের জোরে চেপে ধরেও তিনি রক্ত বন্ধ করতে পারছিলেন না। নিজের শরীরের উষ্ণ রক্তে তিনি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন।
নিজের গায়ের টকটকে তাজা রক্ত অবিরাম ধারায় ঝরছে তো ঝরছেই। কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না তার রক্তপাত, রক্তের বেগ কমছে না। ব্যাণ্ডেজ করা দরকার কিন্তু ব্যাণ্ডেজ করবেন কী দিয়ে? পরনের লুংগি আর গায়ের গেঞ্জি ছাড়া তো আর কিছুই নেই। লুংগি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে লুংগির ছেঁড়া টুকরো দিয়েই তিনি তৈরী করলেন ব্যান্ডেজ। ছাদের উপর সারিবদ্ধ তরুণদের মৃতদেহ। প্রহরীর মত তিনি জেগে আছেন একা। রক্তের স্রোত। হলের ছাদ লাল রক্তে ভেসে গেছে। চারিদিক নীরব নিঝুম। শুধু গোলাগুলির শব্দ ও মানুষের আর্তকান্না ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। পরিমল বলেই চলেছেনঃ মৃত্যুর পাশে বসে থাকার উপর তার ধিককার আসছিলো, আবার কখনো তার চোখের সামনে ভেসে উঠত ভীড় জমানো ফেলে আসা স্বপ্ন রঙ্গিন মধুময় হাজারো দিনের স্মৃতি। আছড়ে আছড়ে কেঁদে সেসব স্মৃতি ফরিয়াদ জানাত। স্মৃতির মিছিলে সুরেস হারিয়ে ফেলতেন। হলের ছাদের উপর পানির ট্যাঙ্ক। হঠাৎ তার চেতনার উদয় হল। সুরেস আর দেরী না করে পানির ট্যাঙ্কে ঢুকলেন। ২৬শে মার্চ পুরোদিন ও সারারাত তিনি পানির ট্যাঙ্কেই কাটালেন আত্মগোপন করে। ২৭ তারিখ পানির ট্যাঙ্কে তার থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। ২৭ তারিখে ভোরের দিকে হাতে প্রাণ নিয়ে তিনি ভয়ে ভয়ে নামলেন ছাদ থেকে।
এগিয়ে গেলেন জগন্নাথ হলের উত্তর পার্শ্বের রাস্তার দিকে। সুরেস ভয়ে সোজা হননি। হামাগুড়ি দিয়ে এগুচ্ছিলেন। পরিমল গুহ তখন কারফিউ তুলে নেবার পর ষ্টাফ কোয়ার্টার থেকে এদিকের রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। সুরেসকে পরিমলের দেখা হওয়ায় সুরেস প্রাণ ফিরে পেলেন। পরিমল গুহ পরে সুরেসকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দিয়ে আসেন। পরিমল ছাদের নারকীয় হত্যালীলার কাহিনী সুরেসের কাছ থেকে শুনেছেন। [বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র অষ্টম খণ্ড থেকে]