পশ্চিম তীরের ১৩টি ইহুদি বসতি এলাকার স্বাধীনতা অনুমোদন করল ইসরায়েল
Published: 24th, March 2025 GMT
ইসরায়েলের নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রিপরিষদ অধিকৃত পশ্চিম তীরে ১৩টি ইহুদি বসতি এলাকাকে আশপাশের এলাকাগুলো থেকে আলাদা ঘোষণা করার একটি পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। গতকাল রোববার ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ এ কথা বলেছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে স্মোট্রিচ এ পদক্ষেপ সম্পর্কে লিখেছেন, বসতি এলাকাগুলো শেষ পর্যন্ত স্বাধীন হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। পশ্চিম তীরজুড়ে কয়েক হাজার আবাসনের অনুমোদনের পর এমন পদক্ষেপ নেওয়া হলো।
স্মোট্রিচ এক্স পোস্টে লিখেছেন, ‘আমরা বসতিগুলোতে স্বাভাবিক অবস্থা ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার বিপ্লব চালিয়ে যাচ্ছি। লুকিয়ে না থেকে এবং ক্ষমা না চেয়ে আমরা পতাকা ওড়াই, নির্মাণ করি এবং বসতি স্থাপন করি। জুডিয়া ও সামারিয়ায় প্রকৃত সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।’ জুডিয়া ও সামারিয়া বলতে গোটা পশ্চিম তীরকে বুঝিয়ে থাকে ইসরায়েল।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলে হামলা হয়েছিল। সে হামলার পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কায় পশ্চিম তীরের নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তরের বিরোধিতা আরও জোরালো করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা পশ্চিম তীরে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে এবং সন্দেহভাজনদের নিশানা করছে।
আন্তর্জাতিক বৈধতা ও সিদ্ধান্তকে তোয়াক্কা না করে বসতিগুলোকে আলাদা করা এবং সেগুলোকে স্বাধীন বসতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সমালোচনা করেছে ফিলিস্তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। তারা এটাকে ফিলিস্তিনি ভূমিতে ঔপনিবেশিক দখলদারি সুসংহত করার একটি মরিয়া প্রচেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করেছে।
১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধে পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমের দখল নেয় ইসরায়েল। এ এলাকাগুলোতে ২৭ লাখ ফিলিস্তিনির পাশাপাশি প্রায় ৭ লাখ ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীর বসবাস।
বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ যুদ্ধে দখলকৃত ভূখণ্ডে ইসরায়েলের বসতি স্থাপনকে অবৈধ বলে মনে করে। তবে বাইবেল ও ইতিহাসের বরাত দিয়ে ইসরায়েল এ মতের বিরোধিতা করে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ইসরায়েলের বসতি স্থাপনের পক্ষের রাজনীতিবিদেরা উৎসাহিত হয়েছেন।
কট্টর ডানপন্থী দল রিলিজিয়াস জায়নিজমের প্রধান স্মোট্রিচ দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন সরকারি জোটের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। স্মোট্রিচ বছরের পর বছর ধরে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছেন।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহি ও দায়িত্ব
ধনী–দরিদ্রনির্বিশেষে ভারতের বহু লোকই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে অধিকতর জবাবদিহি চেয়ে থাকেন। যে বিধবা তাঁর পেনশনের দরখাস্তটার কী হলো, সে সম্পর্কে কোনো খবর পান না; যে পরিচ্ছন্নতাকর্মী মাসের পর মাস তাঁর মজুরি পাননি, যে অসহায় মানুষটি ন্যায্য মাশুলের অঙ্ক বহুগুণ বাড়িয়ে পাঠানো বিদ্যুতের বিলের চোটে জেরবার, যে ট্রাকচালক দুর্নীতিগ্রস্ত ট্যাক্স অফিসারের তোলাবাজির শিকার—এঁদের সবার একটাই চাওয়া, সরকারি কর্মচারী ও প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের কর্তব্য পালনের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে যেন বাধ্য থাকে।
এ বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে, কিছু কাজও হয়েছে। সরকারি কর্তৃপক্ষের জবাবদিহির ব্যাপারে ২০০৫ সালে পাস হওয়া তথ্য অধিকার আইনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। সরকারি জবাবদিহির ব্যাপারটিকে আদালতে আইনগতভাবে বলবৎ করে সরকারি কাজে স্বচ্ছতার মানগত প্রসঙ্গে একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছে এই আইন। কিছু কিছু রাজ্য তো অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য উন্নততর ব্যবস্থাও করেছে, এমনকি নতুন আইনও এনেছে।
গত ১০ বছরে ঘড়ির কাঁটাকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারতে এখন যারা ক্ষমতায় আসীন, তারা নাগরিকদের কাছে সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার বদলে সরকারের কাছে নাগরিকদের জবাবদিহি আদায় করতেই বেশি তৎপর। অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানকেই সরকারের আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত করা হয়েছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে জবাবদিহি বাড়িয়ে তোলার জন্য নেওয়া বিভিন্ন নতুন উদ্যোগে নিশ্চয়ই কিছুটা কাজ হতে পারে। কিন্তু জবাবদিহির যোগ হলো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের সঙ্গে। এগুলোর কাজ থেকে সর্বসাধারণের যেসব সুফল হওয়ার কথা, তা যে তাঁরা সত্যিই পাচ্ছেন, তা নিশ্চিত করার সঙ্গে। তাই জবাবদিহির নিজস্ব সীমাবদ্ধতা থেকেই যায়।
কার্যত জবাবদিহির ব্যাপারটা কাজ করে পুরস্কার ও শাস্তির বন্দোবস্তের মাধ্যমে সরকারি কর্মচারীদের কিছু পূর্বনির্দিষ্ট কাজ ঠিকমতো করানোর মধ্য দিয়ে। অথচ সরকারি কর্মচারীদের অনেক কাজকর্মই একেবারে নিচের স্তর পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। যদি তা সম্ভব হয়ও, তাহলেও লোকেদের কাজ করতে দেওয়া এবং সেগুলো যাতে ঠিকমতো করা হয়ে ওঠে, তা তদারকি করার পূর্বনির্ধারিত কোনো ব্যবস্থা খুব একটা ফলপ্রসূ হয় না। তা ছাড়া ‘পুরস্কার ও শাস্তি’র ব্যাপারটা একটা সীমিত পরিসরে কাজ করে, এর মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর নিজস্ব উদ্যোগ ও সৃষ্টিশীলতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ থাকে না।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো স্কুলশিক্ষকের হাজিরার ওপর নজরদারি হয়তো সম্ভব। কিন্তু তিনি স্কুলে হাজির থাকলেও যে যথেষ্ট নিষ্ঠা ও উদ্যমের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন, সেটা নিশ্চিত করা যাবে কীভাবে? কেউ কেউ এটার একটা মোটাদাগের উত্তর দিয়েছেন—শিক্ষার্থীরা কতটা কী শিখছে, এর ভিত্তিতে শিক্ষকদের মাইনে দেওয়া হোক, কিন্তু স্কুল তো কেবল কোচিং সেন্টার নয়। শিক্ষার মান লেখাপড়া ছাড়াও অনেক কিছুর সঙ্গে যুক্ত, যেমন শিক্ষার্থীদের জীবনকুশলতা, সক্ষমতা, আচরণ, মূল্যবোধ ও সর্বাঙ্গীন বিকাশ।
জবাবদিহি–সংক্রান্ত কিছু ব্যবস্থা হয়তো উৎকৃষ্ট মানের শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু এদের সব কটিরই সীমাবদ্ধতা আছে। একটা কথা তো ঠিক, শিক্ষক ঠিক কী করছেন, সেটাই বাইরের কোনো লোকের পক্ষে এসে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। শিক্ষকের কাজের কী ফল পাওয়া যেতে পারে, সেই বিচার তো অনেক দূরের ব্যাপার।
আমাদের এটা মানতেই হবে যে দায়িত্ব পালন করা অনেক প্রশস্ত ব্যাপার, জবাবদিহি হলো তার একটামাত্র দিক। এটা ঠিক যে অন্যের কাছে জবাবদিহি করতে হবে বলে কোনো শিক্ষক নিজের কাজে দায়িত্বশীল হতে পারেন। কিন্তু বাচ্চাদের সক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করার তাগিদে, একজন ভালো শিক্ষক হিসেবে নিজের অন্তর থেকে উঠে আসা প্রেরণার কারণেও তিনি দায়িত্বের সঙ্গে কাজ করতে পারেন।
জবাবদিহি ও দায়িত্বশীলতার মধ্যে পার্থক্য করাটা অন্তত দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সামাজিক প্রগতিতে দায়িত্ববোধ একটা বিরাট শক্তি হিসেবে কাজ করে। জবাবদিহি লোকদের দিয়ে সেই কাজ করিয়ে নিতে পারে, যেটা অন্যরা তাঁদের দিয়ে করাতে চাইছেন এবং এটা ততখানিই করিয়ে নেওয়া যায়, যতটা নজরদারির মধ্য দিয়ে করানো সম্ভব।অন্য একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। গাজাতে যে অগণন ডাক্তার, সাংবাদিক ও ত্রাণকর্মী আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা করা, বিভিন্ন ঘটনা খবরে তুলে আনা এবং ক্ষুধার্তদের খাবার জোগানোর কাজে লেগে আছেন, তাঁরা তো জবাবদিহির দায়ে এসব কাজ করছেন না! অনবরত মুড়িমুড়কির মতো বোমাবাজি চলছে, কখনো কখনো তাঁদের ওপরও বোমা পড়ছে। এরই মধ্যে তাঁরা যে কাজ করে চলেছেন, সেটা তাঁরা করছেন গাজার মানুষের প্রতি তাঁদের দায়িত্বশীলতা অথবা নিজস্ব পেশাগত নৈতিকতা থেকে।
জবাবদিহি ও দায়িত্বশীলতার মধ্যে পার্থক্য করাটা অন্তত দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সামাজিক প্রগতিতে দায়িত্ববোধ একটা বিরাট শক্তি হিসেবে কাজ করে। জবাবদিহি লোকদের দিয়ে সেই কাজ করিয়ে নিতে পারে, যেটা অন্যরা তাঁদের দিয়ে করাতে চাইছেন এবং এটা ততখানিই করিয়ে নেওয়া যায়, যতটা নজরদারির মধ্য দিয়ে করানো সম্ভব।
অন্যদিকে দায়িত্ববোধ হলো সেটাই, যা লোকেরা জনস্বার্থের কথা ভেবে নিজেদের ভেতর থেকে আসা তাগিদে করতে চান। এই আন্তরিক তাগিদ, উদ্যোগ ও সৃষ্টিশীলতাকে বিপুল রসদ জোগায়, যেটা জবাবদিহির আওতায় পড়ে না। বস্তুত গোটা বিশ্বে যেসব প্রতিষ্ঠান ভালোভাবে সচল, সেগুলোর পেছনে একটা প্রধান ভূমিকা পালন করেছে দায়িত্বশীলতার সংস্কৃতি। এটা শুধু স্কুলের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়; হাসপাতাল, গ্রন্থাগার, সংগ্রহশালা, আদালত থেকে শুরু করে সংসদ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারেই তা দেখা যায়।
দ্বিতীয়ত, জবাবদিহি ও দায়িত্ব পালনের জন্য কী উপায় নেওয়া হচ্ছে, এর ভিত্তিতেও এই দুটির মধ্যে প্রভেদ দেখা দেয়। যেমন যেখানে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে সবাই ঠিক সময়ে দপ্তরে হাজিরা দেবে, সেখানে কারও পক্ষে সময়ানুবর্তিতার অভ্যাস গড়ে তোলাটা সহজ হয়ে ওঠে। এখানে জবাবদিহি ও দায়িত্ববোধ একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু এ দুটি আবার একেবারে বিপরীত দিশায় কাজ করতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে, কাজের জায়গার পরিবেশটা যদি পদানুসারী হয়, সেখানে জবাবদিহি কাজ করতেই পারে। কিন্তু নিচু পদে কাজ করা লোকেরা তাগিদ হারিয়ে ফেলতে পারেন। ফলে দায়িত্বশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। তেমনি কেন্দ্রীকরণ থেকে জবাবদিহি বাড়তে পারে, কিন্তু দায়িত্বশীলতা বাড়ে বিকেন্দ্রীকরণের মধ্য দিয়ে। দুটির মধ্যে পরিপূরকতা থাকলেও, এ দুটির পরিসর কিন্তু একেবারে আলাদা।
সংবিধান রচনার জন্য গঠিত গণপরিষদে জয়পাল সিংহ মুন্ডা ছিলেন আদিবাসীদের অগ্রণী মুখপাত্র। পরে তিনি স্বাধীন ভারতের ক্রীড়ামন্ত্রীও হন। তিনি জবাবদিহি–সংক্রান্ত কোনো পদক্ষেপ না করেও দায়িত্ব–সম্পর্কিত মূল্যবোধ বাড়িয়ে তোলার একটা চমৎকার উদাহরণ তুলে ধরেছিলেন। ক্রীড়ামন্ত্রী থাকাকালে তিনি সংসদের শাসক ও বিরোধী—দুই পক্ষের সদস্যদের নিয়ে একটা ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করেন। এর মধ্য দিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়।
জয়পাল সিংহের নিজের কথায়, ‘এই ম্যাচ, ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে একসঙ্গে বসে মধ্যাহ্নভোজ এবং নৈশাহার—এগুলো থেকে প্রাপ্তির দিকটা বেশ বড়। এটা সব দলকে একত্র করে এবং সংসদের দুই কক্ষেই বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ গড়ে তোলে।’ সংসদে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ’ গড়ে তোলাটা কেবল সংসদকে মনোরম করে তোলার ব্যাপার ছিল না। সংসদের কাজকর্ম ভালোভাবে চলার জন্য এটা জরুরি ছিল। দুর্ভাগ্যের কথা, আজ সেই পরিবেশের কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই।
ওপরের কাহিনিটি থেকে আমরা বুঝতে পারি, দায়িত্বের মধ্যে প্রায়ই একটা সহযোগিতার দিক থাকে। নীতিনিষ্ঠ কোনো লোক অবশ্যই সব সময় দায়িত্ববানের মতোই কাজ করে যাবেন, তা অন্যরা যা-ই করুন না কেন। যেমন অন্যেরা ট্র্যাফিক সিগন্যাল না মেনে রাস্তা পার হলেও তিনি কিন্তু সিগন্যাল সবুজ হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকবেন। কিন্তু বেশির ভাগ লোকের পক্ষেই দায়িত্বশীল আচরণ করাটা তখন সহজ হয়, যখন দেখেন অন্যরাও সেটা করছেন।
এই মৌলিক পর্যবেক্ষণের একাধিক সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য আছে। তার একটা হচ্ছে এই যে দায়িত্ববোধহীনতা প্রায়ই আমাদের এমন একটা ‘সামাজিক ফাঁদ’-এর মধ্যে ফেলে দেয়, যেখানে লোকেরা একটা দায়িত্বশীল পরিবেশের মধ্যে থাকতে চেয়েও অন্যদের দায়িত্বহীনতার অনুকরণ করেন। ভারতে বহু স্কুলই এ রকম একটা ফাঁদে পড়েছে বলে মনে হয়।
মুদ্রাটির একটি অন্য পিঠ আছে—সামূহিক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে এই ফাঁদ এড়ানোর মধ্য দিয়ে আমরা অনেক কিছু পেতে পারি। এখানে একটা স্বতঃসিদ্ধ স্থায়িত্বের ব্যাপারও আছে, যেখানে বিভিন্ন লোকের দায়িত্বশীল আচরণ অন্যদের দায়িত্বশীলতা বাড়িয়ে তোলে। সামাজিক বিধি নিয়ে লেখাপত্রের মধ্যে এ রকম ‘বহুবিধ সমস্থিতি’র উদাহরণ পাওয়া যায়।
আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে নির্বাচনী গণতন্ত্রের পুরো ইমারতটাই দাঁড়িয়ে আছে একটা সাধারণ সহযোগিতামূলক দায়িত্ব পালনের ওপর। সেটা হলো ভোটদান। সব ভোটারই জানেন, তাঁর ভোট এককভাবে কোনো বদল আনতে পারবে না। তা সত্ত্বেও বহু লোকে—প্রায়ই ব্যাপক সংখ্যাগুরু অংশ—অনেক সময়ই অনেকটা পথ হেঁটে যাওয়া বা দীর্ঘক্ষণ কাতারে দাঁড়িয়ে থাকার মতো সমস্যার মধ্যেও ভোট দিয়ে থাকেন। ভোট দেওয়ার পেছনে নানা উদ্দেশ্য কাজ করতে পারে, কিন্তু অনেক লোকেই স্রেফ মনে করেন যে ভোট দেওয়াটা হচ্ছে দায়িত্বশীল নাগরিকের কর্তব্য।
একটি সুস্থ সামাজিক জীবনের জন্য দায়িত্বশীলতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে চিন্তানুশীলকেরা বহু যুগ ধরে আলোচনা করে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন বেশ কিছু অর্থশাস্ত্রীও। দ্য থিওরি অব মরাল সেন্টিমেন্টস বইতে অ্যাডাম স্মিথ জোর দিয়ে বলছেন, ‘আমরা যা যা করে থাকি, তা কেবল আমাদের নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যই করি না; অন্যরা আমাদের কাজকর্ম কোন চোখে দেখছে, সেই আত্মসমীক্ষণ থেকে উঠে আসা “আচরণের সাধারণ নিয়মাবলির” দ্বারাও আমাদের সেই কাজগুলো প্রভাবিত হয়ে থাকে।’
আলফ্রেড মার্শালকে নব্য ধ্রুপদি অর্থশাস্ত্রের জনক বলা হয়ে থাকে। তাঁর অসামান্য গ্রন্থ প্রিন্সিপলস অব ইকোনমিকস-এ তিনি ‘অ-স্বার্থপর আচরণ’-এর শক্তি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। এমনকি তিনি লিখেছেন, ‘অর্থশাস্ত্রীর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো কীভাবে লীন হয়ে থাকা এই সামাজিক সম্পদকে বিকশিত করা যায়, তা আবিষ্কার করা।’
ড. বি আর আম্বেদকরের বিবেচনায়, ‘ভ্রাতৃত্ব’ ব্যতিরেকে স্বাধিকার ও সাম্য ‘কোনো স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবে’ আসে না। ভ্রাতৃত্ব হচ্ছে দায়িত্বশীলতার এমন এক শক্তিশালী রূপ, যা ‘ব্যক্তিবিশেষকে অন্যদের শুভময়তার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেখতে’ শেখায়।
এ কথা ঠিক যে আজকের মূলধারার অর্থশাস্ত্রে, ‘হোমো একনোমিকাস’-এর মন্ত্রে, মানুষের স্বার্থসর্বস্বতার জয়গানের মধ্যে, অ-স্বার্থপর চিন্তাগুলো গুরুত্ব হারিয়েছে, কিন্তু তাদের প্রাসঙ্গিকতা লুপ্ত হয়ে যায়নি। আমাদের পূর্বজ অর্থশাস্ত্রীরা যা জেনেছিলেন, আমরাও সেটা জানতে পারি।
(২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, কলকাতা থেকে প্রকাশিত দ্য টেলিগ্রাফ দৈনিকে প্রকাশিত মূল ইংরেজির বাংলা তর্জমা করেছেন কুমার রানা)
জঁ দ্রেজ বেলজিয়ান বংশোদ্ভূত ভারতীয় সমাজকর্মী ও অর্থনীতিবিদ
অমর্ত্য সেন নোবেলজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ