মোদি–জমানায় ভারতে ইফতারের রাজনীতি আজ ডুমুরের ফুল
Published: 24th, March 2025 GMT
ভারতীয় সংসদ ভবনের অলিন্দে জোর ফিসফিসানি, সংসদ সদস্যদের প্রাতরাশে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য রাষ্ট্রপতি কি আর কোনো সময়ের সন্ধান পেলেন না! রমজান মাসকেই বেছে নিতে হলো?
প্রশ্ন আছে, উত্তর নেই। প্রশ্নটিও মোটেই প্রকাশ্যে উচ্চারিত নয়। রাষ্ট্রপতিকে (নারী এবং আদিবাসী) সরাসরি প্রশ্নের মুখে দাঁড় করানোর মতো অশোভন ও অশালীন হতে কেউ চান না। তাই নিভৃত আলোচনা। অনুচ্চে। রমজান মাসে সংসদ সদস্যদের প্রাতরাশের আমন্ত্রণ দ্রৌপদী মুর্মু না জানালেই পারতেন।
পারতেন, কেননা বাজেট অধিবেশন শুরু হয়েছে রমজান মাস শুরুর ঢের আগে।
এটা ঠিক, বছরের পর বছর ধরে কমতে কমতে প্রায় তলানিতে এসে ঠেকলেও লোকসভা ও রাজ্যসভার সম্মিলিত মুসলমান জনপ্রতিনিধির সংখ্যা এখনো ৪২। লোকসভায় শাসকদল বিজেপিতে যদিও একজনও মুসলমান নেই। ২৪ জন এমপির মধ্যে ‘ইন্ডিয়া’ জোটেরই ২১ জন। ৫৪৩ জনের মধ্যে ২৪, শতাংশের হিসাবে মাত্র ৪ দশমিক ৪। অথচ দেশের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মুসলমান! রাজ্যসভায় ২৫০ জনের মধ্যে মুসলমান মাত্র ১৮ জন। দুই কক্ষের ছবি যেন সেই ‘একে একে নিবিছে দেউটি’র মতোই টিমটিমে। ম্লান।
সে যা–ই হোক, তবু তো তাঁরা আছেন! আমন্ত্রিত তো তাঁরাও! আক্ষেপ তাঁদের হতেই পারে। ভাবতেই পারেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছেও তাঁরা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ পেলেন না!
ফিসফিসানির দ্বিতীয় অংশটা কল্পনাবিলাসী। স্বপ্নালু। আহা, বেশ হতো, রাষ্ট্রপতি যদি অদূর অতীতে ফিরে গিয়ে রমজান মাসের সন্ধ্যায় ইফতারের আয়োজন করতেন! প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ সবকা বিশ্বাস’ স্লোগান তাহলে প্রকৃতই অর্থবহ হতো।
কিন্তু সে গুড়ে বালি পড়েছে আট বছর আগে। ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে প্রণব মুখোপাধ্যায় চলে যাওয়ার পর ইফতারের আয়োজন পুরোপুরি বন্ধ। রামনাথ কোবিন্দ রাষ্ট্রপতি হয়ে জানিয়ে দেন, রাইসিনা হিলসে কোনো ধরনের ধর্মানুষ্ঠানের আয়োজনের পক্ষপাতী তিনি নন।
নরেন্দ্র মোদি দেশের ক্ষমতায় আসার পরও তিন বছর রাষ্ট্রপতি ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। রাইসিনা পাহাড়ের প্রশস্ত প্রাসাদে ফি বছর ইফতারের আয়োজনও তিনি করেছেন। মোদি যদিও একবারও আসেননি। তাঁর রাজনীতির ব্র্যান্ড অথবা বিশ্বাসের সঙ্গে আরও অনেক কিছুর মতো ইফতারও বেমানান।
বেমানান বলেই ২০১৪ সাল থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে একবারও ইফতারের আয়োজন হয়নি।
নরেন্দ্র মোদি অনেক কিছুতেই অন্যদের চেয়ে আলাদা। তিনি একমাত্র প্রধানমন্ত্রী, যিনি একবারও কোনো সংবাদ সম্মেলন করেননি। সংসদে কারও কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি। বিদেশ সফরে সফরসঙ্গী হিসেবে সাংবাদিকদের নেননি। অপছন্দের কাউকে সাক্ষাৎকার দেননি। ঈদের নামাজে অংশ নেননি। রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার দরুন বহু ধরনের টুপি পরেছেন, কিন্তু একবারের জন্যও মুসলমানি ‘স্কাল ক্যাপ’ মাথায় তোলেননি। একবার একদল অনুগত মুসলমান সেই চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদের ব্যর্থ হতে হয়েছিল।
ভারতে রাজনৈতিক স্তরে ইফতারের রীতি চালু হয়েছিল স্বাধীনতার পরপরই। প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু জাতীয় কংগ্রেসের অফিসে ইফতারের আয়োজন করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ভারতের বৈচিত্র্যই তাঁর শক্তি। ঐক্যের প্রধান উপাদান। সেই বৈচিত্র্য ভাষায়। পরিধানে। খাদ্যাভ্যাসে। আচরণে। ধর্ম বিশ্বাসে। নেহরু ইফতারের আয়োজন করেছিলেন মুসলমান মন জিততে নয়, পরধর্ম সহিষ্ণুতা ও দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে।
নেহরু বিলক্ষণ জানতেন, ভারতের ৮০ শতাংশ জনতা হিন্দু। কিন্তু কোনো দিন ভুলেও তিনি ভারতকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বলে বর্ণনা করেননি।
কংগ্রেসের এই চরিত্র বহুকাল অমলিন ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ধর্মভিত্তিক উত্তেজনার ফুলকি থেকে কখনো–সখনো দাবানলের সৃষ্টি হয়েছে। নেতাদের হস্তক্ষেপ ও আন্তরিক চেষ্টায় সেই আগুন নিভেও গেছে। ১৯৭৪ সালে উত্তর প্রদেশে তেমনই এক উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছিল ইফতারের সাহায্যে। সংঘর্ষের আবহ বদলে গিয়েছিল কোলাকুলিতে।
উত্তর প্রদেশের রাজধানী লক্ষ্ণৌতে শিয়া–সুন্নির উত্তেজনা তখন নৈমিত্তিক ব্যাপার। সে বছর ১৯৭৪ সালে, রমজান মাস শুরুর কিছুদিন আগে কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন হেমবতী নন্দন বহুগুণা। শিয়া–সুন্নি সংঘর্ষে উত্তেজনা ছড়ায় ওই রমজান মাসেই। শান্তি রক্ষার চেষ্টায় মুখ্যমন্ত্রী বহুগুণা বৈঠকের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন শিয়া নেতা আসরাফ হুসেনকে। কিন্তু আসরাফ প্রস্তাব নাকচ করলেন রমজান মাসের দোহাই দিয়ে। বললেন, রোজা চলাকালীন তিনি মুখ্যমন্ত্রীর আতিথেয়তা রক্ষা করতে অপারগ। শোনামাত্র বহুগুণা তাঁকে অনুরোধ করে বলেছিলেন, ওই দিন মুখ্যমন্ত্রী নিবাসেই তিনি রোজা ভাঙুন। ইফতারের সব রকম আয়োজন ও বন্দোবস্ত থাকবে।
আসরাফ হুসেন না করতে পারেননি। ইফতারের পর সফল আলোচনা শান্তি স্থাপন করেছিল লক্ষ্ণৌতে।
সেই থেকে প্রতিবছর রমজান মাসে লক্ষ্ণৌর মুখ্যমন্ত্রী নিবাসে ইফতারের আয়োজন একরকম পাকাপাকি বন্দোবস্ত হয়ে যায়। প্রথাটা ভাঙে ২০১৭ সালে বিধানসভা ভোটে জিতে যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসার পর।
স্বাধীনতার পর নেহরু ও সত্তরের দশকে বহুগুণা যা শুরু করেছিলেন, ক্রমেই তা গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। রাজ্যে রাজ্যে, দলে দলে ইফতারের আয়োজন হয়ে ওঠে মুসলমান মন জয়ের রাজনৈতিক হাতিয়ার। কংগ্রেসের দেখাদেখি ওই রাজনীতিতে নেমে পড়ে অন্যরাও। যা ছিল ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার প্রতীক; ধীরে ধীরে তা হয়ে ওঠে মুসলিম মন জয়ের রাজনৈতিক ছক। বিজেপি ও সংঘ পরিবার এই রাজনীতিকেই ‘ছদ্ম ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘ভোটব্যাংক পলিটিকস’ বলে জাহির করে এসেছে। যদিও কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসে অটল বিহারি বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রীর ইফতার আয়োজনের ঐতিহ্য থেকে সরে আসেননি। বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন বিহারের বিজেপি নেতা শাহনওয়াজ খান। বাজপেয়ী তাঁকেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাঁর হয়ে ফি বছর ইফতার আয়োজনের।
সংঘ অনুগামী ও দক্ষিণপন্থী হলেও বাজপেয়ী সবাইকে নিয়ে চলতে জানতেন। গণতন্ত্রের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা। ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করতেন। বিরোধী নেতা হিসেবে যে সম্মান তিনি চিরকাল পেয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সেই সম্মান বিরোধীদেরও তিনি দিয়েছেন। নেহরুর আমলে ইফতারের যে রীতি চালু হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে সব প্রধানমন্ত্রী যে আয়োজন করে এসেছেন, বাজপেয়ীও তা থেকে বিচ্যুত হননি। কংগ্রেসের ‘ছদ্ম ধর্মনিরপেক্ষতা ও তোষণের রাজনীতি’র সমালোচনা করেও তিনি প্রধানমন্ত্রীর সরকারি আবাসে ইফতার আয়োজন করেছেন। সেই আয়োজনের নেপথ্যে দেশের স্বার্থও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রক্ষায় ইফতারের প্রতীকীর গুরুত্ব বাজপেয়ী অনুধাবন করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশনে (ওআইসি) পাকিস্তানের প্রভাব খর্বে সরকারি স্তরে ইফতার আয়োজন সহায়ক হতে পারে। মুসলিম দেশকে পাশে পেতে সরকারকেও মুসলিমবান্ধব হওয়া প্রয়োজন।
বাজপেয়ীর অন্য প্রয়োজনও ছিল। তিনি ছিলেন সংখ্যালঘু একান্নবর্তী পরিবারের বড় কর্তা। সরকার চালাতে শরিকি সমর্থনের প্রয়োজনের কথাটা তিনি কখনো ভোলেননি।
মোদি সেদিক থেকে মুক্ত পুরুষ। ২০১৪ থেকে ২০১৯ ও ২০১৯ থেকে ২০২৪, কারও সাহায্য ছাড়াই তিনি রাজা। এখনো এই তৃতীয় দফাতেও তিনিই এক ও অদ্বিতীয়। ধর্মীয় মেরুকরণের তীব্রতার দরুন নির্বাচনকে তিনি অতি সহজে ৮০ বনাম ২০–এর লড়াইয়ে পরিণত করতে পেরেছেন। বিরোধীরাও ছাড়া ছাড়া। ইফতারের রাজনীতির কোনো প্রয়োজনই তিনি উপলব্ধি করেন না। একটানা ১১ বছর প্রধানমন্ত্রীর নিবাস ও ৮ বছর রাষ্ট্রপতি ভবন তাই ইফতারহীন।
ওয়াক্ফ বিল পাস হয়ে গেলে মুসলিম ধর্মাচরণেও সংখ্যাগুরুর আধিপত্য বিস্তার হবে। একদিন না একদিন সারা দেশে চালু হয়ে যাবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধিও। আজ হোক কাল হোক লোকসভার আসনবিন্যাস বদলে দেবে উত্তর–দক্ষিণের রাজনৈতিক ভারসাম্য। ৮০ বনাম ২০–এর লড়াই হয়ে যাবে আরও একপেশে।
কে জানে, রমজান মাসে রাষ্ট্রপতি ভবনে সংসদ সদস্যদের প্রাতরাশের আমন্ত্রণ জানানো শাসকদলের আদর্শ ও রাজনীতির পল্লবিত হওয়ার প্রমাণ কি না।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম খ যমন ত র র ষ ট রপত রমজ ন ম স র জন ত ক কর ছ ল ন র র জন ত র ইফত র ম সলম ন আমন ত র ন কর ছ হয় ছ ল বছর র সরক র সদস য একব র
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কৃতির ভুবন আলোকিত করে সন্জীদা খাতুনের বিদায়
আজীবন দেশের সংস্কৃতির ভুবন আলোকিত করার গুরুদায়িত্ব পালন করে বিদায় নিলেন সন্জীদা খাতুন। গতকাল মঙ্গলবার ৯২ বছর পূর্ণ করার কিছু আগে প্রয়াত হলেন দেশের এই অগ্রগণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। আগামী ৪ এপ্রিল তিনি ৯৩ বছরে পদার্পণ করতেন। জন্মদিনের পরিবর্তে সেদিনে হবে তাঁর স্মরণসভা।
রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বেলা ৩টা ১০ মিনিটে হৃৎস্পন্দন থেমে যায় সন্জীদা খাতুনের (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ ও পুত্রবধূ লাইসা আহমদ লিসা জানিয়েছেন, তাঁর হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ (হার্ট অ্যাটাক) হয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি সুস্থ ছিলেন না। তাঁর ছিল কিডনির জটিল রোগ। নিউমোনিয়াতেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। ১৯ মার্চ তাঁকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর নেওয়া হয় আইসিইউতে। অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি।
সন্জীদা খাতুনের বড় মেয়ে অপালা ফরহাদ নভেদ আগেই প্রয়াত। ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ আর মেয়ে রুচিরা তাবাসসুম নভেদসহ অনেক আত্মীয়স্বজন ও দেশ-বিদেশে অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন বহু গুণের অধিকারী অনাড়ম্বর জীবন যাপন করা এই মানুষটি। তাঁর ছেলেমেয়েরা জানিয়েছেন, মরদেহ রাতে হিমঘরে রাখা হবে।
সর্বজনের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় আনা হবে তাঁর হাতে গড়া দেশের অগ্রগণ্য সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানট সংস্কৃতি–ভবনে। সন্জীদা খাতুনের অনেক নাতি–নাতনি ও ঘনিষ্ঠ বহু আত্মীয় বিদেশে অবস্থান করছেন। তাঁরা শেষবিদায় জানাতে আসবেন। সে কারণে দাফনের দিনক্ষণ পরে ঠিক করা হবে। ৪ এপ্রিল সন্জীদা খাতুনের জন্মদিনে ছায়ানটে স্মরণসভা করার পরিকল্পনা করা হলেও সময় এখনো ঠিক হয়নি।
সন্জীদা খাতুনের কীর্তির ধারা বিচিত্র। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষক, গবেষক, শিল্পী, সংগীতজ্ঞ, সংগঠক ও সক্রিয় সাংস্কৃতিক নেত্রী। ছিলেন ছায়ানট ও রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সভাপতি। ব্যতিক্রমী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নালন্দার প্রতিষ্ঠাতা। জনসাধারণের সাংস্কৃতিক বোধের উন্নয়ন এবং মুক্ত–উদার মানবিক সমাজ নির্মাণের অবিরাম প্রচেষ্টাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পরে দেশের শিল্প–সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। আত্মীয়স্বজন ছাড়াও তাঁর সহযোদ্ধা, সহশিল্পী, ছাত্রছাত্রী ও গুণমুগ্ধরা শোকার্ত চিত্তে স্কয়ার হাসপাতালে ছুটে যান। অনেকেই ছিলেন অশ্রুসিক্ত।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক হাসপাতালে প্রথম আলোকে বললেন, তিনি দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন এবং জীবনকালটা মানুষের জন্য উজাড় করে দিয়েছেন। জনমানসে সংগীত, শিল্প, সাহিত্যের বোধ সৃষ্টি এবং এর সঙ্গে সামাজিক–সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতার বোধ সঞ্চার করে গেছেন। বিপুলভাবে তিনি বাঙালির জীবন সমৃদ্ধ করে তোলার কাজ করেছেন। তাঁর মতো দ্বিতীয় কেউ নেই।
রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সহসভাপতি ও শিল্পী বুলবুল ইসলাম বলেন, দেশে রবীন্দ্রসংগীতের প্রসার ও সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে ওয়াহিদুল হক, জামিল চৌধুরী ও সন্জীদা খাতুন—এই তিনজনের ভূমিকা পথিকৃতের মতো। তাঁরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক আন্দোলনের পথ সুগম করেছেন। দুজন আগেই প্রয়াত। এখন তৃতীয়জনও চলে গেলেন। নিজেকে অভিভাবকহীন মনে হচ্ছে।
ছায়ানটের তবলার শিক্ষক এনামুল হক ওমর বললেন, যে অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতায় তিনি সারা দেশের সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিল্পীদের সংগঠিত করেছেন, ছায়ানটকে পরিচালনা করেছেন, তার তুলনা হয় না। তাঁর প্রয়াণ জাতির জন্য অপরিমেয় ক্ষতি।
সন্জীদা খাতুনের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে ছায়ানট, উদীচী, চারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন।
সন্জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল। তাঁর বাবা কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক। মা সাজেদা খাতুন গৃহিণী। সন্জীদা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৪ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক, ১৯৫৫ সালে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৭৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু। দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই এতে জড়িয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতায় সংগঠিত করেন বাংলাদেশের শিল্পীদের। শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে সন্জীদা খাতুন ব্রতচারী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।
সন্জীদা খাতুনের প্রথম গানের গুরু ছিলেন সোহরাব হোসেন। তাঁর কাছে তিনি দীক্ষা নেন নজরুলসংগীত, আধুনিক বাংলা গান ও পল্লিগীতির। প্রথমে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছেন প্রখ্যাত হুসনে বানু খানমের কাছে। এরপর তালিম নেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার, আবদুল আহাদ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেনদের মতো বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীদের কাছ থেকে।
আইয়ুব খানের কঠোর শাসনকালে নানা বাধা অগ্রাহ্য করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনে তিনি ও সংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের ঐতিহ্যবাহী সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানটের যাত্রা শুরু। ১৯৬৭ সালে তাঁরা রমনার বটমূলে প্রথমবারের মতো বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখে আয়োজন করে প্রভাতি গানের আসর। ছায়ানটের এই অনুষ্ঠান থেকেই প্রাণিত হয়ে নববর্ষ উদ্যাপন এখন দেশজুড়ে বিপুল এক অসাম্প্রদায়িক উৎসব। ধর্মীয় উগ্রবাদীরা ছায়ানটের এই প্রভাতি গানের আসরে ২০০১ সালে ভয়াবহ বোমা হামলা চালালেও অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি।
এসব সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের বাইরে সন্জীদা খাতুনের গবেষণা ও রচনার কাজও কম নয়। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টির অধিক। রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ, কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, স্বাধীনতার অভিযাত্রা, সাহিত্য কথা সংস্কৃতি কথা, নজরুল মানস ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
সন্জীদা খাতুন দেশে একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। এ ছাড়া সম্মানিত হয়েছেন ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পদক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের দেশিকোত্তম পুরস্কার এবং কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রবীন্দ্র–তত্ত্বাচার্য উপাধিতে।