মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে থাকুক জনগণের মালিকানা
Published: 24th, March 2025 GMT
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরের প্রথম মার্চ মাস এটি। স্বাধীনতার এ মাস উদ্যাপনের সময় পরিবর্তিত বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের বয়ান নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন রয়েছে। কর্তৃত্ববাদের চূড়ান্ত সীমায় গিয়ে জন-অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতন আমাদের সামনে একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব ও গৌরব পুনরুদ্ধার করা দরকার। সেই সঙ্গে কোনো একক দল বা ব্যক্তি নয়, গণযুদ্ধের কৃতিত্ব জনগণের হাতেই ফিরে আসুক।
আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক একটি মহা বয়ান (গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ) তৈরি করেছিল, যাতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, নেতৃত্ব ও ঘটনাবলির ওপর তাদের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
এই মহা বয়ানে স্বাধীনতাসংশ্লিষ্ট অবদানের জন্য বাংলাদেশকে শাসন করার অধিকার আওয়ামী লীগের রয়েছে বলে এই দলের নেতারা মনে করতেন। একই সূত্র ধরে দলটির সমালোচনাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমালোচনার সমর্থক হিসেবে পরিণত করা হয়েছিল। এ প্রক্রিয়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বহুবিধ মানুষের ভিন্ন ভিন্ন অবদানকে ছাপিয়ে একটি দলের একক বয়ান তৈরি করে এবং শেখ মুজিবকে ‘দেবতার’ মতো সম্মান দিয়ে একজন ‘অতুলনীয়, সর্বদা সঠিক নেতায়’ পরিণত করে।
রাজনীতিতে ন্যারেটিভ বা বয়ানের গুরুত্ব নতুন কোনো বিষয় নয়। প্লেটোর একটি বিখ্যাত উক্তি আছে, ‘দোজ হু টেল দ্য স্টোরিজ রুল সোসাইটি’, অর্থাৎ ‘যারা গল্প বলে তারাই সমাজকে শাসন করে।’
এই উক্তির মাধ্যমেই বোঝা যায়, কীভাবে গল্প বা বয়ান তৈরি শাসনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। ন্যারেটিভ বা বয়ান হচ্ছে এমন একটি গল্প, যা ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও সামাজিক রীতিনীতিকে জায়েজ করার চেষ্টা করে। বয়ান নির্মাণ তাই রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য একটি জরুরি বিষয়। বিশেষ করে রাষ্ট্রক্ষমতাকে সমুন্নত রাখতে প্রয়োজন একই ধরনের ব্যাখ্যা। যেহেতু বয়ান অনেকাংশে ইতিহাসনির্ভর, তাই ইতিহাসের ঘটনাসমূহ নিজেদের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে।
জঁ ফ্রাসোঁয়া লিওটার্ড মহা বয়ানকে বর্ণনা করেন এমন একটি তত্ত্ব হিসেবে, যা ইতিহাসের ঘটনাবলি, অভিজ্ঞতা এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঘটমান বিষয়কে সর্বজনীন নিয়মের মাধ্যমে একটি সর্বাত্মক ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে। তাই মহা বয়ান ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে, বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ ও ভিন্ন ঘটনাকে সর্বজনীন নিয়মের মাধ্যমে একই সূত্রে ফেলে একধরনের বয়ান তৈরি করে। এর সমস্যা হচ্ছে এটি কেবল ইতিহাসের একটি দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরে, একই ধারার ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসে এবং কেবল এক ব্যক্তি অথবা একটি দলের অবদানকে একক বানিয়ে দেয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ–সম্পর্কিত মহা বয়ান তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষই সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করে। গ্রাম–শহর থেকে বিভিন্ন বয়সের নানা শ্রেণির মানুষের সংমিশ্রণেই তৈরি হয় এই বাহিনী। কিন্তু যুদ্ধ শেষে মুক্তিযুদ্ধের মালিকানা আস্তে আস্তে সাধারণ জনগণের হাত থেকে হাতছাড়া হয়ে এক ব্যক্তি ও একটি দলের অধিকারে চলে যায়।
আওয়ামী লীগের শাসনে মুক্তিযুদ্ধ কোনো ইতিহাসের ঘটনা না হয়ে ধর্মের মতো অলঙ্ঘনীয় হয়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধের একক বয়ানকে প্রশ্নবিহীন, অলঙ্ঘনীয় করে তোলার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের মহান নেতা ও তাঁর পরিবারের প্রতিও প্রশ্নবিহীন আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করতে কঠোর আইন পর্যন্ত করা হয়।
মহা বয়ান তৈরির এ প্রকল্পে ইতিহাসকে শাসকের ইচ্ছেমতো নির্মাণ করা হয়। এখানে কী ঘটেছিল, সেটা নয়, বরং কী ঘটলে বয়ানের সঙ্গে যায়, সেটাই বিবেচ্য হয়ে দাঁড়ায়। সত্য কী, তার চেয়ে কোন সত্যটি বয়ানের জন্য ‘স্বস্তিকর’, তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় মুসলিম লীগের কর্মী হিসেবে শেখ মুজিবের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং পরবর্তী সময়ে স্বপ্নভঙ্গ—এসব আলোচনা ব্রাত্য। এই অস্বস্তির জন্যই ১৯৪৭–এর ভারতীয় উপমহাদেশ ভাগ থেকে হঠাৎই ১৯৭১–এ আলোচনা চলে আসে।
’২৪ ও ’৭১ যে একে অপরের প্রতিপক্ষ নয়, বরং মুক্তিসংগ্রামের ধারাবাহিকতা, তা নিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও কিছু কট্টরপন্থী ছাড়া বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলেরই ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। এই ঐকমত্যকে কাজে লাগিয়ে ও একক মহা বয়ানকে ভেঙে দিয়ে আওয়ামী লীগের হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সাধারণ জনগণের হাতে তুলে দিতে হবে। এ লক্ষ্যে সাধারণ জনগণের অবদান ও ত্যাগ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা থাকা এই বয়ানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই জিয়াউর রহমানের মতো মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের অন্যতম সেনাপতিকে হয়ে যেতে হয় ‘পাকিস্তানের এজেন্ট’। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য রাজনৈতিক মতাদর্শের, গ্রাম্য ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর, এমনকি বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকেও এড়িয়ে যাওয়া হয়। কারণ, ‘প্রকৃত’ মুক্তিযোদ্ধা কারা বা কাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত বা উচিত নয়, এটা এই মহা বয়ান নির্ধারণ করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আসলে কী ঘটেছিল, কারা প্রকৃতই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তা অনেক সময় কম গুরুত্ব পায়। এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় কারা একক বয়ানে নির্দেশিত ইতিহাসকে মেনে নেন, সমর্থন করেন এবং সে অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলিকে বিশ্লেষণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের মহা বয়ানের অংশ হিসেবে যে শুধু মুক্তিযোদ্ধা কে, তার সীমারেখা তৈরি করা হয় তা–ই নয়, এর সঙ্গে বিভিন্ন প্রজন্মে রাজাকার কারা, সেটাও ঠিক করা হয়। এই বয়ানে দল হিসেবে যেহেতু আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের ‘অভিভাবক’, তাই এই দল ও দলের নেতাদের কার্যক্রমের বিরোধিতাকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা হিসেবে সরলীকরণ করা হয়। তাই আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরোধিতা করলে ‘রাজাকার’, ‘জামায়াত-শিবির’ কিংবা ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ইত্যাদি তকমা দেওয়া হতো।
আরও পড়ুনআওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে০৩ নভেম্বর ২০২৪২০১৩ সালে দেশে দুটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠে—একটি শাহবাগ আন্দোলন ও আরেকটি হেফাজত আন্দোলন। এই দুটি আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধের নব্য বয়ান তৈরি ও সেই বয়ান অনুযায়ী আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক লাভ তুলে আনতে সহযোগিতা করে। এটি একটি চমকপ্রদ বিষয় যে শাহবাগ আন্দোলনের প্রকৃতপক্ষে শুরু হয়েছিল সরকারবিরোধী আন্দোলন হিসেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনকে আওয়ামী লীগের স্বার্থ রক্ষার আন্দোলনে রূপান্তরিত করা হয়।
এই আন্দোলনের শুরু হয় আওয়ামী সরকারের সঙ্গে জামায়াতের একধরনের আঁতাত হচ্ছে, এ সন্দেহে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীকে সহযোগিতা করা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলে এই সন্দেহের সূত্রপাত হয়।
কীভাবে একটি সরকারবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সরকারের মদদপুষ্ট আন্দোলনে পরিণত হলো, তা বুঝতে হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহা বয়ান ও শত্রু নির্মাণের কাঠামোটি বুঝতে হবে। যেহেতু আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধের বয়ান অনুযায়ী আওয়ামী লীগই মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র অভিভাবক বা দেখভাল করার কর্তৃত্বের অধিকারী, তাই শেষ পর্যন্ত আন্দোলন তাদের পকেটস্থ হয়। দীর্ঘ সময় ধরে যে সাংস্কৃতিক শক্তি ও লোকবল দিয়ে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে নিজেদের একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে, ফলে এমনকি তাদের রাজনৈতিক বিরোধীরাও অনেক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আওয়ামী লীগের মালিকানা মেনে নেয়।
শাহবাগ আন্দোলনে সরকার কীভাবে মিত্রে পরিণত হলো, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে যখন আলোচনা ও প্রতিবাদের দরকার ছিল, তখন কট্টর ইসলামপন্থী গোষ্ঠী হেফাজতের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হলো। হেফাজতের অপ্রয়োজনীয় আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ক মূল বিষয় থেকে নজর সরিয়ে দিল। আওয়ামী লীগ সরকার শক্তি প্রয়োগ করে হেফাজতের ঢাকায় অবস্থানকে বানচাল করলেও কিছুদিনের মধ্যেই তাদেরকে কাছে টেনে নিয়েছে। প্রথম দিকে স্বঘোষিত নাস্তিক ব্লগারদের পাশে থাকলেও পরের দিকে তাদের গ্রেপ্তার ও মামলা করে হেফাজতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে আওয়ামী লীগ।
এভাবে শাহবাগ ও হেফাজত দুই আপাত পরস্পরবিরোধী গোষ্ঠী কট্টর জাতীয়তাবাদ ও ধর্মকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের সমাজে ঘৃণার চর্চা বাড়ায়। তৈরি হয় বাইনারি বিভাজন এবং দুটি মেরু। সমাজের এই অসহিষ্ণু বিভাজন ‘সেক্যুলার’ হিসেবে পরিচয় দেওয়া আওয়ামী লীগের ইসলামপন্থীদের প্রতিরোধের নামে যেকোনো মূল্যে বিকল্পহীন হিসেবে ক্ষমতায় টিকে থাকাকে জায়েজ করে।
৫ আগস্টের পর জুলাই অভ্যুত্থানকে ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে ঢেকে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে, প্রথমে বিএনপি এবং পরে নতুন দল এনসিপি মুক্তিযুদ্ধকে ভুলিয়ে দেওয়ার এই অপচেষ্টাকে রুখে দেয়।
’২৪ ও ’৭১ যে একে অপরের প্রতিপক্ষ নয়, বরং মুক্তিসংগ্রামের ধারাবাহিকতা, তা নিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও কিছু কট্টরপন্থী ছাড়া বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলেরই ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। এই ঐকমত্যকে কাজে লাগিয়ে ও একক মহা বয়ানকে ভেঙে দিয়ে আওয়ামী লীগের হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সাধারণ জনগণের হাতে তুলে দিতে হবে। এ লক্ষ্যে সাধারণ জনগণের অবদান ও ত্যাগ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
● ড.
সাইমুম পারভেজ অসলোর নরওয়েজিয়ান স্কুল অব থিওলজি, রিলিজিয়ন ও সোসাইটির জ্যেষ্ঠ গবেষক (সহযোগী অধ্যাপক)
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জনগণ র হ ত র জন ত ক র অবদ ন ঐকমত য শ হব গ র জন য র ঘটন আওয় ম একক ব ইসল ম সরক র ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
গণপরিষদ নির্বাচন চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি
পাঁচটি সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে ১১৩টির সঙ্গে একমত পোষণ করেছে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তারা বলেছে, যে সুপারিশগুলো সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, সেগুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। আর সংবিধান–সম্পর্কিত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন দরকার।
রোববার দুপুরে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে সংস্কার নিয়ে নিজেদের লিখিত মতামত জমা দেয় এনসিপি। পরে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সংস্কার সমন্বয় কমিটির কো-অর্ডিনেটর সারোয়ার তুষার সাংবাদিকদের এ কথাগুলো জানান।
এর আগে ঐকমত্য কমিশনের কাছে মতামত দেওয়ার পর বিএনপি বলেছে, গণপরিষদ গঠনের কোনো প্রয়োজন নেই। নতুন রাষ্ট্র হলে তখন গণপরিষদ গঠন করা হয় নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সারোয়ার তুষার সাংবাদিকদের বলেন, নতুন সংবিধানের জন্য গণপরিষদ প্রয়োজন—এ ধারণা সঠিক নয়। অনেক দেশে সংবিধানের বড় পরির্তনের জন্য এ রকম হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তিনি থাইল্যান্ড, ভেনেজুয়েলা, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের উদাহরণ দেন।
এনসিপি বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে ৩০০ আসনে গণপরিষদ নির্বাচন চায় কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে সারোয়ার তুষার বলেন, জুলাই সনদ হবে। এর মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপার রয়েছে। সংবিধানের বড় পরিবর্তন বা সম্পূর্ণ নতুন সংবিধান যেটাই হোক, এটা লিখিত হবে। তখন এ সংবিধানের প্রশ্নে নতুন সিদ্ধান্ত হতে পারে। বর্তমান সংবিধানকে বাতিল করা দরকার, এটা তাঁরা আগেই বলেছেন।
আরেক প্রশ্নের জবাবে সারোয়ার তুষার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র ছিল প্রথম সংবিধান। কিন্তু ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগের দলীয় মূলনীতি সংবিধানে নিয়ে আসা হয়। তাই বাহাত্তরের সংবিধান দাঁড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রের বিরুদ্ধে। বাহাত্তরের সংবিধান হচ্ছে ‘সাংবিধানিক ক্যু’।
তিন বিষয়ে উদ্বেগসারোয়ার তুষার সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা তিনটি বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের কাছে উদ্বেগ বা প্রশ্ন রেখেছেন। প্রথমটি হলো, ছয়টি সংস্কার কমিশন অনেকগুলো সুপারিশ করেছিল। কিন্তু স্প্রেডশিটে কনসাইজ (সংক্ষিপ্ত) করে ১৬৬টি সুপারিশ রাখা হয়েছে। তাঁরা বুঝতে পারছেন, এই ১৬৬ সুপারিশের সব কটি জুলাই সনদে থাকবে না, আরও সংক্ষিপ্ত হবে। গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো কেন অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না, এ বিষয়ে কমিশন কী ভাবছে, তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে, ১১১টি সুপারিশ আলোচনা ছাড়াই বাস্তবায়নের কথা ভাবছে সরকার। এসব কোন প্রক্রিয়ায় নির্ধারণ করা হলো, তা কমিশনের কাছে তাদের জিজ্ঞাসা ছিল। তৃতীয়ত, পুলিশ সংস্কার কমিশন ও স্থানীয় সরকার কমিশনের প্রতিবেদন না পাঠানোর বিষয়টিও ঐকমত্য কমিশনের কাছে জানতে চেয়েছে এনসিপি।
উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবঐকমত্য কমিশনের কাছে মতামত জমা দেওয়ার পর এনসিপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা ১১৩টি সুপারিশের সঙ্গে একমত ও ২৯টির সঙ্গে আংশিকভাবে একমত হয়েছে। ২২টি সুপারিশের বিষয়ে তারা একমত হতে পারেনি।
এনসিপি বলেছে, রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিষয়ে তাদের আপত্তি নেই, তবে এটা দাপ্তরিক ভাষা হওয়া উচিত। বাংলাদেশের নাগরিক ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে পরিচিত হবেন, এর সঙ্গে বিভিন্ন জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকতে হবে। মৌলিক অধিকারের মধ্যে প্রাণ, প্রকৃতির সুরক্ষা থাকা উচিত। দলের প্রার্থী মনোনয়নে ১০ শতাংশ তরুণ-তরুণীকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে তারা একমত। এ ক্ষেত্রে তরুণ–তরুণীর সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ বছর পর্যন্ত ধরা যেতে পারে। সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বয়স ন্যূনতম ২৩ বছর হওয়া উচিত। ডেপুটি স্পিকার একজন হওয়া উচিত, তা বিরোধী দল থেকে।
এনসিপি বলেছে, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদনেতা একই ব্যক্তি হতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার মধ্যে প্রথমজন হলে এ ক্ষেত্রে বাধা থাকবে না। তারা প্রস্তাব করেছে, অর্থ বিল ও আস্থা ভোট ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে সংসদে সদস্যরা স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারবেন। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে এনসিপি একমত। তবে এ ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষের প্রার্থী কারা, তা আগেই ঘোষণা দিতে হবে।
সারোয়ার তুষার বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার হবে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের মেয়াদ ৭০ থেকে ৭৫ দিন হতে পারে। একটা পর্যায়ে গিয়ে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রয়োজন নেই। তখন জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) এ দায়িত্ব নিতে পারে। এনসিসির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তা তদন্ত করতে পারে। তারা বলেছে, বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা, স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জরুরি অবস্থা জারির পরিস্থিতি এলে সংসদের উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে তা করতে হবে। নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের সময় জরুরি অবস্থা জারি করা যাবে না।
এনসিপির পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, সাধারণ নির্বাচনে কোনো দল অন্তত ১ শতাংশ ভোট পেলে তারা সংসদের উচ্চকক্ষে আসন পাবে। সংসদের উচ্চকক্ষে দলের প্রাপ্ত আসনে ৩৩ শতাংশ নির্দলীয় ব্যক্তি ও ২৫ শতাংশ নারীদের জন্য বরাদ্দ রাখা, উচ্চকক্ষের জন্য সর্বনিম্ন বয়স ৩৩ বছর রাখা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত না রাখার প্রস্তাব করেছে এনসিপি।
দলের মতামত জমা দেওয়ার সময় সারোয়ার তুষারের সঙ্গে এনসিপির সংস্কার সমন্বয় কমিটির সদস্য মুনিরা শারমিন, জাবেদ রাশিম, আরমান হোসাইন ও সালেউদ্দিন সিফাত উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষে ছিলেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য বদিউল আলম মজুমদার ও ইফতেখারুজ্জামান, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার।