গাজার হাসপাতালে ইসরায়েলি হামলায় হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা নিহত
Published: 24th, March 2025 GMT
ফিলিস্তিনের গাজার একটি হাসপাতালে গতকাল রোববার সন্ধ্যায় বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এ হামলায় হামাসের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা ও তাঁর এক সহযোগী নিহত হয়েছেন। হামাসের এক কর্মকর্তা বিবিসিকে এ কথা বলেছেন।
হামাসের এই জ্যেষ্ঠ নেতার নাম ইসমাইল বারহুম। তিনি হামাসের অর্থবিষয়ক প্রধান।
গাজার খান ইউনিসের প্রধান চিকিৎসাকেন্দ্র নাসের হাসপাতালে ইসরায়েলের চালানো হামলায় ইসমাইল নিহত হন।
হামাসের একই কর্মকর্তা বলেছেন, চার দিন আগে ইসরায়েলের বিমান হামলায় ইসমাইল আহত হয়ে খান ইউনিসের হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, বিস্তৃত পরিসরে সংগ্রহ করা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তারা হাসপাতাল প্রাঙ্গণের ভেতরে কার্যক্রম চালানো একজন গুরুত্বপূর্ণ হামাস সদস্যকে নিশানা করে হামলা চালিয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি কমাতে তারা নির্ভুলভাবে হামলা চালাতে সক্ষম অস্ত্র ব্যবহার করেছে।
গাজার হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, এ হামলায় চিকিৎসাকর্মীসহ অন্য অনেকে আহত হয়েছেন।
আরও পড়ুনইসরায়েলি নৃশংসতায় গাজায় নিহত ৫০ হাজার ছাড়াল, ১৭ হাজারই শিশু১৪ ঘণ্টা আগেস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, হামলায় হাসপাতালটির একটি বড় অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। হাসপাতালের ক্ষতিগ্রস্ত বিভাগটি খালি করে দেওয়া হয়েছে।
বিবিসির যাচাই করা ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, হামলার পর লোকজন আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন।
ইসরায়েল বারবার অভিযোগ করে আসছে, অস্ত্র ও কমান্ড সেন্টার আড়াল করার জন্য হাসপাতাল ব্যবহার করছে হামাস। তবে ইসরায়েলের এ অভিযোগ হামাস অস্বীকার করে আসছে।
গতকাল খান ইউনিসে পৃথক ইসরায়েলি বিমান হামলায় আরেক হামাস নেতা সালাহ আল-বারদাউইল নিহত হন। হামাসের এক কর্মকর্তা বিবিসিকে এ কথা বলেছেন।
হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, গতকাল রোববার সকাল পর্যন্ত গাজার খান ইউনিস ও রাফায় ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে ৩০ জন নিহত হয়েছেন। এ হিসাবের মধ্যে গত সন্ধ্যায় খান ইউনিসের হাসপাতালে চালানো হামলায় হতাহতের পরিসংখ্যান নেই।
আরও পড়ুন‘নেতানিয়াহু ইসরায়েলের বড় শত্রু’: ইসরায়েলে টানা তৃতীয় দিন ব্যাপক বিক্ষোভ২১ ঘণ্টা আগেগত ১৮ মার্চ গাজায় আবার সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। এর মধ্য দিয়ে গাজায় প্রায় দুই মাস ধরে চলা যুদ্ধবিরতির অবসান ঘটে। এর পর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় শত শত মানুষ নিহত হয়েছেন।
যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার জন্য হামাসকে দায়ী করেছে ইসরায়েল। অন্যদিকে গত জানুয়ারিতে হওয়া যুদ্ধবিরতির মূল চুক্তি পরিত্যাগ করার জন্য ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করেছে হামাস।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাস হামলা চালালে গাজা যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। ইসরায়েলে হামাস হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ ব্যক্তি নিহত হন। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক। এ ছাড়া ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায় হামাস।
আরও পড়ুনইসরায়েলের হামলায় গাজায় হামাস নেতা নিহত২৩ মার্চ ২০২৫জবাবে হামাসকে ধ্বংস করতে গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
আরও পড়ুনইসরায়েলি নৃশংসতা চলছেই ২২ মার্চ ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র খ ন ইউন স
এছাড়াও পড়ুন:
রাতে শুনি ‘গেম ওভার’, সকালে শুনি কী
শেক্সপিয়ারের ‘হেনরি দ্য ফোর্থ’ নাটকের একটি চরিত্র হলো ‘গুজব’।
সেখানে গুজব নিজের সম্পর্কে বলে, ‘হাওয়া আমার ঘোড়া, হাওয়াই ঘোড়ায় চড়ে পুবের আকাশ থেকে আমি পশ্চিমেতে যাই। সব ঘটনা, সব রটনা ছড়িয়ে দিই তাবৎ বিশ্বময়। মিথ্যা-বিষে পূর্ণ করি সব মানুষের কান।’
আজকের দিনে গুজব হাওয়াই ঘোড়া থেকে নেমে ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ নামের ঘোড়ায় চেপেছে। সে ঘোড়া আরও জোরে ছোটে।
তবে কিনা এই ভাটির দেশে খাঁটি গুজব বলে কিছু নেই; এখানে সব গুজবেই সত্যের মিশেল থাকে। এখানে হিউমারাসলি সব রিউমারই ফ্যাক্ট।
এখানে যা রটে, তার অনেকটাই ঘটে। সে কারণে এখানে শুধু মানুষের ওপর নয়, গুজবের ওপরও বিশ্বাস হারানো পাপ।
কিন্তু সাত-আট মাস ধরে কিছু লোক গুজব ছড়ানোর নামে দেশে যে গজবের পরিবেশ তৈরি করেছে, তাতে সত্যিকারের গুজবের ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে যাচ্ছে।
আরও পড়ুনসবখানে গুজব ও অপতথ্যের বিষ, প্রতিষেধক কোথায়৩০ জানুয়ারি ২০২৫কাল (২৩ মার্চ দিবাগত রাত) সারা রাত ছিল গুজবের রাত। রাতদুপুরে এক বন্ধুর ফোনে ঘুম ভাঙল। সে বলল, ‘ঘটনা যা শুনলাম সত্যি নাকি? সকালে নাকি ইমার্জেন্সি দিচ্ছে? ঢাকা নাকি ফাঁকা হয়ে গেছে?’
আমি আধা ঘুম আধা জাগরণের কণ্ঠে বললাম, ‘তোরে এই কথা “সোর্স চালাই দেন” বলল?’
সে বলল, ‘না, খুবই রিলায়েবল সোর্স জানাইছে। ঘটনা সত্য।’
রাত দুইটায় ঘুমের বারোটা বাজল। ফেসবুকে ঢুকলাম। দেখলাম, আওয়ামী সমর্থক এক বন্ধু লিখেছেন, ‘গেম ওভার!’
তাঁর মন্তব্যের ঘরে একজন লিখেছেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’; একজন লিখেছেন, ‘জয় বাংলা’; একজন লিখেছেন, ‘এই সরকারের সব কয়টার হিসাব নেওয়া হবে’।
একজন আবার আনন্দের চোটে আবেগ দমন করতে না পেরে এমন অশ্রাব্য ভাষায় সম্ভাব্য ‘বিজয়’কে উদ্যাপন করেছেন, যা এখানে উল্লেখ করাটা ঠিক হবে না।
আরও পড়ুনকানে গুজব, হাতে আইন২৩ জুলাই ২০১৯৫ আগস্টের পর থেকে পলাতক আছেন, এমন এক বন্ধু লিখেছেন, ‘একটাকেও পালাতে দেওয়া হবে না। সকালে সবাই এয়ারপোর্টে যান।’
তাঁর মন্তব্যের ঘরে একজন লিখেছেন, ‘ইনশা আল্লাহ ভাই, জয় বাংলা!’; একজন লিখেছেন, ‘ভোরেই বিমানবন্দরে থাকব ভাই। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’
একজন লিখেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত সকালেই সুখবর আসছে!’; একজন ছাত্র-জনতা আন্দোলনের নেতাদের উদ্দেশে লিখেছেন, ‘সুরা-কালাম যা পড়ার পড়ে নে, সময় শেষ!’
একজন লিখেছেন, ‘কাল সকালে ঢাকা শহরের মিষ্টির দোকান খালি হয়ে যাবে। সকাল দশটার আগে মিষ্টির অর্ডার দিয়ে রাখেন।’
সরকারি কিছু নথিপত্র এবং চিঠিজাতীয় কাগজের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে একজন আবার জানিয়ে দিয়েছেন, আজ ২৪ মার্চই অন্তর্বর্তী সরকারের শেষ দিন। সেই স্ট্যাটাস কয়েক শ জন শেয়ার করেছেন।
আরও পড়ুন১৩ তারিখ গেল, বাংলাদেশে তো কিছু ওল্টাল না!১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫একজন হোয়াটসঅ্যাপে ভারতের ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র একটি খবরের লিংক পাঠিয়েছেন। সেই খবরের হেডিং, ‘থমথমে ঢাকা, ইউনূস উচ্ছেদ ও সেনাশাসন চেয়ে মিছিল’।
আরেকজন ভারতের আরেকটি নিউজ পোর্টালের লিংক পাঠিয়েছেন। সেই খবরের হেডিং—‘গৃহযুদ্ধে গোটা বাংলাদেশ; হাসিনাকে ঢোকাতে আর্মি নামালেন সেনাপ্রধান ওয়াকার।’
কেউ কেউ আবার সকাল হওয়ার পর কয়টা কত মিনিটে কোন কর্মকর্তা কী ঘোষণা দেবেন, ঠিক কয়টায় কী ঘটনা ঘটবে, সুনির্দিষ্ট করে তা ঘণ্টা–মিনিট উল্লেখ করে বলে দিয়েছেন।
আগের দিন হলে এসব দেখার পর উদ্বেগে-চিন্তায় ঘুম আসত না। কাল রাতেও ঘুম আসেনি। তবে উদ্বেগে বা চিন্তায় না; ঘুম আসেনি মেজাজ খারাপ হওয়ার কারণে।
ফেসবুকের কারণে গোটা দেশটাই যেহেতু সত্যোত্তর—‘পোস্টট্রুথ’, সেহেতু এখানে কোনো গুজবকে ‘সত্য’ হয়ে উঠতে শুধু কিছু ফেসবুক পোস্টের হাজার কয়েক শেয়ারের দরকার হয়। কটাকট কিছু ছবি ফটোশপে মেরে দিয়ে কায়দামতো একটা ক্যাপশন লিখে ফেসবুকে আপলোড করে দিলেই হলো। এই ছবিসংবলিত বয়ানগুলোই বাস্তব। ইনফো-হাইওয়েতে সেগুলো ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু একই ধরনের গুজব একই কায়দায় ছড়ানো হলে তা যে একসময় আর কাজে দেয় না; এই আনস্মার্ট গুজববাজদের কে বোঝাবে?মেজাজ খারাপ হয়েছে এই ভেবে যে গুজব ছড়ানোরও তো একটা আদবকায়দা আছে; একটা ‘গোল্ডেন রুল’ আছে। এরা তো সেই নিয়ম কানুনের ধারেকাছেই থাকছে না।
পাবলিক যাতে গুজবটা গেলে, তার জন্য মিনিমাম ‘ফ্যাক্ট’ তো মেশাতে হবে!
কয়দিন পরপর নিঝুম রাতে শিয়ালের মতো কেউ একজন ‘গেম ওভার, কেউ যেন পালাতে না পারে’ মার্কা হুক্কা হুয়া দিচ্ছে। বাদ বাকিরা ‘হুয়া হুয়া’ বলে ‘ধুয়া’ দিচ্ছে।
পরে যখন সকাল হচ্ছে, তখন দেখা যাচ্ছে, নিঝুম রাত উধাও, শিয়ালের হুক্কা হুয়াও নেই।
ফেসবুকভিত্তিক এই গুজবগুলো সাধারণত সূক্ষ্মভাবে একটি পক্ষকে লক্ষ্য করে রাতে ছড়ানো হয়। তখন সেই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে তুমুল জোশ আসে।
এটা অনেকটা এনার্জি ড্রিংকের মতো কাজ করে। গুজব-জুসের পীযূষ পান করে হুঁশ হারিয়ে তাঁরা বিপুল বিক্রমে রাজা-উজির মেরে ফেলেন।
অমুকের পতন আর তমুকের প্রত্যাবর্তনে তাঁরা দিনক্ষণ ঠিক করে দিয়ে সমানে স্ট্যাটাস দিতে থাকেন।
পরে যখন সকাল হয়; পরে যখন ‘ঘটনা ঘটার’ সময় পার হয়ে যায়, তখন জুসের ঘোর কাটে। তাঁরা তখন বেহুঁশ থেকে হুঁশে আসা শুরু করেন।
আবার কয়েক দিন পর নতুন করে নতুন এনার্জি ড্রিংক খাওয়ানো হয়। আবার ভাঙা মন চাঙা করা হয়।
কিন্তু বারবার একই জিনিস একই কায়দায় খাওয়ানোর কারণে নেতা-কর্মীরা আর আগের মতো চাঙা হচ্ছেন না।
গুজবমতো পাশের দেশ থেকে কেউ চট করে ঢুকে পড়ছেন না বা অবস্থা জরুরির দখলে যাচ্ছে না দেখে তাঁদের অনেকে বিরক্ত হচ্ছেন।
ইন্টারনেট আসার আগে হুইসপারিং ক্যাম্পেইনের চল ছিল। ‘ওয়ার্ডস অব মাউথ’ বা মুখে মুখে ফিসফাস করে গুজব ছড়ানোর ধারা ছিল।
ফেসবুক সেই ধারায় বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। এখন কারেন্টের গতিতে ভুয়া খবর ভাইরাল হয়ে তা খবরের মর্যাদা পেয়ে যাচ্ছে।
ঘটনা সত্যি নাকি ভুয়া, তা যাচাই করার আগ্রহ বা সময় কোনোটাই বেশির ভাগ মানুষের থাকছে না।
ফেসবুকের কারণে গোটা দেশটাই যেহেতু সত্যোত্তর—‘পোস্টট্রুথ’, সেহেতু এখানে কোনো গুজবকে ‘সত্য’ হয়ে উঠতে শুধু কিছু ফেসবুক পোস্টের হাজার কয়েক শেয়ারের দরকার হয়।
কটাকট কিছু ছবি ফটোশপে মেরে দিয়ে কায়দামতো একটা ক্যাপশন লিখে ফেসবুকে আপলোড করে দিলেই হলো। এই ছবিসংবলিত বয়ানগুলোই বাস্তব। ইনফো-হাইওয়েতে সেগুলো ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু একই ধরনের গুজব একই কায়দায় ছড়ানো হলে তা যে একসময় আর কাজে দেয় না; এই আনস্মার্ট গুজববাজদের কে বোঝাবে?
দুই দিন পর পর গুজবসেবীরা রাতভর গুজব ছড়াচ্ছেন, আর রাজনীতি সচেতন বন্ধুরা ফোন করে ‘ঘটনা সত্যি নাকি?’ বলে কাঁচাঘুম ভাঙাচ্ছেন, ব্যাপারটা কি ভালো হচ্ছে?
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]