এবার রোজায় নতুন করে সক্রিয় ৩১৭ প্রতিষ্ঠান, বেড়েছে আমদানি
Published: 24th, March 2025 GMT
গত আগস্টে সরকার বদলের পর এবার রোজার পণ্য আমদানিতে নতুন করে সক্রিয় হয়েছে ৩১৭টি নতুন ও পুরোনো প্রতিষ্ঠান। এ তালিকায় রয়েছে ফল আমদানিকারক থেকে শুরু করে প্রাণিখাদ্য তৈরির প্রতিষ্ঠানসহ নানা শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। গত ১ জানুয়ারি থেকে ১১ মার্চ পর্যন্ত ৭০ দিনের আমদানি তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে রোজার পণ্য হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে ছোলা, মটর ডাল, মসুর ডাল, খেজুর, চিনি, গম, সয়াবিন ও পাম তেল।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, এ বছর উল্লিখিত রোজার আটটি পণ্য আমদানি করেছে ৪৯৯টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ৩১৭টি প্রতিষ্ঠান গত বছর রোজার আগে কোনো পণ্য আমদানি করেনি, অর্থাৎ এবার আমদানির মাধ্যমে নতুন করে সক্রিয় হয়েছে এই ৩১৭ প্রতিষ্ঠান। অবশ্য গত বছর রোজার সময় আমদানি করেছে এমন ১৮১টি প্রতিষ্ঠান এবার কোনো পণ্য আমদানি করেনি। এসব প্রতিষ্ঠান আমদানি না করলেও পণ্য আমদানি কমেনি। কারণ, গতবারের চেয়ে এবার বেশিসংখ্যক প্রতিষ্ঠান নিত্যপণ্যের ব্যবসায় সক্রিয় ছিল। এতে পণ্য আমদানি গতবারের তুলনায় ৯ লাখ টন বেড়ে সাড়ে ৩৫ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।
পণ্য আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় রোজার চাহিদার চেয়ে বাড়তি পণ্য আমদানি হয়েছে এবার। এতে রোজার পণ্যের কোনোটির দাম কমেছে, কোনোটি স্থিতিশীল রয়েছে। অবশ্য ফেব্রুয়ারির প্রথম তিন সপ্তাহে সয়াবিন আমদানি কমে যাওয়ায় বাজারে তেলের সংকট দেখা দেয়। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে আমদানি বাড়তে থাকায় বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ বেড়েছে।
সক্রিয় যারা
এ বছর রোজার আগে সক্রিয় হওয়া ৩১৭টি প্রতিষ্ঠানের একটি চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে অবস্থিত সামুদা এডিবল অয়েল। প্রথমবারের মতো এবার প্রতিষ্ঠানটি পাম তেল আমদানি করেছে। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি ৩১ লাখ মার্কিন ডলারের ৩ হাজার টন পাম তেল আমদানি করেছে। এটি টি কে গ্রুপের দ্বিতীয় প্রজন্মের উত্তরসূরিদের প্রতিষ্ঠান।
জানতে চাইলে গ্রুপটির পরিচালক মোস্তফা হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের শেষে সামুদা এডিবল অয়েলের উৎপাদন শুরু হয়েছে। ভোজ্যতেলের চাহিদা সামনে বাড়বে—এমন সম্ভাবনা থেকেই নতুন এ বিনিয়োগ করা হয়েছে।
আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া মানে নিত্যপণ্যের ব্যবসায় সুস্থ প্রতিযোগিতা বেড়েছে। এতে নতুন নতুন আমদানিকারক যুক্ত হয়েছে। বাজারের জন্য এ চিত্র ইতিবাচক। মোস্তফা কামাল, চেয়ারম্যান, এমজিআইএবার রোজায় সক্রিয় হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর আরেকটি মেসার্স সৈনিক ট্রেডার্স। গাজীপুরের কাশিমপুরের হাতিমাড়া রোডের এ প্রতিষ্ঠানের গত বছর রোজার আগপর্যন্ত কোনো পণ্য আমদানির রেকর্ড নেই। এ বছর রোজার আগে পণ্য আমদানি শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এবার এই প্রতিষ্ঠান ৪ কোটি ২৯ লাখ ডলারের দেড় লাখ টন পণ্য আমদানি করেছে। এ পণ্যের তালিকায় রয়েছে মটর ডাল ও গম।
জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মো.
ঢাকার বনানীর ইনফিনাইট হরাইজন করপোরেশন এ বছর প্রথমবারের মতো রোজার পণ্য আমদানি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রায় ২৭ লাখ ডলারের ছোলা আমদানি করেছে। এর আগে পণ্য আমদানির কোনো রেকর্ড নেই তাদের। গাজীপুরের কাশিমপুরের এমজি গ্লোবাল ট্রেডও প্রথমবার রোজার পণ্য আমদানি করেছে। এবার প্রতিষ্ঠানটি ১৬ লাখ ৮০ হাজার ডলারের খেজুর আমদানি করেছে।
নতুন করে আবার এ বছর আমদানি শুরু করা আরেকটি প্রতিষ্ঠান হলো ঢাকার উত্তরার সহোদর এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটি ৪১ লাখ ডলারের প্রায় ১১ হাজার টন মটর ডাল আমদানি করেছে এবার। এর আগে ২০২১ সালে একটি চালান আমদানির রেকর্ড রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
বগুড়ার কাহালু উপজেলার শীতলাইয়ে অবস্থিত মৎস্য খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আরবি এগ্রো লিমিটেড এবার ৪২ হাজার টন রোজার পণ্য আমদানি করেছে। এ পণ্যের তালিকায় রয়েছে ছোলা, মসুর ডাল ও গম। এতে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৭১ লাখ ডলার। প্রতিষ্ঠানটি গত বছর রোজার আগে কোনো পণ্য আমদানি করেনি। অবশ্য প্রাণিখাদ্য তৈরির প্রতিষ্ঠানটি কয়েক বছর ধরে মৎস্য খাদ্যের কাঁচামাল আমদানি করত।
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ক্রাউন এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ এবার রোজার আগে পণ্য আমদানিতে সক্রিয় হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৪৩ লাখ ডলারের মসুর ডাল ও গম আমদানি করেছে। প্রাণিখাদ্য তৈরির প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সাল থেকে পণ্য আমদানি করলেও গতবার রোজার আগে সক্রিয় ছিল না।
নিত্যপণ্যের চাহিদা বাড়ছে। আবার নিত্যপণ্যের ব্যবসায় সুস্থ প্রতিযোগিতাও ফিরে এসেছে। এ কারণে গত বছর রোজার কোনো পণ্য আমদানি না করলেও এবার আমদানি করেছি। মো. মাহবুবুর রহমান, কর্ণধার, মেসার্স সৈনিক ট্রেডার্সখুলনার রূপসা এডিবল অয়েল গত বছর রোজার আগে পণ্য আমদানি করেনি। তবে এবার প্রতিষ্ঠানটি ১ কোটি ৩৯ লাখ ডলারের ভোজ্যতেলের কাঁচামাল আমদানি করেছে। এটি নারায়ণগঞ্জের ডেল্টা এগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের সহযোগী কারখানা।
জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর রোজার আগে হয়তো পণ্য মজুত থাকায় আমদানি করা হয়নি। এবার ভোজ্যতেলের বাজারে সরবরাহ যাতে বাড়ে, সে জন্য আমদানি করেছি।’
নিষ্ক্রিয় যারা
এবার রোজায় পণ্য আমদানিতে নিষ্ক্রিয় রয়েছে চট্টগ্রামে বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো। গ্রুপটির এস আলম ভেজিটেবল অয়েল, এস আলম সুপার এডিবল অয়েল ও সোনালি ট্রেডার্স গত বছর রোজার আগে ৫ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের ১ লাখ ২৭ হাজার টন পণ্য আমদানি করেছিল। এবার এই তিন প্রতিষ্ঠান এক কেজি পণ্যও আমদানি করেনি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ নামে–বেনামে ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা বের করে নিয়েছেন। এখন আমদানির সক্ষমতা হারিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
একইভাবে বেক্সিমকো ফুডস গত বছর রোজার আগে খেজুর আমদানি করলেও এবার কোনো পণ্য আমদানি করেনি। বেক্সিমকো গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান গত ১৩ আগস্ট থেকে কারাগারে রয়েছেন।
বড় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চিনি প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠান দেশবন্ধু সুগার মিলস এবার কোনো পণ্য আমদানি করেনি। ঋণপত্র খুলতে না পারায় গ্রুপটি এবার আমদানি করেনি বলে জানা গেছে।
খাতুনগঞ্জের আমির মার্কেটের এন মোহাম্মদ ট্রেডিং গত বছর রোজার আগে প্রায় ২৬ হাজার টন ছোলা ও গম আমদানি করেছিল। এবার প্রতিষ্ঠানটি কোনো পণ্য আমদানি করেনি। একইভাবে কমোডিটি হারভেস্ট গত বছর রোজার আগে ১৩ লাখ ডলারের পাম তেল আমদানি করলেও এবার কোনো পণ্য আমদানি করেনি। এ ছাড়া খাতুনগঞ্জের ব্লু স্কাই এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স এস এস ট্রেডিং ও সাবিসা মাল্টিট্রেড গত বছর ৩ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের ছোলা ও গম আমদানি করলেও এবার কোনো পণ্য আমদানি করেনি। একইভাবে ঢাকার মৌলভীবাজারের জে কে ট্রেডিং গত বছর রোজার আগে মটর ডাল, মসুর ডাল ও ছোলা আমদানি করলেও এবার কোনো পণ্য আমদানি করেনি।
ব্যবসায়ীরা জানান, নিষ্ক্রিয় তালিকায় থাকা ব্যবসায়ীদের বড় অংশই আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, যাঁরা সরকারের পটপরিবর্তনের পর ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। আবার নতুন করে খেলাপির কারণেও অনেক প্রতিষ্ঠানকে পণ্য আমদানি বন্ধ করতে হয়েছে।
বাজারের জন্য ইতিবাচক
নিত্যপণ্যের ব্যবসায় আমদানিকারকদের উত্থান–পতন নিয়মিত চিত্র। উত্থান–পতনের পরও এবার রোজার আগে সক্রিয় আমদানিকারকের সংখ্যা বেশি। বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বড় আমদানিকারকেরাও। জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া মানে নিত্যপণ্যের ব্যবসায় সুস্থ প্রতিযোগিতা বেড়েছে। এতে নতুন নতুন আমদানিকারক যুক্ত হয়েছে। বাজারের জন্য এ চিত্র ইতিবাচক।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক হ জ র টন আমদ ন র ন আমদ ন য় আমদ ন মটর ড ল ল আমদ ন এস আলম য় হয় ছ এ বছর সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কৃতির ভুবন আলোকিত করে সন্জীদা খাতুনের বিদায়
আজীবন দেশের সংস্কৃতির ভুবন আলোকিত করার গুরুদায়িত্ব পালন করে বিদায় নিলেন সন্জীদা খাতুন। গতকাল মঙ্গলবার ৯২ বছর পূর্ণ করার কিছু আগে প্রয়াত হলেন দেশের এই অগ্রগণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। আগামী ৪ এপ্রিল তিনি ৯৩ বছরে পদার্পণ করতেন। জন্মদিনের পরিবর্তে সেদিনে হবে তাঁর স্মরণসভা।
রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বেলা ৩টা ১০ মিনিটে হৃৎস্পন্দন থেমে যায় সন্জীদা খাতুনের (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ ও পুত্রবধূ লাইসা আহমদ লিসা জানিয়েছেন, তাঁর হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ (হার্ট অ্যাটাক) হয়েছিল। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি সুস্থ ছিলেন না। তাঁর ছিল কিডনির জটিল রোগ। নিউমোনিয়াতেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। ১৯ মার্চ তাঁকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর নেওয়া হয় আইসিইউতে। অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি।
সন্জীদা খাতুনের বড় মেয়ে অপালা ফরহাদ নভেদ আগেই প্রয়াত। ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ আর মেয়ে রুচিরা তাবাসসুম নভেদসহ অনেক আত্মীয়স্বজন ও দেশ-বিদেশে অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন বহু গুণের অধিকারী অনাড়ম্বর জীবন যাপন করা এই মানুষটি। তাঁর ছেলেমেয়েরা জানিয়েছেন, মরদেহ রাতে হিমঘরে রাখা হবে।
সর্বজনের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় আনা হবে তাঁর হাতে গড়া দেশের অগ্রগণ্য সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানট সংস্কৃতি–ভবনে। সন্জীদা খাতুনের অনেক নাতি–নাতনি ও ঘনিষ্ঠ বহু আত্মীয় বিদেশে অবস্থান করছেন। তাঁরা শেষবিদায় জানাতে আসবেন। সে কারণে দাফনের দিনক্ষণ পরে ঠিক করা হবে। ৪ এপ্রিল সন্জীদা খাতুনের জন্মদিনে ছায়ানটে স্মরণসভা করার পরিকল্পনা করা হলেও সময় এখনো ঠিক হয়নি।
সন্জীদা খাতুনের কীর্তির ধারা বিচিত্র। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষক, গবেষক, শিল্পী, সংগীতজ্ঞ, সংগঠক ও সক্রিয় সাংস্কৃতিক নেত্রী। ছিলেন ছায়ানট ও রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সভাপতি। ব্যতিক্রমী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নালন্দার প্রতিষ্ঠাতা। জনসাধারণের সাংস্কৃতিক বোধের উন্নয়ন এবং মুক্ত–উদার মানবিক সমাজ নির্মাণের অবিরাম প্রচেষ্টাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পরে দেশের শিল্প–সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। আত্মীয়স্বজন ছাড়াও তাঁর সহযোদ্ধা, সহশিল্পী, ছাত্রছাত্রী ও গুণমুগ্ধরা শোকার্ত চিত্তে স্কয়ার হাসপাতালে ছুটে যান। অনেকেই ছিলেন অশ্রুসিক্ত।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক হাসপাতালে প্রথম আলোকে বললেন, তিনি দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন এবং জীবনকালটা মানুষের জন্য উজাড় করে দিয়েছেন। জনমানসে সংগীত, শিল্প, সাহিত্যের বোধ সৃষ্টি এবং এর সঙ্গে সামাজিক–সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতার বোধ সঞ্চার করে গেছেন। বিপুলভাবে তিনি বাঙালির জীবন সমৃদ্ধ করে তোলার কাজ করেছেন। তাঁর মতো দ্বিতীয় কেউ নেই।
রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সহসভাপতি ও শিল্পী বুলবুল ইসলাম বলেন, দেশে রবীন্দ্রসংগীতের প্রসার ও সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে ওয়াহিদুল হক, জামিল চৌধুরী ও সন্জীদা খাতুন—এই তিনজনের ভূমিকা পথিকৃতের মতো। তাঁরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক আন্দোলনের পথ সুগম করেছেন। দুজন আগেই প্রয়াত। এখন তৃতীয়জনও চলে গেলেন। নিজেকে অভিভাবকহীন মনে হচ্ছে।
ছায়ানটের তবলার শিক্ষক এনামুল হক ওমর বললেন, যে অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতায় তিনি সারা দেশের সাংস্কৃতিক কর্মী ও শিল্পীদের সংগঠিত করেছেন, ছায়ানটকে পরিচালনা করেছেন, তার তুলনা হয় না। তাঁর প্রয়াণ জাতির জন্য অপরিমেয় ক্ষতি।
সন্জীদা খাতুনের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে ছায়ানট, উদীচী, চারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন।
সন্জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল। তাঁর বাবা কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক। মা সাজেদা খাতুন গৃহিণী। সন্জীদা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৪ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক, ১৯৫৫ সালে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং ১৯৭৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু। দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই এতে জড়িয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতায় সংগঠিত করেন বাংলাদেশের শিল্পীদের। শিল্পী কামরুল হাসানের নেতৃত্বে সন্জীদা খাতুন ব্রতচারী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।
সন্জীদা খাতুনের প্রথম গানের গুরু ছিলেন সোহরাব হোসেন। তাঁর কাছে তিনি দীক্ষা নেন নজরুলসংগীত, আধুনিক বাংলা গান ও পল্লিগীতির। প্রথমে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছেন প্রখ্যাত হুসনে বানু খানমের কাছে। এরপর তালিম নেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার, আবদুল আহাদ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেনদের মতো বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীদের কাছ থেকে।
আইয়ুব খানের কঠোর শাসনকালে নানা বাধা অগ্রাহ্য করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনে তিনি ও সংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের ঐতিহ্যবাহী সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছায়ানটের যাত্রা শুরু। ১৯৬৭ সালে তাঁরা রমনার বটমূলে প্রথমবারের মতো বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখে আয়োজন করে প্রভাতি গানের আসর। ছায়ানটের এই অনুষ্ঠান থেকেই প্রাণিত হয়ে নববর্ষ উদ্যাপন এখন দেশজুড়ে বিপুল এক অসাম্প্রদায়িক উৎসব। ধর্মীয় উগ্রবাদীরা ছায়ানটের এই প্রভাতি গানের আসরে ২০০১ সালে ভয়াবহ বোমা হামলা চালালেও অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি।
এসব সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের বাইরে সন্জীদা খাতুনের গবেষণা ও রচনার কাজও কম নয়। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টির অধিক। রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ, কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, স্বাধীনতার অভিযাত্রা, সাহিত্য কথা সংস্কৃতি কথা, নজরুল মানস ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
সন্জীদা খাতুন দেশে একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। এ ছাড়া সম্মানিত হয়েছেন ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পদক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের দেশিকোত্তম পুরস্কার এবং কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রবীন্দ্র–তত্ত্বাচার্য উপাধিতে।