সংবিধান সংস্কারে গণপরিষদ গঠন করার কোনো প্রয়োজন নেই বলে মনে করে বিএনপি। দলটি বলেছে, আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা উচিত। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা হলে সংসদে সব আলোচনা হবে।

গতকাল রোববার দুপুরে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে সংস্কারের সুপারিশ নিয়ে লিখিতভাবে দলীয় মতামত জমা দেয় বিএনপি। পরে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের দলীয় এ অবস্থানের কথা তুলে ধরেন।

সংবিধানের প্রস্তাব পরিবর্তনে সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিরোধিতাও করেছে বিএনপি। দলটি বলেছে, সুপারিশে ১৯৭১ ও ২০২৪ সালকে এককাতারে আনা হয়েছে। এটি তারা সমুচিত বলে মনে করে না। রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তন করার প্রয়োজন আছে বলেও মনে করে না দলটি। বিএনপি বলেছে, যেভাবে সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন করার প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তেমন একটা ভূমিকা থাকবে না। এ ছাড়া নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হবে।

৬ মার্চ সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ স্প্রেডশিটে ছক আকারে দিয়ে দলগুলোর মতামত চেয়েছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ১৩ মার্চের মধ্যে তাদের মতামত দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল। বিএনপি মতামত দিতে অতিরিক্ত সময় চেয়ে নেয়। গতকাল বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের হাতে দলের মতামত জমা দেয়।

লিখিত মতামতের ভিত্তিতে দলগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা করছে কমিশন। বিএনপির সঙ্গে ঈদের পর আলোচনা হবে। দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি সনদ তৈরি করা হবে। এর ভিত্তিতে হবে আগামী নির্বাচন।

গতকাল মতামত জমা দেওয়ার পর সালাহ উদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের ২০টির মতো প্রস্তাবের মধ্যে বিএনপি ১১টিতে সরাসরি একমত। সাত-আটটিতে মন্তব্যসহ নীতিগতভাবে একমত। একটি প্রস্তাবে ভিন্নমত জানানো হয়েছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ২৬টি প্রস্তাবের মধ্যে প্রায় অর্ধেক বিষয়ে তাঁরা একমত, বাকি অর্ধেকের বিষয়ে তাঁদের মতামত আছে। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর বিষয়ে প্রায় সব ক্ষেত্রেই বিএনপি একমত পোষণ করেছে। তিনি বলেন, সংবিধান সংস্কার কমিনের সুপারিশের বিষয়ে বিএনপি নিজেদের মতামত তুলে ধরে স্প্রেডশিটের সঙ্গে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন সংযুক্ত করেছে।

সংস্কারের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের ছয়টি বিকল্প উপায় স্প্রেডশিটে উল্লেখ করেছিল ঐকমত্য কমিশন। প্রতিটি সুপারিশের বিষয়ে যেকোনো একটি উপায়ে টিক চিহ্ন দিতে বলা হয়েছিল। বিএনপি কোন উপায়ে সংবিধান সংশোধনের কথা বলেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘স্প্রেডশিটে দেওয়া অপশনগুলোর বিষয়ে মন্তব্য হলো, প্রথমেই লিডিং কোয়েশ্চন না করে আমাদের অপশন দিতে হবে, আমরা গণপরিষদে একমত কি না। তারপর গণপরিষদের মাধ্যমে বাস্তবায়নের প্রশ্ন আসবে।’

সংবিধান সংশোধনে গণপরিষদের প্রয়োজন আছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, একটি নতুন রাষ্ট্র গঠিত হলে, সেখানে সংবিধান প্রণয়ন করার জন্য গণপরিষদ প্রয়োজন হয়। সেই সংবিধানের ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচন হয়।

‘এখানে আমাদের কি রাষ্ট্র নতুন হয়েছে?’—এমন প্রশ্ন রেখে বিএনপির এই নেতা বলেন, বাংলাদেশ ৫৩-৫৪ বছরের পুরোনো রাষ্ট্র। একটা সংবিধান আছে। হয়তো সংবিধানের গণতান্ত্রিক চরিত্র নষ্ট হয়েছে। যে কারণে কাঠামোগুলো নতুন করে বিনির্মাণ করা দরকার। তিনি বলেন, যারা গণপরিষদ দাবি করছে, তারাও ৬৯টা দাবি দিয়েছে। বিএনপি আরও কম দাবি দিয়েছে। এগুলো আলোচনা করে একটা বৃহত্তর ঐকমত্যের ভিত্তিতে এসে ব্যাপক সংশোধিত সংবিধান পাওয়া যাবে। সে সংবিধানকে কেউ নতুন সংবিধান বলতে পারে, এখানে বিএনপির আপত্তি নেই।

সালাহ উদ্দিন আহমদ জানান, তাঁরা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের সুপারিশে একমত। তবে উচ্চকক্ষের সদস্য কীভাবে মনোনীত হবে, তা পরবর্তী সময়ে আলোচনা করে নির্ধারণ করা যাবে। নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০–তে উন্নীত করার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। তবে নারী আসনে সরাসরি ভোট নয় বিদ্যমান পদ্ধতিতে মনোনয়নের কথা বলেছে তারা।

প্রস্তাবনা সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ উল্লেখ করে সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা ‘স্প্রেডশিটে’ উল্লেখ করা হয়নি। এটি রাখা উচিত ছিল। সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধানের প্রস্তাবনা পুরোপুরি পরিবর্তন বা সংশোধনের প্রস্তাব করেছে। এটা অনেকটা পুনর্লিখনের মতো। সেখানে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের সঙ্গে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানকে এককাতারে আনা হয়েছে। এটা সমুচিত বলে বিএনপি মনে করে না। এটাকে অন্য জায়গায় রাখা বা সংবিধানের তফসিল অংশে রাখার বিভিন্ন রকম সুযোগ আছে। সেটা আলোচনা করে করা যাবে। পঞ্চদশ সংশোধনের আগের অবস্থায় যে প্রস্তাবনা ছিল, সেটির পক্ষে বিএনপি।

রাষ্ট্রের সাংবিধানিক নাম পরিবর্তনের বিষয়ে সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিনের প্র্যাকটিসের (চর্চা) মাধ্যমে রাষ্ট্রের নাম মেনে নিয়েছে। এটা নিয়ে কতটুকু কী অর্জন হবে, তা প্রশ্নের দাবি রাখে। এ বিষয়ে বিএনপি একমত নয়।

নির্বাহী, আইন ও বিচার—এই তিন বিভাগের বিষয়ে এবং কিছু কমিশন বিশেষ করে সাংবিধানিক কাউন্সিল করে কিছু অনির্বাচিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের যেসব এখতিয়ার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তাতে রাষ্ট্রের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তেমন একটা ভূমিকা থাকবে না। রাষ্ট্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হবে, এটা হচ্ছে সংবিধানের মূল চেতনা। সাংবিধানিক কাউন্সিল করা হলে, সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সালাহ উদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে বলে মনে করে বিএনপি। সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের ক্ষমতা, জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা ইসির হাতে থাকা উচিত বলে মনে করে বিএনপি। নির্বাচন কমিশনকে দায়বদ্ধ করার জন্য সংসদীয় কমিটির হাতে ক্ষমতা দেওয়ার যে প্রস্তাব করা হয়েছে, বিএনপি সেটির সঙ্গেও একমত নয়। এ ক্ষেত্রে তাঁদের মত হলো, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আছে, তারাই দায়বদ্ধ করতে পারে।

বিএনপি তাদের লিখিত মতামত জমা দেওয়ার সময় অধ্যাপক আলী রীয়াজের সঙ্গে কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার ও ইফতেখারুজ্জামান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার উপিস্থিত ছিলেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন র প রস ত ব র মত মত ব এনপ র দ র মত

এছাড়াও পড়ুন:

আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করতে হবে : নাহিদ

গত ১৬ বছর জুলুম–নির্যাতন ও গণহত্যা চালানো আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণার দাবি করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। 

তিনি বলেন, আমরা মানুষের প্রত্যাশা ও ভালোবাসা নিয়ে নতুন রাজনীতি করতে চাই, যা বাংলাদেশকে নতুনভাবে তৈরি করবে। এনসিপি তিনটি বিষয় নিয়ে কাজ করছে, তা হচ্ছে, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার, রাষ্ট্র ও সংবিধান সংস্কারের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন। নির্বাচনের আগে দৃশ্যমান বিচার নিশ্চিত করা আমাদের অন্যতম দাবি।

সোমবার নারায়ণগঞ্জ জেলা জাতীয় নাগরিক পার্টির ইফতার মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন। 

নাহিদ ইসলাম বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার প্রক্রিয়া চলছে, যা নিয়ে এনসিপি তাদের সুস্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করেছে। যেকোনো উপায়ে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করলে নাগরিক কমিটি তা প্রতিহত করবে। গত ১৬ বছর জুলুম-নির্যাতন ও জুলাই গণহত্যা চালানোর পর আওয়ামী লীগের দল হিসেবে বৈধতা থাকতে পারে না। এদের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।

এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, এ দেশের মানুষ চায় না জুলাই অভ্যুত্থানের পর পুরোনো রূপেই দেশের রাজনীতি চলুক। আমরা দেশের সংস্কার ও সংবিধান পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করে যাব। এই সংবিধান সংস্কারের জন্য গণপরিষদ নির্বাচন প্রয়োজন।

বিশেষ অতিথি যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, আমাদের অবশ্যই গণপরিষদ নির্বাচনে যেতে হবে। গণপরিষদ ছাড়া আর কোনো নির্বাচনের ম্যান্ডেট নাই। এই সংবিধান একটি প্রশ্নবিদ্ধ সংবিধান।

এই সংবিধান অভিশপ্ত সংবিধান। এখানে বেশির ভাগ মানুষের মতামতের জায়গা রাখা হয় নাই। এই সংবিধানে তরুণ প্রজন্মের লড়াই-সংগ্রামের কোনো ছিটেফোঁটা নাই। মোটাদাগে এই সংবিধান একদলীয় সংবিধান।

সামান্তা শারমিন বলেন, এই পার্লামেন্ট এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক পার্লামেন্ট ছিল। আমরা যদি তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতিতে আগ্রহী করতে চাই, তাহলে এখানে যে মাসল পাওয়ার পলিটিকস রয়েছে, তা পরিবর্তন করে দায়িত্বের রাজনীতি করতে হবে। এই দায়িত্ব শুধু এনসিপির নয়, কারণ, অভ্যুত্থান ছিল সব দলের অংশগ্রহণে। তাই এই দায়িত্ব সব দলকেই নিতে হবে।

সংগঠনের যুগ্ম সদস্যসচিব আব্দুল্লাহ আল আমিনের সভাপতিত্বে ও তামীম আহমেদের সঞ্চালনায় ইফতার মাহফিলে আরও উপস্থিত ছিলেন দক্ষিণ অঞ্চলের সংগঠক শওকত আলী, সদস্য আহমেদুর রহমান তনু প্রমুখ।  
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সিনেমা ছাড়া নিয়ে বর্ষার মন্তব্য, জবাব দিলেন দীপা খন্দকার
  • সিনেমা ছাড়া নিয়ে বর্ষার মন্তব্যের জবাব দিলেন দীপা খন্দকার
  • আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করতে হবে: নাহিদ ইসলাম
  • সংস্কার এজেন্ডা উচ্চাভিলাষী হলেও প্রয়োজনীয়: নাহিদ ইসলাম
  • আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করতে হবে : নাহিদ
  • বিএনপির চাওয়া সংসদ নির্বাচনই কি সংস্কার বাস্তবায়নের শ্রেষ্ঠ উপায়
  • গণপরিষদ নির্বাচন চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি
  • ঐকমত্য কমিশনের ১১৩ সুপারিশে একমত এনসিপি
  • ১৯৭১–এর সঙ্গে ২০২৪–কে এক কাতারে আনা সমুচিত মনে করে না বিএনপি