সংবাদমাধ্যম ব্যবসায় না জনসেবা, সেটা আগে ঠিক করতে হবে
Published: 23rd, March 2025 GMT
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক আফসান চৌধুরী অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় সাংবাদিকতার সঙ্গেও যুক্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি ঢাকা কুরিয়ার, দ্য ডেইলি স্টার ও বিবিসিতে কাজ করেছেন। সাহিত্যিক ও গবেষক হিসেবেও তিনি খ্যাতিমান। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। আফসান চৌধুরী ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের সহকারী সম্পাদক সাইফুর রহমান তপন।
সমকাল: অন্তর্বর্তী সরকার যে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল, তারা শনিবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এ বিষয়ে আপনার প্রাথমিক মন্তব্য জানতে চাই।
আফসান চৌধুরী: একটা ভালো উদ্যোগ। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে সংস্কারের প্রয়োজন মানুষ সবসময়ই অনুভব করে। এ প্রতিবেদন বাস্তবায়িত না হলে তো বটেই, হলেও এ প্রয়োজন থাকবে। আমি মনে করি, গণমাধ্যম কমিশন একটা কাঠামো দিয়েছে, কিছু সুপারিশ। এ সুপারিশগুলো নিয়ে এখন আলোচনা হোক– কোনটা বাস্তবায়নযোগ্য, কোনটা নয়। কোনটা করা যাবে, কোনটা করা যাবে না।
সমকাল: সংবাদমাধ্যম যে চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে কমিশনের প্রতিবেদনে?
আফসান চৌধুরী: একটা বড় সমস্যা হলো, আর্থিক যে শৃঙ্খলা থাকা দরকার, সংবাদমাধ্যমে সেটা নেই। আমাদের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, যারা সংবাদমাধ্যমে পুঁজি বিনিয়োগ করেন, তারা এটা আর্থিক লাভের জন্য করেন না। আমাদের দেশে যতগুলো বড় ব্যবসায় হাউস, তাদের সবারই কোনো না কোনো সংবাদমাধ্যম আছে। সেগুলো নিয়ে সমালোচনাও আছে। ২০০৬ সালে একটা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার জন্য সংবাদমাধ্যম-সংক্রান্ত একটা গবেষণা করেছিলাম আমি। সেখানে দেখা গেছে, যেসব ব্যবসায়ী বাজার থেকে ব্যবসায়ের মাধ্যমে পুঁজি সংগ্রহ করেছেন, তাদের মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যমে স্বাধীনতা বেশি। আর যারা সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করে পুঁজি সংগ্রহ করেছেন, তাদের সংবাদমাধ্যমে স্বাধীনতা কম। পেশাদারিত্বের প্রশ্নের প্রথমোক্ত সংবাদমাধ্যম এগিয়ে। আমার গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে– পিআইডি, প্রেস কাউন্সিল ইত্যাদি সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর সাংবাদিকদের আস্থা নেই। এমআরডিআইর গবেষণা বলছে, সংবাদমাধ্যমের ওপর মানুষের আস্থা কমছে। আমি দেখেছি, সাংবাদিকদের অনেকের নিজের পেশা সম্পর্কে ধারণা নেই। তারা মনে করেন, জনসেবা করছেন। এটা করতে গিয়ে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা গড়ে উঠছে। মালিকপক্ষও কর্মী-সাংবাদিকদের সুবিধা-অসুবিধা দেখেন না। ওয়োজবোর্ড বা অন্যান্য বিষয় না দেখে তারা তাদের করপোরেট সুবিধাটা দেখছেন। এসব কারণে অনেক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। যে কারণে আমাদের পারফরম্যান্স অপটিমাল হচ্ছে না। দক্ষতা বাড়ছে না। সংস্কার কমিশন এগুলোর কিছু কিছু ডিল করার চেষ্টা করেছে।
সমকাল: কমিশনের প্রতিবেদনে মালিকানার ধরন পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে।
আফসান চৌধুরী: কী রকম?
সমকাল: বলা হয়েছে, কোনো সংবাদমাধ্যমের মালিকানা একক ব্যক্তির হাতে থাকতে পারবে না। শেয়ার বিতরণের কথা বলা হয়েছে। যেমন ইংল্যান্ডের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, সেখানে কেউ কোনো সংবাদমাধ্যমের ২০ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক হতে পারেন না। আপনি কী মনে করেন?
আফসান চৌধুরী: আমার মনে করার কিছু নেই এখানে। আমার কথা হলো, এটা কি আইনি হবে, না বেআইনি?
সমকাল: এ নিয়ে আইন তৈরির সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোনো একক পরিবারের হাতে একটা সংবাদমাধ্যমের ২৫ শতাংশের বেশি শেয়ার থাকতে পারবে না।
আফসান চৌধুরী: কিন্তু এ আইন কি বাস্তবায়ন করা যাবে? এ ধরনের আইন করতে হলে সংবিধানে তো তার ভিত্তি থাকতে হবে। সাংবাদিকদের শেয়ার দেওয়ার বিষয়টার আইনগত ভিত্তিও দেখতে হবে। তবে বাংলাদেশে যেখানে পাঁচজন মালিক মিলে একটা ব্যবসা চালাতে পারেন না, সেখানে তারা পত্রিকা চালাবেন কীভাবে? তখন তো সবাইকে হয় আওয়ামী লীগপন্থি বা বিএনপিপন্থি হতে হবে। এ পন্থিদের মধ্যেই তো ঝগড়া লাগবে।
সমকাল: কমিশন সংবাদমাধ্যমের মালিকানা কেন্দ্রীভূত না হওয়ার জন্য এ সুপারিশ করেছে।
আফসান চৌধুরী: কিন্তু এ ধরনের বিনিয়োগে কি কোনো মালিক উৎসাহিত হবেন? এ বিনিয়োগ নিয়ে কী করবেন তিনি? প্রতিষ্ঠানও কি ভালোভাবে চলতে পারবে? একটা সংবাদমাধ্যম চালাতে যে পরিমাণ টাকা দরকার, সেই টাকাটা মার্কেট থেকে তোলা যাবে কিনা, সেটা ভাবতে হবে। আমি মনে করি, যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, একটা সংবাদমাধ্যম আইন মেনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিনা; যিনি মালিক হচ্ছেন তিনি আইন মেনে তা হচ্ছেন কিনা; প্রতিষ্ঠানটি তিনি আইন মেনে চালাচ্ছেন কিনা। একটা প্রতিষ্ঠান ভালোভাবে চালাতে গেলে কর্মীদের বেতন-ভাতা ঠিকমতো দিতে হবে; রিপোর্টিংয়ের জন্য ঠিকমতো খরচ জোগাতে হবে; সম্পাদকের চাহিদা মেটাতে হবে। এগুলো মেনে চলে মালিক দেখবেন, তার মুনাফা হচ্ছে কিনা। সমস্যা হলো, আমাদের ভোক্তারাও সংবাদমাধ্যমকে একটা মুনাফাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাবেন না। মালিকরাও সেভাবে চিন্তা করেন না। বাজারের ওপর নির্ভরশীল হলে সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপনও আসবে। বিজ্ঞাপন এলে প্রতিষ্ঠানটি চলতে পারবে। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না।
সমকাল: কমিশন সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতা নিয়ে একটা সুপারিশ করেছে। তারা একজন সাংবাদিকের চাকরির শুরুতে সরকারি চাকরির প্রথম শ্রেণির বেতন দেওয়ার সুপারিশ করেছে।
আফসান চৌধুরী: আমি তো মনে করি, এর চেয়ে বেশি হওয়া উচিত। যেমন, আমি তো এর চেয়ে বেশি দিয়ে শুরু করেছিলাম। তবে আমার ৫১ বছরের পেশাগত জীবনে ঠিকমতো বেতন পাইনি, এমন বহু প্রতিষ্ঠান ছিল। এ দীর্ঘ সময়ে আমি যত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছি; বিবিসি ছাড়া খুব সংবাদমাধ্যমেই বলা যেত– বেতন ৭ তারিখে হবে, না ২৫ তারিখে হবে, নাকি হবেই না।
সমকাল: সরকার ঘোষিত ওয়েজবোর্ড তো বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম মানে না।
আফসান চৌধুরী: মানবে কী করে? মালিক বলবে, আমার টাকা নেই। কিছু বলার নেই এ নিয়ে। কারণ এটাকে তো কেউই ব্যবসা হিসেবে নেয়নি। অন্যদিকে সংবাদকর্মীরাও বেশির ভাগ এটাকে পেশা হিসেবে নিচ্ছে না। যারা এ পেশায় আসছে তাদের বেশির ভাগ স্বল্পকালীন পেশা হিসেবে নিচ্ছে। আরেকটা হলো, ঢাকায় যারা পা রাখতে পারছে না, তারাই সাধারণত এতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। তার মানে, ঢাকার বাইরের লোকেরা হয়তো সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিচ্ছে। আমি একটা প্রতিষ্ঠানের কথা জানি। যেখানে ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়নের চাপ থাকায় সবাইকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়। তাদের পরিবর্তে নতুন লোক নেওয়া হয় যাদের ওয়োজবোর্ড অনুযায়ী বেতন দিতে হবে না। কমিশন সুপারিশ দিতে পারে, কিন্তু আমি নিশ্চিত না– সেটা বাস্তবায়িত হবে কিনা। দেখুন, আমাদের দেশে চার-পাঁচটা ফ্রিজ কোম্পানি আছে। নতুন কাউকে আপনি বললেন ফ্রিজ কোম্পানি খুলতে; তিনি রাজি হবেন? না। কারণ তিনি ভালো করেই জানেন, তার লাভ হবে না। কিন্তু পত্রিকা নিয়ে এমনটা ভাবেন না কেন মালিকরা।
সমকাল: সাংবাদিক হতে হলে স্নাতক ডিগ্রি লাগবে– এটাকে কীভাবে দেখেন আপনি?
আফসান চৌধুরী: আমি পত্রিকায় দেখেছি এ সুপারিশটা। কিন্তু এটা কখনও হতে পারে? আমার সাংবিধানিক অধিকার এতে খর্ব হবে না? বিবিসিতেও তো এ নিয়ম নেই। সাংবাদিকতা করতে পারাই সাংবাদিক হওয়ার যোগ্যতা। এটা আমি মনে করি। এখানে স্নাতক হওয়ার দরকার নেই। তবে এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা হওয়া উচিত। ঢাকার বাইরে যারা সাংবাদিকতা করেন তাদের তো খুবই খারাপ অবস্থা। তাদের দেখভাল করারও কেউ নেই। তাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা না করে বলে দিলেই হলো, স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে এসো সাংবাদিকতা করার জন্য?
সমকাল: সাংবাদিকরা যে এখন শ্রম আইনের অধীনে আছে, এ নিয়েও আছে বিতর্ক। একটা আলাদা আইন প্রয়োজন, এমন কথা বলছেন অনেকে। আপনার মত কী?
আফসান চৌধুরী: আমার সঙ্গে কমিশনের একজনের কথা হয়েছিল। তারা শ্রম আইনের পাশাপাশি পৃথক একটা আইনের কথা ভাবছিলেন, যার সঙ্গে প্রচলিত শ্রম আইনের বিরোধ হলে ওই আইনটিই প্রাধান্য পাবে। এমন আইনের সুপারিশ কি করা হয়েছে?
সমকাল: কমিশন প্রতিবেদনের সঙ্গে দুটি আইনের খসড়াও জমা দিয়েছে বলে জানানো হয়েছে। একটি হলো গণমাধ্যম কমিশন আইন, আরেকটি সাংবাদিকতা সুরক্ষা আইন।
আফসান চৌধুরী: এখানে গণমাধ্যম কমিশন প্রতিষ্ঠা এবং সাংবাদিকতার সুরক্ষা আইন– দুটিই গুরুত্বপূর্ণ। তবে আগে তো ঠিক করতে হবে, সংবাদমাধ্যম কি ব্যবসা, না সেবার জন্য। কেউ যদি বলেন, এটা জনসেবার জন্য তিনি করছেন। তাহলে এর জন্য কত টাকা খরচ করবেন; এ জনসেবার উদ্দেশ্য কী; এসব বিষয়ে আগে সুরাহা করতে হবে। গণমাধ্যম কমিশন কিন্তু এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। অথচ এটাই মৌলিক বিষয় যে, সংবাদমাধ্যম চালানো যদি ব্যবসা হয়, তাহলে ব্যবসার নিয়মনীতি প্রযোজ্য হবে। আর জনসেবা হলে সেবা খাতের নিয়মনীতি এখানে কার্যকর হবে। সাংবাদিক বা সম্পাদক বা মালিক বিএ পাস হবে, না এমএ পাস হবে– এগুলো তো পরের বিষয়। আগে হলো এ খাতের চরিত্র নির্ধারণ। কিন্তু সেটা কমিশনের প্রতিবেদনে করা হয়েছে বলে আমি জানি না।
সমকাল: কমিশন বিদ্যমান শ্রম আইন ও ১৯৭৩ সালের নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (কন্ডিশন্স অব সার্ভিসেস অ্যাক্ট)-এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নও দাবি করেছে।
আফসান চৌধুরী: আমি যতটুকু জানি, বিদ্যমান শ্রম আইন সাংবাদিকদের অধিকার বাস্তবায়নে যথেষ্ট। তার আগে ঠিক করতে হবে, শুরুতে যেমনটা বলেছি, সংবাদমাধ্যম ব্যবসায়, না জনসেবার জন্য চালু করা হবে।
সমকাল: এখানে কেউ কেউ শুধু সংবাদমাধ্যমের জন্য আলাদা কমিশন গঠনের পক্ষে। আপনার মত কী?
আফসান চৌধুরী: শুধু সংবাদমাধ্যমের জন্য একটা কমিশন থাকতে পারে, আমিও তা মনে করি। পত্রিকায় যতটুকু পড়লাম, কমিশন সরকারের মালিকানাধীন সংবাদমাধ্যম এক ধরনের মালিকানায় নেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছে। আর বেসরকারি খাতের সব ধরনের গণমাধ্যমের জন্য একটা কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছে। সেটা হয়তো একটা আম্ব্রেলা প্রতিষ্ঠান হবে। কিন্তু এখন তো ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম হলো সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী খাত। আমি জানি না, কমিশন এ নিয়ে গবেষণা করেছে কিনা। তারা জরিপ করেছে শুনেছি। কিন্তু ডিজিটাল মিডিয়া চলছে একেবারেই নিজের মতো। সামাজিক মাধ্যমভিত্তিক মিডিয়াগুলো কোনো নিয়মেরই মধ্যে চলছে না। সামনের দিনে এ মিডিয়াই আধিপত্য চালাবে। এগুলোকে কীভাবে রেগুলেট করা হবে, আমি জানি না।
সমকাল: ওয়েজবোর্ড কার্যকর হচ্ছে কিনা, সেটাও তো গণমাধ্যম কমিশন দেখবে; তাই না?
আফসান চৌধুরী: তাই তো হওয়ার কথা। কিন্তু ওয়েজবোর্ডটা বাস্তবায়নযোগ্য কিনা, সেটাও তো দেখতে হবে। এটা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
সমকাল: আপনি বলতে চাচ্ছেন, ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন না করেও কোনো সংবাদমাধ্যম থাকতে পারে?
আফসান চৌধুরী: এমনটা তো হতেই পারে। কেউ ঘোষণা দিল– আমি একটা সংবাদমাধ্যম চালাব, যেখানে কেউ কাজ করলে এই সুযোগ-সুবিধা পাবে। এই নিয়ম মেনে কেউ সেখানে কাজ করতে চাইলে আপনি বাধা দেবেন কীভাবে? যেমন আমি একটা লিটল ম্যাগাজিন চালাই; যেটার জন্য কাউকে কিছু দিই না, নিজেও নিই না। এটা করার সুযোগ থাকতে হবে।
সমকাল: সাংবাদিকতার স্বাধীনতা নিয়ে কিছু বলবেন?
আফসান চৌধুরী: আমি এ জন্যও সংবাদমাধ্যমের জন্য পৃথক কমিশন চাই। সাংবাদিকতার মান ধরের রাখার দায় শুধু সাংবাদিকের নয়। এখানে মালিকেরও দায় আছে। আমাকে স্বাধীনতা দিলে আমি যে কোনো কিছু লিখতে পারি। কিন্তু সেটা কি আছে? আমি বিপদে পড়লে মালিক আমার পাশে দাঁড়াবে, তার নিশ্চয়তা কই? গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন নিশ্চয় সাংবাদিকদের জন্য কোড অব এথিকসের কথা বলেছে। একই বিষয় মালিকদের জন্য দরকার। প্রতিষ্ঠানকেও তা মানতে হবে। এখানে পেশাগত কোডও দরকার। কোনটাকে খবর বলব, কোনটাকে খবর বলব না– তা ঠিক করতে হবে।
সমকাল: শেষ কথা হিসেবে কিছু বলবেন?
আফসান চৌধুরী: আমরা খুব ক্রান্তিকাল পার হচ্ছি। গোটা সংবাদমাধ্যমের সামনে সামাজিক মাধ্যম যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে, তা মোকাবিলা সহজ নয়। গোটা বিশ্বের জন্যই তা প্রযোজ্য। এ প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো সম্পর্কে আমার মন্তব্য হলো, সূচনা হিসেবে মন্দ নয়। কিছু একটা তো শুরু হয়েছে। চলুক না আলোচনা।
সমকাল: ধন্যবাদ আপনাকে।
আফসান চৌধুরী: সমকালকেও ধন্যবাদ।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স প র শ কর ছ আফস ন চ ধ র স ব ধ নত ব র জন য র জন য ক ব দ কত র ব যবস য় ঠ ক করত আম দ র জনস ব আইন র ধরন র হওয় র সরক র সমক ল দরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তাঁরা চান আগামী নির্বাচনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক। এ জন্য নির্বাচন কমিশন সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।
মহান স্বাধীনতা দিবস ও পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আজ মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা এ কথা বলেন। তাঁর এই ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার সরাসরি সম্প্রচার করেছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ব্যাপক উৎসাহ, উদ্দীপনায় নির্বাচনের জন্য তৈরি হতে শুরু করবে বলে তিনি আশা করছেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম পর্ব সফলভাবে সমাপ্ত হয়েছে। প্রথম পর্বের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হলো। তিনি বলেন, ‘সব সময় মনে রাখতে হবে, আমরা কিন্তু যুদ্ধাবস্থায় আছি। “গুজব” হলো এই জুলাই অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে পরাজিত শক্তির মস্ত বড় হাতিয়ার। গুজব দেখলেই গুজবের সূত্রের সন্ধান করতে থাকবেন। গুজবকে অবহেলা করবেন না। বহু অভিজ্ঞ সমরবিশারদ এই গুজবের পেছনে দিনরাত কাজ করছে, সীমাহীন অর্থ এর পেছনে নিয়োজিত আছে। এর মূল লক্ষ্য জুলাই অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করা। আমরা তাকে ব্যর্থ হতে দেব না।’
সামগ্রিক ঐক্য পলাতক শক্তির গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে মন্তব্য করে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘তারা এই ঐক্য ভাঙতে চায়। তাদের অভিনব কৌশল আপনি টেরই পাবেন না। আপনি বুঝতেই পারছেন না কখন তাদের খেলায় আপনি পুতুল হয়ে গেছেন। আমাদের সচেতনতা এবং সামগ্রিক ঐক্য দিয়েই এই গুজবকে রুখতে হবে। পলাতক অপশক্তির ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিতে হবে।’
‘অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরেছে’
ভাষণে সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে জোরালো ব্যবস্থা নিয়েছে। রমজান ও ঈদে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল জিনিসপত্রের দামের লাগাম টেনে ধরা ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা। এ রমজানে যাতে কোনো পণ্যের দাম বেড়ে না যায় এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ যেন বিঘ্নিত না হয়, সে জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে। রমজান মাসজুড়ে সরবরাহ চেইনের প্রতিবন্ধকতা কঠোরভাবে প্রতিহত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দেশের সব জায়গা থেকে খবর এসেছে, এই রমজানে দ্রব্যমূল্য আগের তুলনায় কমেছে; জনগণ স্বস্তি পেয়েছে। দাম নিয়ন্ত্রণে এই প্রচেষ্টা চলমান থাকবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘গত ১৬ বছরে শেখ হাসিনা যে ভয়াবহ লুটপাট কায়েম করেছিলেন, আপনারা সেটির ভুক্তভোগী ছিলেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে তারা পালিয়ে যাওয়ার সময় এক লন্ডভন্ড অর্থনীতি রেখে গেছে। এই পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরেছে, ক্রমান্বয়ে অর্থনীতির অপরাপর সূচকগুলো ইতিবাচক ধারায় ফিরতে শুরু করছে। এ সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি। ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৩২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে, যা ২২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। আগামী জুন মাসের মধ্যে এটি ৮ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে আশা করছি।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, দেশের ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিতে স্বস্তি এনে দিয়েছে প্রবাসী ভাই-বোনেরা। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ রেকর্ড গড়েছে, প্রায় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে আড়াই বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। রেমিট্যান্স–যোদ্ধারা দেশের অর্থনীতি গড়ার বীর সৈনিক। তাঁদের জন্য প্রক্রিয়াগত যেসব বিষয় রয়েছে, সেগুলো সহজ করে দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। তাঁরা যেন ভোগান্তির শিকার না হন, দূতাবাস যেন ঠিকমতো কাজ করে, এটি নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আগামী নির্বাচনে যেন তাঁদের ভোটাধিকার দিতে দেওয়া যায়, সে জন্য কাজ করা হচ্ছে।
পলাতক সরকারের আমলে চর দখলের মতো দেশের ব্যাংকগুলো দখল করে নেওয়া হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, আমানতকারীর টাকাকে তারা নিজেদের ব্যক্তিগত টাকায় রূপান্তর করে ফেলেছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম কাজ ছিল ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা ফিরিয়ে আনা, আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষা করে নিয়মশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা, হিসাবপত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা স্থাপন করা। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা প্রতিষ্ঠা করা গেছে। এর ফলে অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের অর্জনগুলোর মধ্যে এটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গত সরকারের লুটপাটের মহোৎসবে গত ১৫ বছরে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। কত রকমভাবে পাচার হয়েছে, তা–ও জানার বিষয়। অভিনব একেকটা পদ্ধতি ছিল। এই অর্থ পাচারকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শীর্ষস্থানীয় বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করে যাচ্ছে। তারা বাংলাদেশের বর্তমান ব্যবস্থায় বিনিয়োগের বিষয়ে খুবই আগ্রহী। আশা করা হচ্ছে, দ্রুততম সময়ে দেশে নতুন নতুন বিদেশি বিনিয়োগ দেখা যাবে।
আগামীকাল চার দিনের সফরে চীনে যাচ্ছেন উল্লেখ করে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে আমার বৈঠক হবে। চীনের বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সিইওদের সঙ্গেও বৈঠক করব। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ চায়নিজ সোলার প্যানেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লংজি বাংলাদেশে কারখানা স্থাপনের আগ্রহ জানিয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে কাজ করছি। এ ছাড়া প্রযুক্তিগত সহায়তা, মেডিকেল সহায়তা, স্বল্প মূল্যে চিকিৎসাসহ অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা হবে। তারা আমাদের দেশ থেকে আম, কাঁঠাল ও পেয়ারা আমদানি করতে চায়। এটা খুব দ্রুতই শুরু হবে। এই সফরের মধ্য দিয়ে আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হবে।’
বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান—দক্ষিণ এশিয়ার এই চারটি দেশ মিলে একটি যৌথ অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারলে চার দেশই লাভবান হবে বলে ভাষণে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
‘বড় সমস্যা দুর্নীতি’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা সীমাহীন দুর্নীতি। স্বৈরাচারী সরকার এই দুর্নীতিকে বিশ্বের শীর্ষ স্থানে নিয়ে গেছে। দুর্নীতির ফলে শুধু যে সবকিছুতে অবিশ্বাস্য রকম ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা–ই না, এর ফলে সরকার ও জনগণের সব আয়োজন বিকৃত হয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘পুরো বিশ্ব বুঝে গেছে, আমরা জাতি হিসেবে সততার পরিচয় বহন করি না। এটা শুধু জাতীয় কলঙ্কের বিষয় নয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এটা আত্মঘাতী বিষয়। দেশবাসীর মতো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও চায় আমরা দুর্নীতিমুক্ত হই; কারণ, তারা আমাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে চায়। দুর্নীতিমুক্ত হতে না পারলে ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুই চলবে না। দুর্নীতি থেকে মুক্ত হওয়া ছাড়া বাংলাদেশের কোনো গতি নেই।’
অন্তর্বর্তী সরকার সব কাজ দুর্নীতিমুক্ত করতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ভাষণে তিনি বলেন, বিগত সরকারের আমলে ভিন্নমতকে দমন করার জন্য মিথ্যা মামলাকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন পর্যায়ে যাচাই–বাছাই করে এসব হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় করা রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলাগুলোর মধ্যে সারা দেশে এ পর্যন্ত ৬ হাজার ২৯৫টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে। অন্য সব হয়রানিমূলক মামলাও ক্রমান্বয়ে প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া এ পর্যন্ত সাইবার নিরাপত্তা আইনের অধীনে বিচারাধীন স্পিচ অফেনস (মতাপ্রকাশ) সংক্রান্ত ৪১৩টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ আইন অবিলম্বে বাতিল করে নাগরিক বান্ধব সাইবার সুরক্ষা আইন করা হচ্ছে।
সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, রাজস্ব সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুসারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর জায়গায় দুটি পৃথক বিভাগ করা হচ্ছে। একটি হলো নীতি প্রণয়ন বিভাগ বা জাতীয় রাজস্ব নীতি বোর্ড, অন্যটি বাস্তবায়ন বিভাগ বা জাতীয় রাজস্ব সংগ্রহ বিভাগ। এর ফলে সরকারের পছন্দের ব্যক্তিরা হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ আর পাবে না। তাঁর আশা, পরবর্তীতে যাঁরা সরকারে আসবেন, তাঁরাও এই নীতি বহাল রাখবেন।
স্টারলিংকের সঙ্গে তিন মাসের মধ্যে বাণিজ্যিক চুক্তি
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনারা শুনেছেন, আমি স্টারলিংকের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বের শীর্ষ ধনকুবের স্পেসএক্স ও টেসলার মালিক ইলন মাস্কের সঙ্গে ফোনে আলাপ করে বাংলাদেশে স্টারলিংকের কার্যক্রম শুরু করার আহ্বান জানিয়েছি। সে অনুসারে, কোম্পানির প্রতিনিধিরা এখন বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরুর আয়োজন করছে। তাদের সঙ্গে তিন মাসের মধ্যে বাণিজ্যিক চুক্তি চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। স্টারলিংকের মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে উচ্চগতির ইন্টারনেট বাংলাদেশের ডিজিটাল জগতে একটি বিপ্লব আনবে।’
হত্যাকারীদের বিচার হবেই
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশ সফরের প্রসঙ্গ টেনে অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশের প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে আগামী সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একটি পৃথক অধিবেশন আয়োজন করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পতিত স্বৈরাচারের নিপীড়নের বর্ণনা উঠে এসেছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের প্রতিবেদনে। জাতিসংঘের রিপোর্ট পড়ে সবার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। কী ভয়াবহতা! কীভাবে একজন প্রধানমন্ত্রী নিজ দেশের নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার পর লাশ লুকিয়ে ফেলার নির্দেশ দিতে পারেন! ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য তিনি পৃথিবীর সব নিষ্ঠুরতা ছাড়িয়ে গেছেন—এটাই জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে যে সুপারিশ করা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার সে সুপারিশগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। তিনি বলেন, ‘আপনাদের আশ্বস্ত করে বলতে চাই, যারা গণহত্যায় জড়িত ছিল, যারা নির্বিচার মানুষ হত্যা করেছে, যারা ইতিমধ্যে হত্যাকারী হিসেবে বিশ্বের কাছে স্বীকৃত, তাদের বিচার এ দেশের মাটিতে হবেই।’
জুলাই সনদ হবে
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ইতিমধ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের কাজ শুরু করেছে। ৬টি সংস্কার কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশ ও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনসহ ৩৮টি রাজনৈতিক দলের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো খুবই ইতিবাচকভাবে সংস্কারকাজে সাড়া দিয়েছে, তাদের মতামত তুলে ধরছে। কোনো রাজনৈতিক দল কোন কোন সংস্কার প্রস্তাবে একমত হয়েছে, কোনটিতে দ্বিমত হয়েছে—সেসব তারা জানাচ্ছে। এটা জাতির জন্য অত্যন্ত সুখকর বিষয় যে প্রতিটি রাজনৈতিক দল সংস্কারের পক্ষে মত দিচ্ছে।
ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দলের মতামত নেওয়ার কাজ এখন চলমান উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কমিশনের লক্ষ্য হচ্ছে যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে, সেগুলো চিহ্নিত করা এবং তার একটি তালিকা প্রস্তুত করা। যেসব দল এতে একমত হয়েছে, তাদের স্বাক্ষর নেওয়া। এ তালিকাই হবে জুলাই চার্টার বা জুলাই সনদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব, জাতির সামনে পুরো প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছভাবে তুলে ধরা এবং প্রক্রিয়া শেষে নির্বাচনের আয়োজন করা।’
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের পটভূমি বদলে দিয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘জুলাইয়ের পর নারীদের অবস্থান ইতিবাচকভাবে পরিবর্তন হবে, সেটাই আমরা চাই। আমরা বাংলাদেশ নিয়ে নতুন করে ভাবতে চাই। আর এই নতুন ভাবনায় নারীদের অবস্থান উচ্চতম পর্যায়ে অগ্রাধিকার পাক, সেটাই আমরা চাই। নারীর প্রতি বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা, নারীকে খাটো করে রাখার প্রবৃত্তি যারা ধারণ করে, তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, নারী অধিকারের পাশাপাশি একই রকম গুরুত্বের সঙ্গে মনে রাখতে হবে সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকার। সমতল ও পাহাড়ের জাতিগোষ্ঠীর নাগরিক অধিকার। কারও কোনো নাগরিক অধিকারকে অবহেলা করলেই এ জাতির জন্য মহাসংকট সৃষ্টি করবে। নাগরিক হিসেবে কেউ যেন অন্য নাগরিকের অধিকার হরণের দায়ে অভিযুক্ত হতে না পারেন, সে ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে হবে। তাহলেই সত্যিকার নতুন বাংলাদেশ জন্মলাভ করবে।