ছাত্র রাজনীতি: গণতন্ত্রের স্তম্ভ, নাকি ক্ষমতার হাতিয়ার?
Published: 23rd, March 2025 GMT
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্র রাজনীতি একসময় পরিবর্তনের চালিকাশক্তি ছিল। প্রতিটি ঐতিহাসিক গণআন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ছাত্র রাজনীতি আদর্শবাদিতা থেকে সরে এসে ক্রমশ দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বর্তমানে এটি শুধু মূলধারার রাজনৈতিক দলের তরুণ শাখায় পরিণত হয়েছে, যেখানে আদর্শের চেয়ে ব্যক্তি ও দলের প্রতি আনুগত্য বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ফলে সহিংসতা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের দমিয়ে রাখার প্রবণতা বাড়ছে।
স্বাধীনতার আগে ও পরে ছাত্র রাজনীতির চরিত্র ভিন্ন ছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিল। এসব আন্দোলন ছিল ন্যায্য দাবির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এবং ছাত্রদের মধ্যে নৈতিকতা ও আদর্শিক চেতনা বজায় ছিল। কিন্তু নব্বই- পরবর্তী ছাত্র রাজনীতি ক্রমশ দলীয়করণের ফাঁদে আটকে যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য দেখা যায়, যেখানে বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠনগুলো প্রায় নিষ্ক্রিয় থাকে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে মুক্তচিন্তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং রাজনীতিতে অংশগ্রহণ মানেই ক্ষমতার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন হয়ে দাঁড়ায়। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান এই দলীয় রাজনীতির আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক বড় ধাক্কা দিয়েছে। এই অভ্যুত্থানে তরুণ প্রজন্ম ও শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো ছিল, যা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়– তারা প্রচলিত দলীয় রাজনীতির বাইরে নতুন বিকল্প খুঁজছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এই পরিবর্তন কি স্থায়ী হবে? নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কেমন হবে? কিংবা কীভাবে ছাত্র রাজনীতি পুনর্গঠন করা যায়?
বর্তমানে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি মানেই ক্ষমতার দখল ও নিয়ন্ত্রণ। ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রধান লক্ষ্য হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থ রক্ষা এবং বিরোধীদের দমন করা। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহিংসতা বেড়েছে, মুক্ত চিন্তার জায়গা সংকুচিত হয়েছে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দলীয় আনুগত্যকেই এখন নেতৃত্বের যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেখানে মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষার্থীরা নেতৃত্বে আসার সুযোগ পায় না। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এটি মূলত তরুণদের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি গণজাগরণ ছিল, যেখানে প্রচলিত দলীয় রাজনীতির প্রতি আস্থাহীনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। এতে স্পষ্ট হয়েছে, তরুণরা পরিবর্তন চায় এবং প্রচলিত রাজনৈতিক কাঠামোর বাইরে একটি নতুন ধারা খুঁজছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের ছাত্র রাজনীতির দিকে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে এটি অনেকটাই ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতি মূলত শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষায় কাজ করে, যেখানে দলীয় রাজনীতির সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নেই। ভারতে ছাত্র রাজনীতি বাংলাদেশের মতোই দলীয়কেন্দ্রিক হলেও সেখানে গণতান্ত্রিক চর্চা বেশ সক্রিয় এবং শিক্ষার্থীরা সরাসরি তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে। সেসব দেশে ছাত্র ইউনিয়ন ও ক্লাবগুলো শিক্ষার্থীদের একাডেমিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। চীনে ছাত্র রাজনীতি কার্যত নিষিদ্ধ। শুধু কমিউনিস্ট পার্টির অনুমোদিত সংগঠনগুলো কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। অন্যদিকে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি এখন দলীয় স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, যেখানে নীতিভিত্তিক রাজনীতি অনুপস্থিত। ফলে এটি শিক্ষার্থীদের কল্যাণের পরিবর্তে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ক্ষমতা রক্ষার কাজে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশে যদি ছাত্র রাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনা যায়, তবে এটি গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্তিশালী করবে। এ জন্য কয়েকটি কাঠামোগত পরিবর্তন জরুরি। প্রথমত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতির প্রভাব কমিয়ে স্বাধীন ছাত্র সংগঠনের বিকাশ ঘটাতে হবে। দ্বিতীয়ত, নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন পুনরায় চালু করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা সরাসরি তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারে। তৃতীয়ত, সহিংস রাজনীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে ছাত্র সংগঠন সত্যিকার অর্থে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে।
গণতন্ত্রের বিকাশে শক্তিশালী ছাত্র রাজনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এটি যদি শুধু দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হয়, তবে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব দুর্বল ও স্বার্থান্বেষী হয়ে উঠবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গণআকাঙ্ক্ষা ম্লান হয়ে যাবে।
’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে গণমানুষের অংশগ্রহণ মূলত আমাদের দেখিয়েছে, জনগণ প্রচলিত রাজনৈতিক কাঠামোর ওপর আর আস্থা রাখে না। এটি যদি দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিক সংস্কারের সূচনা করতে পারে, তবে ছাত্র রাজনীতির নতুন ধারা তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। এখন সময় এসেছে ছাত্র রাজনীতি পুনর্গঠন এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক চর্চা উদ্বুদ্ধকরণের, যেন তা নিশ্চিত হয়। দলীয় লেজুড়বৃত্তির পরিবর্তে নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্বই হতে পারে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গঠনের ভিত্তি।
শাহরিয়ার মোহাম্মদ ইয়ামিন: যুগ্ম সদস্য সচিব,
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র গণঅভ য ত থ ন ছ ত র র জন ত ছ ত র স গঠন র র জন ত ক র জন ত র প রচল ত ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই বিপ্লবের স্বপ্ন বাস্তবায়নে গণতন্ত্রে ফিরতে হবে: গিয়াস উদ্দিন
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছেন, “জুলাই বিপ্লবে শহীদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে নির্বাচনের মাধ্যমে অবশ্যই গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের যে সম্ভাবনার কথা বলেছেন সেটিকে নির্বাচনের রোডম্যাপ ধরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে।”
রবিবার (১৩ এপ্রিল) চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিয়মকালে এসব কথা বলেন তিনি।
গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, “প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন দিতে হবে। এই সংস্কারের ভিত্তি হতে পারে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী। কারণ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সংবিধানে যে মূলনীতি স্থাপন করেছেন তা নিয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই।”
আরো পড়ুন:
মহিষ লুট: কুষ্টিয়ায় বিএনপি নেতাসহ ১১ জন কারাগারে
দলের কেউ লুটপাট করলে ছাড় নয়: আযম খান
তিনি বলেন, “মহান স্বাধীনতার ঘোষণার অনেক কিছুই ৭২এর সংবিধানে রাখা হয়নি। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্র হত্যাসহ মানুষের বাকস্বাধীনতার কবর রচনা করা হয়েছিল। ‘৭৫ এর পট পরিবর্তন এবং সিপাহী জনতার বিপ্লবের পর শহীদ জিয়া পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্র, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্তা ও বিশ্বাস স্থাপনসহ যে মূলনীতি স্থাপন করেন তা নিয়ে কারো কোন দ্বিমত নেই। সুতরাং, ওই মূলনীতি ধরেই সংস্কার এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রশংসা করে বিএনপির এই নেতা বলেন, “এই সরকার যেসব ভালো কাজ করছে, ক্ষমতায় আসলে বিএনপি তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সরকারের এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। মেধা পাচারের বদনাম গুছিয়ে বর্তমান সরকার মেধাবীদের দেশে ফিরিয়ে এনে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব দিচ্ছে, তারা ভালো করছেন। বিএনপি এটি মনে রাখবে।”
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের পক্ষে ন্যায্য কথাই বলেছেন তিনি (মুহাম্মদ ইউনূস)। চীনে প্রধান উপদেষ্টাকে যে সম্মান দেওয়া হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের মর্যাদা বেড়েছে।”
দেশের মানুষ গণতন্ত্রে ফিরতে চায় উল্লেখ করে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, “অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনে যে সম্ভাব্য সময় বলেছেন সেটাই রোডম্যাপ। আর কারা কি বললেন, সেটা দেখার প্রয়োজন নেই। কিছু জরুরি সংস্কার শেষ করে সরকারকে নির্বাচন দিতে হবে। এটাই জনগণের প্রত্যাশা।”
হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে যারা জীবন দিয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন তাদের স্বপ্ন পূরণে বিএনপি কাজ করবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তাদের (শহীদ) ত্যাগ বৃথা যেতে দেওয়া হবে না। আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে যে জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে তা অটুট থাকবে। শনিবার ঢাকায় ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচিতে লাখো মানুষের ঢল এটাই প্রমাণ করে। আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য আছে, কিন্তু দেশের প্রশ্নে, অখণ্ডতার প্রশ্নে আমরা এককাতারে আসতে পারি, তা আবারো প্রমাণিত হয়েছে। এটা আধিপত্যবাদী শক্তির জন্য একটি চূড়ান্ত বার্তা।”
চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের অন্তর্বর্তী কমিটির সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচির সভাপতিত্বে সভায় সিএমইউজে সভাপতি মোহাম্মদ শাহনওয়াজ, সাধারণ সম্পাদক সালেহ নোমান, প্রেস ক্লাবের অন্তর্বর্তী কমিটির সদস্য মুস্তফা নঈম, গোলাম মাওলা মুরাদ, স্থায়ী সদস্য মইনুদ্দিন কাদেরী শওকত, রফিকুল ইসলাম সেলিম, সোহাগ কুমার বিশ্বাস বক্তব্য রাখেন।
ঢাকা/রেজাউল/মাসুদ