ভোট হবে ঘড়ি ধরে: ২০৮৯ সালের নভেম্বরের ৪ তারিখে!
Published: 23rd, March 2025 GMT
প্রথম আলোতে প্রকাশিত দুটি লেখার সূত্র ধরে এ লেখা। রাজনৈতিক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘গণতন্ত্রে ফিরতে চাইলে নির্বাচন ছাড়া পথ কী।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমরা বলছি, বহুদলীয় সংসদীয় সরকারব্যবস্থার কথা, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের প্রতিযোগী হবে।’
সম্প্রতি আমার একটা লেখা প্রকাশ পেয়েছে—‘বিএনপির সামনে সুযোগ অনেক, কিন্তু.
এই বিষয়গুলো তোলার কারণ হলো, মহিউদ্দিন যেমন বলেছেন, গণতন্ত্র চাইলে নির্বাচন হবে, বিকল্প নেই। আবার নির্বাচনে বিভিন্ন দল প্রতিযোগিতা করবে—বড় দল, ছোট দল, বলিষ্ঠ দল, দুর্বল দল এ ধরনের অনেকেই। নেতাদের মধ্যেও আবার থাকবে অনেক হেরফের—কেউ উচ্চশিক্ষিত, কেউ বকলম, কেউ বিএ পাস, কেউবা এমএ। নেতা হয়তো খুবই জনপ্রিয়। কারণ, তাঁর বাবা একটা জনপ্রিয় দল গড়ে মারা যাওয়ার আগে দলের চাবিটা তাঁর হাতে তুলে দিয়েছেন। কেউ হয়তো নিজেই গড়ে তুলেছেন জনপ্রিয় দল।
নেতাদের ভিন্ন ভিন্ন রসায়ন থাকবে। যখন নির্বাচন হবে, জনগণই বেছে নেবে কে যোগ্য কে তুখোড় কে বুদ্ধিমান আর কোন দল প্রস্তুত দেশ চালানোর জন্য। আর প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করবে দলের শক্তি, দুর্বলতা ও কৌশল। যিনি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁর যোগ্যতাও শক্তির একটা পরিমাপ। আবার আপনি–আমি যাঁকে যোগ্য ভাবছি, দেশের জনগণ তাঁকে যোগ্য না–ও ভাবতে পারে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যদি জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে এই তিনটা প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, জাতি তার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবে। ২০৮৯ সালের নভেম্বরের ৪ তারিখে আমাদের উত্তরসূরিরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচনে ভোট দেবে, এই অঙ্গীকার নিয়ে যদি আমাদের নেতারা এখন থেকেই কাজ করতে পারেন, আমাদের জনগণের জন্য এর চেয়ে আনন্দের কিছু নেই।যুক্তরাষ্ট্রের দুটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কথাই ধরুন। ১৯৮০ সালের নির্বাচনে রোনাল্ড রিগ্যান দাঁড়ালেন প্রেসিডেন্ট কার্টারের বিরুদ্ধে। রিগ্যান ডিকসন নামের এক অখ্যাত কলেজের কোনোরকমে পাস করা ছাত্র। তিনি পরবর্তী সময়ে হলিউডের তৃতীয় শ্রেণির চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেন আর রেডিওতে খেলাধুলার ধারাবিবরণী দিতেন। তিনি হারিয়ে দিলেন কার্টারকে। প্রেসিডেন্ট হয়ে তাঁর কাজ ও কীর্তি তাঁর নামকে উজ্জ্বল করল, হয়ে গেলেন তিনি আমেরিকার ডানপন্থীদের চোখের মণি। তাঁর সময়ের ‘রেগানোমিক্স’ এখনো রিপাবলিকান পাটির অর্থনৈতিক বাইবেল। অপর দিকে ইরাক যুদ্ধখ্যাত জর্জ ডব্লিউ বুশ আরেক মধ্যমানের প্রার্থী, যিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির তুখোড়-স্মার্ট প্রার্থী আল গোরকে হারিয়ে। বুশ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ডুবিয়ে ইতিহাসে তাঁর অবমূল্যায়ন চিরস্থায়ী করলেন। নেতাদের সফলতা ও বিফলতার কোনো সুচারু নির্ধারক নেই, আমরা শুধু আন্দাজ করতে পারি। নেতা যাঁরাই হোন, প্রক্রিয়া বসে থাকবে না বা প্রক্রিয়াকে জোর করে আটকানো যাবে না। তবে কিছু শৃঙ্খলা রাখতেই হবে প্রক্রিয়ায়।
সংস্কার এখন আমাদের বড় রাজনৈতিক ভাবনা। ছোট সংস্কার, বড় সংস্কার, আবার আছে ফরাসিদের থেকে শেখা দ্বিতীয় রিপাবলিক—এসব নিয়ে বাগ্বিতণ্ডায় হয়তো চলে যাবে আরও এক বছর। মূল সংস্কার হবে কবে? আপাতত সংস্কারের বই বন্ধ রেখে আমরা কিছু শৃঙ্খলার কথা ভাবতে পারি, হয়তো এ শৃঙ্খলার মাধ্যমে আসবে সবার আকাঙ্ক্ষিত সংস্কার। এই শৃঙ্খলাগুলো হতে পারে—
১. প্রতি চার বছর পর ঘড়ি ধরে নির্বাচন হবে, নভেম্বরের ৪ তারিখ। ঝড়, বৃষ্টি, রোদ, জাতীয় ইমার্জেন্সি—কোনো বাহানা নেই, ২০২৫ সালের ৪ নভেম্বরে নির্বাচন হবে, তার পরেরটা ২০২৯ সালের ৪ নভেম্বরে—এভাবে ২০৮৯ সালের নভেম্বরের ৪ তারিখে একটা নির্বাচন অবশ্যই হবে। দেশ এখন একমত, সব নির্বাচন হবে একটা নিরপেক্ষ সরকারের অধীন।
আমাদের দলগুলোর যাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন, তাঁদের থেকে আমরা একজন প্রধানমন্ত্রী পাব। ধরুন, যিনি দেশের নেতা হয়ে এলেন, দেখা গেল জনগণ ভোটের সময় যেমন ভাবছিল, তিনি তেমন নন। দক্ষতা ও কাজে খাটো। দেশে যে রকম আশা করা হয়েছিল, তেমন কিছু হচ্ছে না। কোনো ভাবনা নেই। এ নিয়ে হরতাল বা পদত্যাগের দাবিরও প্রয়োজন নেই। তিনি তো থাকবেন মাত্র চার বছর। এর মধ্যে কী আর এমন হবে? ট্রাম্পের কথাই ধরুন, দুনিয়া ওলট–পালট করে দিচ্ছেন। তাই তো সবাই ভাবছে, আর মাত্র ৩ বছর ৯ মাস তো বাকি! এরপর আবার নির্বাচন হবে, নতুন নেতা আসবেন, হয়তো তিনি হবেন খুব তুখোড়, বিবেচক ও বুদ্ধিমান।
একটা ছোট্ট গল্প মনে পড়ল। ছেলে বিএ ফেল করেছে। বাবা বাড়িতে এসে দারুণ চিৎকার–বিৎকার করছেন। ছেলের মা শান্তভাবে বললেন, ‘তুমি এমন করছ কেন? সামনের বছর ছেলে আবার পরীক্ষা দেবে, তখন পাস পেয়ে যাবে।’ সামনের বছর ছেলে আবারও ফেল করল। বাবার আবারও চিৎকার–চেঁচামেচি, হুলুস্থুল কাণ্ড! ছেলের মা একই কথা বলে সান্ত্বনা দিলেন, আরও বললেন, ‘এত রাগারাগি করলে ছেলেটা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে, আর কোনো দিনই পাস হবে না।’ তৃতীয়বার ছেলে আবার পরীক্ষা দিল, সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করল। মা-বাবা দুজনেই খুশি। বিশৃঙ্খলা না করে পদ্ধতিটার পুনরাবৃত্তি করতে হবে। এই পুনরাবৃত্তির মধ্যেই সংশোধন হবে, সংস্কার হবে এবং সফলতা আসবে, ঠিক যেভাবে ছেলেটা পাস করে ফেলল।
গল্প থেকে আবার প্রক্রিয়াতেই ফিরে যাই। যে নেতা স্মার্ট, পরপর দুবার নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁকে নিয়ে যদি সারা জীবন ঝুলে থাকতে হয়, সেটাও ভালো নয়। একজন নেতা মাত্র পরপর দুবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। অন্যরা তখন সুযোগ পাবেন, হয়তো পরেরজন হবেন প্রথম জনের চেয়ে আরও তুখোড় ও উদ্ভাবনী ব্যক্তি। খারাপ হলেও ক্ষতি নেই, চারটা তো বছর, সেটা আগেই বলেছি। এই পুনরাবৃত্তির পদ্ধতিটা অনেক দেশেই আছে, নতুন কিছু নয়। যেটা নতুন, তা হলো আমাদের দেশেও প্রয়োজন এর চর্চা করা।
২. নির্বাচন শুধু সময় অনুযায়ী পুনরাবৃত্তি করলেই চলবে না। নির্বাচন হতে হবে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য। নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা থাকবে ত্রুটিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের।
৩. আর লাগবে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা। যেকোনো নির্বাচনী অনিয়মের প্রতিকার হবে স্বাধীন বিচারব্যবস্থায়।
এই তিনটা পদ্ধতিকে শৃঙ্খলা বা সংস্কার বা সাধারণ বুদ্ধিসম্মত কার্যক্রম যে যা–ই বলুন না কেন, কিছু যায় আসে না। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যদি জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে এই তিনটা প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, জাতি তার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবে। ২০৮৯ সালের নভেম্বরের ৪ তারিখে আমাদের উত্তরসূরিরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচনে ভোট দেবে, এই অঙ্গীকার নিয়ে যদি আমাদের নেতারা এখন থেকেই কাজ করতে পারেন, আমাদের জনগণের জন্য এর চেয়ে আনন্দের কিছু নেই।
সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত ক ব এনপ র আম দ র র জন য র বছর
এছাড়াও পড়ুন:
ভোট হবে ঘড়ি ধরে: ২০৮৯ সালের নভেম্বরের ৪ তারিখে!
প্রথম আলোতে প্রকাশিত দুটি লেখার সূত্র ধরে এ লেখা। রাজনৈতিক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘গণতন্ত্রে ফিরতে চাইলে নির্বাচন ছাড়া পথ কী।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমরা বলছি, বহুদলীয় সংসদীয় সরকারব্যবস্থার কথা, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের প্রতিযোগী হবে।’
সম্প্রতি আমার একটা লেখা প্রকাশ পেয়েছে—‘বিএনপির সামনে সুযোগ অনেক, কিন্তু...’। লেখাটাকে অনেকে অনেকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। একজন পাঠক লিখেছেন , ‘শুধু স্তুতি গাইলেন। দেশ চালাতে লাগে প্রজ্ঞা, যেটা তারেকের নাই।’ বিএনপির বেশ কিছ সমর্থক আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ই–মেইল পাঠিয়েছেন, বিএনপিকে ‘সমর্থন’ করার জন্য। আমার একজন বন্ধু আমার ওপর তেড়ে এসে বললেন, ‘তুমি যে এত সুনাম গাইলে, বিএনপিতে কি তুখোড় বুদ্ধির নেতা আছে যে দেশ চালাতে পারবে?’ আমি আমার বন্ধুকে বললাম, ‘তুমি আমার লেখাটা ভুলভাবে পড়েছ। আমি বলেছি, বড় দল হিসেবে বিএনপির সুযোগ আছে। আর আমি বিএনপি নেতাদের সামর্থ, বুদ্ধি বা তাদের দলের নীতি দেশের জন্য ভালো বা খারাপ—এসব নিয়ে কোনো আলোচনাই করিনি। আমি শুধু তাদের সাংগঠনিক দিকগুলো নিয়ে কথা বলেছি—বিএনপির শক্তি, দুর্বলতা, কৌশল ও ভবিষ্যৎ নিয়ে। দলের পরিপক্বতা নিয়ে কথা বলেছি, দলের নেতাদের পরিপক্বতা নিয়ে কিছু বলিনি।’ বন্ধু লেখাটি আরেকবার পড়লেন এবং লজ্জার হাসি হেসে আমার সঙ্গে একমত হলেন।
এই বিষয়গুলো তোলার কারণ হলো, মহিউদ্দিন যেমন বলেছেন, গণতন্ত্র চাইলে নির্বাচন হবে, বিকল্প নেই। আবার নির্বাচনে বিভিন্ন দল প্রতিযোগিতা করবে—বড় দল, ছোট দল, বলিষ্ঠ দল, দুর্বল দল এ ধরনের অনেকেই। নেতাদের মধ্যেও আবার থাকবে অনেক হেরফের—কেউ উচ্চশিক্ষিত, কেউ বকলম, কেউ বিএ পাস, কেউবা এমএ। নেতা হয়তো খুবই জনপ্রিয়। কারণ, তাঁর বাবা একটা জনপ্রিয় দল গড়ে মারা যাওয়ার আগে দলের চাবিটা তাঁর হাতে তুলে দিয়েছেন। কেউ হয়তো নিজেই গড়ে তুলেছেন জনপ্রিয় দল।
নেতাদের ভিন্ন ভিন্ন রসায়ন থাকবে। যখন নির্বাচন হবে, জনগণই বেছে নেবে কে যোগ্য কে তুখোড় কে বুদ্ধিমান আর কোন দল প্রস্তুত দেশ চালানোর জন্য। আর প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করবে দলের শক্তি, দুর্বলতা ও কৌশল। যিনি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁর যোগ্যতাও শক্তির একটা পরিমাপ। আবার আপনি–আমি যাঁকে যোগ্য ভাবছি, দেশের জনগণ তাঁকে যোগ্য না–ও ভাবতে পারে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যদি জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে এই তিনটা প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, জাতি তার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবে। ২০৮৯ সালের নভেম্বরের ৪ তারিখে আমাদের উত্তরসূরিরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচনে ভোট দেবে, এই অঙ্গীকার নিয়ে যদি আমাদের নেতারা এখন থেকেই কাজ করতে পারেন, আমাদের জনগণের জন্য এর চেয়ে আনন্দের কিছু নেই।যুক্তরাষ্ট্রের দুটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কথাই ধরুন। ১৯৮০ সালের নির্বাচনে রোনাল্ড রিগ্যান দাঁড়ালেন প্রেসিডেন্ট কার্টারের বিরুদ্ধে। রিগ্যান ডিকসন নামের এক অখ্যাত কলেজের কোনোরকমে পাস করা ছাত্র। তিনি পরবর্তী সময়ে হলিউডের তৃতীয় শ্রেণির চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেন আর রেডিওতে খেলাধুলার ধারাবিবরণী দিতেন। তিনি হারিয়ে দিলেন কার্টারকে। প্রেসিডেন্ট হয়ে তাঁর কাজ ও কীর্তি তাঁর নামকে উজ্জ্বল করল, হয়ে গেলেন তিনি আমেরিকার ডানপন্থীদের চোখের মণি। তাঁর সময়ের ‘রেগানোমিক্স’ এখনো রিপাবলিকান পাটির অর্থনৈতিক বাইবেল। অপর দিকে ইরাক যুদ্ধখ্যাত জর্জ ডব্লিউ বুশ আরেক মধ্যমানের প্রার্থী, যিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির তুখোড়-স্মার্ট প্রার্থী আল গোরকে হারিয়ে। বুশ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ডুবিয়ে ইতিহাসে তাঁর অবমূল্যায়ন চিরস্থায়ী করলেন। নেতাদের সফলতা ও বিফলতার কোনো সুচারু নির্ধারক নেই, আমরা শুধু আন্দাজ করতে পারি। নেতা যাঁরাই হোন, প্রক্রিয়া বসে থাকবে না বা প্রক্রিয়াকে জোর করে আটকানো যাবে না। তবে কিছু শৃঙ্খলা রাখতেই হবে প্রক্রিয়ায়।
সংস্কার এখন আমাদের বড় রাজনৈতিক ভাবনা। ছোট সংস্কার, বড় সংস্কার, আবার আছে ফরাসিদের থেকে শেখা দ্বিতীয় রিপাবলিক—এসব নিয়ে বাগ্বিতণ্ডায় হয়তো চলে যাবে আরও এক বছর। মূল সংস্কার হবে কবে? আপাতত সংস্কারের বই বন্ধ রেখে আমরা কিছু শৃঙ্খলার কথা ভাবতে পারি, হয়তো এ শৃঙ্খলার মাধ্যমে আসবে সবার আকাঙ্ক্ষিত সংস্কার। এই শৃঙ্খলাগুলো হতে পারে—
১. প্রতি চার বছর পর ঘড়ি ধরে নির্বাচন হবে, নভেম্বরের ৪ তারিখ। ঝড়, বৃষ্টি, রোদ, জাতীয় ইমার্জেন্সি—কোনো বাহানা নেই, ২০২৫ সালের ৪ নভেম্বরে নির্বাচন হবে, তার পরেরটা ২০২৯ সালের ৪ নভেম্বরে—এভাবে ২০৮৯ সালের নভেম্বরের ৪ তারিখে একটা নির্বাচন অবশ্যই হবে। দেশ এখন একমত, সব নির্বাচন হবে একটা নিরপেক্ষ সরকারের অধীন।
আমাদের দলগুলোর যাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন, তাঁদের থেকে আমরা একজন প্রধানমন্ত্রী পাব। ধরুন, যিনি দেশের নেতা হয়ে এলেন, দেখা গেল জনগণ ভোটের সময় যেমন ভাবছিল, তিনি তেমন নন। দক্ষতা ও কাজে খাটো। দেশে যে রকম আশা করা হয়েছিল, তেমন কিছু হচ্ছে না। কোনো ভাবনা নেই। এ নিয়ে হরতাল বা পদত্যাগের দাবিরও প্রয়োজন নেই। তিনি তো থাকবেন মাত্র চার বছর। এর মধ্যে কী আর এমন হবে? ট্রাম্পের কথাই ধরুন, দুনিয়া ওলট–পালট করে দিচ্ছেন। তাই তো সবাই ভাবছে, আর মাত্র ৩ বছর ৯ মাস তো বাকি! এরপর আবার নির্বাচন হবে, নতুন নেতা আসবেন, হয়তো তিনি হবেন খুব তুখোড়, বিবেচক ও বুদ্ধিমান।
একটা ছোট্ট গল্প মনে পড়ল। ছেলে বিএ ফেল করেছে। বাবা বাড়িতে এসে দারুণ চিৎকার–বিৎকার করছেন। ছেলের মা শান্তভাবে বললেন, ‘তুমি এমন করছ কেন? সামনের বছর ছেলে আবার পরীক্ষা দেবে, তখন পাস পেয়ে যাবে।’ সামনের বছর ছেলে আবারও ফেল করল। বাবার আবারও চিৎকার–চেঁচামেচি, হুলুস্থুল কাণ্ড! ছেলের মা একই কথা বলে সান্ত্বনা দিলেন, আরও বললেন, ‘এত রাগারাগি করলে ছেলেটা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে, আর কোনো দিনই পাস হবে না।’ তৃতীয়বার ছেলে আবার পরীক্ষা দিল, সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করল। মা-বাবা দুজনেই খুশি। বিশৃঙ্খলা না করে পদ্ধতিটার পুনরাবৃত্তি করতে হবে। এই পুনরাবৃত্তির মধ্যেই সংশোধন হবে, সংস্কার হবে এবং সফলতা আসবে, ঠিক যেভাবে ছেলেটা পাস করে ফেলল।
গল্প থেকে আবার প্রক্রিয়াতেই ফিরে যাই। যে নেতা স্মার্ট, পরপর দুবার নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁকে নিয়ে যদি সারা জীবন ঝুলে থাকতে হয়, সেটাও ভালো নয়। একজন নেতা মাত্র পরপর দুবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। অন্যরা তখন সুযোগ পাবেন, হয়তো পরেরজন হবেন প্রথম জনের চেয়ে আরও তুখোড় ও উদ্ভাবনী ব্যক্তি। খারাপ হলেও ক্ষতি নেই, চারটা তো বছর, সেটা আগেই বলেছি। এই পুনরাবৃত্তির পদ্ধতিটা অনেক দেশেই আছে, নতুন কিছু নয়। যেটা নতুন, তা হলো আমাদের দেশেও প্রয়োজন এর চর্চা করা।
২. নির্বাচন শুধু সময় অনুযায়ী পুনরাবৃত্তি করলেই চলবে না। নির্বাচন হতে হবে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য। নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা থাকবে ত্রুটিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের।
৩. আর লাগবে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা। যেকোনো নির্বাচনী অনিয়মের প্রতিকার হবে স্বাধীন বিচারব্যবস্থায়।
এই তিনটা পদ্ধতিকে শৃঙ্খলা বা সংস্কার বা সাধারণ বুদ্ধিসম্মত কার্যক্রম যে যা–ই বলুন না কেন, কিছু যায় আসে না। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যদি জাতীয় সংলাপের মাধ্যমে এই তিনটা প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, জাতি তার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবে। ২০৮৯ সালের নভেম্বরের ৪ তারিখে আমাদের উত্তরসূরিরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচনে ভোট দেবে, এই অঙ্গীকার নিয়ে যদি আমাদের নেতারা এখন থেকেই কাজ করতে পারেন, আমাদের জনগণের জন্য এর চেয়ে আনন্দের কিছু নেই।
সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]