ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে দুই দলের ব্যবধান খুবই পরিষ্কার। ভারত ১২৬তম, বাংলাদেশ ১৮৫তম। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের চেয়ে ৫০ ধাপের বেশি এগিয়ে থাকা ভারত আগামী মঙ্গলবার এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে এগিয়ে থেকেই মাঠে নামবে। তবে একটি দলের শক্তি সামর্থ্য ফুটে ওঠে আরও যেসব মানদণ্ডে, তাতে ভারতের দাপট কিন্তু একচ্ছত্র নয়।

আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা, তারুণ্যের সমাহারে বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই। এমনকি ট্রান্সফার মার্কেটে খেলোয়াড়দের বাজারমূল্যের যে হিসাব, তাতেও এগিয়ে বাংলাদেশই। যদিও এক হামজা চৌধুরীই পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন।

একটি ফুটবল ম্যাচের স্কোয়াড ২৩ জনের হলেও বাংলাদেশ কোচ হাভিয়ের কাবরেররা ভারতে নিয়ে গেছেন ২৪ জন। একইভাবে ভারত কোচ মানোলো মার্কেজও দলে রেখেছেন ২৫ জন। দুই দলের বাড়তি খেলোয়াড়দের নিয়ে হিসাব করলে ট্রান্সফারমার্কেটে যে বাজারমূল্য দাঁড়ায়, তাতে স্পষ্ট ব্যবধানে এগিয়ে বাংলাদেশ।

কাবরেরার দলের ২৪ খেলোয়াড়ের বাজারমূল্য দাঁড়ায় ৮৬ লাখ ২৫ হাজার মার্কিন ডলার। এর মধ্যে শেফিল্ড ইউনাইটেডে খেলা হামজার একাই প্রায় ৪৯ লাখ ডলার।

এক হামজা চৌধুরীর বাজারমূল্য বাংলাদেশ দলের বাকি সবার মূল্যের চেয়ে বেশি।.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

রাজনীতিতে অস্থিরতা তৈরির পেছনে কী

গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ সম্ভবত সবচেয়ে জটিল ও কঠিন সময় পার করছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার বা সেনাবাহিনী নিয়ে প্রচারিত ও প্রকাশিত নানা মন্তব্য ও মতামত দেশে অস্থিরতার পরিবেশ তৈরি করেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান মতপ্রকাশের বন্ধ দরজার অর্গল ভেঙে দিয়েছে। বর্তমান মুক্ত পরিবেশে সত্য, অসত্য, উদ্দেশ্যমূলক বা বিভ্রান্তিকর—     কোনো মত বা তথ্যের প্রকাশ ঠেকানোর সুযোগ নেই। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা নানা মত-পথের ব্লগার ও ইউটিউবাররা নাহয় এর সুযোগ নিলেন কিন্তু দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা পক্ষও যদি উত্তেজনা তৈরি ও বিভ্রান্তি ছড়াতে ভূমিকা রাখে, তবে তা বিশেষ উদ্বেগের বিষয়।

দেশ এখন যে অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা তৈরির পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে নতুন গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহর একটি ফেসবুক মন্তব্য। তিনি দাবি করেছেন, ১১ মার্চ সেনানিবাসে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগের ‘রিফাইন্ড’ অংশকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের জন্য তাঁদেরকে চাপ দেওয়া হয়েছে এবং তা পুরোপুরি ভারতের পরিকল্পনা। আসন সমঝোতার বিনিময়ে তাঁদেরকে এই প্রস্তাব মেনে নিতে বলা হয়।

ঘটনার ১০ দিন পর ২১ মার্চ তিনি এই ফেসবুক পোস্ট দেন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার একটি বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার পর। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে ড. ইউনূস বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের পরিকল্পনা সরকারের নেই। হাসনাত তাঁর পোস্টে বলেছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে কোনো ধরনের আপস করার সুযোগ নেই। সঙ্গে যুক্ত করেছেন, ‘জুলাইয়ের দিনগুলোতে জনগণের স্রোতে ক্যান্টনমেন্ট আর এজেন্সির সকল প্রেসক্রিপশন আমরা উড়িয়ে দিয়েছিলাম। আজ আবারও যদি আপনাদের সমর্থন পাই, রাজপথে আপনাদের পাশে পাই, তবে আবারও এই আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের ভারতীয় ষড়যন্ত্রও আমরা উড়িয়ে দিতে পারব।’

এ ধরনের মন্তব্যের যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ্যে, অপ্রকাশ্যে ও জনমনে হওয়ার কথা, তা-ই হয়েছে। হাসানাতের দল এনসিপি দ্রুততার সঙ্গে তাঁর পক্ষ নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনেও করেছে। সেখানে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের নিন্দা করা হয়। লিখিত বক্তব্যে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মন্তব্য করেছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। আমরা তাঁর এ বক্তব্যের নিন্দা জানাই।’

প্রায় একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারে ছাত্রদের প্রতিনিধি উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার আগে রেকর্ড করা ভিডিওর একটি অংশও ফেসবুকে শেয়ার করেন হাসনাত আবদুল্লাহ। সেখানে আসিফ মাহমুদ এটা স্পষ্ট করেন যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার ব্যাপারে সেনাপ্রধানের আপত্তি ছিল।

হাসনাতের বক্তব্য নিয়ে সেনাবাহিনীর বক্তব্য কী—তা নিয়ে জনমনে কৌতূহল ছিল। সুইডেনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজ জানতে চাইলে সেনা সদর এক বিবৃতিতে হাসনাতের দাবিকে ‘অত্যন্ত হাস্যকর ও অপরিপক্ব গল্পের সম্ভার’ হিসেবে বর্ণনা করে। তারা সেনানিবাসে ১১ মার্চের বৈঠকের বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছে। হাসনাত আবদুল্লাহ না বললেও সেনা সদর বলেছে, সেনানিবাসে খোদ সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গেই ১১ মার্চ বৈঠকটি হয়েছিল। তবে হাসনাত আবদুল্লাহকে ‘ডেকে নিয়ে যাওয়া’ এবং ‘আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন’ বিষয়ে তাঁদেরকে প্রস্তাব বা চাপ প্রয়োগের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, হাসনাত আবদুল্লাহ ও তাঁর দলের আরেক মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলমের আগ্রহেই ওই বৈঠকটি হয়েছিল।

ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। এরপর সেই বৈঠকে উপস্থিত সারজিস আলমের কাছ থেকে যে ভাষ্য পাওয়া গেছে, হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্য বা অবস্থানের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই তার মিল নেই। হাসনাতের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে সারজিস বলেছেন, ‘যেভাবে এই কথাগুলো ফেসবুকে স্ট্যাটাসের মাধ্যমে এসেছে, এই প্রক্রিয়াটি আমার সমীচীন মনে হয়নি বরং এর ফলে পরবর্তীতে যেকোনো স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আস্থার সংকটে পড়তে পারে।’

কোনো বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থান আইনকানুন, নিয়ম বা সংবিধান মেনে হয় না। বাংলাদেশের ৫ আগস্টের পরিবর্তনও তাই। বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থানের পরের ঘটনাপ্রবাহও নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম মেনে চলে না। বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে ছাত্রদের নেতৃত্বে নানা মত ও পথের রাজনৈতিক শক্তির অংশগ্রহণে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে নানা আলোচনা ও তৎপরতার মধ্য দিয়েই একটি সমঝোতায় আসতে হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় নানা মত এসেছে, বিরোধিতা এসেছে। বাস্তবতা বিবেচনায় কোনো পক্ষ ছাড় দিয়েছে, কেউ নমনীয় হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত ঐকমত্যের ভিত্তিতেই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার গত সাড়ে সাত মাস ভালোভাবে দেশ পরিচালনা করতে পেরেছে এমন বলা যাচ্ছে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে অদক্ষতা, সিদ্ধান্তহীনতা বা কিছু বিষয়ে জোরালো অবস্থান গ্রহণে ব্যর্থতার দিকই স্পষ্ট হয়েছে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি নতুন কিছু নয়। গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকেই এই দাবি বিভিন্ন পক্ষ থেকে উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই ইস্যুতে হঠাৎ কেন মাঠ গরম হয়ে উঠল? নাকি গরম করা হলো? অন্তর্বর্তী সরকার গঠনপ্রক্রিয়ায় কে কাকে পছন্দ বা অপছন্দ করেছেন, সেই পুরোনো প্রসঙ্গই-বা কেন সামনে আনা হলো? অথবা ছাত্রদের নতুন দলটি বা তাদের দলের কেউ কেন সেনাপ্রধানকে প্রতিপক্ষ বানাতে চাইল? কোনো পক্ষ কি পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটাচ্ছে? এতে আসলে কার লাভ?

রোববার হয়ে উঠেছিল গুজবের রাত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাতভর এর চর্চা হয়েছে। গতকাল সকালে সেনা সদরে সেনাবাহিনী প্রধানের ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ নিয়েও শুরু হয় নানা জল্পনা-কল্পনা। সেনা সূত্র একে রুটিন বৈঠক বললেও সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই যে সেনাপ্রধানকে এই বৈঠকটি করতে হয়েছে, সেটা পরিষ্কার।

আগেই বলেছি, নেতৃত্বে ছাত্ররা থাকলেও গণ-অভ্যুত্থানের অনেক পক্ষ ছিল। সেই পক্ষগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ৫ আগস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে ৮ আগস্ট। মাঝের তিন দিন দেশে কোন সরকার কাজ করেছে? এ সময় কাদের ওপর ভরসা ছিল জনগণের? দেশের সেই সংকটময় সময়ে ছাত্রনেতৃত্ব, রাজনৈতিক শক্তি ও সেনাবাহিনী নানা তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে মিলেমিশে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানকে তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। সেই পর্বে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে নানা মতপার্থক্য স্বাভাবিক। এসব আলোচনায় অনেক সংবেদনশীল বিষয় থাকে, যা প্রকাশ করা যায় না। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য ছাড়া তো এই বিষয়গুলোকে এখন সামনে আনার কথা নয়।

ছাত্ররা নতুন দল করেছেন, আবার তাঁদের প্রতিনিধিরা এখনো সরকারে আছেন। মানে তাঁরা সরকারে আছেন, আবার সরকারের বাইরেও আছেন। যাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের বাইরে, তাঁরা না হয় সরকারের সমালোচনা করতে পারেন। তাঁদের দল এনসিপি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা নিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের অবস্থানের নিন্দাও করতে পারে (যদিও অনেকে মনে করেন, ‘কিংস পার্টির’ বদনাম ঘোচাতেই তারা এই কৌশল নিয়েছে)। কিন্তু যাঁরা সরকারে আছেন, তাঁরাও তো কোনো সীমা মানছেন বলে মনে হয় না।

ফেসবুকে হাসনাত ও সারজিসের বক্তব্য নিয়ে তাঁদের দল এনসিপিতে অস্বস্তি ও অসন্তোষের কথা আমরা সংবাদমাধ্যম সূত্রে জেনেছি। দলটির মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এরই মধ্যে হাসনাতের পোস্টটিকে ‘শিষ্টাচারবর্জিত’ বলে মন্তব্য করেছেন। অন্য এক সমাবেশে তিনি কোনো ক্ষেত্রে ভুল হয়ে থাকলে তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।

গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররা দল গঠন করেছেন, এটা আশাব্যঞ্জক ঘটনা। কিন্তু তাঁরা সম্ভবত এটা বুঝে উঠতে পারেননি যে আন্দোলন আর রাজনৈতিক দল গঠন করে দল পরিচালনা ভিন্ন বিষয়। হাসনাত ও সারজিস ছাত্রদের দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন, দলের অবস্থান বা সিদ্ধান্তের বাইরে সেনানিবাসে গিয়ে বৈঠক করা বা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার দায় তাই দলকেই নিতে হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হাসনাত আবদুল্লাহর ফেসবুক মন্তব্য ও এর পরের ঘটনাপ্রবাহকে আমরা কীভাবে দেখব? এটা কি নিছক রাজনৈতিক অপরিপক্বতা? হাসনাত আবদুল্লাহর ফেসবুক মন্তব্য এবং একই সঙ্গে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের আগের রেকর্ড করা সাক্ষাৎকারের ভিডিও ক্লিপ প্রকাশকে পরিকল্পিত মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কোনো শক্তি বা গোষ্ঠী পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে কি না, সেই প্রশ্ন কিন্তু জনমনে আছে। নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপির উচিত তাদের অবস্থান বিশ্বাসযোগ্যভাবে পরিষ্কার করা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ