ট্রাম্প যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য হুমকি হয়ে উঠছেন
Published: 23rd, March 2025 GMT
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক মাহমুদ খলিলকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করায় ট্রাম্প প্রশাসনের চেষ্টা তীব্র ক্ষোভ ও দেশব্যাপী বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
বিশ্ববাসীর কাছে খলিলের গ্রেপ্তার বিস্ময়কর মনে হতে পারে; তবে আমাদের কাছে তা মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। কারণ, আমরা গাজার ওপর যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়া ফিলিস্তিনবিরোধী ঘৃণা মোকাবিলা করে যাচ্ছি।
২০২৩ সালের অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর এই ঘৃণা আরও বেড়েছে। এটি ট্রাম্পকে ‘অপ্রয়োজনীয়দের’ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া এবং বাক্স্বাধীনতা ও শিক্ষা অর্জনের অধিকার খর্ব করার সুযোগ করে দিয়েছে।
গত বসন্তে লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস–এ আমি একটি কলাম লিখেছিলাম। সেখানে আমি আমার নিজ বিশ্ববিদ্যালয় সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি (ইউএসসি) কর্তৃপক্ষের কঠোর সমালোচনা করেছিলাম। কারণ, তারা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের গ্রেপ্তার করতে দাঙ্গা পুলিশ ডেকেছিল। এরপর এক ক্ষুব্ধ পাঠক আমাকে লিখেছিলেন, ‘তুমি যদি হামাসকে এত ভালোবাসো, তাহলে গাজার দক্ষিণে চলে যাও। তাহলে অন্তত ভবিষ্যতে কোনো বোমা হামলায় তোমার নামও নিহতদের তালিকায় থাকবে।’
এর কয়েক মাস পর আমার লেখা ক্যাম্পাস লকডাউনের ব্যঙ্গাত্মক সমালোচনা নিয়ে প্রায় চার হাজার স্বয়ংক্রিয় ই-মেইল আসতে থাকে, যার শুরুতেই লেখা থাকত ‘চরম ঘৃণ্য স্যান্ডি টোলান’।
আর আমি তো ভুলতে পারব না—গত সপ্তাহে যখন আমি গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার প্রমাণ নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলাম, তখন ক্ষুব্ধ টেক্সানরা আমার বক্তৃতা বন্ধ করতে কীভাবে চিৎকার করছিলেন।
তবে এসব ঘটনা আমার কাছে তেমন বড় কিছু মনে হয় না। আমি ভাবি, আমার সেই সহকর্মীদের কথা, যাঁরা শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে গিয়ে নিজেদের সামনে দাঁড় করিয়েছেন, তারপর গ্রেপ্তার হয়েছেন বা শাস্তি ভোগ করেছেন। কিংবা সেই শিক্ষার্থীদের কথা, যাঁদের নাম কালোতালিকায় তোলা হয়েছে, চাকরি হারাতে হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করে দেওয়া হয়েছে, এমনকি চাকরির অফারও বাতিল করা হয়েছে।
এত কিছু সহ্য করার পরও আমার অভিজ্ঞতা গাজার মানুষের চরম দুর্ভোগের সামনে একেবারেই তুচ্ছ। গত ১৭ মাসে সেখানে ৪৭ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। তাঁদের অনেকেই ইসরায়েলি বাহিনীর ছোড়া মার্কিন অস্ত্রে মারা গেছেন। হাজার হাজার মানুষ চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন, অনেকের দেহের অঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
গাজার সব বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। নিহত হয়েছেন এক শর বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, অধ্যাপক ও শিক্ষাকর্মী; সঙ্গে শত শত ছাত্রছাত্রী।
গাজার বাস্তবতা তুলে ধরতে গেলে আমাদের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ ও বিদ্বেষ দেখা যায়, তা মূলত ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠস্বর দীর্ঘদিন ধরে মুছে ফেলার ফল। মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) ফিলিস্তিনিদের হয় ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিত্রিত করে, নয়তো শুধু ‘ভুক্তভোগী’ হিসেবে। এসব সংবাদমাধ্যম তাঁদের কখনোই একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে দেখে না।
এই অমানবিকীকরণের কারণেই মাহমুদ খলিলের মতো ব্যক্তির গ্রেপ্তার এত সহজ হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পরিষ্কারভাবে বলেছেন, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভয় সৃষ্টি করাই উদ্দেশ্য। তিনি ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ লিখেছেন, ‘আমরা এই সন্ত্রাসীদের সমর্থকদের খুঁজে বের করব, গ্রেপ্তার করব এবং বহিষ্কার করব। আমরা আশা করি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এই নির্দেশ মানবে।’
খুব দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এখনই এই স্বৈরাচারী নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিন ধরে অবমাননা ও দমন করার কারণে এই কাজ আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। আর অযৌক্তিকভাবে ‘অ্যান্টি-সেমিটিজম’ (ইহুদিবিদ্বেষ)-এর মিথ্যা অভিযোগ ব্যবহার করা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই অভিযোগগুলোর শিকড় গত বছরের গাজা আন্দোলনে প্রোথিত, অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল। সেখানে গণহত্যার অভিযোগ তোলা হয়েছিল এবং ‘নদী থেকে সমুদ্র পর্যন্ত’ ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার স্লোগান দেওয়া হয়েছিল—যা আসলে ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির মূলনীতির অংশ ছিল।
এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকা এবং আরও কয়েকটি দেশ আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তুলেছে। এমনকি গণহত্যা ও হলোকাস্ট নিয়ে গবেষণা করা অনেক বিশেষজ্ঞও এই মতামতের সঙ্গে একমত। তাই এটি কোনোভাবেই ইহুদিবিদ্বেষ হতে পারে না।
অবশ্যই প্রকৃত ইহুদিবিদ্বেষের ঘটনা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা উচিত। কিন্তু বাস্তবে কিছু ক্ষমতাবান ব্যক্তি এসব অভিযোগ করছেন বাক্স্বাধীনতা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য, সত্যিকারের ইহুদিবিদ্বেষ ঠেকানোর জন্য নয়।
এখন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্তকারীদের পাঠাচ্ছে। এই তদন্তকারীরা বিদেশি শিক্ষার্থীদের কর্মকাণ্ড নজরদারি করে রিপোর্ট তৈরি করবেন। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মাহমুদ খলিলের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে ট্রাম্প বলেছেন, ‘এটি প্রথম ঘটনা, এ রকম আরও অনেক কিছু আসছে।’
ট্রাম্প প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর আর্থিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের নীতিগত সমর্থন আদায় করতে চাইছে। এই চাপের মূল হাতিয়ার হলো ফেডারেল তহবিল (যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থায়ন) হ্রাসের হুমকি। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে যেগুলো গবেষণা ও শিক্ষার্থীদের আর্থিক সাহায্যের জন্য ফেডারেল তহবিলের ওপর নির্ভরশীল—সরকারের নির্দেশনা মানতে বাধ্য হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ইউএসসি (ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া) এবং কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও ফেডারেল গবেষণা অনুদান, শিক্ষার্থীর ঋণসুবিধা বা বিশেষ প্রকল্পের তহবিল হারানোর ভয়ে নীতিগত পরিবর্তনে বাধ্য হতে পারে।
স্বৈরশাসকদের আদেশ মানার কোনো মানে হয় না, বিশেষ করে যখন তা মেনে নিয়েও শেষ পর্যন্ত ক্ষতিই হয় এবং তাদের দমনমূলক পরিকল্পনা কোনো গোপন বিষয় নয়। ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্মকাণ্ড দুর্বল করে দিতে চায়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিক্রিয়া কী হওয়া উচিত, তা খুবই স্পষ্ট আর তা হলো দমনমূলক চাপের কাছে নতিস্বীকার করা যাবে না। আমাদের এখন নিজেদের মূল্যবোধ নির্ভয়ে রক্ষা করতে হবে, বাধ্য হয়ে নয়, বরং সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের জ্ঞানচর্চা রক্ষা করতে হবে, শিক্ষার্থীদের অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
● স্যান্ডি টোলান লস অ্যাঞ্জেলেসের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির অ্যানেনবার্গ স্কুল ফর কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজমের অধ্যাপক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউন ভ র স ট ইসর য় ল গণহত য আম দ র র জন য হয় ছ ন ক র কর র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’ বলা কেন বিভ্রান্তিকর
২ এপ্রিল প্রথম আলো অনলাইনে ‘জুলাই হত্যাকাণ্ড কি জেনোসাইডের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। লেখক আরিফ রহমান প্রবন্ধটিতে দাবি করছেন, ‘বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট সময়ে সংঘটিত সহিংস নিধনযজ্ঞকে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত গণহত্যা বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত’...বা ‘একাডেমিক ও নৈতিক যুক্তিতে এ ঘটনা যে গণহত্যা, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।’
লেখক জেনোসাইড কনভেনশনের সংজ্ঞার কথা উল্লেখ করলেও নামজাদা কয়েকজন গবেষকের সংজ্ঞা ও মডেল ব্যবহার করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। আরিফের লেখার মূল যে স্পিরিট—‘রাষ্ট্র পরিচালিত নিষ্ঠুর বলপ্রয়োগ যে কতটা ভয়ংকর রূপ নিতে পারে, বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ঘটনাই তার এক গভীর শিক্ষা’-এর সঙ্গে পরিপূর্ণ একমত হয়েও তাঁর অবস্থানের আইনি/যৌক্তিক দুর্বলতা ও এর সম্ভাব্য পরিণতির আশঙ্কা থেকে এই লেখার অবতারণা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে ‘গণহত্যা’ শব্দের দুই ধরনের ব্যবহার রয়েছে। প্রথমত, রাজনৈতিক রেটরিক অর্থে ‘গণহত্যা’ দিয়ে আসলে বোঝানো হয়ে থাকে একসঙ্গে একের অধিক মানুষকে হত্যা করা; সেখানে ইংরেজি ‘ম্যাসাকার’ বা ‘মাসকিলিং’ অর্থে এটা ব্যবহৃত হয়।
ষাটের দশক থেকে আজতক এ ভূখণ্ডে যেকোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, যেখানে একের অধিক লোক মারা গেছেন, সব কটাকেই রাজনৈতিক পরিসরের জনপ্রিয় বুলিতে ‘গণহত্যা’ বলা হয়ে থাকে। মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা সংঘটনের বহু আগেও যেমন রাষ্ট্রীয় সহিংসতা/হত্যাযজ্ঞ বোঝাতে ‘গণহত্যা’ শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়, তেমনি বর্তমানে পিলখানা বা শাপলার রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞের ক্ষেত্রে ‘গণহত্যা’ সম্বোধনও বহুল প্রচলিত। এখানে গণহত্যা ও মাসকিলিং আসলে সমার্থক।
এর বাইরে দ্বিতীয় আরেক ধরনের ব্যবহার রয়েছে: ‘জেনোসাইড’ অর্থে। ‘জেনোসাইড’–এর অর্থ ও সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক আইন বা জেনোসাইড কনভেনশনে খুবই নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের অভিধান থেকে শুরু করে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় ‘জেনোসাইড’–এর পরিভাষা হিসেবেও ‘গণহত্যা’ ব্যবহারের চল রয়েছে।
কিন্তু আইনে জেনোসাইডের সংজ্ঞায় যে কয়েকটা অপরাধমূলক কাজ বা অ্যাক্টকে জেনোসাইড হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে, তাতে হত্যা বা মাসকিলিং আরও অনেকগুলো অপরাধের একটি। সেখানে দেখা যায়, কাউকে ‘হত্যা’ না করেও আসলে ‘জেনোসাইড’ চালানো সম্ভব, কেননা সেখানে হত্যার বাইরে আরও কিছু অপরাধমূলক কাজের উল্লেখ রয়েছে, যেমন, শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিসাধন বা জোরপূর্বক জন্মদানে বাধা প্রদান বা এক গোষ্ঠীর শিশুদের অন্য গোষ্ঠীতে স্থানান্তর।
কিন্তু ‘গণহত্যা’ ব্যবহার করলে কেবল ‘হত্যা’কেই প্রাধান্য দেওয়া হয়, ফলে বাংলাদেশের অনেকেই জেনোসাইডের পরিভাষা হিসেবে গণহত্যা ব্যবহার না করে সরাসরি জেনোসাইড বা গোষ্ঠীনিধন/বা জাতিনিধন বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
আরিফ রহমান তাঁর কলামে চব্বিশের হত্যাকাণ্ডকে যে ‘গণহত্যা’ বলতে চান, সেটা আসলে ‘জেনোসাইড’ অর্থে। রাজনৈতিক রেটরিক অর্থে ইতিমধ্যে এটা ‘গণহত্যা’ হিসেবে বহুল প্রচলিত হয়ে গেছে। কিন্তু ‘জেনোসাইড’ অর্থে একে ‘গণহত্যা’ বলাটা বিভ্রান্তিকর। কেন, সেটা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা যাক।
প্রথমত, ‘জেনোসাইড’ হচ্ছে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক অপরাধ। আরিফ রহমানও বলছেন, ‘একটি গোষ্ঠীর অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পিত অভিযান’। ‘জেনোসাইড’ শব্দের প্রবর্তক রাফায়েল লেমকিন থেকে শুরু করে জেনোসাইড কনভেনশন হয়ে প্রায় প্রত্যেক গবেষক পর্যন্ত এ বিষয়ে একমত।
১৯৪৮ সালে জেনোসাইড কনভেনশনে যখন এই আইন চূড়ান্ত হচ্ছে, তখন বহু বাহাসের পর গোষ্ঠীর চারটি বর্গকে ‘সুরক্ষিত গোষ্ঠী’ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে: জাতীয়, নৃগোষ্ঠী, জাতিগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠী; অর্থাৎ, এই চার বর্গের কোনো গোষ্ঠীকে আংশিক বা পূর্ণ ধ্বংস করার নিয়তে (ইনটেনশন) যদি কিছু নির্দিষ্ট অপরাধমূলক কাজ করা হয়, তাহলে সেটা জেনোসাইড হবে।
এই ‘গোষ্ঠী পরিচয়’–এর নির্দিষ্টতাই অপরাপর অপরাধ থেকে একে পৃথক করে। আন্তর্জাতিক আইনে কেন ‘রাজনৈতিক’ বর্গ নেই, সেটা নিয়ে পরবর্তীকালে বহু গবেষক প্রশ্ন তুলেছেন, সমালোচনা করেছেন। কিন্তু, লিও কুপারসহ সবাই বাস্তবিক কারণেই এই আইনকে আলাপের রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে নিয়ে থাকেন।
এখন চব্বিশের ঘটনায় ভিকটিমরা (ভুক্তভোগী) আন্তর্জাতিক আইনের সংজ্ঞার আওতায় পড়েন না। অর্থাৎ, কেবল জাতীয়, নৃগোষ্ঠী, জাতিগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার কারণে কেউ হত্যাযজ্ঞ বা ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হননি। আরিফ রহমান সে কারণে আন্তর্জাতিক আইন ধরে আলাপ না করে বিভিন্ন গবেষকের মারফতে আলোচনা করেছেন, যাঁরা ‘রাজনৈতিক’ বর্গের অনুপস্থিতির কারণে জেনোসাইডের সংজ্ঞার সমালোচনাও করেছেন বা তাদের আলোচনার সুবিধার্থে সংজ্ঞাকে খুবই শিথিল আকারে ব্যবহার করেছেন।
আরিফ যে গ্রেগরি স্ট্যান্টনের ৮টি (পরে স্ট্যান্টন আরও দুটো ধাপ বাড়িয়েছিলেন) ধাপের মডেল ব্যবহার করেছেন, সেই গ্রেগরি স্ট্যান্টনও কিন্তু কনভেনশনের সংজ্ঞা ও পরিচয়ের ওই চারটি বর্গকে কবুল করেই আলোচনা করেছেন। তিনি কেবল জেনোসাইডকে একটা প্রক্রিয়া হিসেবে কিছু ধাপে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, যেন এটা আগে থেকে মোকাবিলা করা যায়।
অন্যদিকে, আরিফ যদি গবেষকদের বরাত দিয়ে ‘রাজনৈতিক’ বর্গকে অন্তর্ভুক্ত করতেও চান, তাহলেও চব্বিশের সহিংসতাকে এটাতে আটানো সম্ভব হবে না। কারণ, কোনো নির্দিষ্ট ‘রাজনৈতিক’ দল বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ছিল না।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যই ছিল, কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা ব্যানারের বাইরে গিয়ে এটা সংঘটিত হয়েছে। তাদের নানা ধরনের রাজনৈতিক মতামত থাকলেও, বা একটা বিশেষ মুহূর্তে একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে সমাবেশ তৈরি হলেও, এটাকে নির্দিষ্ট ‘রাজনৈতিক’ গোষ্ঠী বলা সম্ভব হবে না।
প্রথমত, এখানে যেকোনো সুরক্ষিত গ্রুপ বা গোষ্ঠী হওয়ার জন্য সেটাকে স্থায়ী (পারমানেন্ট) ও স্থিতিশীল (স্টেবল) হতে হবে; রুয়ান্ডা ও যুগোস্লাভিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলোয় গোষ্ঠী প্রসঙ্গে এ কথা বলা হয়েছিল। অর্থাৎ, এই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিরা সাধারণত জন্মসূত্রে নির্ধারিত হবেন যা সহজে পরিবর্তনযোগ্য নয়।
দ্বিতীয়ত, আরিফ যেভাবে শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে জনতাকে ‘রাজনৈতিক’ গোষ্ঠী হিসেবে তুলে ধরতে চান, সেটা করতে গেলে ‘রাজনৈতিক’ বর্গ এতই শিথিল হয়ে পড়ে যে আইনের দিক থেকে এটা আর অর্থবহ থাকে না। যেকোনো দলবদ্ধ গোষ্ঠীকে আসলে সে অর্থে ‘রাজনৈতিক’ বলা সম্ভব, এমনকি অনেক জাতীয় বা নৃগোষ্ঠীকেও কেউ কেউ রাজনৈতিক নির্মাণ বলেও সাব্যস্ত করতে পারবেন।
এটাও উল্লেখ করা জরুরি যে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংজ্ঞায় পূর্বে ‘রাজনৈতিক’ বর্গ অন্তর্ভুক্ত ছিল, সেটা অভ্যুত্থানের পর আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংশোধনীর মাধ্যমে বাদ দেওয়া হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন, এটা বাদ না দিলে আমাদের আইন অনুযায়ী চব্বিশের সহিংসতাকে ‘জেনোসাইড’ বলা যেতে পারত! কিন্তু, ওপরে এটাই বলার চেষ্টা করা হলো যে ‘রাজনৈতিক’ বর্গ থাকলেও চব্বিশের সহিংসতাকে ‘জেনোসাইড’ বা জেনোসাইড অর্থে গণহত্যা বলা সম্ভব নয়।
তৃতীয়ত, চব্বিশের সহিংসতাকে ‘জেনোসাইড’ না বললে কি অপরাধকে লঘু করা হয়? আমাদের উত্তর হচ্ছে, না। জেনোসাইডকে ‘ক্রাইম অব অল ক্রাইমস’ বলে সাব্যস্ত করার যে বহুল রেওয়াজ রয়েছে, তাতে মনে হয়, আইনে বুঝি একধরনের অপরাধের ক্রমবিন্যাস বা হায়ার্কি রয়েছে!
এটা ঠিক যে আন্তর্জাতিক আইনে জেনোসাইড প্রমাণের মানদণ্ড খুব উঁচু, কোনো ঘটনাকে জেনোসাইড প্রমাণ করতে খুব কসরত করতে
হয়। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যেকোনো হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’–এর খোপে ঢোকানোর প্রয়াস খুব লক্ষণীয়।
সম্প্রতি গবেষকেরা (যেমন ডার্ক মোজেস) বলছেন, এই মনোভাব মানে এটাই সবচেয়ে বড় অপরাধ এবং সবকিছু এটাতে অন্তর্ভুক্ত করার যে প্রবণতা, তা আদতে ক্ষতিকর। এটা বিভিন্ন সহিংসতা ও অপরাধের বিবিধ মাত্রাকে কাটছাঁট করে, তার ধরন ও প্রকৃতিকে ঠিকঠাকমতো বুঝতে দেয় না।
ফলে হত্যাযজ্ঞমাত্রই ‘জেনোসাইড’ বা সে অর্থে গণহত্যা বলে দাবি করলে, একদিকে যেমন গণহত্যা/জেনোসাইড বর্গ হিসেবে অর্থহীন হয়ে উঠে, তেমনি যেসব ঘটনা আসলেই জেনোসাইড, সেগুলো লঘু হয়ে পড়ে। এ কারণে অনেকেই হরেদরে ঘটনাকে জেনোসাইড ব্যবহার করতে সতর্ক করেন।
চব্বিশের ঘটনাকে যদি জেনোসাইড অর্থে গণহত্যা না বলি, তাহলে অপরাধের কোন ব্যানারে আলোচনা করা যেতে পারে? আরিফ নিজেও তাঁর লেখায় যেসব প্রতিবেদনের কথা বলছেন, সেখানেও এর স্পষ্ট ইঙ্গিত দেওয়া আছে। যেমন জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এই ঘটনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ রয়েছে এবং পুরো প্রতিবেদনে নানা কায়দায় সেটাকেই প্রমাণ করা হয়েছে। চব্বিশের সহিংসতাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করাই যৌক্তিক ও সঠিক। এটাকে জেনোসাইড অর্থে গণহত্যা বললে মারাত্মক আইনি বিভ্রান্তি তৈরি হবে।
তাই আমরা মনে করি যে আন্তর্জাতিক আইনে কোনোভাবেই চব্বিশের সহিংসতাকে ‘জেনোসাইড’ বলে প্রমাণ করা যাবে না। এটাকে জোর করে যদি ‘জেনোসাইড’ অর্থে গণহত্যা বলা হয়ে থাকে, তাহলে কিছুদিন পর মূল অপরাধীরাই বলতে শুরু করবেন যে এটাকে গণহত্যা হিসেবে প্রমাণ করা যাবে না; ফলে নৈতিকভাবে দায়মুক্তি ঘটেছে বলে প্রচারণার সুযোগ পাবেন।
এ রকম তৎপরতা থেকে এ ধরনের ‘ভুল’ চিহ্নায়ন দুই তরিকার বিপদ ঘটাবে। এক. খোদ চব্বিশের সহিংসতাকে পুরোপুরি বুঝতে সহায়ক হবে না এবং অপরাধীদের প্রচারণার সুযোগ করে দেবে; দুই. যেগুলো আসলেই ‘জেনোসাইড’মূলক ঘটনা, সেগুলোকে লঘু করে তুলবে।
সহুল আহমদ লেখক ও গবেষক
উম্মে ওয়ারা সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়