এক মাসে দ্বিগুণ শাইনপুকুর সিরামিকসের শেয়ারের দাম
Published: 23rd, March 2025 GMT
দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গত সপ্তাহে লেনদেনের শীর্ষে ছিল বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান শাইনপুকুর সিরামিকস। আগের তিন সপ্তাহেও এটির শেয়ারদর বেড়েছে। গত এক মাসে সিরামিক খাতের এই লোকসানি কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বাজারে শাইনপুকুর সিরামিকসের শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ১১ টাকা ৪০ পয়সা। এরপর টানা মূল্যবৃদ্ধিতে গত বৃহস্পতিবার এটির শেয়ারদর বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ টাকা ২০ পয়সায়। সেই হিসাবে এক মাসে এটির দাম বেড়েছে ১৩ টাকা ৮০ পয়সা বা ১২১ শতাংশ।
শেয়ারবাজারে হুহু করে শেয়ারের দাম বাড়লেও কোম্পানিটি কিন্তু লোকসানি। সর্বশেষ গত জুলাই–ডিসেম্বরের অর্ধবার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে কোম্পানিটি ২১ কোটি টাকার বেশি লোকসান করেছে। তাতে এটির শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস ছিল ১ টাকা ৩৫ পয়সা ঋণাত্মক। তা সত্ত্বেও কোম্পানিটির শেয়ারের দাম গত এক মাস ধরে বেড়েই চলেছে। যদিও মূল্যবৃদ্ধির সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ জানেন না বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা মনে করেন, গুজব ছড়িয়ে কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারটির দাম বাড়ানো হচ্ছে।
গত বছরের আগস্টে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বেক্সিমকো গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গঠন করা হয়েছিল উপদেষ্টা কমিটি। ওই কমিটি শাইনপুকুর সিরামিকসসহ বেক্সিমকোর বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নানা প্রতিবন্ধকতা দেখা দেওয়ায় সরকার শেয়ার বিক্রির উদ্যোগ থেকে পিছিয়ে যায়। এর বদলে সরকারের পক্ষ থেকে অর্থ সহায়তা দিয়ে বেক্সিমকোর বন্ধ হয়ে যাওয়া কোম্পানিগুলোর শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হয়।
ঢাকার বাজারে গত সপ্তাহে লেনদেনের শীর্ষে ছিল শাইনপুকুর সিরাকিমস। সপ্তাহের ৫ কার্যদিবসে কোম্পানিটির দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১৬ কোটি টাকা। বাজারের মোট লেনদেনের প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশই ছিল কোম্পানিটির দখলে। শুধু লেনদেন নয়, গত সপ্তাহে মূল্যবৃদ্ধিতেও দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল কোম্পানিটি। গত সপ্তাহের ৫ কার্যদিবসে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়েছে ৫ টাকা ২০ পয়সা বা ২৬ শতাংশের বেশি।
হঠাৎ এক মাস ধরে শেয়ারবাজারে শাইনপুকুর সিরামিকসের শেয়ারের এমন দাপুটে অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, বেক্সিমকো গ্রুপের শেয়ারগুলো নিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে কর্তৃপক্ষ নানা কারণে এগুলোর আয় ও মুনাফাকে নানাভাবে কমিয়ে দেখাত। এ ছাড়া বেক্সিমকোর তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মালিকানা বদল নিয়েও নানা জল্পনাকল্পনা রয়েছে। এসব প্রচারণাকে কাজে লাগিয়ে কারসাজিকারকদের একটি অংশ এই শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা ঘটাচ্ছে।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের আগস্টে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শেয়ারবাজারে বেক্সিমকোর মালিকানাধীন কোম্পানি শাইনপুকুর সিরামিকসের শেয়ারের দরপতন শুরু হয়। এর আগে ৯ জুলাই কোম্পানিটির শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ৩৮ টাকা। টানা দরপতনে গত ২৭ অক্টোবর সেই দাম নেমে আসে ১০ টাকায়। অর্থাৎ আড়াই মাসে এটির শেয়ারের দাম প্রায় চার ভাগের এক ভাগে নেমে আসে। সেখান থেকে গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে এটির শেয়ারের দাম বাড়তে শুরু করে।
২০০৮ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান শাইনপুকুর সিরামিকস। সর্বশেষ গত বছরের জুনে সমাপ্ত অর্থবছরে কোম্পানিটি শেয়ারধারীদের জন্য ২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এর শেয়ারের ৫০ শতাংশই রয়েছে উদ্যোক্তা–পরিচালকদের হাতে। বাকি ৫০ শতাংশ শেয়ার প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে। এটি শেয়ারবাজারে মাঝারি মানের ‘বি’ শ্রেণিভুক্ত কোম্পানি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ য় রব জ র ল নদ ন র এক ম স
এছাড়াও পড়ুন:
দেশে পেঁয়াজের দাম কমতে পারে, লোকসানের শঙ্কায় কৃষকেরা
প্রায় দেড় বছর ধরে পেঁয়াজ রপ্তানিতে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছিল ভারত সরকার। পেঁয়াজের মজুত বেড়ে যাওয়ায় দীর্ঘ সময় পর এই বিধিনিষেধ থেকে বেরিয়ে এল দেশটি। গত শনিবার ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব বিভাগের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আগামী ১ এপ্রিল থেকে পেঁয়াজ রপ্তানিতে সব শুল্ক তুলে নিচ্ছে দেশটি। এত দিন ভারত থেকে পেঁয়াজ রপ্তানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
এমন সময়ে ভারত শুল্ক প্রত্যাহার করছে, যখন দেশের বাজারে দেশি নতুন পেঁয়াজে ভরপুর। উৎপাদন মৌসুমের কারণে দেশি পেঁয়াজের দামও তুলনামূলক কম। দেশের বাজারে দাম তুলনামূলক কম থাকায় ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানিও কমেছে। আগে যেখানে প্রতি মাসে গড়ে ৫০ হাজার টনের বেশি পেঁয়াজ আমদানি হতো, সেখানে গত জানুয়ারিতে আমদানি হয়েছে ২৯ হাজার টন। ফেব্রুয়ারি মাসে তা আরও কমে নেমেছে ২৪ হাজার টনে।
আমদানিকারক ও উৎপাদকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে শুল্ক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তার দুটি প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের বাজারে। প্রথমত ভারতের এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম আরও কমবে। অর্থাৎ ক্রেতারা বর্তমানের চেয়ে আরও কম দরে পেঁয়াজ কিনতে পারবেন। দ্বিতীয়ত দেশি পেঁয়াজ উৎপাদকেরা ভালো দাম পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন। ভালো দাম না পেলে আগামী মৌসুমে পেঁয়াজ উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হতে পারেন কৃষকেরা।
* বর্তমানে ভারত থেকে আমদানি করা প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম পড়ছে ৪১ থেকে ৪২ টাকা। * শুল্ক প্রত্যাহার করায় ২৫ থেকে ৩০ টাকায় প্রতি কেজি পেঁয়াজ আমদানি করা যাবে। * বাজারে এখন প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৫০ টাকা।বিশ্লেষকেরা মনে করেন, পেঁয়াজের দামে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে কৃষি বিভাগ। কারণ, পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয় কৃষি বিভাগ। এখন ভারত থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত আমদানির অনুমতির মেয়াদ রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে এই ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে কৃষি বিভাগ; যাতে ভোক্তাদের পেঁয়াজ কিনতে বেশি দাম দিতে না হয়, আবার উৎপাদকেরাও যেন ন্যায্য দাম পান।
আমদানি খরচ কমবে ৯-১০ টাকা
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ভারত থেকে প্রতি কেজি পেঁয়াজ আমদানির দাম পড়ছে ৩৬ থেকে ৩৭ টাকা। আমদানি করা পেঁয়াজ খালাসের সময় শুল্ক–কর দিতে হচ্ছে ৫ টাকা। তাতে সব মিলিয়ে আমদানি করা প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম পড়ছে ৪১ থেকে ৪২ টাকা। এর বাইরে রয়েছে পরিবহন খরচ। তবে বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়।
পেঁয়াজ আমদানিকারকেরা জানান, ভারতের রপ্তানি শুল্কের কারণে এত দিন পেঁয়াজ আমদানিতে প্রতি কেজিতে বাড়তি খরচ পড়ত ৯ থেকে ১০ টাকা। শুল্ক প্রত্যাহার করায় প্রতি কেজিতে এই খরচ কমবে। তাতে ভারত থেকে প্রতি কেজি পেঁয়াজ আমদানিতে ২৬ থেকে ২৭ টাকা খরচ পড়তে পারে।
হিলি স্থলবন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মারিয়া করপোরেশনের কর্ণধার মোবারক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ভারত শুল্ক প্রত্যাহার করায় ২৫ থেকে ৩০ টাকায় প্রতি কেজি পেঁয়াজ আমদানি করা যাবে। এতে পেঁয়াজের দামে অস্থিতিশীলতার শঙ্কা থাকবে না।
শুল্ক প্রত্যাহারে শঙ্কায় কৃষকেরা
ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করায় এখন দেশি উৎপাদকেরা শঙ্কায় আছেন। কারণ, উৎপাদন মৌসুমের কারণে এমনিতেই পেঁয়াজের দাম কম। নতুন করে কম দামে আমদানি হলে উৎপাদকদের ভালো দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এতে লোকসানেরও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ বা টিসিবির হিসাবে, বাজারে এখন প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৫০ টাকা। গত বছর এই সময়ে দাম ছিল ৬০ থেকে ৭০ টাকা। গত বছর ভালো দাম পাওয়ায় এবার কৃষকেরা পেঁয়াজ উৎপাদন বাড়িয়েছেন। তবে বাজারে দাম কমে যাওয়ায় এখন তাঁদের মাথায় হাত।
কৃষকেরা বলছেন, বর্তমানে বাজারে যে পেঁয়াজের দাম, তাতে তাঁদের উৎপাদন খরচও উঠছে না। নতুন করে দাম আরও কমলে তাঁরা লোকসানের শিকার হবেন।
পাবনার সাঁথিয়ার বায়া গ্রামের পেঁয়াজচাষি আবদুল হাই সরকার শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, বাজারে বর্তমানে যে দামে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে, তাতে উৎপাদন খরচই উঠবে না। এমনিতে বৃষ্টির কারণে এবার ফলনের ক্ষতি হয়েছে। এখন দামের কারণেও ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। প্রতি কেজি হালি পেঁয়াজ উৎপাদনে ৪৫ টাকার মতো খরচ পড়েছে। অথচ বাজারে এই পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়। ভারত রপ্তানি শুল্ক তুলে নেওয়ায় দাম আরও কমলে কৃষকেরা বড় ক্ষতিতে পড়বেন।
পেঁয়াজের তথ্যে অস্পষ্টতা
দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ও উৎপাদন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই অস্পষ্টতা চলে আসছে। যেমন কৃষি বিভাগের হিসাবে গত অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ৩৯ লাখ টন। পরিসংখ্যান ব্যুরো কৃষি বিভাগের হিসাব থেকে ২৫ শতাংশ বাজারজাতজনিত ক্ষতি বাদ দিয়ে হিসাব করে। তাদের হিসাবে, গত অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় ২৯ লাখ ১৭ হাজার টন। আবার ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে, বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ থেকে ২৭ লাখ টন।
চাহিদার বাড়তি উৎপাদন হওয়ায় পেঁয়াজ রপ্তানি হওয়ার কথা। কিন্তু প্রতিবছর পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে। যেমন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে গত অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ১৪ হাজার টন।
দেশে প্রতিবছর কী পরিমাণ পেঁয়াজের প্রয়োজন, তার কত অংশ দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমে মেটানো সম্ভব এবং কত অংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হবে, এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই। আর সেই সুযোগটাই নেন মজুতদারেরা। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দেন তাঁরা। ফলে এই সময় ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানি শুরু হলে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম আরও কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন উৎপাদকেরা।