শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ ভুয়া, নির্ধারিত সময়ের পর আবেদন ও চার বছর পরের পে-অর্ডার জমাসহ নানা অনিয়ম করে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা পদে চাকরি পেয়েছিলেন পাঁচজন। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ মাদক কারবারে দণ্ডপ্রাপ্ত। কেউ আবার চাকরির জন্য আবেদনই করেননি। দলীয় বিবেচনায় তবুও জুটেছে চাকরি নামের সোনার হরিণ। এমন তুঘলকি কাণ্ড ঘটেছে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনে (ডিসিসি)। এ বিশেষ কর্মকর্তাদের নিয়োগের অনিয়ম ঢাকতে ধারাবাহিকভাবে অনিয়ম করে তৎকালীন প্রশাসন। কিছুদিন পর অনিয়ম ধরা পড়ে। এতে তাদের চাকরিও চলে যায়। 

পরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে এসবের প্রমাণ পেয়ে মামলা করে। আদালত থেকেও তাদের পুনর্নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। রয়েছে অডিট আপত্তিও। বিস্ময়কর হলেও সত্য, এত কিছুর পর ১৩ বছরের মাথায় পাঁচ কর্মকর্তার মধ্যে দু’জন সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) ফের যোগদান করেছেন। আরেকজন যোগদান করার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে আবেদন দিয়েছেন। চতুর্থজন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মাস্টাররোলে (অস্থায়ী) কর্মরত। এ ঘটনায় রাজধানীর দুই নগর ভবনে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। কর্মকর্তারা বলছেন, দলীয় প্রভাব বিস্তার করে ও ডিএসসিসির শীর্ষ কর্মকর্তাদের ‘খুশি’ করে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তারা।

অবশ্য ডিএসসিসির ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ বশিরুল হক ভূঁঞা সমকালকে বলেন, তারা যোগ দিলেই তো হবে না। বর্তমানে ডিএসসিসিতে কোনো প্রশাসক নেই। নতুন প্রশাসক এলে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।

অনিয়মের মাধ্যমে চাকরি পাওয়া ওই পাঁচ কর কর্মকর্তা হলেন– সিটি ও পৌর কর্মচারী ফেডারেশনের (বিএনপিপন্থি) সাবেক সভাপতি আমান উল্লাহ খানের ছেলে সাইফুল্লাহ, ডিসিসির সাবেক ডেপুটি মেয়র (বিএনপি) কামরুজ্জামান মিন্টুর ছেলে এসএম হাসানুজ্জামান, অবিভক্ত ডিসিসির ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক বিএনপি দলীয় কমিশনার এডিএম মোস্তফা বাদশার ছেলে শামী ফয়সাল, বিএনপির সাবেক মহাসচিব আবদুল মান্নান ভুঁইয়ার এপিএস মিজানুর রহমান ও আতাহার আলী খান। তাদের মধ্যে সম্প্রতি চাকরিতে যোগদান করেছেন শামী ফয়সাল ও এসএম হাসানুজ্জামান। আতাহার আলী খান যোগ দেওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের কাছে আবেদন দিয়েছেন। মিজানুর রহমানের নিয়োগে অনিয়ম থাকলেও তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ সঠিক থাকায় তাঁকে চাকরিতে পুনর্বহালের আদেশ দেন আদালত। এ অবস্থায় ডিএনসিসি তাঁকে মাস্টাররোলে চাকরি করার সুযোগ দেয়। 

ডিএসসিসি, দুদকের অনুসন্ধান ও নিয়োগপ্রাপ্ত পাঁচজনের নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৪ সালের ৭ জানুয়ারি বিভিন্ন পদে নিয়োগের জন্য আবেদনপত্র আহ্বান করে ডিসিসি। এর মধ্যে পাঁচটি ছিল প্রথম শ্রেণির কর কর্মকর্তার পদ। ২০০৬ সালের ১৩ অক্টোবর কর কর্মকর্তা পদে আবেদনকারীদের লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। চার দিন পর ১৮ অক্টোবর একই দিনে তাদের মৌখিক পরীক্ষা, নিয়োগ আদেশ জারি, নিয়োগপত্র প্রদান, বাছাই কমিটির মিটিং এবং নিয়োগদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ডিসিসি। মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টায় এতগুলো কাজ শেষ করা হয়। বেশি তড়িঘড়ি করে এত কিছু করতে গিয়ে অনিয়মের অনেক প্রমাণ রয়ে যায়। এরপরই ফেঁসে যান নিয়োগপ্রাপ্তরা। মেয়র পদ থেকে সাদেক হোসেন খোকা দায়িত্ব ছাড়ার পর তৎকালীন প্রশাসক হিসেবে খলিলুর রহমান যোগ দেওয়ার পরই তদন্তে এসব অনিয়মের চিত্র বেরিয়ে পড়ে।

আবেদনই করেননি শামী ফয়সাল
আবেদনপত্র আহ্বানের পর শামী ফয়সাল আদতে কোনো আবেদনই করেননি বলে তদন্তে প্রমাণিত হয়। চাকরি শুরুর কয়েক বছর পর তাঁর ব্যক্তিগত ফাইলে আবেদনের পে-অর্ডারের কপি ঢোকানো হয়। সেটির ইস্যুর তারিখ ২০০৮ সাল। চাকরির আবেদনের মেয়াদ শেষের চার বছর পর পে-অর্ডার ইস্যুর ঘটনায় প্রমাণিত হয় আবেদনের সঙ্গে শামী ফয়সাল কোনো পে-অর্ডারই জমা দেননি। ফলে ডিসিসি ওই পে-অর্ডার নগদায়নও করতে পারেনি। আবার শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে ন্যূনতম বাণিজ্যে স্নাতক চাওয়া হলেও তিনি আদতে মাত্র এইচএসসি পাস। ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি তাঁর স্নাতকের সার্টিফিকেট দাখিল করতে পারেননি। ব্যক্তিগত ফাইলে স্নাতকের কোনো তথ্য মেলেনি। 

এইচএসসির সনদ দিয়ে কর্মকর্তা
আবেদনের সময় হাসানুজ্জামান উল্লেখ করেন, ১৯৯৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিকম পিকিউ (প্রি-কোয়ালিফায়েড) শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন। অতছ তার কোনো কপি ফাইলে পাওয়া যায়নি। এমনকি ওই শিক্ষাগত যোগ্যতার পক্ষে দেশের কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমমান সনদও দেননি। ‘পিকিউ’ বিষয়টিও রহস্যজনক। শুধু এইচএসসির সনদ দিয়ে তিনি প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা বনে যান।

বি.

কম ও এম.কম এক বছরেই পাস!
চাকরিতে আবেদনের সময় আতাহার আলী খান বি.কম ও এম.কমের দুটি সার্টিফিকেট দাখিল করেন। দেখা যায় বি.কম ও এম.কমের সেশন একই ১৯৯৫-৯৬, যা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। উপরন্তু এম.কমের সনদে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কোনো স্বাক্ষর নেই। মিজানুর রহমান যে সনদ দাখিল করেন, তার বি.কমের সেশন ছিল ১৯৯৫-৯৬। এম.কমের সেশন ছিল ১৯৯৮, যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

মাদক ব্যবসায় গ্রেপ্তার সাইফুল্লাহ
তিনি চাকরিতে থাকাকালীন মাদক ব্যবসার অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে দণ্ডিত হন। পরে তাঁর সার্টিফিকেটও জাল বলে ধরা পড়ে। এ অভিযোগে তখনই সাইফুল্লাহকে চাকরিচ্যুত করা হয়। প্রত্যেকেরই শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ যাচাইয়ের জন্য বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি পাঠায় ডিসিসি। তখনও এসবের সত্যতা পায় ডিসিসির তদন্ত কমিটি। এ ঘটনায় ২০১২ সালে ওই পাঁচ কর্মকর্তা, ডিসিসির সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকাসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করে ডিসিসি। এরপর দুদক তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে। দুদকের তদন্তে আরও অনিয়ম ধরা পড়ে।

দেখা যায়, আতাহার আলী খান সিটি করপোরেশনের চাকরি বিধিমালা লঙ্ঘন করে নিজ নামে ডিসিসির একাধিক দোকানও বরাদ্দ নিয়েছেন। এ অবস্থায় তারা আদালতের দ্বারস্থ হলে আদালত তাদের বিপক্ষে রায় দেন। আপিল বিভাগে গেলে আদালত তাদের পুনর্নিয়োগের বিষয়ে স্থগিতাদেশ জারি করেন। 

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য নগর ভবনে গেলেও যোগদানকৃতদের কর্মস্থলে পাওয়া যায়নি। আতাহার আলী খান সমকালকে বলেন, ‘আমার নামে যে দোকান আছে, তার টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য আবেদন করেছি। যখন দোকান নিয়েছিলাম, তখন চাকরিতে যোগদান করিনি।’ যোগদানে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, এ জন্য তিনি এ প্রতিবেদকের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।

ডিএসসিসির এক কর্মকর্তা জানান, যোগদানকৃতরা ইতোমধ্যে তাদের গত ১৩ বছরের বেতন-ভাতাসহ যাবতীয় পাওনা বুঝে পাওয়ার জন্যও আবেদনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এটি দিলে ডিএসসিসির কোষাগার থেকে গুনতে হবে অন্তত তিন কোটি টাকা।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: কর মকর ত প রথম শ র ণ র কর র কর মকর ত ড এসস স র র রহম ন কম র স চ কর ত র জন য ব এনপ ফয়স ল তদন ত র সনদ

এছাড়াও পড়ুন:

অতীতের ঘটনাগুলো যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে: বেবী নাজনীন

দুই দশক পর বিটিভি প্রাঙ্গণে দেখা মিলল নন্দিত কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীনের। ঈদের একক সংগীতানুষ্ঠানের জন্য শুক্রবার রাষ্ট্রীয় এই টিভি চ্যানেলে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এদিন সন্ধ্যা থেকে শনিবার ভোর ৪টা পর্যন্ত রেকর্ড করা হয় ‘প্রিয়তম একটু শোনো’ শিরোনামে একক সংগীতানুষ্ঠানের আটটি গান। 

সে তালিকায় রয়েছে দেশজুড়ে আলোড়ন তোলা গান ‘দু চোখে ঘুম আসে না’, ‘কাল সারারাত’, ‘মধুচন্দ্রিমা এই রাতে’, ‘সারা বাংলায় খুঁজি তোমারে’, ‘দারুণও বরষায় নদী’, ‘প্রিয়তম একটু শোনো’ ও ‘বন্ধু তুমি কই’। এর পাশাপাশি রেকর্ড করা হয় ‘খোলা হাটের বালুচরে’ শিরোনামে একটি আঞ্চলিক বিয়ের গান।

অনুষ্ঠানে বৈচিত্র্য আনতে কবিরুল ইসলাম রতনের পরিচালনায় তিনটি গানে আলাদাভাবে কোরিওগ্রাফি করা হয়েছে। অনুষ্ঠানটির নির্বাহী প্রযোজনার দায়িত্বে ছিলেন আফরোজা সুলতানা।

এ আয়োজন নিয়ে বেবী নাজনীন বলেন, ‘ঈদ উৎসব আনন্দময় করে তুলতেই দর্শক-শ্রোতার প্রিয় কিছু গান দিয়ে অনুষ্ঠানটি সাজানো হয়েছে। নির্মাণেও আছে নান্দনিকতার ছাপ। সব মিলিয়ে অনুষ্ঠানটি অনেকের ভালো লাগবে বলেই আশা করছি।’

দুই দশক পর বিটিভিতে ফেরা নিয়ে এই শিল্পী আরও বলেন, ‘বিটিভি শুধু রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলই নয়, সেই সঙ্গে বহু শিল্পী ও তারকার আঁতুরঘর। দশকের পর দশক পেরিয়ে গেছে, তারপরও যেখানে গান গাওয়া যেভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে, তার ইতি টানা প্রয়োজন মনে করেননি কেউ। রাজনৈতিক কারণে শিল্পীদের অদৃশ্য এক কালো তালিকা তৈরি করে সেখানে একরকম প্রবেশ নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। একজন শিল্পী হিসেবে জাতীয় গণমাধ্যমে গাইতে না পারা কষ্ট কেমন, তা দুই দশক ধরে উপলব্ধি করেছি। অবশেষে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিটিভিতে ফিরে আসা। এই ফেরা অন্যরকম এক ভালো লাগার। এখন আমার একটাই চওয়া, অতীতের ঘটনাগুলোর যেন আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে। প্রত্যেক শিল্পী যেন স্বাধীনভাবে প্রচার মাধ্যমগুলোয় নিজস্ব সৃষ্টি ও প্রতিভা তুলে ধরার যেন সুযোগ পান।’

এদিকে বিটিভির পাশাপাশি বিভিন্ন চ্যানেলের আরও কয়েকটি ঈদ অনুষ্ঠানে দেখা মিলবে বেবী নাজনীনের। এরই মধ্যে জিটিভির ‘টাইমলাইন বাংলাদেশ’ এবং একাত্তর টিভিতে জীবনীভিত্তিক একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন তিনি। শিগগিরই অংশ নেবেন যমুনা টিভির ‘যমুনার নিমন্ত্রণে’ অনুষ্ঠানে।

প্রসঙ্গত, ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’ ও ‘উত্তরবঙ্গের দোয়েল’খ্যাত শিল্পী বেবী নাজনীনের সংগীত ক্যারিয়ার চার দশকের বেশি সময়ের। দীর্ঘ এই সংগীত সফরে তিনি টিভি, চলচ্চিত্র, বেতারসহ দেশ-বিদেশের মঞ্চে গান করে কুড়িয়েছেন অগণিত শ্রোতার ভালোবাসা।

তাঁর গাওয়া ‘এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি শাড়ির আঁচল’, ‘কাল সারা রাত ছিল স্বপনেরও রাত’, ‘দু চোখে ঘুম আসে না’, ‘মানুষ নিষ্পাপ পৃথিবীতে আসে’, ‘ওই রংধনু থেকে’, ‘পত্রমিতা’, ‘মরার কোকিলে’, ‘আর কতদিন’, ‘লোকে বলে আমার ঘরে নাকি চাঁদ উঠেছে’, ‘প্রিয়তমা’সহ আরও অসংখ্য গান আজও শ্রোতাদের মনে অনুরণন তুলে যাচ্ছে।

অনিন্দ্য কণ্ঠ আর অনবদ্য গায়কীর জন্য ভূষিত হয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অগণিত পুরস্কার ও সম্মাননায়। সংগীত সাধনার পাশাপাশি রাজনৈতিক কমকাণ্ড নিয়েও এখন ব্যস্ত সময় কাটছে এ শিল্পীর। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ