শত বাধা ও প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে নারী ঘর সামলানোর পাশাপাশি নিজের ও পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৩-এর চতুর্থ প্রান্তিকের (অক্টোবর-ডিসেম্বর) প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে দেশে কর্মক্ষম জনশক্তি ৭ কোটি ১১ লাখ। এর মধ্যে কর্মজীবী পুরুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৬৪ লাখ আর কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ২ কোটি ৪৬ লাখ। পরিসংখ্যান লক্ষ্য করলে দেখা যায়, কর্মক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। কিন্তু ঘরের বাইরে কাজ করতে গিয়ে পদে পদে ভোগান্তিতে পড়তে হয় নারীকে। এ যুগে এসেও নারীদের ঘরের বাইরে কাজ করাকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়।
অফিস, সংসার ও সন্তান– সব সামলানোর পর নারীর মনে অনুশোচনা, অপরাধবোধের কমতি নেই। মা হিসেবে সন্তানকে আরেকটু সময় দেওয়া, স্ত্রী হিসেবে স্বামীকে এবং সন্তান হিসেবে বাবা-মার প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন নিয়েও আছে চিন্তা। তবে সদ্যোজাত সন্তান ও শিশুদের নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তার অভাব নেই– সন্তান কোথায়, কীভাবে কার কাছে থাকবে, কেমন থাকবে! সব ব্যবস্থা হলেও একজন করপোরেট মা অফিস থেকে টেলিফোন করে বারবার খোঁজখবর নিতে থাকেন সন্তানের। নূর নীসা রীমা নামে এমন এক করপোরেট মায়ের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের বয়স দুই বছর। সন্তান জন্মের আগে থেকে এখন পর্যন্ত সময়টা কত চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। সন্তান আসার খবরটা সবার জন্য সুখের হলেও আমার জন্য ছিল কষ্টের। সন্তান হবে, এমন খবরে একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে চাকরি স্থায়ী হওয়ার পরও আমাকে বিনা দোষে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আমি ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। প্রায় দুই বছর পর নানা সংকট ছাপিয়ে আবার যখন কাজ শুরু করি তখন সন্তান কোথায় রাখব, এই চিন্তায় আমার ঘুম হারাম হয়। অবশেষে অফিসের কাছাকাছি একটি চাইল্ড কেয়ারে সন্তানকে ভর্তি করি। এখন কিছুটা স্বস্তি এলেও ওকে সময়মতো আনা-নেওয়া করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অফিস মা হিসেবে আমাকে কিছু ছাড় দিলেও সময়মতো বেড়ে যাওয়ায় জটিলতা কাটাতে আরেকজনকে ঠিক করতে হয়েছে। ফলে যে আয় আসে তার অধিকাংশই চলে যায় এসবে। তবুও আমি কাজ চালিয়ে যেতে চাই, নিজেকে নিজের উপার্জনে চালাতে চাই।’
কথা হয় এই কিডস লিডজ প্রিস্কুল ডে কেয়ার অ্যান্ড চাইল্ড কেয়ার ইনস্টিটিউটের স্বত্বাধিকারী লীনা ফেরদৌসের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘১৫ বছর আগে আমি এই প্রতিষ্ঠান চালু করি। আমি করপোরেট অফিসে চাকরি করতাম। একটা সময় আমার সন্তানকে রাখা নিয়ে বেশ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলাম। কর্মজীবী মায়েদের এমন কষ্ট আমি বেশ অনুভব করতাম। তখন মায়েরা যেন সন্তানকে কোথাও নিশ্চিন্তে রেখে কাজ করতে পারে, এমন চিন্তা থেকেই আমার এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। এখানে যেসব শিশু আসে, তাদের অধিকাংশের বাবা-মাই কর্মজীবী। সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের বিকল্প নেই তবে আমরা চেষ্টা করি যতক্ষণ তাদের সন্তান থাকে যেন ঘরোয়া পরিবেশে সুস্থ ও নিরাপদে থাকে।’ মানসিক ও শারীরিক বিকাশের বিষয়টি প্রাধান্য দেই।’
অনেকে মনে করেন, ‘কর্মজীবী নারীর সন্তান বখে যায়। তারা মানুষ হয় না।’ কিন্তু হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, কর্মজীবী মায়েদের মেয়েরা জীবনে তুলনামূলক বেশি সফল হয়। আর এসব মায়ের ছেলেসন্তান হয় নারীর প্রতি অনেক যত্নশীল। গবেষণাপত্রে বলা হয়, যেসব মা শুধু গৃহকর্মে নিয়োজিত থাকেন, তাদের মেয়ের চেয়ে কর্মজীবী মায়ের মেয়েদের চাকরি করতে বা স্বনির্ভর হতে বেশি দেখা যায়। এমনকি কর্মজীবী মায়ের মেয়েরা অন্যদের চেয়ে বেশি উপার্জনও করেন। কর্মজীবী মা তাঁর বাড়িতে সন্তানদের জন্য একটি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে রাখেন। ফলে তাদের ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারে যে কার কতটুকু দায়িত্ব।’
তবে এসব বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় বাসস্থান সংকট, নারীবান্ধব পরিবহন, ডে-কেয়ার সেন্টারের অপর্যাপ্ত, যৌন হয়রানির ভয়, বেতন-বৈষম্য ইত্যাদি। তবে সব সংকট ও চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে এ দেশের কর্মজীবী নারীরা অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, যাবে– এটা সবার প্রত্যাশা। v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
নববর্ষে মেয়ের জন্ম, ডাক্তার খুশি হয়ে নাম রেখেছেন বৈশাখী
পহেলা বৈশাখে তৃতীয় সন্তান এসেছে চাঁদপুরের শাহাদাত হোসেন ও রিনা আক্তারের পরিবারে। বৈশাখের স্নিগ্ধ সকালে চাঁদপুর মা ও শিশু স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে মেয়ে সন্তান জন্ম নেয় তাদের ঘরে।
তাদের চরম এক টানাপড়েনের সংসারে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে মেয়ের আগমনে বেশ খুশি শাহাদাত-রিনা দম্পতি। সকালে মেয়ের মিষ্টিমুখ দেখে চিকিৎসক এবং নার্স হাসপাতালে নবজাতকের নাম তালিকাভুক্ত করার সময় পরিবারের সদস্যদের ডেকে বলেন, ‘আজ বাংলা নববর্ষ এবং পহেলা বৈশাখ। তাই মেয়ের নামটি আমরা তালিকায় বৈশাখী দিয়ে দিলাম। খুশি তো?’ নবজাতকের মা-বাবা মাথা নেড়ে সায়ও দেন।
তবে চিকিৎসক আবার সঙ্গে সঙ্গে এটাও বললেন, ইচ্ছে করলে আপনারা এই বিশেষ দিনের নামটার সঙ্গে নিজেদের পছন্দের আরও নাম জড়িয়ে রাখতেই পারেন। সেটা আপনাদের বিষয়।
নবজাতকের বাবা শাহাদাত হোসেন পেশায় একজন রিকশাচালক। ৮ বছর আগে দুই ছেলে- ৫ম শ্রেণির ছাত্র রহমত আর ছোট ছেলে মাদরাসায় পড়ুয়া ইসমাইলকে নিয়ে চলে আসেন চাঁদপুর জেলা শহরের রহমতপুর কলোনিতে। এখানে সেমিপাকা ছোট্ট এক রুমের ভাড়া বাসা নেন। তার মূল বাড়ি ফরিদগঞ্জ উপজেলার সকদী রামপুর গ্রামে। স্ত্রী রিনা আক্তারের বাড়িও একই উপজেলার পাশের গ্রামে।
শহরে এসে ভাড়ায় রিকশা চালান শাহাদাত। ৩'শ টাকা রিকশা মালিককে দেন আর এক দেড়-দুইশ টাকায় চলে সংসার।
বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখে জন্ম নেওয়া মেয়ে সন্তানটিকে নিয়ে কথা হয় শাহাদাত হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাত তিনটায় স্ত্রী রিনার প্রসব ব্যথা উঠে। ক্রমেই ব্যথা বাড়তে থাকলে একটা অটো ডেকে আমার এক ভাবীসহ বাসা থেকে আধা কিলোমিটার দূরে সরকারি মা ও শিশু স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে (মাতৃমঙ্গল নামে পরিচিত) নিয়ে যাই। সঙ্গে সঙ্গে দারোয়ান হাসপাতালের গেট খুলে দেয় এবং নার্স এসে আমার স্ত্রীকে বেডে নিয়ে যায়। পর পরই ডিউটি ডাক্তার আসেন।
তিনি বলেন, হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী আমাকে গেটের বাহিরে অপেক্ষা করতে বলে। তবে চিকিৎসক নার্সরা আমার ভাবীকে বলেন, চিন্তা করবেন না, সব কিছু ঠিক আছে। ইনশাআল্লাহ, উনার নরমাল ডেলিভারিই হবে এবং মা আর গর্ভের সন্তান ভালো আছে।
শাহাদাত হোসেন বলেন, হাসপাতালের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভোরের আলো ফুটে যায়। আর সে সময়ই হাসপাতালের পাশের অফিসার্স ক্লাব থেকে ভেসে আসছিল নববর্ষের গান। ঠিক তখনই গেট খুলে দিয়ে দারোয়ান বলেন ভেতরে আসেন আপনি মেয়ের বাবা হয়েছেন। তখন আল্লার কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম। ডাক্তার এবং নার্স বললেন- সকাল সাড়ে আটটায় আপনার মেয়ে জন্ম নিয়েছে। একটা স্যালাইন আর সামান্য কিছু ওষুধ দেওয়া হয়েছে। স্যালাইন শেষ হলেই ১০টার মধ্যেই বাসায় নিয়ে যেতে পারবেন। আর বাচ্চার ওজন ২ কেজি ৯ শ গ্রাম।
পহেলা বৈশাখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আপনার মেয়েকে কি উপহার দিলো, এমন প্রশ্নের জবাবে সরল হাসি দিয়ে রিকশাচালক শাহাদাত হোসেন বলেন, এই ভোররাতে তারা আমার বউ আর সন্তানের সেবায় একটুও হেলা করেনি। এটাই আমার মতো গরীব বাবার কাছে অনেক বড় উপহার। এর আগেও এই হাসপাতালে দুই-একবার গিয়েছিলাম। তারা তখনও অনেক যত্ন নিয়ে চিকিৎসা দিয়েছিলেন।
মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের চিকিৎসক মেহেদী আল মাসুদ জানান, নববর্ষের প্রথম প্রহরের রোগী রিনা আক্তার। তার চিকিৎসার কোনরূপ হেলা করিনি আমরা। আর এখানে আগে থেকেই আমরা গর্ভবতী মায়েদের প্রসব এবং অন্যান্য চিকিৎসাগুলো দিয়ে থাকি।
শাহাদাত হোসেন বলেন, গরীব ঘরের মেয়েকে কতদিন নিজের কাছে আগলে রাখতে পারবো আল্লাহই ভালো জানেন। তবে যথাসম্ভব চেষ্টা করবো মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মনুষ করার।
তিনি আরও বলেন, আমার মেয়ে যেন সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেচে থাকে সবাই এই দোয়া করবেন।