Samakal:
2025-04-13@20:29:05 GMT

আমাদের মুক্তি কত দূরে

Published: 22nd, March 2025 GMT

আমাদের মুক্তি কত দূরে

স্বাধীনতা ও মুক্তির কথা আমরা একসঙ্গেই শুনে থাকি, তারা কাছাকাছি বটে, কিন্তু এক বস্তু নয় মোটেই। তফাৎ আছে। যেমন ধরা যাক, ইংরেজ আধিপত্যের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধ, সেটিকে বলা হয় স্বাধীনতাযুদ্ধ। অন্যদিকে একাত্তরে আমাদের যে যুদ্ধ তাকে আমরা বলি মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের ওই যুদ্ধের আগে রাজনৈতিক দাবিটা প্রথমে ছিল স্বায়ত্তশাসনের, পরে আন্দোলন রূপ নিল স্বাধীনতা সংগ্রামের এবং যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অত্যন্ত দ্রুতগতিতে আকাঙ্ক্ষাটা চলে এলো মুক্তির, স্বাধীনতার যুদ্ধ পরিণত হলো মুক্তিযুদ্ধে।

মুক্তি আলাদা কিসে স্বাধীনতা থেকে? তফাৎটা কোথায়? হিসাব করলে দেখা যাবে, স্বাধীনতাকে চেষ্টা করলে গণনা করা যায়। যেমন বাকস্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, পছন্দ করার স্বাধীনতা, নারীর স্বাধীনতা; কিন্তু মুক্তিকে ওইভাবে গণনা করা হয় না। মুক্তি একটি সার্বিক অবস্থা, যার ভেতর অনেক রকমের স্বাধীনতা থাকতে পারে, থাকেও। ফলের ভেতরে থাকে যেমন বহু কোষ।
মুক্তির জন্য স্বাধীনতা দরকার, কিন্তু স্বাধীনতা এলেই যে মুক্তি আসবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। খাঁচায় আটক আছে যে পাখি তাকে ছেড়ে দেওয়া মাত্রই যে সে মুক্ত হয়ে যাবে এমনটা নাও ঘটতে পারে, খাঁচার ‘নিরাপদ’ আশ্রয়ে সে অভ্যস্ত হয়ে ভুলে যেতে পারে মুক্ত আকাশকে এবং মুক্তিকে অনিশ্চিত ও অনিরাপদ জ্ঞান করে ফিরে আসতে পারে খাঁচার বন্ধনে। আবার স্বাধীনতা না থাকলেও মানুষের মন মুক্ত থাকতে পারে এমন কথা বলা হয়েছে। কবি বলেছেন, পাথরের দেয়াল মানেই কারাগার নয়, কারাবন্দির স্বপ্নেও কল্পলোক থাকে বৈকি। কিন্তু আমরা ব্যতিক্রমের কথা ভাবছি না। আমরা বিবেচনা করছি এই সত্যকে যে মানুষের মন তার বস্তুগত অবস্থান দ্বারা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রিত হয়, মানুষ কোনো অতিপ্রাকৃত প্রাণী নয়, সে রক্তমাংসে গড়া, পাখির সঙ্গে অবশ্যই তার পার্থক্য রয়েছে, তাই বলে মিল যে নেই এমনও নয়।

এ পর্যন্ত এসে একটি জরুরি প্রশ্নের মুখোমুখি হব। কার মুক্তি নিয়ে ভাবছি আমরা, ব্যক্তির নাকি সমষ্টির? আসলে ব্যক্তিরই। ব্যক্তির মুক্তিই প্রথম বিবেচনা; সর্বশেষও বটে। মিল থাকুক কিংবা ঝগড়া থাকুক ব্যক্তিকে তো সমষ্টির ভেতরই থাকতে হয়। সন্ন্যাসী, অরণ্যবাসী কিংবা ধর্মানুশীলনে নিমগ্ন ব্যক্তির জন্য মুক্তির ব্যাপারটা একেবারেই আলাদা, সেটা একান্তই ব্যক্তিগত ও অসাধারণ। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক মুক্তির কথাটাই আমাদের বিবেচ্য, সে মুক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের ভেতর থেকেই পেতে হয়, তার বাইরে নয়। স্বাভাবিক মুক্তির ক্ষেত্রে পরীক্ষিত সত্য হলো এটা যে, সমষ্টির মুক্তি না এলে ব্যক্তির পক্ষে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব। ব্যক্তির মুক্তিই হচ্ছে সেই নিরিখ, যা দিয়ে পরীক্ষা করা যায় সমষ্টি কতটা মুক্ত এবং কোনদিক দিয়ে মুক্ত।

স্বাধীনতার বিষয়টা যে রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হবে এটা খুবই স্বাভাবিক। ব্রিটিশ যুগে আমাদের লড়াইটা ছিল স্বাধীনতার জন্য। কেননা রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা ছিলাম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন। স্বাধীনতার পরে সমাজের কী হবে সে বিষয়টা নিয়ে তখন তেমন একটা ভাবনা-চিন্তা করা হয়নি। মানুষ অস্থির ছিল শাসকদের হটিয়ে দিয়ে স্বাধীনতা লাভের জন্য। নিজেদের শাসন আগে আসুক, আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারটা পাওয়া যাক, তারপরে দেখা যাবে কীভাবে সবার জন্য মুক্তি নিশ্চিত করা যায়– মনোভাবটা ছিল এ রকমের। ফলে ব্রিটিশ যখন ভারত ছাড়তে বাধ্য হলো তখন দেখা গেল কেবল ক্ষমতার হস্তান্তরই ঘটল, রাষ্ট্র বা সমাজের কাঠামোতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন এলো না। মুক্তি তো দূরের কথা, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতাও পাওয়া যায়নি। ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রই রয়ে গেছে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অধীনে। পাকিস্তানের ব্যাপারটা তো আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্যেই রয়েছে। সে রাষ্ট্র ব্রিটিশের নয় শুধু, অতিদ্রুত চলে গেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অধীনে।

পূর্ববঙ্গের অবস্থাটা দাঁড়াল আরও খারাপ। পূর্ববঙ্গের মানুষ ছিল জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ জন, কিন্তু তাদের শতকরা ৪৪ জনের বাস যে পশ্চিম পাকিস্তানে তার উপনিবেশে পরিণত করা হলো। স্বাধীন হবে কী, সে হয়ে গেল ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের উপনিবেশ। শুরু থেকেই তাই আওয়াজ উঠেছিল স্বায়ত্তশাসনের। তারপরে ধাপে ধাপে পূর্ববঙ্গ এগিয়েছে স্বাধীনতার পথে, অবশেষে শুরু করেছে মুক্তিযুদ্ধ।
একাত্তরের যুদ্ধ নানা স্রোত ও শ্রেণি থেকে মানুষ এসেছিল। সবার লক্ষ্য এক ছিল না, কিন্তু শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে যে ঐক্যটা গড়ে উঠেছিল তার ভেতরকার মূল কথাটা ছিল মুক্তি। সবাই মুক্তি চেয়েছে এবং যদিও মুক্তি বলতে কী বোঝায় তা অধিকাংশ মানুষের কাছেই স্পষ্ট ছিল না, তবু অস্পষ্ট করে হলেও কামনা ছিল এমন একটি রাষ্ট্র ও সমাজের, যেখানে মানুষের ওপর মানুষের শোষণ থাকবে না। মানুষের সঙ্গে মানুষের থাকবে মৈত্রী, এবং সেই মৈত্রীই তাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে উন্নতির নতুন নতুন ক্ষেত্রে।

মুক্তির ধারণা ইউরোপে এক সময়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। ফরাসি বিপ্লবের রণধ্বনি ছিল স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর। তিনটি আলাদা আলাদা নয়, একসঙ্গে। মুক্তির ভিত্তি হচ্ছে ওই তিনটি উপাদান-স্বাধীনতা, সাম্য এবং মৈত্রী। স্বাধীনতাই প্রথমে আসে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়, চাই সাম্যও, দরকার মৈত্রীও, যে দুটি কিছুতেই আসবে না সাম্য না থাকলে। ফরাসি বিপ্লব হঠাৎ করে ঘটেনি, তার পেছনে একটি প্রাণবন্ত বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতি ছিল। সে দেশে তখন রাজতন্ত্রের দুঃশাসন চলছে। সঙ্গে ছিল পুরোহিততন্ত্রের অত্যাচার। মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। তারা স্বাধীনতা চাইছিল রাজতন্ত্র ও পুরোহিততন্ত্রের হাত থেকে। কিন্তু এই বোধ তাদের ভেতর ছিল যে, কেবল ওই দুই শত্রুর পতনেই মুক্তি আসবে না, যে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে রেখেছে সেটিকেও দূর করা চাই, তার জন্য দরকার সাম্য, সাম্য না থাকলে মৈত্রী আসবে না এবং সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটা যদি মৈত্রীর না হয়ে হয় শত্রুতার, তা হলে তো সেই সমাজ মনুষ্য বসবাসের উপযুক্ত হবে না। সেখানে তৈরি হবে না সামাজিক শক্তির। বিপ্লবীরা তাই একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠা চেয়েছিল স্বাধীনতা, সাম্য এবং মৈত্রীর।

আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। যুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু স্বাধীনতা তো দেখা যাচ্ছে না। ব্যক্তিস্বাধীনতা নেই। স্বাধীনতার হিসাব পরে, ব্যক্তিগত নিরাপত্তাই নেই, না অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, না জীবনের ক্ষেত্রে। ওদিকে রাষ্ট্র যে স্বাধীন তাও বলার উপায় নেই। যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকে অতিতীব্রভাবে বিরোধিতা করেছিল, এখন রাষ্ট্র চলে তাদের অঙ্গুলি সঞ্চালনে। দেশের শাসকশ্রেণি নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সাম্রাজ্যবাদীদের তোষণ করার ব্যাপারে। আর মুক্তি? সে তো সুদূরপরাহত।

ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ল স ব ধ নত র স ব ধ নত স ব ধ নত র ত র জন য আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

গানে-নাচে-আবৃত্তিতে বর্ষবিদায়

গতকাল রোববার ছিল ৩০ চৈত্র। বাংলা ১৪৩১ সনের শেষ দিন। বছরের শেষ দিনকে বিদায় জানাতে এ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘চৈত্রসংক্রান্তি’ উৎসব। বর্ষবিদায়ে ছিল গান, নাচ, আবৃত্তিসহ নানা আয়োজন।

আজ সোমবার পয়লা বৈশাখ। বাংলা নতুন বছর ১৪৩২ সনের প্রথম দিন। বাংলা পুরোনো বছরের বিদায় এবং নতুন বছরের আগমন উপলক্ষে প্রতিবছরের মতো এবারও চৈত্রসংক্রান্তির মধ্য দিয়ে চারুকলা অনুষদের তিন দিনের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা হয়।

চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে মুখোশ, কাগজের ঘূর্ণি, রঙিন কাগজ, তালপাতা, বাঁশসহ নানা গ্রামীণ উপকরণ দিয়ে বকুলতলা সাজানো হয়। পূর্বনির্ধারিত সময়ের চেয়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা দেরিতে বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে বকুলতলায় চৈত্রসংক্রান্তি অনুষ্ঠান শুরু হয়।

চারুকলার শিক্ষার্থী আরিবা, সিন্দিত, শর্মীর সমবেত কণ্ঠে ‘এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো/ তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক’ গান দিয়ে শুরু হয় এ আয়োজন।

এরপর ‘বাজেরে বাজে ঢোল আর ঢাক/এলো রে পহেলা বৈশাখ’ গানের সঙ্গে নাচ পরিবেশন করেন জয়া, আঁচল ও গল্প। চারুকলার শিক্ষার্থী সুপ্রিয় কুমার ঘোষ আবৃত্তি করেন ‘বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও/ ক্ষমা করো আজিকার মতো/ পুরাতন বরষের সাথে/ পুরাতন অপরাধ যত’। বকুলতলায় এভাবে চলতে থাকে একের পর গান, কবিতা, নাচ। আর এই আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়টির চারুকলা অনুষদের বর্তমান শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন।

অনুষ্ঠানের সূচনা বক্তব্যে চারুকলার বৈশাখ উদ্‌যাপন কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক এ এ এম কাওসার হাসান বলেন, এবারের বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা উদ্‌যাপনের জন্য ব্যাপকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন চারুকলা অনুষদের খণ্ডকালীন শিক্ষক জাকিয়া আহমেদ ও মেরাজি আশা।

চারুকলা অনুষদের তথ্য অনুযায়ী, তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিন আজ সোমবার সকাল ৯টায় শুরু হবে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। তৃতীয় দিন আগামীকাল মঙ্গলবার রাত ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় যাত্রাপালার আয়োজন করা হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ