কুরস্কে পিছু হটেছে ইউক্রেন, অভিযান ঘিরে নানা প্রশ্ন
Published: 22nd, March 2025 GMT
বন্ধু পাভলো হুমেনিউকের (২৪) সঙ্গে সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে বার্তা আদানপ্রদান হয়েছিল মারিয়া পানকোভার। ওই সময় মারিয়ার ধারণা ছিল না যে পাভলো রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনের হয়ে লড়াই করছেন। কিছুদিন পর মারিয়া জানতে পারেন ইউক্রেনের ৪৭ মাগুরা ব্রিগেডের সদস্য পাভলোর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। মারিয়াকে ওই ব্রিগেডের আরেক সেনা জানায়, গত ৬ ডিসেম্বর কুরস্কের নভোইভানিভকা গ্রাম থেকে নিখোঁজ পাভলো। মারিয়া বলেন, চার মাস পেরিয়ে গেছে। পাভলোর ভাগ্য এখনো অজানা। তিনি এখনো বেঁচে আছেন কি না তা জানতে ফেসবুক, টেলিগ্রামসহ সবখানে খুঁজে বেড়াচ্ছেন মারিয়া।
মারিয়া পানকোভা মনে করেন, ইউক্রেন ঝুঁকি নিয়ে রাশিয়ার কুরস্কে যে অভিযান চালিয়েছে, তার অত্যন্ত চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। মারিয়ার মতো এমন কথা ইউক্রেনের অনেকেই এখন বলছেন। তাঁরা এ অভিযান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
ইতিমধ্যে চলতি মার্চ মাসে রুশ সেনাদের সঙ্গে ব্যাপক লড়াইয়ের পর ইউক্রেনের সেনাদের পিছু হটতে বাধ্য হতে হয়েছে। এর পর থেকে ইউক্রেনের অনেকেই কুরস্ক অভিযান নিয়ে তাঁদের প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন।
চোখের পানি মুছতে মুছতে মারিয়া বলেন, এটার দরকার ছিল কি না, তা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই। মারিয়া বলেন, ‘আমরা অনুপ্রবেশকারী নই। আমরা শুধু আমাদের এলাকা ফিরে পেতে চাই। আমাদের রাশিয়ার কোনো এলাকা দরকার নেই।’
এ বিষয়ে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর জেনারেল স্টাফ আন্দ্রি গনাটভ বলেন, এ অভিযান চালানো হয়েছিল রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়াতে, রুশ সেনাদের মনোযোগ ভিন্নদিকে ফেরাতে। এ ছাড়া ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে কুরস্কে অভিযান চালানো হয়।
ইউক্রেনের জেনারেল স্টাফ আরও বলেন, ওই অভিযানের অধিকাংশ লক্ষ্যই পূরণ হয়েছে। এ অভিযান ঠেকাতে রাশিয়াকে ৯০ হাজার সেনার বাহিনী গড়তে হয়। এর বাইরে ১২ হাজার উত্তর কোরিয়ার সেনা তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
গত বছরের আগস্ট মাস থেকে কুরস্কে হামলা শুরু করে ইউক্রেন। তাদের আকস্মিক এ হামলায় পুরো বিশ্ব চমকে গিয়েছিল। ১৯৪১ সালের নাৎসি হামলার পর রাশিয়ায় এত বড় হামলার ঘটনা আর ঘটেনি। ইউক্রেনের সেনাদের আক্রমণে কুরস্কের ১ হাজার ৩৭৬ কিলোমিটার এলাকা ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কিন্তু সেনা-স্বল্পতার কারণে ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ কয়েক সপ্তাহের মধ্যে খাদের কিনারায় চলে আসে। এ আক্রমণে কিয়েভ মেরিন ও বিমানবাহিনীর সেনা ব্যবহার করে। তবে বিশাল এলাকার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য সেনা অপ্রতুল হয়ে দাঁড়ায়।
ইউক্রেনের পার্লামেন্টের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কমিটির আইনপ্রণেতা সের্হি রাখমানিন বলেন, শুরু থেকে রসদ সরবরাহ ব্যবস্থা গুরুতরভাবে জটিল ছিল। শুরু থেকে রাশিয়ার জন্য পর্যাপ্ত সেনা থাকার সুবিধা ছিল। গত বছরের শেষের দিকে রাশিয়া তাদের প্রশিক্ষিত বাহিনীর সঙ্গে ড্রোন সুবিধা যুক্ত করে। একই সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সেনারাও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এতে কোণঠাসা হয়ে পড়েন ইউক্রেনের সেনারা।
কুরস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনের সেনাদের হটিয়ে রাশিয়া মূলত শান্তিচুক্তির আগে ইউক্রেনের হাতে থাকা একটি দর-কষাকষির গুটি ছিনিয়ে নিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়া ও ইউক্রেনকে যুদ্ধবিরতিতে যেতে চাপ দিচ্ছেন। তবে রাশিয়ার দাবি হচ্ছে, ইউক্রেনে তারা যে এক-পঞ্চমাংশ ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, এর দাবি তারা ছাড়বে না।
কুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ শহর সুদঝা থেকে ১৬ মার্চ পিছু হটে ইউক্রেনের বাহিনী। এর পর থেকে ইউক্রেনের জনগণের মনে রাশিয়ায় অনুপ্রবেশের সুবিধা নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি তৈরি হয়েছে। কুরস্কের লড়াইয়ে এক হাত হারানো সৈনিক ওলেক্সি দেশেভি বলেন, ‘তিনি এ অভিযানের কোনো যুক্তি দেখতে পান না। তিনি বলেন, আমাদের এ অভিযান শুরু করা ঠিক হয়নি।’
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি স্বীকার করেন, তাঁর বাহিনী কুরস্কে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছে। তবে রুশ বাহিনী তাদের সেনাদের ঘিরে রেখেছে বলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দাবিকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ইউক্রেনের সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্রেনের সুমি অঞ্চলে হামলা শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছেন রুশ সেনারা।
পাল্টাপাল্টি হামলা
ট্রাম্পের সঙ্গে কথোপকথনে জ্বালানি অবকাঠামোর ওপর হামলা বন্ধে ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি নিয়ে সম্মতির কথা বলেছেন পুতিন। তা সত্ত্বেও গত শুক্রবার রাশিয়া ও ইউক্রেন পাল্টাপাল্টি হামলা চালিয়েছে। রাশিয়ার পক্ষ থেকে তাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় একটি গ্যাস পাম্পিং স্টেশন উড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। এদিকে রুশ বাহিনীর হামলায় জাপোরিঝঝিয়াসহ কয়েকটি অঞ্চলে পাঁচজন নিহত হয়েছেন।
ইউক্রেনকে সহায়তা জার্মানির
জার্মানির পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে সামরিক সহযোগিতা হিসেবে ৩২৫ কোটি ইউরো অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সীমিত যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা শুরুর আগে জার্মানির পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য সরকার বলেছে, তিন বছর আগে ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তারা রাশিয়ার ৩২ বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদ জব্দ করেছে। এ ছাড়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও নিষেধাজ্ঞা জারির কথা ভাবছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউক র ন র স ন ন ইউক র ন ক রস ক র
এছাড়াও পড়ুন:
'দুই বেটি নিয়া হামার কোনো কষ্ট নাই'
‘বাহে, শনিবার রাইত ১০টার সময় ছাওয়াটার ব্যথা ওঠে। সে কি ব্যথা, আতালি পাতালি। গ্রামের দাই আসি অনেক চেষ্টা করিল। কই, কিছুই তো হইল না। এলা কি করং, অতো রাইতত হাসপাতাল যাইম কেমন করি! গাড়ি, ঘোড়া, রিকশা-কিছুই নাই। তারপর একখান অটোরিকশা জোগাড় করি ভোর ৫টার সময় ফুলবাড়ি থাকি লালমনিরহাট রওনা হইনো। শহরের সাপটানা বাজারের ক্লিনিকে হাজির হই হামরাগুলা। ক্লিনিকের লোকজন অপারেশন করি মোর ছোট নাতনিক দুনিয়ার মুখ দেখায়ছে।'
নববর্ষের প্রথম প্রহরে জন্ম নেওয়া নাতনির সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন জমিলা বেগম। বলতে থাকেন, ''বাহে, হামরা গরিব মানুষ, অতো কিছু বুঝি না, তোমরাগুলা এই গরিবের ছাওয়াক যে সম্মান কইরলেন, তাতে মনটা ভরি গ্যালো। হাউস করি নাতনির নাম রাখমো ‘বৈশাখি’।’’
লালমনিরহাট শহরের খোদেজা ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সোমবার সকাল ৬টায় শাহ আলম ও হামিদা দম্পতির কোলজুড়ে আসে কন্যাশিশু। বাংলা বছরের প্রথম দিনে সন্তান উপহার পেয়ে তাদের পরিবারে বইছে খুশির বন্যা। এটি তাদের দ্বিতীয় কন্যাসন্তান। বড় মেয়ে শিমু নার্সারি শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে।
পার্শ্ববর্তী কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার নাওডাঙ্গা কুমারপাড়া গ্রামের শাহ আলম মিয়া বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে পুরোনো খাতাপত্র, পত্রিকা, ভাঙ্গা টিন কিনে শহরে তা বিক্রি করেন। দিনে তিন থেকে চারশ টাকা আয় হয়। তা দিয়েই চলে সংসার। পাঁচ শতকের বসতভিটায় তিন ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে তিনি বসবাস করেন। বসতভিটার ওইটুকু জায়গা ছাড়া আর কিছুই নেই তার। তাই সন্তানকে ক্লিনিকে রেখে টাকার সন্ধানে ছুটছেন। কারো কাছ থেকে টাকা নিয়ে ক্লিনিকের বিল পরিশোধ করতে হবে। শাহ আলম বলেন, ‘মুই বাহে হকার, দিন আনি দিন খাই। হামার নববর্ষ বলি কিছু নাই। দোয়া কইরবেন ছাওয়াক মুই নেখাপড়া শিখাইম। দুই বেটি নিয়া হামার কোনো কষ্ট নাই। আল্লাহ সুস্থ রাখছে, তাতে হামরা খুশি।'
শাহ আলমের এসব কথা শুনে ক্লিনিকের বিছানায় শুয়ে থাকা নবজাতকের মা হামিদা বেগম বলেন, ‘আমি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করেছি। বাবা অটোরিকশা চালান। অভাবের সংসারে ইচ্ছা থাকার পরও লেখাপড়া করতে পারিনি। ২০১৪ বিয়ে হয়। পরের বছর প্রথম সন্তানের জন্ম হয়।' দুই মেয়েকে লেখাপড়া শেখানোর ইচ্ছা রয়েছে বলে জানান তিনি।
ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিশ্বজিৎ জানান, বাড়িতে অনেক চেষ্টা করেও হামিদার নরমাল ডেলিভারি করাতে পারেনি পরিবার। সময় ক্ষেপণ করায় বেশ সমস্যা হয়েছিল। পরে অস্ত্রোপচার করেন বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রাক্তন প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. ভোলানাথ ভট্টাচার্য্য। তাকে সহায়তা করেন ডা. হাবিব। ডা. ভোলানাথ ভট্টাচার্য্য জানান, মা ও শিশু এখন সুস্থ রয়েছে।