ঢাকার কেরানীগঞ্জে ‘জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে’ দিনদুপুরে এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও একজন। আজ বেলা দেড়টার দিকে কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের গোলামবাজার বড় মসজিদ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

নিহত জুবায়ের হোসেন (৩৬) দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা উত্তরপাড়া মসজিদপাড় এলাকার বাসিন্দা এবং নির্মাণসামগ্রীর ব্যবসা করতেন। এ ঘটনায় আহত বাবু খান (২৮) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী ও স্বজনদের সূত্রে জানা গেছে, আজ বেলা সোয়া একটার দিকে গোালামবাজার এলাকায় নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে (আবু বকর সিদ্দীক এন্টারপ্রাইজ) বসে ছিলেন জুবায়ের। এ সময় বাবুও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। হঠাৎ স্থানীয় অর্ধশতাধিক ব্যক্তি সেখানে ঢুকে অতর্কিতভাবে তাঁদের ওপর হামলা চালান। দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে জুবায়েরকে পেছনে থেকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে তাঁরা। এ সময় একটি চায়ের দোকানে ঢুকে প্রাণে বাঁচার আকুতি জানান জুবায়ের। তখন দলটির সদস্যরা সেখান থেকে তাঁকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে এনে মাথা, বুকের ডান পাশ ও পিঠের বাঁ পাশে গুলি করেন। এরপর তাঁরা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান। পরে স্থানীয় লোকজন জুবায়ের ও বাবুকে উদ্ধার করে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে জুবায়েরকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। আর গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়ে সেখানে চিকিৎসাধীন আছেন বাবু।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গোলামবাজার বড় মসজিদ এলাকার একাধিক ব্যবসায়ী জানান, জুবায়ের নির্মাণসামগ্রীর পাশপাশি জমি বেচাকেনার ব্যবসাও করতেন। আওয়ামী লীগের আমলে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা তাঁতী লীগের সভাপতি ওমর ফারুক ঢালী ওরফে মোল্লা ফারুক গোলামবাজার এলাকায় একটি জমি দখল করেন। ওই জমির মালিকানা নিয়ে মোল্লা ফারুকের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দা সেন্টুর মিয়ার বিরোধ চলছিল। সম্প্রতি ওই জমি দেখভালের জন্য জুবায়েরকে দায়িত্ব দেন সেন্টু। আজ শনিবার সকালে জুবায়েরের উপস্থিতিতে ওই জমিতে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়। এতে জুবায়েরের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে মোল্লা ফারুকের নির্দেশে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে ওমর ফারুকের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। গত ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে আছেন।

ঘটনার পর ঢাকা জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কেরানীগঞ্জ সার্কেল) জাহাঙ্গীর আলম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তিনি বলেন, কী কারণে এবং কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। দোষীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ল মব জ র ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

সবাই ভয়ে পালিয়েছে, ভারতের নন্দনগরে এক মুসলিম পরিবারের টিকে থাকার লড়াই

নন্দাকিনী নদীর তীরে রোজ সকাল আটটায় নিজের ড্রাই ক্লিনিংয়ের দোকানের বাদামি শাটার খুলে কাজ শুরু করেন আহমেদ হাসান। উত্তর ভারতের হিমালয় অঞ্চলের উত্তরাখন্ড রাজ্যের নন্দনগরে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসছেন তিনি।
সকালে দোকান খুলে নিত্যদিনের কাজ শুরু করেন হাসান। শুকনো পদ্ধতিতে পরিষ্কার (ড্রাই ক্লিনড) করা কাপড় নিজের দোকানের গোলাপি দেয়ালের প্লাস্টিক কভারে সুচারুভাবে ঝুলিয়ে রাখেন। এরপর ৪৯ বছর বয়সী এই ব্যক্তি গ্রাহকের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মধ্যাহ্নভোজের আগে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন গ্রাহক হাসানের কাছে আসতেন। শেরওয়ানি, স্যুট, কোট, প্যান্ট এবং শীতকালীন পোশাক তাঁর কাছে পরিষ্কার করতে দিতেন। কোনো কোনো গ্রাহক তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতেন। চা খেতে খেতে রাজনীতি নিয়ে আলাপ ও মজা করতেন, হাসি–আনন্দ ও সুখ-দুঃখ বিনিময় করতেন। গ্রাহকদের বেশির ভাগ ছিলেন হিন্দু, অল্প কিছু ছিলেন মুসলিম।
কিন্তু ১২ এপ্রিল দুপুর পর্যন্ত পাঁচজনেরও কম হিন্দু গ্রাহক হাসানের দোকানে এসেছেন। তিনি জানান, কোনো মুসলিম গ্রাহকের আশায় থাকা বৃথা। এ সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে।

নন্দনগরে এখন হাসানই একমাত্র মুসলিম পুরুষ। অথচ এই শহরে কয়েক মাস আগেও ১৫টি মুসলিম পরিবার ছিল, যারা বংশপরম্পরায় এখানে বসবাস করে আসছিল। হাসানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এখানেই। প্রতিবেশী হিন্দুদের সঙ্গে তাঁর পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল। পূজা-পার্বণে হিন্দুরা তাঁদের নিমন্ত্রণ করতেন। আর ঈদের সময় হিন্দু প্রতিবেশীদের তাঁরা দাওয়াত দিতেন। প্রতিবেশী হিন্দু মারা গেলে শবদাহের জন্য তিনি কাঠ সংগ্রহ করতেন, হিন্দু বন্ধুদের মরদেহ কাঁধে বহন করে শ্মশানে নিয়ে গেছেন।

কিন্তু গত সেপ্টেম্বরে এই এলাকায় মুসলিমবিরোধী সহিংসতা শুরুর পর এ সবকিছু রাতারাতি বদলে গেছে। এক হিন্দু মেয়েকে যৌন হয়রানির অভিযোগে এ সহিংসতা শুরু হয়েছিল। তবে নন্দনগরে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে মন–মানসিকতায় আরও আগে থেকেই বড় পরিবর্তন সূচনা হয়েছিল, যা করোনাকাল থেকে খেয়াল করে আসছিলেন হাসান।

গত সেপ্টেম্বরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে শারীরিক হামলার আগে তাঁদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ঘৃণামূলক স্লোগান দেওয়া হতো। মুসলিমবিরোধী কিছু বিক্ষোভও হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় হিন্দু মেয়েকে যৌন হয়রানির অভিযোগে তাঁদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। দোকানপাট ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রাণভয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মানুষেরা রাতের আঁধারে নন্দনগর ছেড়ে পালিয়ে যান।

হাসানও পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি স্ত্রী, দুই মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে ফিরে আসেন। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই ছোট্ট শহর আবার মুসলিমদের বসবাসের উপযোগী করার ব্যাপারে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কারণ, এটাই তাঁদের জন্মভূমি। কিন্তু হাসানের পরিবারকে সেখানে এখনো ভয়ে ভয়েই থাকতে হচ্ছে।

হিন্দু প্রতিবেশীরা এখন হাসানের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন না। আগে তিনি সন্ধ্যায় নিয়মিত নন্দাকিনী নদীর তীরে হাঁটতে গেলেও এখন যান না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের কারও সঙ্গে দেখা করতে দেন না। তাঁর আশঙ্কা, আবারও সহিংসতা দেখা দিতে পারে।

হাসান বলেন, ‘আমি সোজা দোকানে যাই, দোকান থেকে বাসায় আসি। সারাটি জীবন এই শহরে কাটালেও নিজেকে আমার এখন ভূত বলে মনে হয়। আমি যেন সম্পূর্ণ অদৃশ্য। এমনকি কেউ আমার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলছেন না।’

‘মুসলিমদের জুতা দিয়ে পেটাও’

রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে গাড়িতে করে নন্দনগর যেতে সময় লাগে প্রায় ১০ ঘণ্টা। ভারত-চীন সীমান্তের কাছাকাছি স্থানের এই শহরটি নন্দাকিনীর কয়েকটি উপনদীর সংগমস্থলে অবস্থিত। গঙ্গার ছয়টি উপনদীর একটি হলো নন্দাকিনী, যাকে হিন্দুরা পবিত্র বলে বিশ্বাস করেন। শহরটি জনসংখ্যা প্রায় দুই হাজার।

হাসানের দাদা পার্শ্ববর্তী উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বিজনৌর জেলার নাজিবাবাদ শহর থেকে ১৯৭৫ সালে নন্দনগরে এসেছিলেন। তাঁদের পরিবার সেখানেই বসতি গড়ে। পরের বছর হাসানের জন্ম হয়।

এক মুসলমান নরসুন্দরের যৌন হয়রানির অভিযোগের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ মিছিলে হাসান ও নন্দনগরের অন্য মুসলমানরাও অংশ নিয়েছিলেন

সম্পর্কিত নিবন্ধ