নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ছয় বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে দু’জনকে  গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

গ্রেপ্তাররা হলো- শরিয়তপুরের পালং থানাধীন খেয়ালপুর গ্রামের মো. শাহজাহানের ছেলে হাসান ও পিরোজপুরের নেছারাবাদ থানাধীন মাগুরা গ্রামের আনিছুজ্জামান রনির ছেলে মাজিদুল আলিফ ওরফে শাহরিয়া। আহত ওই শিশুকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করে তার পরিবার।

এ ঘটনায় শুক্রবার রাতে ভুক্তভোগীর মা নুসরাত জাহান বাদি হয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় তিনজনের নামে অভিযোগ দায়ের করলে পুলিশ ওই দু’জনকে গ্রেপ্তার করে। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে সিদ্ধিরগঞ্জের সাহেবপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। অভিযুক্ত আরেকজন হলো সাহেব পাড়া এলাকার জাহাঙ্গীরের ছেলে আরাফাত।  

ভুক্তভোগীর পরিবার ও অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, একই বাড়িতে বসবাসের সুবাদে ঘটনার রাতে ভুক্তভোগী শিশুটি খেলাধুলা করতে করতে ঘর থেকে বাইরে চলে যায়। এই সুযোগে অভিযুক্তরা শিশুটিকে তাদের ঘরে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করে। পরে শিশুটির মা টের পেয়ে চিৎকার করলে অভিযুক্তরা শিশুটিকে ছেড়ে দেয়। 

ভুক্তভোগী শিশুর মা নুসরাত জাহান বলেন, অভিযুক্তরা আমাদের প্রতিবেশি। অভিযুক্ত আরাফাতদের বাসায় অপর দুই অভিযুক্তসহ আমরা ভাড়া থাকি। ঘটনার রাতে আমি বাসায় রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। আমার মেয়ে তখন খেলাধুলা করছিল।

পরে দীর্ঘ সময় আমার মেয়েকে দেখতে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে অভিযুক্ত হাসানের বাসায় গিয়ে দেখি আমার মেয়েকে নগ্ন কওে সে ধর্ষণের চেষ্টা করছে এবং অপর দুই অভিযুক্ত আলিফ-আরাফাত সহযোগীতা করছিল।

বিষয়টি নিশ্চিত করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ শাহিনূর আলম জানান, অভিযুক্ত দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শিশুটিকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পরবর্তী আইনানুগ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।
 

.

উৎস: Narayanganj Times

কীওয়ার্ড: স দ ধ রগঞ জ ন র য়ণগঞ জ স দ ধ রগঞ জ

এছাড়াও পড়ুন:

গণ-অভ্যুত্থানে শ্রমিক আকাঙ্ক্ষা: সমাজ ও সংস্কৃতিতে শ্রমিক সুরত

বাধা ডিঙিয়ে হয় না পাখা মেলা

জন্ম থেকেই জোটে না কানাকড়ি সময়ও

তবু প্রতিক্ষণে তোমায় ক্ষুদ্র-তুচ্ছ ভাবায় তারা।

আপসে মেনে নেওয়া যেন নিয়তি তোমার।

যতক্ষণ ওই নিষ্ঠুর চাপানো নিয়তির তীব্র যন্ত্রণা কুরে কুরে না খায়

যতক্ষণ না তা অসহনীয় হয়ে ওঠে

ততক্ষণ যেন তা তোমার গায়ে সয়ে রয়

একজন শ্রমিকশ্রেণির নায়ক হওয়া সহজ কথা নয়

একজন শ্রমিকশ্রেণির নায়ক হওয়া সহজ কথা নয়

[জন লেনন (১৯৪০-১৯৮০)–এর ‘শ্রমিকশ্রেণির নায়ক’ গানের ভাবালম্বনে]

সমাজে শ্রম কিংবা শ্রমিকের জীবনের মূল্য কত? তার পরিমাপ বা চিত্রায়ণ হয় কীরূপে? সেই ভাবনায় জন লেননের কালজয়ী গান ‘শ্রমিকশ্রেণির নায়ক’–এর কথা মনে পড়ে। গানে গানে যুক্তরাজ্যের কবি–চিত্রশিল্পী–লেখক-গায়ক-সংগঠক জন লেনন শ্রমিকের পরিচয় সম্পর্কে বলেন, ‘জন্মের পর থেকেই…প্রতিক্ষণে তোমায় ক্ষুদ্র-তুচ্ছ ভাবায় তারা।’ মনে পড়ে রোকেয়া সাখাওয়াতের লেখা ‘সুলতানার স্বপ্ন’ প্রবন্ধের লাইন, ‘শিখিবার পূর্বেই আমাদের ডানা কাটিয়া লওয়া হয়।’ রোকেয়া সাখাওয়াত যদিও নারীদের অবস্থা নিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন, কিন্তু এ কথা সব নারী–পুরুষ শ্রমিকের বেলায় সমান প্রযোজ্য। এমনই সেকাল-একালে সময় যত গড়ায়, নতুন এ জমানার নারী ও পুরুষ শ্রমিক যেন আধুনিক দাসের লেবাসে পর্দায় পা রাখেন। এ বিষয়ে সমাজের ওপরতলা থেকে খোদ শ্রমজীবীদের বাহাস-লড়াই ইতিহাসে কালে কালে চলমান থাকে। কখনো কোনো বিশেষ ঐতিহাসিক দিনে, আন্দোলনমুখর মুহূর্তে কিংবা কোনো মাহেন্দ্রক্ষণে এ আলাপ ওঠে তুঙ্গে। ‘জুলাই ২০২৪ গণ-অভ্যুত্থান’ আমাদের সেই রকম ক্ষণে হাজির করেছে। তাই এ যাত্রায় লড়াইয়ের ময়দানে, পুলিশের লাঠি-বারুদ-কাঁদানে গ্যাসের শেল কিংবা বন্দুকের নলের মুখে, মন্ত্রণালয়ের টেবিলে, জুলাই–পরবর্তী নানা সংস্কার কমিশনে অথবা দেশি–বিদেশি সরকার-মালিকদের নির্দেশনামা-পরিকল্পনা-রোডম্যাপে কিংবা সুধী সমাজের গবেষণা-সভা-সেমিনারে জাতীয় অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির আলাপে শ্রমিক কল্যাণ প্রশ্নের ঠাঁই জুটেছে।

এটাকে কেউ কেউ ইতিহাসের দায় মেটানোর ও পাকাপোক্ত জবাবদিহির কাঠামো তৈরির সুযোগ বলেও চিহ্নিত করতে পারেন। একই সঙ্গে চিহ্নিত করতে পারেন চব্বিশ গণ-অভ্যুত্থানের শিক্ষার্থী-শ্রমজীবী, নারী-শিশুর জীবনের বিনিময়ে পাওয়া এক সুবর্ণরেখায়। সন্দেহ নেই, এই রেখা বাংলাদেশের জনগণের জন্য এক বিশেষ মুহূর্ত। এই মুহূর্তের দায় খুব তাড়াহুড়োয় বা রাতারাতি পূরণ সম্ভব নয়, তা–ও জানি। কিন্তু দিন শেষে এই দায় অপূরণীয় থাকলে আর যেই ছাড়ুক, ইতিহাস পিছু ছাড়বে না।

সমাজে শ্রমজীবীর আসল পরিচয় কী? তাঁর পাওয়া না–পাওয়া বা অধিকারই–বা কী? জাতীয় অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নের সংযোগ কী? সমাজের বাস্তব পাটাতনে এই হিসাব-নিকাশ বাদ দেওয়ার পথ নেই। নতুন করে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া এখন আবশ্যক। কারণ, শ্রমিকের মৌলিক অধিকার কী অবস্থায় আছে, সেই আলাপ ছাড়া দেশে গণতন্ত্র, জবাবদিহি ও উন্নতির অগ্রগতির পরিমাপ সম্ভব নয়। ফ্যাসিবাদ সশরীর বিদায় হলেই শ্রমিক ও জনগণের জীবনমানে উন্নতি হয় না। মন ও মননে গেড়ে বসত করা ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির সমূলে বদল হলে তবেই শ্রমিকের নাগরিক-গণতান্ত্রিক অধিকার ও ভয়মুক্ত কর্মপরিবেশ তৈরির পথ প্রশস্ত হয়। সুগম হয় জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ। তাই সমাজে বিরাজমান শ্রেণি-জাত-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গবৈষম্যের আলোকে এই চাওয়া-পাওয়ার সীমাকে পাঠ করতে হবে। বিশেষভাবে এ ক্ষেত্রে যুক্ত করা প্রাসঙ্গিক, নারী শ্রমিকের ওপর চাপানো ঘর-গেরস্তালি ও কর্মস্থলের দ্বৈত বোঝা এবং শ্রম খাত ও শ্রমিকের ওপর বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব প্রশ্নও।

বলার অপেক্ষা রাখে না, গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে শ্রমিক আন্দোলনে জান, জীবিকা ও জবানের অধিকার, নারী-পুরুষ ও অন্যান্য লিঙ্গের সম–অধিকার এবং নাগরিক মর্যাদা প্রথম চাওয়া। পাশাপাশি দরকার ক্ষতিপূরণ ও মজুরির মর্যাদাপূর্ণ মানদণ্ড নির্ধারণসহ ন্যায়সংগত অধিকারের বাস্তবায়ন, যা পূরণে দেশে একটি অভিন্ন গণতান্ত্রিক শ্রম আইন, মর্যাদাপূর্ণ খাতভিত্তিক ও জাতীয় ন্যূনতম মজুরির মতো সব অধিকারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তেমনি আবশ্যক মতপ্রকাশ, সংগঠন ও প্রকৃত ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিগ্রস্ত ইউনিয়নের চর্চা বন্ধে আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন চলমান রাখা।

একই সঙ্গে শ্রমিক ও শ্রম খাত–সম্পর্কিত সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ [শ্রম অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, শ্রম শিল্প সম্পর্ক শিক্ষায়াতন আইআরআই, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ ইত্যাকার সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান) সর্বত্র জবাবদিহি, গণতান্ত্রিক চর্চা, স্বচ্ছতা ও তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারকেও প্রতিষ্ঠিত করার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার সময় এটা। এসব বাস্তবায়নের খাতিরে যথাযথ রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা-উদ্যোগ ও ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের বিকল্প নেই।

মাঠের লড়াই, আইনি লড়াই ও সাংস্কৃতিক লড়াই—এই তিন ময়দানেই সমসক্রিয় উপস্থিতি ছাড়া গণ-অভ্যুত্থানের অর্জন আবারও শ্রমিক ও জনগণের হাতছাড়া হবে। তাই শ্রমিকের মর্যাদাপূর্ণ পরিচয় নির্ধারণ এবং অধিকার বাস্তবায়নের রাজনীতি নতুন মাত্রায় সক্রিয়-সজ্জিত রাখা এখন সময়ের আকাঙ্ক্ষা। দিন শেষে শ্রমিকের জীবন কেমন হবে, সেটি কেবল শ্রমিকপক্ষ কিংবা উদ্যোক্তারা বিচ্ছিন্নভাবে নির্ধারণ করেন না। এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। ফলে একে রাজনীতি নিরপেক্ষভাবে বিচার করার পথ নেই।

শ্রমিকের জীবনমান ও শ্রম খাতের বিকাশের সঙ্গে পুরো দেশের নাগরিকের জীবন, গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। তাই এ খাতের উন্নয়ন বাস্তবায়নে আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও মনোনিবেশ করা শ্রমিক আন্দোলনের এই মুহূর্তের ঐতিহাসিক কর্তব্য। বাংলাদেশের আর যেকোনো সময়ের সঙ্গে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী এই সময়কে গুলিয়ে ফেললে ইতিহাসে সেই ভুলের মাশুল টেনে বেড়াতে হবে।

বর্তমানে দেশের মোট শ্রমশক্তি প্রায় সাড়ে সাত কোটি। মোট জনগোষ্ঠীর বড় অংশ তারা। তরুণ নারী-পুরুষ মিলে ভোটের হিসাবেও এটি কোনো অংশে ছোট নয়। অথচ এর প্রায় ৮৫ ভাগ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক। যাঁদের কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই। তাঁদের জীবনে মঙ্গল প্রদীপের ছোঁয়া লাগাতে এবং শ্রম ও শিল্প খাতকে শক্তিশালী করতে কী কী প্রয়োজন? সেই আলাপ অন্যান্য আলাপের সঙ্গে এখন সামনের সারিতে। অন্তর্বর্তী সরকারই কেবল নয়, শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠকদের এবং প্রবীণ-নবীন দুই প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের কাছেও বিশেষ ভূমিকা জাতি আকাঙ্ক্ষা করে এই সময়ে।

এই ভূমিকার সীমা কানাগলিতে আটকে থাকার নয়। এই প্রশ্নে সরব হওয়া কর্তব্য দেশপ্রেমিক-জনস্বার্থের পক্ষে থাকা ছাত্র-শিক্ষক, নারী, সাংস্কৃতিক কর্মী, আইনজীবী, গবেষক, লেখকসহ নানা পেশার সংগঠক–সংগঠনের সচেতন নাগরিকের। যাতে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নের দিকে ধাবিত হয়।

কোনো রাষ্ট্রে জনগণের মৌলিক ও নাগরিক অধিকার, জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ এবং গণতান্ত্রিক চর্চা, ভোটাধিকার, জবাবদিহি দিন দিন নাই হতে থাকলে সমাজ কী চেহারা নেয়, তা সবার জানা। স্বেচ্ছাচারিতা চরমে পৌঁছায়, ক্ষমতা হয়ে উঠে ব্যক্তির গোষ্ঠীর লুটপাটের হাতিয়ার। বিচারহীনতার সংস্কৃতি জেঁকে বসে। ক্রমে ফ্যাসিবাদ শিকড়ে–বাকড়ে ছড়িয়ে পড়ে রাষ্ট্রের জমিনে–আসমানে।

শ্রমিকের অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে শ্রম আইনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন সংশোধন ও সংস্কার উদ্যোগের মধ্যেও এর গুরুত্ব টের পাওয়া যায়। এটি সমাজের আয়না বা দর্পণের মতো। বিশেষত, সমাজের ওপরতলার জন, ক্ষমতাশালী দল ও রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রম আইনের চলাচল। আইন কখনো হতে পারে রক্ষাকবচ, কখনোবা মারণাস্ত্র। যদিও ৮৫ ভাগ শ্রমিক এর আওতার বাইরে, তারপরও গণ–অভ্যুত্থানে পাওয়া নতুন আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আইনে পরিবর্তন ও সংস্কার নিয়ে সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার। কেননা, ভবিষ্যতে সব শ্রমিকের স্বীকৃতি, তাঁদের কপালের লিখন এবং এই খাতের বিকাশে শ্রমিকের হিস্যা কতটুকু, কতটুকু জবান ও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার থাকবে—এসবের পূর্বাভাস মিলবে আইনে। অনুগ্রহ বা দয়াদাক্ষিণ্যে নয়, আইনে নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি জন্মায়। তাই বর্তমান আইনের সংস্কার ও পরিবর্তন এমন হওয়া দরকার, যাতে তার ফলাফল শতভাগ শ্রমশক্তি ভবিষ্যতে ব্যবহার করতে পারে। দরকার বাস্তবায়নের জন্য লড়াই। সংবিধান, শ্রম আইনবিধি, ফৌজদারি আইন, পারিবারিক আইন, নারী নীতি, নারীবিষয়ক প্রস্তাবনা যাতে পারস্পরিক সংঘাতপূর্ণ, দ্বন্দ্বের বা শ্রমিক স্বার্থবিরোধী-অগণতান্ত্রিক না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখবে অন্তর্বর্তী সরকার, সেটাই জনগণের প্রত্যাশা। সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ যাতে ঘটে শ্রম আইনে, তার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে সবাইকে।

সংসদ আইন প্রণীত হওয়ার স্থান। বিগত সময়ে মালিক বা উদ্যোক্তারা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদে গিয়েছেন, আইন তৈরি করেছেন। সেখানে মালিকপক্ষের স্বার্থই প্রধানত রক্ষিত হয়েছে। ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে প্রবলভাবে তৈরি করেছেন প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ। আইন প্রায়ই ব্যবহৃত হয়েছে নিপীড়ন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার অস্ত্র আকারে। সংবিধানে সংগঠন ও মত প্রকাশ করা জনগণের মৌলিক অধিকার বলা হলেও সংগঠন করাতেই এসেছে সরকার-মালিকের সম্মিলিত কায়দায় যত বাধা। সংবিধানে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া শ্রমিক স্বার্থের পক্ষের সংগঠনগুলো। ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে শ্রমশক্তি ব্যবস্থাপনার নামে এমন বাধা–নিষেধ আরোপ করা হয়েছে, যাতে নিয়মনীতির মধ্যে ইউনিয়ন করা কঠিনতর হয়।

‘সিংহকে বশে’ রাখার চিন্তার প্রভাব যেন খুঁজে পাওয়া যায় ইউনিয়ন করার আইনি বিধিবিধানে। রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে শতকরা হার আরোপসহ নানা যে শর্ত, তা পূরণ প্রায়ই অসম্ভব। কারণ, এসব পাহাড়সম শর্ত আদতে নিষেধের সমান। প্রকৃত ট্রেড ইউনিয়নের অন্যতম বাধা এসব শর্ত। অর্থাৎ স্পষ্ট ও সহজ বিধির বদলে পরোক্ষভাবে এমন বিধান আইনে যুক্ত আছে, যাতে শ্রমিক স্বার্থে প্রকৃত ট্রেড ইউনিয়ন তৈরি হতে না পারে। মালিকপক্ষের যত ভীতি এই ইউনিয়ন এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন সংগঠন ও সংগঠকদের নিয়ে।

বিগত সময়ের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এমন রেজিস্টার্ড ইউনিয়ন-ফেডারেশন যার বেশির ভাগ মালিক-সরকারের ‘বশে’ থাকা বা বিদেশিদের সুনজরে থাকা। এ রকম ‘বশে’ থাকা ইউনিয়ন শ্রমিক কল্যাণের প্রকৃত আধার হওয়ার চরিত্র হারাতে বাধ্য। এ ছাড়া শ্রমিক স্বার্থের খুব সামান্য কিছু সংগঠনকে দেশের বিশেষ পরিস্থিতিতে রেজিস্ট্রেশন পেলেও তা কাগজে–কলমে আছে। বাস্তবে ততটা চর্চার সুযোগ থাকে না। রেজিস্ট্রেশন করলে, সংঘগুলোর সুযোগ-সুবিধা বিস্তৃত হলে, সবার তাতে স্বীকৃতি ও আইনি অধিকার পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা না হওয়ায় শ্রমিকের স্বার্থের পক্ষের সংঘগুলো ক্রমেই নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে এই প্রক্রিয়ায়। প্রকৃত ইউনিয়ন তৈরির সব পথই যেন রুদ্ধ, অনিয়ম-দুর্নীতি যখন নিয়ম, তখন মাঠের আন্দোলনই সংগঠিত ও দাবি আদায়ের অন্যতম পথ হয়।

শ্রম আইনের সঙ্গে আদালতেও রয়েছে জটলা। শ্রম আদালতের শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল থেকে হাইকোর্ট ও অ্যাপিলেট ডিভিশন পর্যন্ত সর্বত্র নেই বাংলা ভাষার প্রচলন। শ্রম আইন তৈরি হয়েছে এমন বাংলা ভাষার গঠনে, যা সাধারণ শ্রমিক তো দূরে থাক, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জন্যও নাকানিচুবানির দশা। দ্রুত নিষ্পত্তি নেই মামলার, নেই পর্যাপ্ত আদালত। শ্রমিক কখনো শ্রম আইনে ছাঁটাই-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, কখনোবা ফৌজদারি মামলায় জেল-জুলুমের শিকার হচ্ছেন। এত কিছুর পরও আইনকে ধরাছোঁয়ার বাইরে কিংবা মধ্যপন্থা বা সরল দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই। আইন নিয়ে সরব থাকার সময় এটা। তবে সরবে পঞ্চমুখ হয়ে উচিত কথা বললেই সব সমস্যার সমাধান হবে বা রাত পোহালে সব বাস্তবায়ন হবে, তা–ও নয়। কিন্তু অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়েও আমার-আপনার শ্রমিক প্রশ্নে নির্দিষ্ট অবস্থান নেওয়া এবং তার ঘোষণা নিতে দোটানা থাকলে, সেটার হিসাবও ইতিহাস করবে। তরুণ প্রজন্ম, আগামী প্রজন্ম করবে। তাই রব তুলতেই হবে এই সময়ে। একসময়ে তার প্রতিধ্বনি হবেই।

এযাবৎ বিদ্যমান মজুরি, শ্রমঘণ্টা, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার—কোনোকিছুই শ্রমিকের আকাঙ্ক্ষার স্মারক নয়। কর্মপরিবেশ, নারী-পুরুষের সমান অবস্থান, দক্ষতা—সব ক্ষেত্রেই অধিকার দিন দিন যেন সংকুচিত হচ্ছে। নারীরা শ্রমশক্তির বড় অংশ হলেও নাগরিক মর্যাদা তো দূরে থাক, দক্ষ শ্রমিক হওয়ার সুযোগটুকু পাচ্ছেন না। মাতৃত্বকালীন ছয় মাস ছুটি, ডে–কেয়ার, যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতাবিরোধী নীতিমালা, অভিযোগ নিষ্পত্তিসহ নানা দাবি করে আসছেন তাঁরা। আইন আর ন্যায্যতার ফারাক টেনে শ্রমিক বঞ্চিত হচ্ছেন। সর্বোপরি দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতি, মুদ্রাস্ফীতিতে বেহাল আছেন নারী ও পুরুষ শ্রমিকেরা। তাই বর্তমান কাঠামোয় লড়াই করে ন্যূনতম ঐক্যের ভিত্তিতে শ্রমিকদের পাওনাগুলো আদায়ে মতাদর্শিক ও মাঠের লড়াই জীবন্ত থাকা দরকার।

লুটেরা ও নয়া উদারনীতি অর্থনীতির প্রাধান্য ও জাতীয় অর্থনীতির যথাযথ বিকাশ না হওয়ায় আমাদের দেশে আর দশটা গণতান্ত্রিক দেশের মতো শ্রমিকদের অবস্থান ও অধিকার সুরক্ষিত হয়নি। সুরক্ষিত হয়নি শিল্প খাত। সুরক্ষার বদলে একধরনে নীতিবিরুদ্ধ ট্রেড ইউনিয়ন চর্চার সুযোগ সরকার ও মালিকপক্ষ এযাবৎকাল জারি রেখেছে। দিন শেষে সেই চর্চা এই খাতের ক্ষয়ই ডেকে এনেছে। দাঁড় করিয়েছে এক বুমেরাং সিন্ডিকেট চক্র, যা দুষ্টচক্রের মতো এই খাতকে বারবার আঘাতে হেনেছে। বঞ্চিত করেছে শ্রমিককে।

শ্রমিকের অধিকার অনিশ্চিত রেখে উৎপাদশীলতা ও শ্রম খাতের বিকাশ সম্ভব নয়। এই উপলব্ধি মালিকশ্রেণিরও আসতে হবে। হয়তো এর জন্য শ্রমিক ও অর্থনীতির গতিপথকে আরও বিকশিত ও রক্তাক্ত হতে হবে। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক-ভূরাজনৈতিক অবস্থার এবং শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দক্ষতা তৈরির কারণে বাংলাদেশে সামনে রপ্তানিভিত্তিক খাতে অমিত সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। সেই সম্ভাবনা অর্জনে নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তাসহ প্রবীণদেরও নতুন করে শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতে ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু আন্তর্জাতিক নয়, দেশীয় নতুন নতুন বাজার, খাত ও জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিতে মনোযোগী না হলে আত্মনির্ভরশীল জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ বারবার মুখ থুবড়ে পড়বে।

মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলা পরিষদের সামনে চা–শ্রমিকদের অবস্থান (২২ আগস্ট, ২০২২)

সম্পর্কিত নিবন্ধ