সকাল থেকেই দিনটার মেজাজ ছিল অন্য রকম। কখনো কখনো এ রকম হয় বটে, তবে আজকের ব্যাপারটা আলাদা যেন। চৈত্রের গরম হয়ে ওঠা হাওয়ার সঙ্গে একটা চাপা উত্তেজনা আরও তপ্ত করে তুলছিল চারপাশের পরিস্থিতি। সেই উত্তেজনা অজানা আশঙ্কা ও অব্যক্ত ক্রোধের। চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে নানা গুঞ্জন। কোনটা সত্যি, কোনটা বানানো—বোঝা মুশকিল। ঢাকা থেকে আসা খবরের ডালপালা ছড়ালেও মূল খবর একটাই, অবাঙালি মিলিটারিরা হাজারে হাজারে মানুষ মেরে ফেলেছে, পুলিশ ব্যারাকে আগুন দিয়ে বের হয়ে আসা পুলিশদের গুলি করেছে পাখির মতো, ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের হলগুলোতেও হামলা করেছে মাঝরাতে। রাস্তায় যাকে পেয়েছে তাকেই গুলি করে মেরেছে। অবিশ্বাস্য এ রকম খবরের পর খবর আসছে ঢেউয়ের মতো। খবরগুলো গুজবের মতো মনে হলেও অবিশ্বাস করে না কেউ।
একাব্বরের চায়ের দোকানে বসে রেডিওর খবর শোনার চেষ্টা করে ইলিয়াস, খবরটবর নেই কিছুই, একটানা বাজনা বেজে যাচ্ছে কেবল। কিছুক্ষণ পরপর হেঁড়ে গলায় একটা ঘোষণা শোনা যাচ্ছে অদ্ভুত এক ভাষায়, ‘ঢাকা শহর ও শহরতলিতে কারফিউ জারি করা হইয়াছে। কেহই এই কারফিউ ভঙ্গ করিবার অধিকার রাখে না। যাহাকে কারফিউ ভঙ্গ করিতে দেখা যাইবে, তাহাকে গুলি করিয়া মারা যাইতে পারে।’
এ রকম আজব ঘোষণা শুনে চায়ের দোকানে রেডিও শুনতে ভিড় করা লোকজন শুকনা মুখে ফ্যালফ্যাল করে চারপাশে তাকায়। একজন বলে, ‘এ বিটারে বাঙালি মোনে হচ্ছে না। বাঙালি অ্যানাউন্সারগের মাইরে ফেলাইসে মনে হয়।’ কেউ এ কথার কোনো জবাব দেয় না। অস্থিরভাবে উঠে পড়ে ইলিয়াস, বুকের ভেতর বহু দূর থেকে শোনা ঢাকের মতো শব্দ হচ্ছে। বড় রাস্তায় উঠলে চোখে পড়ে বড় গাছ ফেলে রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে পাহারা বসিয়েছে এলাকার মানুষ। শোনা গেছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে মিলিটারির বড় একটা দল এ পথ দিয়ে যাবে মূল শহরের দিকে। এভাবে গাছ ফেলে কতক্ষণ ওদের আটকে রাখা যাবে, কে জানে। তবে শহরে পৌঁছাতে দেরি করিয়ে দিতে পারলে শহরের বাঙালি সৈন্যরা আরও গুছিয়ে নিতে পারবে নিজেদের। এখান থেকে মাইলখানেক গেলে কাছিমের মতো পিঠ উঁচু করা ব্রিজটার ওপাশে বাঙালি সৈন্যদের একটা দল এসে ঘাঁটি গেড়েছে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসা পাঞ্জাবি সৈন্যদের এখানেই আটকাতে হবে। স্থানীয় নেতাদের অনেকেই এসেছেন। তার মানে বড়সড় কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে এখানে। বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর ইপিআরের অফিসারদের সঙ্গে দফায় দফায় সলাপরামর্শ চলছে তাদের। সেই আলোচনার যতটুকু বের হয়ে আসছে, সেসব শুনে মানুষের মধ্যে ভয় ও ক্রোধ একসঙ্গে দলা পাকিয়ে যায়।
দলে দলে মানুষ ছুটছে বাঙালি সেনাদের দেখতে। ইলিয়াস ওদের সঙ্গ নেয়। খালের ধারে যেখানে হাট বসে, সেখানকার সারি সারি চালার নিচে কবরের মতো উঁচু করা একচিলতে করে ভিটে, সেগুলোর সামনের সারির প্রতিটির পেছনে বসানো হচ্ছে দুই পায়ের ওপর ভর করা রাইফেলের মতো অস্ত্র। এত দিন পুলিশের হাতে যে মোটাসোটা রাইফেল দেখেছে মানুষ, এগুলো সে রকম নয়, আগে দেখেনি কেউ। কে যেন বেশ ভাব নিয়ে জানায়, এগুলো হচ্ছে এলএমজি। রাইফেলের মতো একটা একটা নয়, একসঙ্গে অনেকগুলো গুলি ছোড়া যায় এগুলো দিয়ে। বাজারের আধপাকা দোকান ঘরগুলোর আশপাশের আড়ালকেও কাজে লাগাতে চাইছে ওরা। কাছেধারে কোথাও বালু পাওয়া যায়নি, তাই এত অল্প সময়ের মধ্যে বালুর বস্তা দিয়ে বাংকার বানানো হয় না। দোকানের ইটের দেয়ালগুলোই আপাতত বাংকার। ঘুরেফিরে এসব জোগাড়যন্ত্র দেখতে গিয়ে ইলিয়াসের ইচ্ছা হয় হাতে একটা বন্দুক পেলে সে-ও এদের সঙ্গে নেমে যেত। তাই যুদ্ধপ্রস্তুতির জায়গাটা ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছা করে না ওর, যদি কোনো কাজে লাগতে পারে। মানুষের ভিড় বাড়তে থাকলে সৈন্যরা কড়া গলায় ওদের সরে যেতে বলে। এতে উৎসুক মানুষের জটলা একটু টোল খায়, তবে সবাই চলে যায় না। সৈন্যদের নেতাগোছের একজন এসে বলে, ‘এখানে তামাশা দেখার কিছু নাই। আমাদের জন্য চেয়ারম্যানের বাড়িতে রান্না হচ্ছে, পারলে সেখানে গিয়া ফাইফরমাশ খাটেন।’ এ কথা শুনে কয়েকজনের সঙ্গে ইলিয়াস ছুট লাগায় আফাজুল্লা চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে। সেখানে বড় বড় ডেকচিতে বাঙালি সৈন্যদের জন্য দুপুরের রান্না চড়িয়েছে কাসেম বাবুর্চি। ভাত, বুটের ডাল আর গরুর মাংস। হারেস মেম্বার একটা চেয়ারে বসে রান্নার তদারক করছে দেখে ইলিয়াস সামনে গিয়ে সালাম দেয়। হারেস মেম্বার ওকে দেখে বলে, ‘তুমি আইসে পড়িছ, ভালোই অলো। মিছিল–মিটিং তো বহুত করিস, অ্যাহন অন্য কিছু করা লাগবি। এহান থে খানা যাবে সোলজারগের জন্যি। পেলেট–বাটি জোগাড় হচ্ছে, সেগুলান ধুয়ে নিতি অবে। তোমরা হাত লাগাবা।’
একটা কাজ পেয়ে খুশিতে বুকের ভেতরটা ভরে যায় ইলিয়াসের। এখন আপাতত আর কোনো কাজ নেই, তাই এখানে খামোখা বসে না থেকে রাস্তার দিকে ছুট লাগায় ও। অসহযোগ আন্দোলনে স্কুল বন্ধ হওয়ার পর থেকে পড়াশোনা করতে হচ্ছে না, ম্যাট্রিক পরীক্ষা কখন হবে আল্লাহ মালুম। যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, শিগগিরই হবে বলেও মনে হচ্ছে না। অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে মিছিলে যাওয়াই ছিল একমাত্র কাজ। মাত্র কিছুদিন আগে এখানকার জুট মিলের বিহারিদের সঙ্গে একটা দাঙ্গা লাগতে গিয়েও লাগেনি। নেতারা পরিস্থিতি সামলে বলে, ‘এদের মাইরে কী অবে? আমাগের যুদ্ধ খানসেনার সঙ্গে। শুনিসনি, তোমরা আমাগের ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাগের কিচ্ছু বলবে না নে। কিন্তু আর আমার ভাইয়ের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা কোরো না।’
হাঁটতে হাঁটতে ও ভাবে, এখন তো আর ওরা ব্যারাকে নেই, তাহলে এখন কী হবে?
রাস্তার ওপর কাত হয়ে পড়ে থাকা বিরাট গাছটার দুপাশে লোকজন উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি করছে। কারও কারও হাতে শক্ত লাঠি। পরিচিত কাউকে দেখতে পায় না ও। মিলিটারিরা যদি সত্যিই চলে আসে ঠিক কী করতে হবে, জড়ো হওয়া লোকজনকে সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করছিল নেতাগোছের একজন। কিন্তু আসলে নিজেও ঠিক জানে না নিরস্ত্র মানুষ কী করবে। ওকে বলতে শোনা যায়, ‘খালি হাতে কী আর করবানে আমরা? দা-কুড়োল নিয়ে ওগের সাতে যুদ্ধ করতি পারবা? খুব বেশি অলে দূর থেইকে দু–চারডে পাথর মারতি পারবা বোধয়। অ্যাহন বাঙালি সোলজারগের সাহায্য করতি পারো। দু–এক দিনির মধ্যে বুইঝে যাবানে কী করতে অবে।’
এসব কথায় কান না দিয়ে কয়েকজন ভূপতিত গাছের ডালের ওপর বসে দূরে রাস্তার বাঁকের দিকে তাকিয়ে থাকে, মিলিটারির ট্রাক দেখা গেলেই ছুট লাগাবে।
একসময় মিলগেটের দিকে হাঁটতে থাকে ইলিয়াস। রাস্তায় কোনো গাড়ি চলছে না, দু–একটা রিকশা ব্যারিকেডের পাশের সংকীর্ণ পথ গলিয়ে চলাফেরা করছে নেহাত দায়ে ঠেকে। মিলগেট পেরিয়ে আরও কিছু দূর পর পাশের ব্রিকফিল্ড থেকে ইট এনে রাস্তার ওপর ছোটখাটো পাহাড় বানিয়ে ফেলেছে লোকজন। ওর ক্লাসে পড়া কয়েকজনও আছে সেখানে, ইট টানতে টানতে ধুলায় আর ঘামে চেহারা হয়েছে ভূতের মতো। ইলিয়াসকে দেখে বলে, ‘গায়ে হাওয়া লাগায়ে ঘুইরে বেড়াচ্ছিস? আমরা খাইটে মরতিসি এহানে।’ ওদের দেখে লজ্জা পায় ইলিয়াস। বলে, ‘আমি তো ইপিআর বাহিনীর ওহানে তোগের খুঁইজে আলাম। চেয়ারম্যানের বাড়িত্থে খাবার নিয়ে যাতি অবে ওগের জন্যি। যাবি?
ওরা বলে, ‘বানে। গোসল করতি অবে আগে। আজ জুমার নামাজে যাচ্ছিসনে?’
ইলিয়াস বলে, ‘নামাজে গেলি খাবার নিতি দেরি অয়ে যাবে নে। একদিন জুমা না পড়লি কিচ্ছু অবেনানে। পাঞ্জাবিরা আইসে পড়লি জুমা পড়বি কিডা?’
আসন্ন ঘূর্ণিঝড়ের আগে যেমন চারপাশ থমথম করে, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দমবন্ধ করা পরিবেশটা বুকের ওপর আরও চেপে বসে, পুরো এলাকাটা সেই ভারী আবহাওয়ায় নিচে পড়ে হাঁসফাঁস করে যেন। দুপুরে জুমার আজানের শব্দও আজ অন্য রকম লাগে। মুয়াজ্জিনের গলা থেকে ভয়ার্ত কাঁপা স্বর যেন নিস্তব্ধ জনবিরল প্রান্তরের ওপর দিয়ে আহাজারির মতো ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। অন্য দিন আজানের শব্দ শুনে লোকজন যেমন বাড়ির দিকে পা চালাত নামাজের প্রস্তুতির জন্য, আজ সে রকম বিশেষ চাঞ্চল্য দেখা যায় না। এক অনিশ্চিত অজানা আশঙ্কায় মানুষের দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহ যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে।
দুপুরের পর থেকে পথেঘাটে লোকজনের চলাচল আরও কমে আসে। বিকেল নাগাদ প্রধান রাস্তা প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। একাব্বরের দোকানের ঝাঁপ অর্ধেক ফেলা। রাস্তার আশপাশে এদিক–সেদিক উৎসুক উদ্বিগ্ন মানুষের সংশয়ী জটলা। এ সময় ইউনিফর্ম পরা আনসার বাহিনীর সঙ্গে গ্রাম প্রতিরক্ষা দলের একটা প্লাটুন রাস্তা ধরে কুচকাওয়াজ করে যাচ্ছিল। রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে পৌঁছার পর হঠাৎ দলনেতার হুইসেল বেজে ওঠে। চোখের পলকে লাফ দিয়ে রাস্তার ঢালে নেমে লুকিয়ে পড়ে পুরো দলটা। আচমকা এ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকে উৎসুক মানুষ রাস্তা ছেড়ে সভয়ে ছুটে পালাতে থাকে। কিছুক্ষণ পর আত্মগোপনকারী দলটা রাস্তার ঢাল থেকে উঠে এসে আবার সারিবদ্ধ হলে মানুষ বুঝতে পারে, এটা ছিল একটা মহড়া।
সময়ের গতি যেন আজ বেশি অলস হয়ে পড়েছে। যা-ই ঘটুক, সেটা যেন দ্রুত ঘটে যায়, এমন অনিশ্চিত উৎকণ্ঠা আর বইতে পারছিল না মানুষ। এ সময় আসরের আজান শুরু হয়। সেই ডাকে সাড়া দেবে কি না বুঝতে পারে না কেউ। যেকোনো মুহূর্তে এসে পড়তে পারে পাঞ্জাবিরা। মানুষকে এই দোটানা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই যেন মিলগেটের দিক থেকে খই ফোটার মতো একপশলা শব্দ ছুটে আসে। সম্পূর্ণ অপরিচিত এই শব্দ শোনার পর মানুষ কী করবে বুঝতে পারে না। কেউ কেউ সন্তর্পণে সরে যায় রাস্তা থেকে। শব্দটা আগে শোনা না থাকলেও মানুষের মনে হয়, অশুভ কিছু একটা আছে তার মধ্যে। তাই বেশির ভাগ মানুষ দূরে সরে গিয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখে রাস্তার ওপর। বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় না। গোঁ গোঁ শব্দ তুলে সেনাভর্তি বড় বড় ট্রাক আর জিপের বহর রাস্তার মোড় পেরিয়ে ব্যারিকেডের সামনে গিয়ে থেমে যায়। ট্রাক থেকে ঝুপঝুপ করে লাফিয়ে রাস্তায় নামে সৈন্যরা। পড়ন্ত বিকেলের রোদ তাদের লালচে চেহারাকে আরও লাল করে তোলে। রাস্তায় আড়াআড়িভাবে ফেলে রাখা বড় গাছটা সরানোর জন্য নিজেদের শক্তি খরচ করতে চায় না বলেই পালাতে না পারা লোকজনকে লাথি মেরে নিয়ে যায় ব্যারিকেড সরানোর কাজে। গুলি করছে না দেখে মানুষের ভেতরের ভয়টা কিছুটা কেটে যায়। তাই নিজেদের আড়াল করে পুরো দৃশ্যটা দেখে যায় ওরা।
ইলিয়াস এসব দেখার জন্য দাঁড়ায় না, পরিচিত আরও কয়েকজনসহ রাস্তা থেকে নেমে ফসলহীন মাঠের ওপর আড়াআড়ি ছুট দেয় খালের দিকে। ওটা পেরিয়ে ঘুর পথে পৌঁছে যাওয়া যাবে বাঙালি সৈন্যদের কাছে। এ সময় গোধূলির ম্লান আলো ধীরে ধীরে নেমে আসছিল গাছপালার জটলার ভেতর। ঠিক সে সময় ব্রিজের দিক থেকে শুরু হয় একটানা শব্দ। খই ফোটার মতো সেই শব্দের করাত দ্রুত নেমে আসা আঁধারের শরীরকে চিরে ফেলতে থাকে। খালের পাড় ধরে ছুটতে শুরু করে ওরা। চারপাশ থেকে ভেসে আসে স্বজন-বিচ্ছিন্ন মানুষের আর্তনাদ এবং চিৎকার। গুলির উৎস থেকে দূরে সরে যাওয়ার জন্য সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে মানুষ ছুটতে থাকে চারদিকে।
রাত বাড়তে থাকলে ধীরে ধীরে কমে আসে গুলির শব্দ। পরদিন সকালের নরম রোদ তপ্ত হয়ে উঠতে শুরু করলে আবার শোনা যেতে থাকে গুলির শব্দ। এবারে কেবল একটানা একদিক থেকে নয়, বিভিন্ন দিক থেকে ভেসে আসছিল বিচ্ছিন্ন শব্দ, তবে কাল রাতের তুলনায় সেই শব্দ যেন আরও ক্লান্ত, একটানা চালিয়ে যাওয়ার শক্তি নেই। দুপুর নাগাদ সব শব্দ থেমে গেলে লুকিয়ে থাকা মানুষ সন্তর্পণে বেরিয়ে আসে। দুই বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা বের করার আগে ওদের চোখে পড়ে পাঞ্জাবি বাহিনীর পরিত্যক্ত ঘাঁটির কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা ইলিয়াসের লাশ। ওর হাতে তখনো ধরা ছিল একটা মাঝারি পাথর।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন য আরও ক র একট ল কজন র ওপর একট ন
এছাড়াও পড়ুন:
আনন্দের বন্যা বইছে জুলেখার পরিবারে
মায়ের কোলে থাকা সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুকে কখনও কোলে নিচ্ছেন প্রতিবেশীরা, কখনও শিশুটির ছোট বোন। আবার কেউ কেউ কোলে নিয়ে আদর করছে শিশুটিকে, কেউ আবার সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া-চাইছেন শিশুটির জন্য। ঝিনাইদহের হরিনাকুণ্ডু উপজেলার দুর্লভপুর উত্তরপাড়া গ্রামে কৃষক আব্দুর রাজ্জাকের বাড়িতে তাঁর নাতিকে নিয়ে এমনই আনন্দের বন্যা বইছে।
মঙ্গলবার সকালে ওই বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায় এমন চিত্র। বাংলা নববর্ষের প্রথম প্রহরে সকাল পৌনে ৬টার দিকে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে মা জুলেখা বেগমের কোল আলোকিত করে জন্ম নেয় ফুটফুটে ছেলে শিশু।
জানা যায়, ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার সিদ্ধি গ্রামের রাশেম মণ্ডলের স্ত্রী জুলেখা বেগম। জুলেখা বেগম অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন আর এখন তিনি গৃহিণী। তাঁর স্বামী এইচএসসি পাস করে বর্তমানে ব্র্যাক ব্যাংক কুষ্টিয়া শাখায় চাকরি করেন। ২০০৫ সালে তাদের পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিল। মেয়ের বাবার বাড়ি ঝিনাইদহের হরিনাকুণ্ডু উপজেলার দুর্লভপুর উত্তরপাড়া গ্রামে আর ছেলের বাড়ি শৈলকুপা উপজেলার সিদ্ধি গ্রামে। স্বামীর সঙ্গে কুষ্টিয়া শহরে থাকতেন জুলেখা। পরে সন্তানসম্ভবা হওয়ার কিছুদিন পর ঝিনাইদহের হরিনাকুণ্ডু উপজেলার দুর্লভপুর উত্তরপাড়া গ্রামে বাবা আব্দুর রাজ্জাকের বাড়িতে চলে আসেন জুলেখা।
গর্ভাবস্থায় বাবার বাড়িতে থাকার সময় নিয়মিতই সেখানে আসতেন জুলেখার স্বামী রাশেম মণ্ডল। খোঁজখবর নিতেন স্ত্রীর। গর্ভের সন্তানকে ভালো রাখতে যত্নের কমতি রাখেননি জুলেখা। তাঁর স্বামীও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, নিয়মিত চেকআপ করানোসহ অন্যান্য দিকে নজর রাখতেন। তাঁর কোনো শারীরিক জটিলতাও দেখা দেয়নি।
রোববার রাত ১২টার পর থেকে প্রসব বেদনা শুরু হয় জুলেখা বেগমের। এরপর তাঁর মা-বাবাসহ অন্যান্য আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা পাখি ভ্যানযোগে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ওই রাত ২টার দিকে নিয়ে আসেন ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে। সে সময় হাসপাতালে চিকিৎসক ও নার্সরা তাঁর শারীরিক খোঁজখবর নেন। এরপর সকাল পৌনে ৬টার দিকে হাসপাতালের ‘ই ও সি’ বিভাগে নরমাল ডেলিভারিতে জুলেখা বেগম জন্ম দেন এক ফুটফুটে ছেলে শিশু। জন্মের পরপরই হাসপাতাল থেকে আজান শোনানো হয় শিশুটিকে। তার ওজন হয়েছিল দুই কেজি পাঁচশ গ্রাম। এটি জুলেখা বেগমের তৃতীয় সন্তান। তাঁর বড় ছেলে নয়ন মণ্ডল এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে আর মেয়ে রাবেয়া খাতুনকে এখনও স্কুলে ভর্তি করাননি।
সদর হাসপাতালের গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. মার্ফিয়া খাতুন বলেন, নরমাল ডেলিভারিতে শিশুটির জন্ম হয়েছে। শিশু ও মা শারীরিকভাবে সুস্থ আছে, কোনো জটিলতা নেই। এর আগেও এ নারীর নরমাল ডেলিভারিতে দুটি সন্তানের জন্ম হয়েছিল। আমরা হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছাড়পত্র দিয়েছি। তবে বিশেষ করে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে, প্রথম প্রহরে এই শিশুটির জন্ম হওয়াতে আমরা খুবই খুশি, শিশুটি যেন বড় হয়ে দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করতে পারে সেই প্রত্যাশা রইল।
এদিকে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুটির মা জুলেখা বেগম বলেন, বাচ্চা হওয়ার কথা ছিল মে মাসের ৫ তারিখে। তবে একটু আগে হলেও সম্পূর্ণ সুস্থ থাকায় আমি খুবই খুশি। হাসপাতালের ডাক্তার নার্স সবাই খুবই আন্তরিক ছিল। তারা সবসময় খোঁজখবর নিয়েছে। জন্মের পর থেকেই বুকের দুধ খাচ্ছে সন্তানটা। সন্তান পেটে আসার পর থেকেই আমি এবং আমার স্বামী খুবই সতর্ক থাকতাম।
তিনি আরও জানান, আমাদের তিন সন্তান। বড় ছেলে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে, মেয়েটার বয়স ছয় বছর, ওকে স্কুলে ভর্তি করাব। এরপর ইচ্ছা ছিল একটা ছেলে সন্তান হবে। মেয়েটা জন্মের ৬ বছর পর আল্লাহ আমাদের ইচ্ছা পূরণ করেছেন। বিশেষ করে বাংলা নববর্ষের মতো বিশেষ একটি দিনে আমার সন্তান হয়েছে, আমিসহ পরিবারের সবাই খুবই খুশি। এখন আমাদের প্রত্যাশা তিন সন্তানকেই যেন লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলতে পারি। ছেলেটিকে প্রথম কোলে নিয়েছিল আমার ফুফু অর্থাৎ ছেলেটির নানি। তিনি প্রথম সাদা গেঞ্জি কিনে দিয়েছেন।
ছেলের বাবা রাশেম মণ্ডল বলেন, খুবই খুশি আমরা। বিশেষ করে নববর্ষের দিনে সন্তান হওয়াতে।
শিশুটির নানি সুন্দরী খাতুন বলেন, আমরা খুবই খুশি এমন ফুটফুটে নাতি ছেলে পেয়ে। নাতি ও আমার মেয়ে সুস্থ আছে। আল্লাহ যেন আগামী দিনেও এদের ভালো রাখে।
এদিকে শিশুটির নানা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এ আনন্দ আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। নাতি-নাতনি যে কী আদরের জিনিস, সেটা যার আছে সেই ভালো জানে। সদ্য ভূমিষ্ঠ নাতিকে কোলে নিয়েছি, মনে হচ্ছে আল্লাহ যেন আমাদের বড় একটি উপহার দিয়েছে। নাতনিটা মাঝেমধ্যে এসে বলছে, নানা তুমি কি ভাইয়াকে বেশি আদর করবা। তখন বলছি, তোরা যে আমার কলিজার টুকরা। তোরা দুই ভাই ও বোন সবাই আমার কাছে সমান। তোদের কাউকেই আদরের কমতি রাখব না।
এদিকে শিশুটি জন্মের সময় সদর হাসপাতালে ছিলেন সম্পর্কে শিশুর নানি সালেহা খাতুন। তিনি বলেন, রাতে হাসপাতালে আনার সময় অনেক চিন্তায় ছিলাম। শেষমেশ হাসপাতালে সবার আন্তরিকতায় ছেলে সন্তানের জন্ম হলো। আমরা খুবই খুশি, আনন্দিত।
ছোট শিশুটিকে দেখতে এসে প্রতিবেশীরা বলেন, জুলেখার কোলজুড়ে একটি সুস্থ সন্তান জন্ম নিয়েছে। এতে আমরা খুবই খুশি। আল্লাহ যেন তাদের ভালো রাখে।