ষাটের দশকে আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র চালু হলে মানুষকে নির্বাচনমুখী করার জন্য গ্রামগঞ্জে জারি-সারি গানের আয়োজন করা হতো। গানের সূচনাতেই বলা হতো, ‘শোনেন শোনেন সভাজন ভাই, আবার হবে নির্বাচন’। সরকারের পক্ষ থেকেও এই সূচনাসংগীত নিয়ে ফিল্ম বানিয়ে গ্রামগঞ্জে সান্ধ্য প্রদর্শনীর আয়োজন করত। বিনোদনবঞ্চিত মানুষের ঢল নামত সেসব ফ্রি প্রদর্শনীতে। ভোটের নিয়মকানুন সবই বুঝিয়ে দেওয়া হতো গান আর অভিনয়ের মাধ্যমে।

ঢাকার বাইরে জীবন ও জীবিকা নিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গেলে আগে রাজনীতি, ভোট ইত্যাদি প্রসঙ্গ মানুষ আনতেই চাইত না। কাজের পরে চায়ের দোকানেও সহজ ছিল না রাজনীতির হাতি–ঘোড়ায় চড়া। প্রসঙ্গ উঠলেই ইতিউতি চাইত, ঠাহর করার চেষ্টা করত, অন্য কেউ শুনছে কি না! উত্তর করত চাপা স্বরে।

পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। নির্মলেন্দু গুণের ‘হুলিয়া’ কবিতার পঙ্‌ক্তির মতো সবাই জানতে চায় ঢাকার খবর।—আমাদের ভবিষ্যৎ কী?…এখন কোথায়?.

..(তিনি) কি ভুল করছেন? মানুষ এখন মুখের চেয়ে বেশি তাকিয়ে থাকে চোখের দিকে। বলতে গেলে চোখের ভেতরে, খুঁজতে থাকে দেশের বিভিন্ন ভবিষ্যৎকে। কোনটা গুজব কোনটা ঠিক; ঢাকার মানুষেরা কি এবারও ধোঁকা দেবে? আমরা কেবলই দূরে বসে চেয়ে চেয়ে দেখব? নদী, জল, হাওয়া, ফসল, গোখাদ্য, বন্যা, বজ্রপাত, আলু, পেঁয়াজ, ধান, মজুরি, খেতমজুর, নারী শ্রমিকের অধিকার, ধানকল আর চাতালের নারী নির্যাতন, শিশু সুরক্ষা, ইটভাটায় আটকে রাখা শিশুশ্রমিক, বন্ধ স্কুল, বইয়ের অভাব—কোনো কিছুতেই মাতছে না আর মাঠের মানুষ। ঘুরেফিরে একই কথা, কন, ঢাকার খবর কী? কেউ কি কোনো ভুল করছে? একাত্তরের মতো মানুষ এখন দূরের রেডিও (এখনকার ইউটিউব) শোনে রাত জেগে। একেকজন একেক কথা বলে। একবার মনে হয় ওরটা সত্যি, আবার মনে হয় এরটা সত্যি।

হালি, কদম বা দানা পেঁয়াজের খেতে ছত্রাকের আক্রমণে পেঁয়াজের পাতা মরে যাচ্ছে। চাষিরা এখন আর ছত্রাক–ফত্রাক বলেন না। বিষ কোম্পানির লোকদের মতো ছত্রাকের নাম ধরে ডাকেন, বলেন, ‘ইবার পার্পল ব্লচে ধরেছে হালিক’ (হালি পেঁয়াজ)। হঠাৎ শীত কমে যাওয়ায় পেঁয়াজগাছের মাথা মরে যাচ্ছে। মরা ঠেকাতে বাজার থেকে ওষুধ (বিষ) কিনে ছিটিয়ে সাড়া পাচ্ছেন না চাষিরা। গতবার যে বিষে কাজ হয়েছিল, এবার সেই বিষ বাজার থেকে আউট। মুড়িকাটা পেঁয়াজে লস হয়েছে, হালিতেও অশনিসংকেত! এত টেনশনের মধ্যে জানতে চান, আবার নাকি ইলেকশন হবে? কেমন হবে সে নির্বাচন? ভোটকেন্দ্রে নতুন কী ব্যবস্থা থাকবে? মেশিনে হবে না কাগজে সিল দিয়ে হবে? নানা স্বরে নানা ‘টোনে’ পেঁয়াজের চেয়েও কড়া ঝাঁজের সেসব প্রশ্ন।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ইতিমধ্যেই পেশ করা হয়েছে। ইন্টারনেট, ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। ধারণা ছিল, পাবলিককে ‘দিলাম কিন্তু দিলাম না’ জাতের এই ধাপ্পাবাজির খপ্পরে পড়ে মাঠের মানুষদের কাছে এসব পৌঁছায় না। জানতেও পারে না কী আছে কাগজে। তবে দিন পাল্টাচ্ছে। দূরের বেতার বা ইউটিউবারদের কল্যাণে মানুষ দিব্যি জেনে যাচ্ছে, কোন কাগজে কী লেখা হচ্ছে। তারপরও অনেক অস্পষ্টতা তাদের ঘিরে রেখেছে।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন মনে হয় ওপর নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে গোড়ার দিকে তেমন মন দিতে পারেনি। যেমন? এই ধরেন প্রক্সি ভোট, রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, নির্বাচন কমিশনের ব্যয়, প্রশিক্ষণ ভাতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ম্যাজিস্ট্রেটদের ভাতার যথার্থতা ও পরিমাণ, নির্বাচন কমিশনের কার্যপদ্ধতি, নির্বাচন কমিশনের জনবল, কমিশনের জন্য পৃথক সার্ভিস সৃষ্টি—এসবসহ অনেক সম্ভব, অসম্ভব, পরে সম্ভব, সব সময় অবান্তর—এমন অনেক কথা থাকলে পোলিং এজেন্টদের নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। অথচ যেকোনো ভোটের ভিত্তিই রচনা করেন তাঁরা। যে প্রার্থীর যেমন ক্ষমতা ও অর্থ, তিনি ততই পটু ব্যক্তিকে পোলিং এজেন্ট নিয়োগ করেন।

এক প্রার্থী গালকাটা কালামকে পোলিং এজেন্ট মনোনীত করলে অন্য প্রার্থী কমপক্ষে পিস্তল কামালকে নিয়ে আসেন। ভোটের ফ্রন্টলাইনার হিসেবে তাঁরাই সকাল থেকে ভোটকেন্দ্রের আবহ তৈরি করে ফেলেন। দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের দৌড়ঝাঁপ দৌরাত্ম্যে পরিণত হতে থাকে। ভুয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট সাজিয়ে অনেককে ভোটকেন্দ্রে ঢুকিয়ে দিয়ে অন্য প্রার্থীদের এজেন্টদের কোণঠাসা করে রাখা হয়। এসব এজেন্ট কারবারিদের একটা ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনতে হবে। সাজা খাটা ব্যক্তিদের বা এলাকায় দাঙ্গাবাজ হিসেবে পরিচিত এমন কাউকে কোনোমতেই পোলিং এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া আইন করে নিষিদ্ধ করতে হবে।

ডিসি, এডিসিদের ওপর আর ভরসা রাখতে রাজি নয় সংস্কার কমিশন। অনুমান করা যায়, প্রশাসন ক্যাডারের প্রতি এমন অনাস্থার কারণ গত তিন–চারটি নির্বাচন। এটা পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন বলা যাবে না। প্রশাসন ক্যাডারের ছত্রচ্ছায়ায় খারাপ বা অতি খারাপ নির্বাচন যেমন হয়েছে, তেমনি ভালো ও অতি ভালো নির্বাচন এই ক্যাডারের লোকেরাই করেছেন বা করিয়েছেন। তবে সব ক্ষেত্রেই হুকুম এসেছে ওপর থেকে। এসব রক্তচক্ষু হুকুমদাতাদের দায় এককভাবে প্রশাসন ক্যাডারদের কাঁধে চাপানো পথভ্রষ্ট রাজনীতিবিদদের ছাড় দেওয়ার শামিল।

বাস্তবতা হচ্ছে, চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছে প্রশাসন ক্যাডার হচ্ছে প্রথম পছন্দের ক্যাডার। ফরেন সার্ভিস ও অনেকের পছন্দ। অবশিষ্ট বা বাদ পড়াদের নিয়ে অন্য একটা ক্যাডার গড়ার প্রস্তাব অবশিষ্টদের জোর করে বিশিষ্ট বানানোর অপচেষ্টা মনে হতে পারে। ক্যাডার হওয়ার আগেই জাতীয় পরিচয়পত্রের দখলি স্বত্ব নিয়ে নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তা–কর্মচারীদের আচরণ শোভনীয় ছিল কি? যুক্তির বদলে চাপের প্রতি তাঁদের বেশি আস্থা বলে মনে হয়েছে।

কে একজন বলে উঠল ডিসিদের বাদ দিয়ে জেলা দায়রা জজদের দায়িত্ব দিলেই হয়। একজন সাবেক আইনজীবীর সহকারী (আগে যাঁদের মুহুরি বলা হতো) বলে উঠলেন, তাহলে আপিলের শুনানি হবে কার এজলাসে? কথাটা মাটিতে পড়তে না পড়তে শোনা গেল, হাইকোর্ট নাকি বিভাগে বিভাগে বেঞ্চ খুলবে।

ছত্রাক পার্পল ব্লচের হুমকিতে ক্লান্ত পেঁয়াজচাষিরাও ছত্রাকমুক্ত নির্বাচন আর গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখছেন। 

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

আরাকান আর্মির গুলিতে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে দুজন গুলিবিদ্ধ

সীমান্তের ওপার থেকে আসা গুলিতে বান্দরবানে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমে দুজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন রোহিঙ্গা ও একজন ঘুমধুমের বাসিন্দা। গতকাল শুক্রবার রাত ৯টার দিকে ভাজাবনিয়া সীমান্তের মিয়ানমার অংশে এ ঘটনা ঘটে। মিয়ানমারের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মির (এএ) সদস্যরা এ গুলি চালিয়েছেন বলে ধারণা করছে পুলিশ।

সীমান্তের ওপার থেকে আসা গুলিতে ঘুমধুমের উলুবনিয়া গ্রামের নুরুল কবিরের ছেলে মো. জাহাঙ্গীর (১৯) ও ভাজাবনিয়ায় বসবাসরত রোহিঙ্গা আবদুল হাকিমের ছেলে মোহাম্মদ হোসাইন (২৭) আহত হয়েছেন। আহত জাহাঙ্গীর প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। গুরুতর আহত রোহিঙ্গা মোহাম্মদ হোসাইনকে প্রথমে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখান থেকে তাঁকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

নাইক্ষ্যংছড়ির স্থানীয় লোকজন ও ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের একজন সাবেক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মিয়ানমার থেকে পাচারকারীদের বাহকেরা গরু আনার জন্য যাওয়ার সময় আরাকান আর্মি গুলি ছোড়ে। তখন গুলিতে দুজন আহত হন।

জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আবদুল করিম জানিয়েছেন, ভাজাবনিয়া সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের একটি সীমান্ত পোস্ট রয়েছে। পোস্টটি এখন বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির দখলে। গত রাতে ৩৪ ও ৩৫ সীমান্ত পিলারের মাঝামাঝি এলাকায় সাত-আটটি গুলি ছোড়া হয়। ওই ছোড়া গুলিতে শূন্যরেখা থেকে ২০০ মিটার পূর্বে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে একজন বাংলাদেশি ও একজন রোহিঙ্গা আহত হয়েছেন।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরও বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, সীমান্তের রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের গতিবিধির ওপর নগর রাখছে আরাকান আর্মি (এএ)। সন্দেহ হওয়ায় তারা গুলি চালিয়েছে। এই ঘটনার পর সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘ডিভোর্সের পর বাচ্চাদের সঙ্গে ওদের বাবার সম্পর্ক নষ্ট করিনি’
  • ইসরায়েলি হামলায় হামাসের শীর্ষ নেতা নিহত
  • ৮২ বছর বয়সেও লড়াকু রানী হামিদ
  • নাফ নদীতে ৩৩ বিজিবি সদস্য নিখোঁজের বিষয়টি গুজবনির্ভর অপপ্রচার: বিজিবি
  • সাবাশ বাংলাদেশ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
  • থিয়াগো আলমাদা: রাস্তা থেকে উঠে এসে যেভাবে মেসির উত্তরসূরি
  • আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধে সময় বেঁধে দিলেন জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা
  • বাদীর ভুলে শিশু ধর্ষণ মামলায় নির্দোষ ব্যক্তির সাজা
  • আরাকান আর্মির গুলিতে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে দুজন গুলিবিদ্ধ