আজ খতমে তারাবিহতে পবিত্র কোরআনের সুরা হামিম সাজদার ৪৭ থেকে সুরা শুরা, সুরা জুখরুফ, সুরা দুখান ও সুরা জাসিয়া তিলাওয়াত করা হবে। ২৫তম পারা পড়া হবে। তারাবিহর এই অংশে আল্লাহর অনুগ্রহ, জান্নাত-জাহান্নাম, মানুষের অকৃতজ্ঞতা, আল্লাহর ওয়াদা, সব নবী-রাসুলের ধর্ম ইসলাম, সৃষ্টিজগতে আল্লাহর নিদর্শন, আল্লাহর ইচ্ছায় মানুষের সন্তান লাভ, নারীর সম্মান, কন্যাসন্তান আল্লাহর নিয়ামত, গুনাহের কারণে বিপদ, অবাধ্য জাতির পরিণতি, জাহেলি যুগের ঘৃণ্য প্রথা, আল্লাহর রহমত, আরবি ভাষায় কোরআন নাজিল ইত্যাদির বর্ণনা রয়েছে।

 আজকের তারাবিহ শুরু হবে আল্লাহর মাহাত্ম্য ও কুদরত বর্ণনার মাধ্যমে। আল্লাহই শুধু অদৃশ্যের খবর জানেন। অদৃশ্যের জ্ঞানীও একমাত্র তিনি। এটা ইসলামের বিশ্বাসগুলোর একটি। ভবিষ্যতের বিষয় সম্পর্কে শুধু তিনিই জানেন। তিনি ছাড়া ভবিষ্যতের বিষয়ে কেউ কিছু জানেন না; এমনকি নবী-রাসুল। তবে তিনি নবী-রাসুলদের যা জানিয়েছেন, তা তাঁরা জেনেছেন। তাঁর জ্ঞানের বাইরে জগতের কিছুই নেই। তাঁর জানার বাইরে ফল আবরণ মুক্ত হয় না, কোনো নারী গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসব করে না। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘কিয়ামতের জ্ঞান একমাত্র তাঁরই জানা। তাঁর জ্ঞানের বাইরে কোনো ফল আবরণ মুক্ত হয় না এবং কোনো নারী গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসব করে না।’ (সুরা হামিম সাজদা, আয়াত: ৪৭)

আরও পড়ুনহালাল খাবার গ্রহণ ও অসিয়তের গুরুত্ব১৫ মার্চ ২০২৪

সুরা হামিম সাজদার ৫০ থেকে ৫১ নম্বর আয়াতে আছে, দুঃখ-দৈন্য স্পর্শ করার পর যখন আমি তাকে দয়া করে সুখের স্বাদ দিই, তখন মানুষ বলতে থাকে, ‘এটা তো আমার প্রাপ্যই ছিল। আমি তো মনে করি না কিয়ামত বলে কিছু আছে।.

.. আবার যখন মানুষ বিপদে-আপদে অমঙ্গলে পড়ে যায়, তখন সে দীর্ঘ প্রার্থনায় বসে যায়।’ এই আয়াতে মানুষের অকৃজ্ঞতার চিত্র তুলে ধরেছেন আল্লাহ তাআলা। বিপদে পড়লে মানুষ আল্লাহর কাছে প্রার্থনায় নতজানু হয়। এমনভাবে আল্লাহকে ডাকে, যেন আল্লাহ ছাড়া ভিন্ন কিছু তার কল্পনায় নেই। আল্লাহই তার সব; তিনিই একমাত্র মালিক। মানুষ তাঁর গোলাম। কিন্তু বিপদ দূর হলে ভুলে যায় আল্লাহকে। সুখের নদীতে ডুবে ভুলে যায় দুঃখ মোচনকারীকে। অনেককে অহংকার পেয়ে বসে। সুখকে নিজের প্রাপ্য মনে করে।

সব নবী-রাসুলদের ধর্ম এক

কোরআনের ৪২তম সুরা শুরা মক্কায় অবতীর্ণ। এর আয়াতের সংখ্যা ৫৩। এ সুরার ১৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘অবস্থার এই প্রেক্ষাপটে (হে নবী) তাদেরকে আহ্বান কোরো (দ্বীনের প্রতি), আর তোমাকে যে আদেশ দেওয়া হয়েছে তুমি তার প্রতি সুদৃঢ় থাকো, আর তাদের খেয়ালখুশির অনুসরণ করো না। আর বলো, আল্লাহ যে কিতাবই অবতীর্ণ করেছেন, আমি তার প্রতি ইমান এনেছি…।’ আল্লাহর কাছে দ্বীন একটাই—ইসলাম। সব নবী-রাসুল এই দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য পৃথিবীতে এসেছিলেন। তাঁরা সবাই ছিলেন মুসলিম। তবে নবী-রাসুলদের শরিয়ত এবং শাখাগত বিধিবিধান ছিল ভিন্ন ভিন্ন। আর আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বাসীদের নাম মুসলিম রাখেন ইবরাহিম (আ.)।

আরও পড়ুনকোরআনের আয়াত ও দাম্পত্য সম্পর্কে সমঝোতা১৪ মার্চ ২০২৪

সুরা শুরার ৩৬ থেকে ৪০ নম্বর আয়াতে কিছু গুণের কথা আছে। যাঁদের মধ্যে এ গুণ থাকবে, আল্লাহ তাঁদের প্রতি খুশি হবেন। তাঁদের পুরস্কৃত করবেন। গুণগুলো হলো এক. ইমানদার, দুই. আল্লাহর ওপর ভরসাকারী, তিন. কবিরা গুনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে যে দূরে থাকে, চার. ক্ষমাকারী, পাঁচ. আল্লাহর ডাকে সাড়াদানকারী, ছয়. নিয়মিত নামাজ আদায় করে, সাত. পারস্পরিক পরামর্শের মাধ্যমে কাজ করে, আট. দান-সদকা করে এবং নয়. নির্যাতিত হলে সমান সমান প্রতিশোধ গ্রহণ করে।

আল্লাহর সেরা দান কন্যাসন্তান

৮৯ আয়াতবিশিষ্ট সুরা জুখরুফ মক্কায় অবতীর্ণ। এটি কোরআনের ৪৩তম সুরা। জুখরুফ শব্দটি সোনা বা সৌন্দর্যের অর্থে ব্যবহৃত হয়। এ সুরার ৩৫ নম্বর আয়াতে সোনার আলোচনা থাকায় এর নাম জুখরুফ রাখা হয়েছে।

এ সুরার ১৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তাদের কাউকে যখন সংবাদ দেওয়া হয় সেই সন্তানের (কন্যা), যা তারা দয়াময় আল্লাহর প্রতি আরোপ করে, তখন তার মুখমণ্ডলে কালিমা ছেয়ে যায়, আর মন দুঃখ–বেদনায় ভরে যায়।’ কন্যাসন্তান আল্লাহর সেরা দান। তারা মা-বাবার জন্য পৃথিবীতে জান্নাতের সুসংবাদ নিয়ে আসে। জাহেলি যুগে কন্যাসন্তানের মূল্যায়ন ছিল না। কন্যাসন্তানকে তারা অপমানজনক কাজ মনে করত। কন্যা হলে বাবাদের মুখ কালো হয়ে যেত। কন্যাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলত। ইসলাম এমন ঘৃণ্য কাজকে নিষিদ্ধ করেছে। কন্যাকে সম্মান দিয়েছে। কন্যার পিতাকে জান্নাতের শুভ সংবাদ দিয়েছে। বর্তমানেও কন্যাসন্তান হলে অনেকেই মন খারাপ করে। ছেলে হলে খুশি হয়। এই বৈষম্য গুনাহ।

আরও পড়ুনইসলাম যাদেরকে বিয়ে করতে নিষেধ করেছে১৩ মার্চ ২০২৪

ধোঁয়ার নামে সুরার নাম

কোরআনের ৪৪তম সুরা দুখান মক্কায় অবতীর্ণ, এর আয়াতের সংখ্যা ৫৯। দুখান অর্থ ধোঁয়া। মক্কার অবিশ্বাসীরা দুর্ভিক্ষের দিনে যে ধোঁয়াচ্ছন্ন অবস্থা দেখতে পেয়েছিল, ১০ নম্বর আয়াতে তার আলোচনা থাকায় এর নাম রাখা হয়েছে সুরা দুখান। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে জুমার রাতে সুরা দুখান পাঠ করবে, সকাল হওয়ার আগেই তার গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৮৮৯)

এই সুরায় কোরআন নাজিলের ঘটনা, বরকতময় রাত, আল্লাহর একত্ববাদ ও সৃষ্টিজগতে আল্লাহর মহত্ত্বের নানা নিদর্শন, কোরআন ও পুনরুত্থান দিবস সম্পর্কে অবিশ্বাসীদের সন্দেহ, মুসা (আ.)-এর বিরুদ্ধাচরণে বনি ইসরাইলের পরিণাম, অবিশ্বাসীদের পরিণতি ও শাস্তি, সৃষ্টিজগতের অস্তিত্ব উদ্দেশ্যবিহীন না হওয়া, কিয়ামতের দিন কেউ কারও উপকারে না আসা, দোজখবাসীর শাস্তি ও খোদাভীরুদের পুরস্কার বেহেশত সম্পর্কে বয়ান রয়েছে।

সুরা জাসিয়ায় কিয়ামতের বর্ণনা

মক্কায় অবতীর্ণ সুরা জাসিয়া ৩৭ আয়াতবিশিষ্ট। ‘জাসিয়া’ শব্দের অর্থ হাঁটু গেড়ে বসা। কিয়ামতের দিন মানুষ ভয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়বে। সুরায় এ ভয়ানক অবস্থার বর্ণনা আছে, তাই এটিকে জাসিয়া বলা হয়। এ সুরায় আল্লাহর বড়ত্ব, একত্ববাদ, কুদরত, সৃষ্টিজগতের নিদর্শন, অবিশ্বাসীদের পরিণাম, বনি ইসরাইলকে দেওয়া আল্লাহর নিয়ামত, তাদের অবাধ্যতা ও কিয়ামত দিবসের ভয়াবহতার বিবরণ রয়েছে।

রায়হান রাশেদ: লেখক ও আলেম

আরও পড়ুননারীর মর্যাদা ও অধিকার এবং অলৌকিক তিন ঘটনা১২ মার্চ ২০২৪

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ষ ট জগত অব শ ব স ন আল ল হ ক য় মত র ক রআন র র আয় ত র পর ণ ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

রমজানে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে মাথায় পানি দিন

অসহনীয় তাপমাত্রা দেখা দিলে রাসুল (সা.) মাথায় পানি ঢালতেন। আবু বকর বিন আবদুর রহমান কয়েকজন সাহাবির উদ্ধৃতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রমজানে আরজ এলাকায় অত্যধিক পিপাসা বা তাপমাত্রা দেখা দিলে রাসুল (সা.)-কে দেখেছি যে তিনি মাথায় পানি ঢালছেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস: ২,৩৬৫)

 দৈহিক প্রশান্তি ও স্বস্তির জন্য এমন করা দোষের নয়। এর ফলে রোজাদারের ইবাদতের শক্তি বৃদ্ধি পাবে। কারণ, বান্দা স্বতঃস্ফূর্ত ও সানন্দ্যচিত্তে রবের আদেশ-নিষেধ পালন করবে—এটাই মুখ্য। রোজা রাখার উদ্দেশ্য দৈহিক কষ্টভোগ, নির্যাতন কিংবা কঠোরতা আরোপ করা নয়।

 একই ভাবে ভালোভাবে গোসল করা, কাপড় ভেজানো, পানিতে ডুব দেওয়া—সবই মাথায় পানি ঢালার হুকুম ভুক্ত। ইমাম বুখারি (রহ.) তার ‘সহিহ’ গ্রন্থে কয়েকজন সাহাবি ও তাবেইনের উদ্ধৃতিসহ উল্লেখ করেছেন, ‘ইবনে ওমর (রা.) একটি কাপড় পানিতে ভিজিয়ে শরীরে জড়িয়ে নিলেন। তিনি ছিলেন রোজাদার। শাবি (রহ.) রোজা রেখেই গোসলের জন্য হাম্মামে প্রবেশ করেন। হাসান বলেন, কুলকুচা কিংবা শীতলতা গ্রহণ রোজাদারের জন্য দোষের নয়। ইবনে মাসঊদ (রা.) বলেন, তোমাদের যে রোজা রাখবে, সে যেন সকালে মাথায় তেল দিয়ে চুল পরিপাটি করে রাখে। আনাস (রা.) বলেন, আমার একটি পানির টব রয়েছে, রোজা রেখেই আমি তাতে প্রবেশ করি। (বুখারি, ২/৬৮০-৬৮১)

আরও পড়ুনফিতরা কীভাবে হিসাব করব১১ মার্চ ২০২৫

সে-হিসেবে রোজা রেখে বর্তমানে এ-সি রুমে সময় কাটানোও একই হুকুম ভুক্ত ধরা যাবে। (হাকাজা কানান নাবি স. ফি রমাদান, ফয়সাল বিন আলী আল-বাদানি, ৪৪)

এ ক্ষেত্রে মৌলিক ও সাধারণ নীতিমালা হলো, ব্যক্তির জন্য ইবাদত পালন যা সহজ করে দেয়, স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে করা সম্ভব হয়, তা করা রোজাদারের জন্য বৈধ। আর যে পরিশ্রম ও কষ্টভোগের কারণে রোজা থেকে বিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তা এড়িয়ে যাওয়াই কাম্য। তবে যে-কষ্ট রোজাকে আরও মহিমান্বিত করে, তাকে মেনে নেওয়া উত্তম। কেননা, তাতে ইবাদতের প্রতিদান বৃদ্ধি পায়। যেমন, অধিক শীতে অজু করা, হজের জন্য সফর, প্রচণ্ড শীত বা গরমে জামাতে নামাজ আদায় ইত্যাদি।

ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, অযৌক্তিক আত্মাকে কষ্টদান কিংবা কঠোরতা আরোপ করা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উপায় হতে পারে না। অধিকাংশ মূর্খ ভাবে—আমল যত কঠিন, পুরস্কার তত বেশি। তারা ভাবে, কষ্টের মাত্রা অনুসারে প্রতিফল নির্ধারিত হয়। অথচ প্রতিফল নির্ণয় করা হয় আমলের উপকারিতা ও পরিণতি হিসেবে। বান্দা যতটা আল্লাহ ও তার রাসুলের (সা.) আনুগত্যের বিভায় উদ্ভাসিত হবে, তত তার আমল কবুলযোগ্য হবে। সংখ্যাধিক্যের বিচারে নয়, বরং আমল সমৃদ্ধ হয় অন্তরের অবস্থা অনুসারে। (মাজমুউল ফাতাওয়া, ২৫/২৮১-২৮২)

আরও পড়ুনঈদ যেভাবে এল১১ এপ্রিল ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ