অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে সংস্কার সুপারিশের প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ। এতে এক মালিকের একাধিক সংবাদমাধ্যম না রাখা এবং সাংবাদিকদের সুরক্ষায় একটি আইনের সুপারিশ করা হয়েছে। শনিবার দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার হাতে তুলে দেন কামাল আহমেদ। বের হয়ে এসে সাংবাদিকদের সামনে ব্রিফিংয়ে সাংবাদিক সুরক্ষা আইনের প্রস্তাবের কথা জানান। তিনি। এ সময় কমিশনের অপর সদস্যরা এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।

ব্রিফিংয়ে কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, ‘সাংবাদিকতার পথে বাধা তৈরি করে এমন যেসব আইন ও সরকারি নীতিমালা রয়েছে সে সম্পর্কে সুপারিশ দিয়েছি। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আমরা সাংবাদিক সুরক্ষা আইন প্রণয়নের প্রস্তাব রেখেছি। এমনকি আমরা আইনটি কেমন হতে পারে তার জন্য একটি খসড়া অধ্যাদেশ যুক্ত করে দিয়েছি। উপমহাদেশে পাকিস্তান ও ভারতে এমন আইন পার্লামেন্টে বিবেচনাধীন রয়েছে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এরই মধ্যে এই আইন করেছে। সেখানে চাইলেও সাংবাদিকের ফোন তল্লাশি করতে পারে না সরকারি কেউ।’

কামাল আহমেদ বলেন, ‘গণমাধ্যমের ইতিহাস পর্যালোচনা করে কোথায় কোথায় ত্রুটি রয়েছে তা বের করার চেষ্টা করেছি। টেলিভিশন, সংবাদপত্র, রেডিও ও অনলাইনে বিভিন্ন রকমের সমস্যা রয়েছে, তবে সাংবাদিকতার সমস্যা সব জায়গায় একই ধরনের।’

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, ‘গণমাধ্যমের মালিকানায় সমস্যা রয়ে গেছে। অনেক সংবাদমাধ্যমের নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু মালিকানায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। আমরা বলেছি ক্রস ওনারশিপ বাতিল করতে হবে। একই মালিকের একাধিক সংবাদমাধ্যম থাকতে পারবে না। একটিকে বেছে নিতে হবে মালিককে। সেক্ষেত্রে অন্যগুলোর মালিকানা হস্তান্তর করতে হবে অথবা যেটি সবচেয়ে শক্তিশালী তার সঙ্গে একীভূত করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরাও যাতে কোনো সমস্যায় না পড়েন সেটিও বলা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘একই ব্যক্তি টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রের মালিকানা নিতে পারে না যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে এমন বিধান আছে।’

টেলিভিশনের আবেদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সবকটি টেলিভিশন চ্যানেলের অনুমোদনের আবেদন দেখছি, কোথাও জনগণের কথা বলা হয়নি। সবাই সরকারের উন্নয়ন তুলে ধরতে চেয়েছে, ইতিবাচক সংবাদ-কন্টেন্ট দেখাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সারা দুনিয়ার স্ট্যান্ডার্ড দেখেছি আমরা। সে অনুযায়ী সুপারিশগুলো করা হয়েছে।’

বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বেতারের স্বায়ত্তশাসনের সুপারিশ করা হয়েছে জানিয়ে কামাল আহমেদ বলেন, ‘স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠান এই দুটি মাধ্যম চালাবে, একটি সম্প্রচার সংস্থা করার কথা বলেছি। বাসসকে এই দুটির নিউজরুম হিসেবে ব্যবহার করলে সরকারি সম্পদের অপচয় কমানো যাবে।’

বিসিএস নবম গ্রেডের সমান বেতন-ভাতা সাংবাদিকতায় এন্ট্রিলেভেলে রাখতে বলা হয়েছে। সারা দেশে এটি কার্যকর করতে হবে। ঢাকায় যারা থাকেন তাদের জন্য আলাদা ভাতা থাকবে এখানে। প্রথমে এক বছরের শিক্ষানবিশকাল পার করেই তারপর স্থায়ী সাংবাদিক হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। আর ওয়েজবোর্ড নিয়ে মামলা চলমান, এই অবস্থায় কীভাবে এটি নিয়ে কাজ করা যায় তাও বলা হয়েছে।’ কামাল আহমেদ বলেন, ‘সাংবাদিকদের বিজ্ঞাপন এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে দেওেয়া যাবে না। সাংবাদিকের কাজ সাংবাদিকতা করা।’

ডিএফপির মিডিয়া তালিকায় বিস্তর সমস্যার কথা তুলে ধরেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান। তিনি বলেন, ‘আজকের দিনে ঢাকায় এক কোটি ৫১ লাখ পত্রিকা ছাপা হয়েছে সরকারি হিসাব মতে। কিন্তু বাস্তবে ১০ লাখের বেশি হবে না। তাহলে এই এক কোটি ৪১ লাখ পত্রিকার হিসাব কেন এলো। সরকারি বিজ্ঞাপন নেওয়ার জন্য এসব কারসাজি করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকারি ডিএফপির তালিকায় ছয়শর বেশি পত্রিকা রয়েছে, অথচ ৫২টি পত্রিকা বিক্রি হয় ঢাকায়। দুটি প্রতিষ্ঠান সংবাদপত্র সরবরাহের কাজ করে ঢাকায়। তাদের হিসাব দেখলেই অনায়াসে এই তথ্য পাওয়া যায়।’

টেলিভিশনের টিআরপির ক্ষেত্রেও ব্যাপক অনিয়মের চিত্র উল্লেখ করেন কামাল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘টিআরপি কত তা দেখার জন্য আট হাজার ডিভাইস বসানের কথা সারা দেশে। ২০০ ডিভাইস বসানো হয়েছে। এই রিপোর্ট লেখার সময় আরও একশ বসানো হয়েছে। এগুলো বসাতে হবে এবং সবগুলো যাচাইযোগ্য হতে হবে। যাচাই শুধু সরকার বা ওই টেলিভিশন করতে পারবে না, তৃতীয় পক্ষ দিয়ে যাচাইয়েরও সুযোগ থাকতে হবে। আর সেই তৃতীয় পক্ষ হবে সুশীল সমাজ।’

ব্রিফিংয়ে বলা হয়, অধ্যাদেশের খসড়াসহ ১৮০ পাতার পুরোটা অনলাইনে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। যে কেউ চাইলে দেখতে পারবেন কী কী সুপারিশ করা হয়েছে। 

গত বছরের ১৮ নভেম্বর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কামাল আহমেদকে প্রধান করে গণমাধ্যম সংস্কারের সুপারিশ প্রস্তুতের লক্ষ্যে কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত প্রতিবেদন জমার সময় দেওয়া হয় কমিশনকে। ১০ দিন হাতে রেখেই প্রতিবেদন জমা দিল কমিশন। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় কমিশনের অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। তারা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন, দ্য ফিন্যানসিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের প্রতিনিধি শামসুল হক জাহিদ, অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন ওনার্স (অ্যাটকো) প্রতিনিধি মাছরাঙা টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী, নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) সচিব আখতার হোসেন খান, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, যমুনা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের ট্রাস্টি ফাহিম আহমেদ, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের ডেপুটি এডিটর টিটু দত্ত গুপ্ত, মিডিয়া সাপোর্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক সাংবাদিক জিমি আমির, ডেইলি স্টারের বগুড়া জেলা প্রতিনিধি মোস্তফা সবুজ এবং শিক্ষার্থী প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ আল মামুন।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ক ম ল আহম দ ব ন ক ম ল আহম দ ব দ কত র জন য সরক র সমস য

এছাড়াও পড়ুন:

চৈত্রের শেষ দিনে জাবিতে ব্যাঙের পানচিনি ‘বিয়ে’ 

দিনভর প্রবল উত্তাপের শেষে বাংলা বছরের শেষ সূর্যের মেজাজ তখন কিছুটা হালকা হয়ে এসেছে। গাছের নতুন পাতায় সূর্যের আলোর প্রতিবিম্ব উৎসবের সাজ দিয়েছে৷ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের চোখে মুখে ফুটে ওঠেছে উৎসবের আমেজ।

উৎসবের পালে নতুন হাওয়া দিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) পুরাতন কলা ভবনের সামনে চলছে তখন পানচিনির আয়োজন। সবার মাঝে বিয়ের আমেজ। মঞ্চের একপাশে সেজেগুজে বসে আছে কনে। বরপক্ষের আগমনের অপেক্ষায় কনেপক্ষ। বিকেল ৫টার দিকে এক র‍্যালি নিয়ে হাজির বরপক্ষ। বরের মাথায় এক ঢাউস ছাতা।

হলুদ, ধান ও দূর্বা দিয়ে কনেপক্ষ বরপক্ষকে বরণ করে নিল। চলল আশীর্বাদ আদান-প্রদান। মন্ত্র পাঠের আগে অভিভাবকরা কথা দিলেন, আসছে আষাঢ়ে তাদের বিয়ে হবে। বরের বাবা হলেন কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোজাম্মেল হক, অন্যদিকে কনের বাবার দায়িত্বে ছিলেন নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক রশীদ হারুন৷

তবে এটি কোনো মানুষের বিয়ে নয়। ব্যাঙের বিয়ে। খরা মৌসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টির প্রত্যাশায় কলা ও মানবিকী অনুষদ চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এই ‘ব্যাঙের পানচিনি’র আয়োজন করেছিল। পানচিনি অনুষ্ঠান মূলত বিয়ের অঙ্গীকার প্রদান, আশীর্বাদ আদান-প্রদান এবং বর-কনের মধ্যে সম্প্রীতি বাড়ানোর আয়োজন।

ব্যাঙের এই পানচিনি সম্পর্কে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী শরণ এহসান জানান, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা অঞ্চলে প্রচণ্ড দাবদাহে যখন মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়, সেসময় বর্ষার আবাহন হিসেবে ব্যাঙের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়৷ প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ তাদের একটা কৃত্য হিসেবে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে বৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা করে ব্যাঙের বিয়ে সম্পন্ন হয়৷ বর্তমান সময়ে মানুষের সাথে প্রাণ-প্রকৃতির যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে তা নিরসনের প্রত্যাশায় প্রতি বছর চৈত্রসংক্রান্তির দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ব্যাঙের পান-চিনি’ আয়োজন করা হয়।

ব্যাঙের পানচিনিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ভবনের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সেজেছিলেন বরপক্ষের সাজে। আর পুরাতন কলা ভবন কনেপক্ষ। বাঁশ আর রঙিন কাগজ দিয়ে বানানো হয়েছিল ব্যাঙ-যুগলের বিশাল দুটি প্রতিকৃতি। গতরাতেই কনেপক্ষ বরপক্ষের বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে গিয়ে আলাপটা সেরে এসেছিলো।

সকাল থেকেই উভয়পক্ষের বাড়িতে চলছিল সেই প্রস্তুতি। বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে নেচে-গেয়ে বরপক্ষ হাজির হয় পুরাতন কলা ভবনের কনেপক্ষের বাড়িতে। কনেপক্ষ হুই-হুল্লোড় করে ‘গেট ধরলে’ চলে মধুর দর-কষাকষি। এরপর জমে ওঠে প্রীতি কথার লড়াই। কারও হার না মানা অবস্থায় মঞ্চে পাশাপাশি বসার সুযোগ হয় হবু বর-কনের।

বরপক্ষ ও কনপক্ষের এ মধুর লড়াই চলে বেশ সময় ধরে। কেউ কাউকে নাহি ছাড়৷ কারো মতে, বিয়ের দেনমোহর হওয়া উচিত কোটি টাকায়। কারো মতে, আরও কম৷ কেউবা বলছেন, ব্যাঙের বিয়ে হওয়া উচিত যে কোনো ধর্ম মেনে৷ তবে কনেপক্ষের মত, মানুষের ধর্ম নয়, ব্যাঙের ধর্ম মেনেই হবে ব্যাঙের বিয়ে৷ শেষ পর্যন্ত সমঝোতায় পৌঁছে দুই পক্ষ। আংটি বদলের মধ্য দিয়ে শেষ হয় চৈত্র সংক্রান্তির ব্যাঙের বিয়ে৷ 

ব্যাঙের পানিচিনি নিয়ে কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বৈশাখ থেকে প্রকৃতির পরিবর্তন হতে থাকে৷ ফলে প্রকৃতির এই পরিবর্তন আমাদের মানব মনে নাড়া দেয়৷’

সম্পর্কিত নিবন্ধ