‘ইসরায়েল স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা খুবই উদ্বেগের। তারা (সরকার) জিম্মিদের পাশে নেই। দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তোয়াক্কা করছে না।’ কথাগুলো বলছিলেন ৫৯ বছর বয়সী রিনাত হাতাশি। গতকাল শুক্রবার জেরুজালেমে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেন এই ইসরায়েলি। এদিন ইসরায়েলের আগ্রাসনের প্রতিবাদে দেশে দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে।
গাজায় যুদ্ধবিরতি অব্যাহত রাখা, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের হাতে বন্দী থাকা বাকি জিম্মিদের ফিরিয়ে আনা এবং ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেতের প্রধান রোনেন বারকে বরখাস্ত করার প্রতিবাদে কয়েক দিন ধরে ইসরায়েলে বিক্ষোভ করছেন দেশটির হাজার হাজার নাগরিক। তাঁদের মূল ক্ষোভ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে।
এ বিক্ষোভের অংশ হিসেবে গতকাল জেরুজালেমে নেতানিয়াহুর বাসভবনের বাইরে অবস্থান নেন বহু মানুষ। তাঁদের হাতে ছিল ইসরায়েলের পতাকা ও সরকারের সমালোচনা করে লেখা প্ল্যাকার্ড। পশ্চিম জেরুজালেমে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া মাইকেল হালপেরিন বলেন, শিন বেতের বদলে প্রধানমন্ত্রীকে এখন গাজায় মৃত্যুর মুখে থাকা বাকি জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার দিকে নজর দেওয়া উচিত।
জেরুজালেম ও তেল আবিবে গত বুধ ও বৃহস্পতিবারও বড় বিক্ষোভ হয়। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার এই দুই এলাকা থেকে অন্তত ১২ বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আগের দিন বুধবার জেরুজালেমে নেতানিয়াহুর সরকারি বাসভবনের কাছের সড়কগুলোয় অবস্থান নেন হাজার হাজার মানুষ। তাঁদের অনেকের স্লোগান ছিল—‘এখনই জিম্মি মুক্তির চুক্তি করুন।’
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের হামলা চালিয়ে দুই শতাধিক ব্যক্তিকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায় হামাস। এরপর কয়েক দফায় বেশ কয়েকজন জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গত ১৯ জানুয়ারি শুরু হওয়া প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতির সময় ৩৮ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়। বাকিদের যুদ্ধবিরতির পরবর্তী দুই ধাপে মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল। এরই মধ্যে মঙ্গলবার যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে গাজায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এর পর থেকে টানা চার দিন ধরে চলা হামলায় ৫৯০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, তাঁদের মধ্যে দুই শতাধিক শিশু।
গাজায় ১৭ মাসের বেশি সময় ধরে চলা হামলায় ৪৯ হাজার ৬১৭ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে নতুন করে হামলার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন নানা দেশের মানুষ। গতকাল দিবাগত রাত পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, ইসরায়েলের নৃশংসতার প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইরাক, জর্ডান ও ইন্দোনেশিয়ায় বিক্ষোভ হয়েছে।
দূতাবাস ঘেরাও, পতাকায় আগুনগাজায় ইসরায়েলের নির্মম হামলার প্রতিবাদে গতকাল বড় বিক্ষোভ হয়েছে পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে। এর মধ্যে রাজধানী ইসলামাবাদে ইসরায়েলের মিত্রদেশ যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস ঘেরাও করেন জামায়াত-ই-ইসলামি পাকিস্তানের (জেআই) সদস্য ও সমর্থকেরা। পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কনস্যুলেট ঘেরাও করা হয়। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পতাকায় আগুন দেন বিক্ষোভকারীরা।
রাজনৈতিক দল জেআইয়ের প্রধান নাইম-উর-রহমান বলেন, সারা বিশ্বের মতো পাকিস্তানও নিপীড়কদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে। এর আগে জাতিসংঘে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মুনির আকরাম গাজায় ত্রাণসহায়তা প্রবেশ ও দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন।
গাজায় হামলার প্রতিবাদে মধ্যপ্রাচ্যেও বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। জর্ডানের রাজধানী আম্মানে গতকাল জুমার নামাজের পর বিক্ষোভ করেন হাজার হাজার মানুষ। তাঁদের হাতে জর্ডানের পাশাপাশি ফিলিস্তিনের পতাকা দেখা যায়। ইসরায়েলবিরোধী নানা স্লোগান দেন তাঁরা। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে।
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের বাইরে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। সেখানে বিক্ষোভকারীদের হাতে ফিলিস্তিনের পতাকার পাশাপাশি ছিল নেতানিয়াহু ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পবিরোধী প্ল্যাকার্ড।
এদিকে গাজায় নতুন করে ইসরায়েলের হামলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। গতকাল কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আল থানির সঙ্গে পুতিনের ফোনালাপের পর ক্রেমলিন জানায়, মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত নিরসনে এবং দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করতে প্রস্তুত রাশিয়া ও কাতার। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে দেশটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেছেন, ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। বেসামরিক প্রত্যেক মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করছে যুক্তরাজ্য।
হামলা চলছে, ক্যানসার হাসপাতাল ধ্বংসগাজায় প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতি শেষ হয় ১ মার্চ। এরপর দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধবিরতির বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি ইসরায়েল ও হামাস। এমন পরিস্থিতিতে পবিত্র রমজান ও ইহুদিদের ‘পাসওভার’ উৎসব উপলক্ষে আগামী ২০ এপ্রিল পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির মেয়াদ বাড়ায় নেতানিয়াহু সরকার। তবে নিজেদের দেওয়া সে প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে মঙ্গলবার ভোররাতে গাজায় হামলা শুরু করে তারা।
গতকালও গাজা নগরী, খান ইউনিস ও রাফা এলাকায় ব্যাপক হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। যুদ্ধবিমান থেকে হামলার পাশাপাশি অভিযান চালিয়েছে স্থল বাহিনীও। ট্যাংকের গোলাবর্ষণে কেঁপে উঠেছে উত্তরের বেত লাহিয়া এলাকা। দক্ষিণ গাজার রাফা এলাকার উপকণ্ঠ তাল আস-সুলতানের দিকেও অগ্রসর হয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। আতঙ্কে রাফা ছেড়ে পালাচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা।
এদিকে ইসরায়েলের হামলায় গতকাল মধ্য গাজার নেতজারিম করিডরে অবস্থিত টার্কিশ–প্যালেস্টিনিয়ান ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল ধ্বংস হয়ে গেছে। সেখানে প্রতিবছর ১০ হাজার ক্যানসার রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হতো। এসব হামলায় বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত থেকে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানিয়েছেন গাজা সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল।
গাজায় ক্যানসার হাসপাতালে হামলার পর মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে বলেছে, গাজায় আরও নৃশংসতা বন্ধে বিভিন্ন দেশকে এগিয়ে আসতে হবে। উপত্যকাটির বিভিন্ন হাসপাতাল দখলের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ করছে ইসরায়েল। দেশটির এসব অপরাধ ফিলিস্তিনিদের আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
গাজার পাশাপাশি গতকাল অধিকৃত পশ্চিম তীরেও অভিযান চালিয়েছে ইসরায়েল। পশ্চিম তীরে এ অভিযান নিয়ে গতকাল টানা দ্বিতীয় দিনের মতো বৈঠক করেছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ডরথি শেয়া বলেন, গাজায় চলমান যুদ্ধের জন্য পুরো দায় হামাসের। হামাস যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে নিলে নতুন করে হতাহতের ঘটনা ঘটত না।
গাজায় নতুন করে স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। প্রাণ বাঁচাতে শিশুদের নিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে যাচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। গত বৃহস্পতিবার উত্তর গাজার বেইত লাহিয়ায়.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব ক ষ ভ হয় ছ ইসর য় ল র হয় ছ ন সরক র গতক ল
এছাড়াও পড়ুন:
ঘরে ফিরে ঘরের তালাশ
ক্রাচে ভর দিয়ে বাড়ির বার-মহলে এসে দাঁড়ান রাব্বি সাহেব। চুন–সুরকির পলেস্তারা খসে পড়ে ইট বের হয়ে যাওয়া নয়-চালি ঘরটির দিকে তিনি দিশা ধরে খানিক তাকিয়ে থাকেন। মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে তাঁর মুখের মাংসপেশি সামান্য কাঁপে। ধূসর দাড়ি–গোঁফে নাশতার ছিটেফোঁটা লেগে আছে। কাঁপুনি ব্যাপকভাবে বাড়তেই, তা থেকে ঝরে পড়ে একদানা চিনি-ছিটানো খই। ঘাসের গোড়ায় কিছু খুঁটতে থাকা একটি শালিক তা খুট করে তুলে নেয় মুখে।
কাঁপুনি একটু থামতেই তিনি চলে আসেন সিঁড়িতে। খুব সাবধানে এক পা দু–পা করে ঈষৎ লাফিয়ে উঠে পড়েন চতুর্থ ধাপে। ফুলের সুবাস পেতেই থমকে দাঁড়ান। সিঁড়িটির বাঁ পাশে তাঁর কিশোর বয়সের কামিনীগাছটি বয়োবৃদ্ধ হালতে এখনো পত্রপুষ্পে ছড়িয়ে আছে আগের মতো। পুরোনো দিনের চেনা কোনো স্বজনের সাক্ষাৎ পাওয়ার মতো তাঁর ইচ্ছা হয় ভোরবিহানে শ্বেতশুভ্র পুষ্পের জাদু ছড়ানো তরুবরটিকে হাত বাড়িয়ে একটু স্পর্শ করার। কিন্তু সাহস পান না।
বিলাত থেকে সপ্তাহখানেক আগে স্বদেশে ফেরার ঠিক সাত মাস তেরো দিন আগে রাব্বি সাহেবের স্ট্রোক হয়, তবে সেরে ওঠেন, কিন্তু ডান পা, যা বছর চারেক আগে থেকেই কার অ্যাকসিডেন্টে বিক্ষত ছিল, তা স্ট্রোকের ধকলে পুরোপুরি অবশ হয়ে যায়। পায়ে হালফিল খানিকটা সংবিৎ ফিরে পেয়েছেন বটে কিন্তু সে থেকে শরীর-গতরের ডান দিকটাও বেজায় কমজোর হয়ে আছে। কামিনীর কুন্দকুসুম কিংবা পত্রালি স্পর্শ করতে গিয়ে তিনি ভারসাম্য হারানোর ঝুঁকি নিতে চান না। ক্রাচ ঠুকে ঠুকে আরও তিনটি ধাপ ভেঙে তিনি উঠে আসেন খোলামেলা বারান্দায়।
তখনই খেয়াল হয়, সিঁড়ির ডান দিকে তো একই ক্বদের আরেকটি কামিনীগাছ থাকার কথা। ঘাড় ফিরিয়ে, এক পা সামনে বেড়ে, রেলিংয়ে ঝুঁকে নিচের দিকে তাকান। যমজ তরুবরের সহোদরাটি গায়েব হয়েছে পুরোপুরি। তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে একটি মা ছাগল। তার বাঁট থেকে দুধ চুষছে তিনটি ছানা।
রেলিং ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ান রাব্বি। সুরুজের তেজে চোখের সামনে ঝলমলিয়ে ওঠে কাঞ্চা সবুজে লেগে থাকা শিশিরবিন্দু। ভারি তাজ্জব হন! পারিবারিক বনেদি কেতার এ এজমালি বাংলাঘরটির সামনে ঠিক এই জায়গায়ই না ছিল একটি চৌখুপ্পি বাগিচা? কয়েকটি গোলাপ, গন্ধরাজ, করবী ও পাতাবাহারের ছাঁটা ঝোপগুলোর তো এখানে থাকার কথা!
ভাবেন, বারান্দায় বসবেন, কিন্তু যেখানে ইজিচেয়ার ও কাঠের পিঁড়িগুলো থাকার কথা, ঠিক ওই জায়গায় রাখা হয়েছে একটি ওয়াটার পাম্প। চারদিকে ছড়ানো–ছিটানো নিড়ানি, সারের বস্তা ও কীটনাশকের শিশি-বোতলসহ একটি জারিক্যান। রাব্বি ভাবেন, একটু নাহয় সিঁড়িতে বসবেন, কিন্তু নিচু হয়ে বসলে আবার যদি উঠে দাঁড়াতে মুশকিল হয়?
হঠাৎ তাজ্জব হওয়ার ঘোর তাঁর সহজে কাটে না! আবার তাকান, বাগিচার পরিসরজুড়ে সার-জলের স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়তে থাকা ধানের কচি চারাগুলোর দিকে। কয়েকটি রুপালি বিন্দুতে ঝলসে যায় শিশিরের বর্ণালি। অসামান্য এ দৃশ্যপটের দীপ্তিতেও সন্তুষ্ট হতে পারেন না রাব্বি।
মেহেদিগাছগুলোই–বা গেল কোথায়? বিয়েশাদি কিংবা শবে কদরের রাতে গ্রামের কিশোরীরা দল বেঁধে আসত না মেহেদিপাতা তুলতে? হঠাৎ মনে পড়ে যায় ইলেকশনের কথা। প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের জামানায় চালু হয়েছিল, ইউনিয়নভিত্তিক বনিয়াদি গণতন্ত্র বলে একটি প্রথা। তিনি চেয়ারম্যান পদে সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী হয়েছিলেন, লাঙল মার্কা প্রতীকে বিপুল ভোটে জিতেও ছিলেন।
কত সালের কথা—১৯৬৬ না ৬৭? নির্বাচনের বছর তাঁর লাগানো ডালিয়াগুলো বেজায় দৃষ্টিনন্দন হয়েছিল পুষ্পের বর্ণাঢ্য আভায়। একসঙ্গে ফুটেছিল বত্রিশ কিংবা বিয়াল্লিশটি ডালিয়া। সে আমলে গেরামগঞ্জের বিয়েশাদিতে সেভেন-সিটার বলে একধরনের ভ্যানগাড়ি কিরায়া করার রেওয়াজ ছিল। বিবাহে আরেক ধরনের গাড়ি দামান্দ-কন্যা আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হতো। গাড়িটির কী একটা ইংরেজি নামও ছিল...। ইয়েস, নামটা এবার পরিষ্কার মনে পড়ে—স্টাফকার।
না, এ আতরাফে তো বটে, মুহকমা শহরেও তাজা ফুলের কোনো দোকান ছিল না। তার বন্ধু সুজিত দেবনাথের বিয়েতে, এই বাগিচার ডালিয়া দিয়ে তিনি নিজ হাতে স্টাফকারটি সাজিয়ে দিয়েছিলেন। বাসর রচনার জন্যও চাপলিশে পাঠিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি গোলাপ, বকুল ও গন্ধরাজ।
বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে আসেন চোখে সুরমা টানা গোলটুপি মাথায় একজন মৌলভি গোছের তরুণ। তিনি কানে তুলা গুঁজতে গুঁজতে রাব্বি সাহেবকে তাজিমের সঙ্গে সালাম দেন। রাব্বি মিনমিনিয়ে আলেক উচ্চারণ করেন, কিন্তু গলায় চেককাটা গিলাফ পরা তরুণের সঙ্গে অধিক বাতচিতের আগ্রহ তাঁর হয় না। পরিসরে আতরের কড়া গন্ধ ছড়িয়ে তরুণটি চাপা স্বরে ‘আল্লাহু করিম’ বলতে বলতে নেমে যান সিঁড়ি ধরে।
রাব্বি অবগত যে অন্য শরিকানদের ছেলেপিলে তথা তাঁর সম্পর্কে ভাতিজা কিংবা তাদের পুত্ররা, মাদ্রাসায় আলিয়া অবধি পড়া এই তরুণটিকে বাড়ি-সংলগ্ন মসজিদের ইমাম নিযুক্ত করেছেন। এ ছাড়া মক্তবের দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে বাংলাঘরের দক্ষিণ দিকের কামরায় ইনি বসবাসও করছেন।
রাব্বি বারান্দা ধরে কদম কয়েক সামনে বাড়েন। অতঃপর দক্ষিণের কামরাটির সামনে এসে দাঁড়ান। জানালা দিয়ে কামরার ভেতর দেখা যাচ্ছে পরিষ্কারভাবে। চুনকাম উঠে বিবর্ণ হওয়া দেয়ালে আসমা উল হুসনা বা আল্লাহ পাকের নিরানব্বইটি সিফতি নামের ক্যালিওগ্রাফ করা একটি পিকচার ফ্রেম ঝুলছে।
খুলনার মাস্টার সাহেবের কথা তাঁর স্মৃতিতে জোরেশোরে ফিরে আসে। মাস্টারের আসল নাম কী ছিল? রাজনৈতিক কারণে কবিরুল হক ছদ্মনামে এই কামরায় হুলিয়া এড়িয়ে বছর দুয়েক আত্মগোপন করেছিলেন। সদ্য নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসাবে রাব্বি সাহেবের তখন এলাকায় বেশ খানিকটা প্রভাব-প্রতিপত্তিও ছিল। স্থানীয় হাইস্কুলে কবিরুল হককে মাস্টারের চাকরি পাইয়ে দিতে কোনো অসুবিধা হয়নি।
মাস্টার ইংরেজি ও ইতিহাস পড়াতেন। তাঁর আঁকাজোকার হাত ছিল দুর্দান্ত। দেশে তখনো চলছে আইয়ুব খানি মার্শাল ল’র জবর তমতমি। কমিউনিস্ট ভাবধারার বামপন্থী ক্যাডারদের অনেককেই হুলিয়া মাথায় নিয়ে চলে গেছেন পুরোপুরি আন্ডারগ্রাউন্ডে। কবিরুল মাস্টার ছিলেন তাদেরই একজন। তিনি জলরঙের ডালিয়া ফোটা বাগিচার একটি দৃশ্যপট এঁকে দিয়ে সবাইকে চমৎকৃত করেছিলেন।
বৈঠকখানায় ঢুকে রাব্বি পেইন্টিংটি কোথায় তা নিয়ে একটু ভাবেন, চারদিকে খুঁটিয়ে তাকান। দেয়ালে যেখানে চিত্রটির ঝুলে থাকার কথা, ওখানে সস্তা একটি বিরাট আকারের সচিত্র পোস্টার সাঁটা। রাব্বি রংচঙে পোস্টারটির দিকে কিছুক্ষণ দিশা ধরে তাকান। ঢেউতোলা ছাদের দৃষ্টিনন্দন ইমারতটিকে শনাক্তও করতে পারেন, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারেন না, তাঁর পৈতৃক ভিটেবাড়ির দেয়ালে সিডনি শহরের অপেরা হাউসের ছবি টাঙানোর প্রাসঙ্গিকতা!
দেয়ালঘেঁষা বইয়ের আলমারি তিনটি এখনো আগের জায়গায়ই আছে। তবে কোনো কোনোটির ভাঙা কাচ সরিয়ে পাল্লায় গঁদ দিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়েছে পলিথিনের স্বচ্ছ আবরণ। রাব্বি ভুরু কুঁচকে ভেতরের থরে-বিথরে সাজানো বইগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন। অনেকগুলো বইয়ের রচয়িতা মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী।
এক জামানায় তাঁর সংগৃহীত বইপত্র দিয়ে এ আলমারি তিনটিতে রাব্বি চেনা বন্ধুবান্ধবের জন্য চালু করেছিলেন একটি ব্যক্তিগত লাইব্রেরি। লেনদেনের সুবিধার জন্য নিজ হাতে তৈরি করেছিলেন বইগুলোর ক্যাটালগও। দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে তিনি সংগৃহীত পুস্তকগুলোর নাম মনে করার চেষ্টা করেন। যোগাযোগ, চক্রবাক, পদাতিক, সুকান্ত সমগ্র, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা...। না, সিস্টেমেটিক্যালি সব কটির নাম মাথায় আসছে না।
একসময় সমরেশ বসুর উপন্যাসগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। ’৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর ওপার বাংলা থেকে বইপত্রের আমদানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তখন বন্ধু সুজিত দেবনাথ হয়ে ওঠে পশ্চিম বাংলা থেকে বইপত্র আনানোর কান্ডারি। সে মাঝেমধ্যে ওপারে তার আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি বেড়াতে যেত। ফিরে আসত কাঁড়ি কাঁড়ি বইপত্তর নিয়ে...।
সুজিতের সক্রিয় উৎসাহে এ বৈঠকখানায় তিনি চালু করেছিলেন স্টাডি সার্কেল। তত দিনে সে বহুধাবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির একটি ফ্যাকশনের পুরোদস্তুর ক্যাডার বনে গেছে। এলাকার প্রগতিমনা ছেলেরা ছিল স্টাডি সার্কেলের সদস্য। একটি সিলেবাসও তৈরি করা হয়েছিল। ছোটদের রাজনীতি ও ছোটদের অর্থনীতি বই দুটি দিয়ে পাঠচক্রে অধ্যয়নের শুরুয়াত হতো। সিলেবাসে তৃতীয় বইটি ছিল যে গল্পের শেষ নেই।
পাঠ করার পর কমরেড সুজিতের তত্ত্বাবধানে তা নিয়ে আলোচনাও হতো। যারা মাস ছায়েক পাঠচক্রের চর্চায় যুক্ত থাকত, তাদের হাতে অবশেষে ধরিয়ে দেওয়া হতো সাম্যবাদের হাতেখড়ি ও ভলগা থেকে গঙ্গা প্রভৃতি পুস্তক।
স্মৃতির কিসতি চড়ে রাব্বি যেন চলে গিয়েছিলেন পুরোনো দিনের সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি যুগে। হঠাৎ মুখের মাংসপেশিতে কম্পনের তোড় ব্যাপকভাবে বেড়ে গেলে তিনি চকিতে ফিরে আসেন বর্তমান মুহূর্তে। ভাবেন, একটু বসে জিরিয়ে নেবেন, কিন্তু বেতের সোফাগুলোর যে হালত, যেভাবে কুশন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে তুলা, বসার আগ্রহ তাঁর মিইয়ে আসে। আবার একটু ঝুঁকে পড়ে রাব্বি তাকান, আলমারির নিচের দিকের একটি তাকে।
ওখানে মসলা-মাসায়েলের কয়েকটি পুস্তকের শিরোনামগুলো পড়েন। এগুলোর পাশে রাখা কুয়াশা সিরিজের গোয়েন্দা গল্পের বইগুলো। ঠিক বুঝতে পারেন না, তাঁর সংগ্রহকে গায়েব করে দিয়ে এ বইগুলো জোগাড়ে তরুণ ইমামের কোনো ভূমিকা আছে কি না? না, আপাতদৃষ্টে পরহেজগার মানুষটিকে দোষারোপ করতে মন থেকে তিনি সায় পান না।
তাঁর পৈতৃক বসতবাড়িটি আদিতে ছিল চার শরিকে বিভক্ত। গত চল্লিশ বছরে তাঁর বাবাসহ তিন চাচা পরলোকে গেছেন, মোট সাতজন ভাতিজি বিবাহিত হয়ে স্বামীদের ঘরসংসার করছে। বাদবাকি এগারোজন ভাতিজারও নিজস্ব পরিবার হয়েছে। এদের সন্তানাদি বেশুমার। অনেকগুলোরই নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই, ধানি জমির আয় সম্বল করে এরা গল্পগুজব করে, বিবিসি শোনে, মসজিদে চিল্লা দিয়ে, হরেক কিসিমের পত্রিকা পড়ে দিনাতিপাত করে। এদের কেউ কেউ প্রচণ্ড রকমের ধর্মপ্রবণ, কথাবার্তায় পৃথিবীজুড়ে পূর্বপুরুষদের পবিত্র ধর্মের রাজনৈতিক বিজয়ের প্রত্যাশা রাখে। এদের পুত্রসন্তানেরা প্যান্টের পায়া গুটিয়ে ঘন্টার ওপর তুলে হাঁটাচলা করে। কন্যারা প্রায় সবাই হেজাবে মুখমণ্ডল আচ্ছাদিত রাখতে পছন্দ করে।
যাদের শরীরে প্রবাহিত শোণিতের সঙ্গে তাঁর জৈবিক যোগসূত্র বংশপরম্পরার, সেই পরবর্তী প্রজন্মের কুটুমখেশের দিনযাপনের বিষয়–আশয় তাঁকে উদ্বিগ্ন করে। হালফিল তাদের বিবর্তিত সংস্কৃতির কথা ভাবতে ভাবতে রাব্বির মাথা ঘুরন্টি দিয়ে ওঠে। কোনো ক্রমে একটি সোফার কিনার ধরে, নিজেকে সামলে বসে পড়েন। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে তিনি যেন চলে যান ভিন্ন এক শতাব্দীর শেষ দিককার অন্য এক দশকে। মনশ্চক্ষে পরিষ্কার দেখতে পান, তামাম পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে চলছে নির্বাচনের তুলতবিল। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের প্রতিপক্ষ হিসেবে মাঠে নেমেছেন, সম্মিলিত বিরোধীদলীয় প্রার্থী মোহতারেমা ফাতেমা জিন্নাহ। পত্রপত্রিকা তাঁকে অভিহিত করছে ‘মাদারে মিল্লাত’ বিশেষণে।
এই কামরার আসবাব সরিয়ে, মেঝেতে উবু হয়ে বসে মাস্টার সাহেব পোস্টারে বড় করে আঁকছেন বিরোধীদলীয় নির্বাচনী প্রতীক লন্ঠনের ছবি। এরপর ভিন্ন পোস্টারে লিখছেন, ‘বিরোধী দলের প্রার্থীকে আপনার মূল্যবান ভোট দিয়া আইয়ুবশাহিকে গদিছাড়া করুন।’ আবার অন্য পোস্টারে লিখছেন, ‘কৃষকনেতা হাতেম আলী বন্দী কেন? রাজবন্দীদের মুক্তি চাই ।’
কামরার এক কোণে, ডিবানের ওপর বসে, হারমোনিয়ামের রিড টিপে টিপে সুজিত চাপা সুরে গাইছে। কৈশোরে রবীন্দ্রসংগীতের রেওয়াজ করা সুজিতের কণ্ঠস্বরে মূর্ত হয়ে উঠছে শ্রী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গণসংগীত, ‘কাস্তেটারে দিও শাণ/ কিষান ভাই রে...।’
রাব্বি স্মৃতিচারণাকে একটি দৃশ্যপটে ফোকাস রাখতে পারেন না। ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো তা দুলতে দুলতে দূরে দূরে থেকে বহুদূরে সরে গিয়ে ফিরে এসে তৈরি করে খণ্ডবিখণ্ড দৃশ্যপট ও বিগত জনাকয়েক স্বজনের স্মৃতিবিধুর মুখের সমাহারে বিচিত্র একটি কোলাজ। তাঁর বাঁ হাত থেকে খট করে রংচটা মোজাইকের মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে হাইপাওয়ারের চশমাটি। চশমা থেকে ছিটকে খুলে পড়া লেন্স থেকে বিচ্ছুরিত আলোর রেখার দিকে রাব্বি সাহেব তাকিয়ে থাকেন চুপচাপ।