আমার জন্ম ঢাকায়। আব্বা এম এ কাদের ছিলেন একজন চিকিৎসক। আব্বার চাকরির সুবাদে আমরা ষাটের দশকে আজিমপুর সরকারি কোয়ার্টারে থাকতাম। তখনকার আজিমপুর কোয়ার্টার ছিল সবুজ ঘাসে পরিপূর্ণ। আমাদের ভবনের প্রায় সবাই ছিলেন আব্বার সহকর্মী। বিকেল হলে শিশু–কিশোরেরা পরিপাটি হয়ে ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট, গোল্লাছুট, দড়িখেলায় মেতে উঠত। সন্ধ্যায় সবুজ ঘাসে গৃহিণীদের আড্ডা বসত।

মহররমের সময় তাজিয়া মিছিল বের হতো। সে সঙ্গে বড় রাস্তায় বসত মহররম মেলা। আব্বার সঙ্গে মেলায় গিয়ে হাঁড়ি–পাতিল, খেলনা, নানা ধরনের জিনিস কিনে আনতাম। বাসার সামনেই ছিল বেবি আইসক্রিমের ফ্যাক্টরি। ইচ্ছা হলেই কিনে আনা যেত।

আমরা পড়তাম আজিমপুর এলাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে, যেটা বর্তমানে অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ। আমাদের সময় স্কুলটি ছিল একতলা। মিসেস আনোয়ারা মনসুরসহ কয়েকজন বিদেশি শিক্ষক ছিলেন।

সে সময় ঢাকা শহরে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন ছিল। আমাদের নানুভাই চুয়াডাঙ্গা থেকে ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে নেমে ঘোড়ার গাড়ি করে আমাদের বাসায় আসতেন। সঙ্গে আনতেন শাকসবজি, ফল, ঝোলা গুড়, পাটালি গুড়সহ অনেক কিছু।

আজিমপুর থেকে আমরা চলে আসি ঢাকা মেডিকেলের কোয়ার্টারে। বুয়েটের বড় মাঠের উল্টো দিকে সুন্দর গেটওয়ালা ডুপ্লেক্স বাড়িতে আমরা থাকতাম। ঢাকা মেডিকেলের চার কোণে এ ধরনের চারটি গেট রয়েছে। একটি গেটের সামনের আমতলায় ভাষা আন্দোলনের সভা হয়েছিল। আমাদের এ বাসার পাশেই ছিল রেললাইন। রেললাইন পার হলেই বকশীবাজার। রেললাইনের পাশের রাস্তা দিয়ে বান্ধবী সুলতানা কামাল খুকির সঙ্গে বুয়েটের মাঠে খেলতে যাওয়া, বকুল ফুল কুড়ানো, বকুল ফল খাওয়া—সে এক মধুর স্মৃতি।

আব্বা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ায় আমাদের চলে আসতে হয় গ্রিন রোডসংলগ্ন ক্রিসেন্ট রোডের নিজস্ব আঙিনায়। এখানে আব্বা ছোট একটা বাংলোবাড়ি বানালেন। এক ছাদের নিচে শোবার ঘর, বসার ঘর, খাবার ঘর ও রান্নাঘর। দেয়ালের ওপর টিনের চারচালার ছাদ। সীমানার চারদিক বাঁশের বেড়ার দেয়াল। বাংলোর সামনের দিকে কাঁটাতারের বেড়া। নানা রঙের কসমস ফুলের ও বোগেনভিলিয়ার বাগান। দূরে বেশ কয়েকটি বাড়ি। আমরা গোয়ালার বাড়ি থেকে দুধ নিয়ে আসতাম। গ্রিন রোড থেকে ক্রিসেন্ট রোডে আসতে হলে ছোট একটা খাল পার হতে হতো। গাড়ি যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। আমাদের বাড়ির পেছনে ছিল বড়সড় ধানখেত। এখানে আমগাছের ডালে দোলনায় আমরা দোল খেতাম আর ধানখেতের শীতল বাতাস উপভোগ করতাম।

গ্রিন রোডে চলাচল করত পুরোনো আমলের বাস, যাকে অনেকে মুড়ির টিন বলতেন। তত দিনে আমি হাটখোলা রোডের কামরুন্নেছা স্কুলে ভর্তি হয়েছি। স্কুলে যেতাম ঘোড়ার গাড়ি কিংবা মুড়ির টিনের স্কুলবাসে। পরে আব্বার চাকরির কারণে ক্রিসেন্ট রোড থেকে চলে যেতে হয় ময়মনসিংহে। ওখান থেকে আমরা চলে আসি ধানমন্ডির রোড ৩১–এর নিজস্ব বাড়িতে। ধানমন্ডির পরিবেশ ছিল শান্ত ও স্নিগ্ধ। বেশির ভাগ বাড়ি ছিল একতলা বা দোতলা। ফুলে ও ফলে ভরা। আম্মা হাঁস–মুরগি পালতেন। হাঁসগুলোকে মালি নিয়ে যেতেন লেকে। সন্ধ্যা হলে নিজেরাই গেটের সামনে এসে ডাকাডাকি করত। জুঁই ও মাধবীলতায় ঘেরা এ বাড়িতেই আব্বা হাসপাতালের কাজ সেরে রোগী দেখতেন। ৩১ নম্বর রোডে ছিল জাপানসহ কয়েকটি দেশের দূতাবাস।

সে সময় মিরপুর রোড ছিল সরু। রিকশা ও গাড়ি পাশাপাশি কোনোরকমে চলত। ধানমন্ডিতে থেকেই দেখেছি, আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অসাধারণ সব ঘটনা। দেখেছি, মিরপুর রোড ধরে পাকিস্তানি সেনাদের নিরস্ত্রভাবে চলে যেতে। সবার ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ পেলেও আমাদের মন ছিল বিষণ্নতায় ভরা। কারণ, আব্বাকে ১৬ ডিসেম্বরের পর তিন মাস ধরে পাওয়া যায়নি। এরপর একদিন আব্বা ফিরে আসায় আমাদের স্বাধীনতা যেন পূর্ণতা পায়।

আমার শৈশব ও কৈশোরে দেখা আজিমপুর, গ্রিন রোড, ক্রিসেন্ট রোড ও ধানমন্ডির ¯স্নিগ্ধতা, শান্ত পরিবেশ, লেকের স্বচ্ছ পানি আজ আর নেই। আমাদের ধানমন্ডির দ্বিতল বাড়ি এখন অ্যাপার্টমেন্ট।

জিনাত মাহরুখ বানু, সাবেক প্রধান, জাতিতত্ত্ব ও অলংকরণ শিল্পকলা বিভাগ, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ধ নমন ড র আম দ র র স মন

এছাড়াও পড়ুন:

ঈদুল ফিতরে ভূয়া তালিকা করে ভিজিএফ’র চাল আত্মসাত 

দিনাজপুরের হাকিমপুরে উপজেলার খট্রামাধবপাড়া ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান ছদরুল শামীম স্বপনের বিরুদ্ধে দুস্থদের ভিজিএফ’র চাল বিতরণে অনিয়ম ও আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এর কয়েকজন ইউপি সদস্য জড়িত আছেন বলেও অভিযোগ। প্রায় ১৮০০ জনের নামে-বেনামে ভূয়া তালিকা করে ১৮ মেট্রিকটন চাল আত্মসাত করেন তারা। এমন কি মৃত ব্যক্তিরও নাম রয়েছে ওই তালিকায়। 

অভিযোগ থেকে জানা যায়, এই পবিত্র ঈদুল ফিতরে খট্রামাধবপাড়া ইউনিয়নের ৪ হাজার ১৬৯ জনের ভিজিএফ চালের তালিকা করেন ওই প্যানেল চেয়ারম্যান। এ তালিকায় একজনের নাম একাধিকবার তোলেন। এক ওয়ার্ডের তালিকাভুক্তদের অন্য ওয়ার্ডের তালিকায়ও নাম ওঠান। এমনকি ওই তালিকায় মৃত ব্যক্তিরও নাম রয়েছে। এভাবে চাল আত্মসাত প্রক্রিয়ায় প্যানেল চেয়ারম্যান স্বপনের সঙ্গে ৩ ইউপি সদস্যকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এরা হলেন- ১নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য শাহানুর রহমান, ৭নং ইউপি সদস্য আবুল কাশেম ও ৮নং ওয়ার্ড সদস্য জাহাঙ্গীর আলম। 

এ ঘটনায় প্রায় ৩০০ জন বঞ্চিত সুবিধাভোগী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন।

ইউনিয়নের মংলা বাজারের বাসিন্দা তাহাজ্জত আলী বলেন, “আমার প্রতিবেশী মৃত রবিউল ইসলামের নাম ভিজিএফ তালিকায় রয়েছে। কিন্তু  তিনি গত ৩ বছর আগে মারা গেছেন। এক বছর পূর্বে তার স্ত্রীর অন্যত্র বিয়েও হয়েছে। চেয়ারম্যান চাল আত্মসাতের উদ্দেশ্যে ভিজিএফের তালিকায় এই মৃত ব্যক্তির নাম তালিকাভুক্ত করেছেন।”  

অভিযোগকারী মাধবপাড়া গ্রামের কাশেম আলীর স্ত্রী বেগম জানান, ভিজিএফএর তালিকায় তার নামের সিরিয়াল ২৩৭৬। অথচ কয়েকবার চেয়ারম্যানের নিকট ভিজিএফ চালের জন্য গেলে তার নাম তালিকায় নেই বলে ফিরিয়ে দেন। 

তিনি জানান, শুধু তাকে নয় এরকম আরও অনেক মেয়ে মানুষকে চাল না দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন। 

অভিযোগকারী ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের আমিনুল ইসলাম জানান, তার মাস্টার রোলের সিরিয়াল নম্বর ২১০। তালিকায় তার নাম নেই বলে তাকেও ওই দিন চাল না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “আমরা গরীব মানুষ ঈদের আগে ভিজিএফের চালের অপেক্ষায় থাকি। সেই চাল যদি চেয়ারম্যান  খেয়ে ফেলেন তাহলে তো গরীবের তো আর বাঁচার পথ নাই। সরকারের উচিত গরীবের চাল মেরে খাওয়া চেয়ারম্যানকে শাস্তি দেওয়া।” 

লিখিত অভিযোগকারী সাইমুমুর রহমান ডলার জানান, ১নং ওয়ার্ডের ৮৬ জন , ২নং ওয়ার্ডের ৭৫ জন, ৩নং ওয়ার্ডের ৬৩ জন, ৪নং ওয়ার্ডের ৫৬ জন,  ৫নং ওয়ার্ডের ১১১ জন, ৬নং ওয়ার্ডের ১৩১ জন, ৭নং ওয়ার্ডে ৯২ জন, ৮নং ওয়ার্ডের ১০৯ জন ও ৯নং ওয়ার্ডের ৮৩ জনের মোট ৮০৬ জনের নাম অন্য ওয়ার্ডের মাস্টার সিরিয়ালে একাধিকবার ব্যবহার করা হয়েছে। চেয়ারম্যান ও তার লোকেরা এসব নামের বিপরীতে বরদ্দকৃত চাল আত্মসাৎ করেছেন। 

এ ব্যাপারে প্যানেল চেয়ারম্যান ছদরুল শামীম স্বপন বলেন, “ভিজিএফ এর চাল বিতরণে সময় ট্যাগ অফিসারসহ সব ওয়ার্ডের মেম্বাররা উপস্থিত ছিলেন। আমি সব চাল সুষ্ঠুভাবে বিতরণ করেছি।”

এবিষয়ে হাকিমপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার অমিত রায় বলেন, “খট্রামাধবপাড়া ইউনিয়ন প্যানেল চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ভিজিএফ’র চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছি। পিআইওকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

ঢাকা/মোসলেম/টিপু 

সম্পর্কিত নিবন্ধ