‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে!’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের এই পঙ্ক্তি স্মরণ করে কেবল মনে মনে নয়, সশরীর হাজির উত্তরবঙ্গের ঐতিহাসিক ‘দিবর দিঘি’–তে। এর অবস্থান নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার দিবর ইউনিয়নে।
নওগাঁ সদর থেকে ৩৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নজিপুর পৌরসভা, যার ধার ঘেঁষে বয়ে চলেছে আত্রাই নদ। এই নদের ওপর নির্মিত পুরোনো ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিক প্রতাপ সেতু’ পার হয়ে সোজা পথ চলে গেছে ২১ কিলোমিটার পশ্চিমে আমের সাম্রাজ্য সাপাহার উপজেলায়। এই মৌসুমে অজস্র ভাঁটফুল শুভ্র সৌন্দর্য মেলে ফুটে আছে পথের ধারে। যেতে যেতে পথ এক রেখা হয়ে যায়। সাপাহারের দুই কিলোমিটার আগে রাস্তার বাঁ পাশে চোখে পড়ে সারি সারি ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণিগাছে ছেয়ে থাকা বন। কাঁকর বিছানো উঁচু–নিচু মাটি।
একটু এগিয়েই রাস্তার ডান পাশে ‘ঐতিহাসিক দিবর দিঘি’ নামাঙ্কিত বড় এক তোরণ। তোরণ পেরিয়ে গ্রাম, আঁকাবাঁকা পাকা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলা। দুই পাশে আমবাগান। বিয়ের টোপরের মতো মুকুলে ছেয়ে আছে সব আমগাছ। কয়েকটি বড় পুকুর দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি সেই দিঘির দিকে। কাছাকাছি এসে দেখি, ঢালু হয়ে অনেকটা পথ নেমে গেছে দিঘি বরাবর। নামছি ঢাল বেয়ে ইট বিছানো সরু পথে। দুপাশে প্রহরীর মতো দেবদারুগাছের সারি।
দিঘির শানবাঁধানো ঘাটে এসে বসলাম। তখন বিকেল। প্রায় ২০ একরের বিশাল দিঘি। মেঘলা দিন, ঠান্ডা হাওয়া বয়ে চলেছে। একই রঙের আকাশ ও দিঘির পানি। শুধু ওই পাড়ের গাছপালা এমন মিলনরেখায় ছেদ ঘটিয়েছে। ছোট ছোট ঢেউ দুলতে দুলতে এসে মিলিয়ে যাচ্ছে পাড়ে। এক অদ্ভুত প্রশান্তি ভুলিয়ে দেয় পথের ক্লান্তি। দিঘির মাঝখানে যে অখণ্ড গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভ দেখা যাচ্ছে, সেটাই এই দিঘির বিশেষত্ব, সেটাই এখানকার ইতিহাসের স্মারক।
বর্গাকার এই দিঘির মাঝখানের স্তম্ভটি প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সম্পর্কে ইতিহাসবিদদের নানা মত আছে। কারও মতে, কৈবর্ত বিদ্রোহের সময় পাল রাজবংশের রাজা দ্বিতীয় মহিপালকে পরাজিত করার কৃতিত্ব স্মরণীয় করে রাখতে কৈবর্ত রাজা দিব্যক এই জয়স্তম্ভ নির্মাণ ও দিঘি খনন করেন।
আবার কেউ কেউ বলেন, দিব্যকের রাজত্বকালে পাল রাজা রামপাল বরেন্দ্র উদ্ধারের চেষ্টা করে দিব্যকের কাছে পরাজিত হন। দিব্যক সেই জয়ের স্মৃতি রক্ষায় এই স্তম্ভ নির্মাণ করেন। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, কৈবর্ত রাজা ভীম তাঁর চাচা দিব্যকের স্মৃতি রক্ষায় এই স্তম্ভ নির্মাণ করেন।
১৮০৭-০৮ সালে ব্রিটিশ তথ্যানুসন্ধানী ও জরিপকারী ফ্রান্সিস বুকানন দিবর দিঘির শিলাস্তম্ভের দৈর্ঘ্য ৩০ দশমিক ৭৫ ফুট বলে উল্লেখ করেন। স্যার আলেকজান্ডার কানিংহামের বর্ণনা মতে, স্তম্ভটিতে মোট ৯টি কোণ আছে এবং এই স্তম্ভের ব্যাস ৭৩ সেন্টিমিটার (২৯ ইঞ্চি)।
দিঘির চারপাশে চোখ বোলালে মনে হয় বিশাল এক অ্যাম্ফিথিয়েটার বা স্টেডিয়ামের গ্যালারি। রোমের কলোসিয়ামের কথা মনে পড়ে যায়, যেখানে গ্ল্যাডিয়েটরদের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে জিততে হতো প্রতিপক্ষ মল্লবীর অথবা হিংস্র কোনো পশুর সঙ্গে। হেরে গেলে প্রাণপাত, জিতে গেলে বীর।
দিবর দিঘির এই জয়স্তম্ভ যুদ্ধ, রক্তপাত, জয়-পরাজয়, মোটকথা কৈবর্ত বিদ্রোহের সেই সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যা শত শত বছর ধরে এভাবেই দণ্ডায়মান, একটুও হেলে পড়েনি। বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদ আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তাঁর ‘বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ বইয়ে এ বিষয়ে লিখেছেন, ‘বহুতলবিশিষ্ট অট্টালিকার ভিত্তিদেশের মতো স্তম্ভটির মাটির নিচের নিম্নদেশ সাতটি স্তবকে নির্মিত ছিল এবং নিচের স্তবকগুলো নিচের দিকে ক্রমেই স্ফীতকায় করে নির্মিত ছিল।’ আজও সগৌরবে এই শিলাস্তম্ভ কত রহস্য নিয়ে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে!
খাঁজকাটা ও পাথরে খোদাইকৃত অলংকারশোভিত এই স্তম্ভের সৌন্দর্য ও দিঘির বিশালতা পর্যটকদের এক ঘোরলাগা আবেশে টানে। ঘাটে নৌকা বাঁধা। নৌকা নিয়ে গিয়ে ছুঁয়ে দেখে আসা যায় শিলাস্তম্ভ। স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হতে থাকবে, এই স্তম্ভ ঘিরে যেন আশপাশের সবকিছু আকর্ষিত হচ্ছে। এ পাশের পাড় থেকে তাকালে দেখা যায়, স্তম্ভটি অন্য পাড়ের কাছাকাছি। ওই পাড়ে গিয়ে মনে হয়, স্তম্ভটি আগের পাড়ের কাছাকাছি—এমন দৃষ্টিবিভ্রম তৈরি হয়। দিবর দিঘি দেখতে এলে এর বহুমাত্রিক সৌন্দর্য ও রহস্যে যে কেউ মুগ্ধ হবেন।
এমন দৃশ্যমুগ্ধতায় একাত্ম হয়ে থাকতে থাকতে কখন যেন জালের মতো অন্ধকারে জড়িয়ে যায় চারপাশ। সন্ধ্যার হাত ধরে থোকা থোকা ছায়া ঘন হয়ে ওঠে দিঘিপাড়ের আমবাগানে। বাতাসে মুকুলের ম–ম ঘ্রাণ। বুঝলাম, এই প্রত্নগভীরতা থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে। ফিরে যাচ্ছি আবার চলমান জীবনের ব্যস্ততায়, বাস্তবতায়। পেছনে আবছা অন্ধকারে যাবতীয় স্মৃতি নিয়ে পানিতে একলা দাঁড়িয়ে থাকে দিব্যক বিজয়স্তম্ভ।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার’ চালানো হচ্ছে আমার বিরুদ্ধে: টিউলিপ
বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিষয়ে টিউলিপ সিদ্দিক জানিয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার’ চালানো হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের লন্ডনের হ্যাম্পস্টিড অ্যান্ড হাইগেট আসনের এমপি ও ও সাবেক ‘সিটি মিনিস্টার’ বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, আপনারা বুঝবেন যে, এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচারকে কোনো প্রসঙ্গ বা মন্তব্যের মাধ্যমে আমি বিশেষ গুরুত্ব দিতে পারি না। এটা পুরোপুরি আমাকে হয়রানি করার জন্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার। এমন কোনো প্রমাণ নেই যে আমি ভুল কিছু করেছি।’ খবর-বিবিসি
বাংলাদেশে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিষয়ে সোমবার লন্ডনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন টিউলিপ সিদ্দিক। তিনি বলেন, বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষগুলোর কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। পুরোটা সময় তারা মিডিয়া ট্রায়াল চালিয়েছে। আমার আইনজীবীরা উদ্যোগী হয়ে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখেছিলেন। তবে তারা কখনও এর জবাব দেয়নি।’
প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগে করা তিনটি মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর বোন শেখ রেহানা এবং রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ও ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিসহ ৫৩ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা পৃথক তিন মামলার অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে রোববার এ আদেশ দেন ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ জাকির হোসেন গালিব। আদালতে দুদকের প্রসিকিউশন বিভাগের সহকারী পরিচালক আমিনুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তার করা গেল কিনা, সে-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ২৭ এপ্রিল দিন ধার্য করেছেন আদালত। ১০ কাঠা প্লট নেওয়ার অন্য অভিযোগে শেখ রেহানার মেয়ে আজমিনা সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ১৩ জানুয়ারি মামলা করেন দুদকের একজন সহকারী পরিচালক। মামলায় শেখ হাসিনা, টিউলিপসহ ১৬ জনকে আসামি করা হয়।
এর আগে জানুয়ারির মাঝামাঝিতে যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির মন্ত্রী থেকে পদত্যাগ করেন টিউলিপ সিদ্দিক। তিনি যুক্তরাজ্যের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনীতিবিষয়ক মিনিস্টার (ইকোনমিক সেক্রেটারি) ছিলেন। দেশটির আর্থিক খাতে দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্ব ছিল তার কাঁধে।
গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, টিউলিপের খালা বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আর্থিক সম্পর্কের বিষয়ে বারবার প্রশ্ন ওঠায় টিউলিপ সিদ্দিক মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
সম্প্রতি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অর্থনৈতিক অসঙ্গতির অভিযোগ উঠে। এরপর নিজের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ মিনিস্ট্রিয়াল ওয়াচডগকে তদন্তের আহ্বান জানান টিউলিপ। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেন মিনিস্ট্রিয়াল ওয়াচডগের উপদেষ্টা লরি ম্যাগনাস।
টিউলিপ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের কাছে তার পদত্যাগপত্র জমা দেন। তবে এতে তিনি উল্লেখ করেছেন, তার বিরুদ্ধে যে তদন্ত হয়েছে সেখানে, মিনিস্ট্রিয়াল ওয়াচডগের উপদেষ্টা লরি ম্যাগনাস তার বিরুদ্ধে মন্ত্রিত্বের নীতি ভঙ্গের কোনো প্রমাণ পাননি। কেয়ার স্টারমার অফিসিয়াল চিঠিতে টিউলিপ সিদ্দিককে বলেন, ‘আপনার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার সময় এটা পরিষ্কার করতে চাই যে, মিনিস্ট্রিয়াল ওয়াচডগের উপদেষ্টা লরি ম্যাগনাস আমাকে আশ্বস্ত করেছেন- তিনি আপনার বিরুদ্ধে মন্ত্রিত্বের নীতি ভঙ্গের কোনো প্রমাণ পাননি এবং আর্থিক অসঙ্গতির কোনো প্রমাণ খুঁজে পাননি।’