জমানো বৃষ্টির পানি শুষ্ক মৌসুমে বাঁচাতে পারবে উপকূলবাসীকে?
Published: 22nd, March 2025 GMT
ফাল্গুন শেষে চৈত্র মাস শুরু হতেই চলছে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার। এই হাহাকার দক্ষিণ উপকূলবাসীদের। প্রায় সব পানির উৎসগুলোতে লবণাক্ততা ব্যাপক আকারে বেড়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে উপকূলের নদীগুলোকে লবণাক্ত করে তোলে বঙ্গোপসাগরের নোনাপানি।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে গত ২৫-৩০ বছরে শুষ্ক মৌসুমে পানির উৎসগুলোতে লবণাক্ততা বাড়ার ফলে দেখা দিচ্ছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। যারা বর্ষার মৌসুমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রাখে, তারা কিছুটা স্বস্তিতে থাকে। আর যাদের সেই উপায় থাকে না, তাদের বাধ্য হয়েই খাওয়াসহ অন্যান্য কাজে লোনাপানিই ব্যবহার করতে হয়।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। জনশুমারি ও গৃহগণনা (২০২২) অনুযায়ী, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ১৯টি জেলায় বসবাস করেন প্রায় ৪ কোটি ৩৮ লাখ মানুষ।
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সংকট ও সম্ভাবনাময় এলাকা হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর প্রায় সব মিঠাপানির উৎসগুলোতে লোনাপানি ঢুকে নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষিজমি ও মিঠাপানির উৎসগুলোতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্টি হচ্ছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট এবং ব্যাহত হচ্ছে ফসলের স্বাভাবিক উৎপাদন।
বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন অনুযায়ী, দেশের উপকূলে গত চার দশকে লবণাক্ত জমির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ। ভূগর্ভস্থ পানির লবণাক্ততাও মাত্রাভেদে উপকূল থেকে ৫০ থেকে ৭০ কিলোমিটার উজান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। ফলে ভূগর্ভস্থ স্বাদুপানির উৎসগুলো তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ দিন দিন বাড়ছে, ভূপৃষ্ঠের নিচে স্বাদুপানির মজুতও কমে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, উপকূলীয় এলাকায় লোনাপানি ও ভূগর্ভস্থ মিঠাপানি একটি ভারসাম্য বজায় রাখে। বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে জলাশয়ে স্বাদুপানি জমা হয়। তবে সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার কারণে লোনাপানি ভূমির ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করে। ফলে একটি সাম্যাবস্থা সৃষ্টি হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে লোনাপানি লোকালয়ের মিঠাপানির অঞ্চলে প্রবেশ করায় প্রায় সব পানীয় জলের উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
দেশের দক্ষিণ উপকূলের বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা জেলাতে রয়েছে সুপেয় ও নিরাপদ পানির তীব্র সংকট। উপকূলে যেসব এলাকায় পানি লবণাক্ত, সেখানে নিরাপদ পানির উৎসসমূহের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে মিঠাপানির পুকুর, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা, গভীর নলকূপ, পাইপলাইন সরবরাহ, পন্ড স্যান্ড ফিল্টার বা পিএসএফ, রিভার্স অসমোসিস বা আরও প্ল্যান্ট।
ভূগর্ভস্থ নিরাপদ পানি উত্তোলনের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় গভীর নলকূপ। তবে উপকূলের বেশির ভাগ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এসব নলকূপ দিয়ে পানি ওঠে না, আবার উঠলেও লোনাপানি ওঠে। এ ছাড়া শহর এলাকায় পাইপলাইনের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে অথবা ভূ-উপরিস্থ পানি তুলে শোধন করে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এই পানি সব সময় নিরাপদ হয় না।
গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠী খাওয়ার পানির জন্য মিঠাপানির পুকুর ব্যবহার করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিঠাপানির পুকুরের দূরত্ব বেশি হওয়ায় মানুষকে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হয়। পন্ড স্যান্ড ফিল্টার বা পিএসএফের মাধ্যমে মিঠাপানির পুকুরে জমা বৃষ্টির পানি তুলে বালু ও নুড়িপাথরের ফিল্টার দিয়ে পরিশোধন করে পানের উপযোগী করা হয়। এই পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব ও টেকসই। এ ছাড়া রিভার্স ওসমোসিস বা আর,ও প্ল্যান্টের মাধ্যমে লবণাক্ত পানি খাওয়ার পানিতে রূপান্তর করা যায়। তবে এই পদ্ধতি তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল ও রক্ষণাবেক্ষণ কঠিন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় বাড়বে, যার প্রভাব পড়বে পানির উৎসসমূহের ওপর। উপকূলের পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা আরও বাড়বে। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে, বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থার মতো পরীক্ষিত অভিযোজন পদ্ধতিই শুষ্ক মৌসুমের জন্য সবচেয়ে উপযোগী ও কার্যকর উপায়।প্রাচীনকাল থেকেই বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বহুল প্রচলিত একটি স্থানীয় অভিযোজন ব্যবস্থা। বর্ষা মৌসুমে মানুষজন মাটির বড় পাত্র (মটকা) বা প্লাস্টিকের ড্রামে সাধারণত বৃষ্টির পানি ধরে রাখে। তবে এই পানি খুব বেশি দিন ব্যবহার করা যায় না। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ঘরের চাল/ছাদের ওপর পড়া বৃষ্টির পানি পাইপ দিয়ে ট্যাংক/পাত্রে ধরে রাখার পদ্ধতি, যাকে বলা হয় রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং বা ‘বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা’। এই ব্যবস্থায় খুব সহজেই বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও কয়েক মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য বৃষ্টির পানি একটি কার্যকর পানির উৎস, যেহেতু উপকূলীয় অঞ্চলে গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৩ হাজার মিলিমিটারের বেশি। উপকূলীয় অঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহার করা তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (ন্যাপ, ২০২৩) অনুযায়ী, বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের ধরন অঞ্চলভেদে এবং সময়ের সঙ্গে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়। উপকূলীয় ও পার্বত্য অঞ্চলে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ৩ হাজার মিলিমিটারের বেশি, যেখানে বাংলাদেশের গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত প্রায় ২ হাজার ৪০০ মিলিমিটার। বাংলাদেশের মোট বার্ষিক বৃষ্টিপাতের প্রায় ৭০ শতাংশ হয় বর্ষাকালে।
বাংলাদেশে জুন থেকে আগস্ট (বাংলা আষাঢ়-শ্রাবণ মাস) এই সময়কালকে বর্ষাকাল ধরা হয়। বৃষ্টিপাতের ২০-৩০ বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাধারণত জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এ সময় ভূপৃষ্ঠের উপরিস্তরের পানির উৎসগুলোতেও লবণাক্ততার পরিমাণও কম থাকে। অন্যদিকে নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়কালকে, যখন বৃষ্টিপাত হয় না, তখন ভূপৃষ্ঠের উপরিস্তরের পানির উৎসগুলোতেও লবণাক্ততার পরিমাণ অনেকাংশে বেড়ে যায়।
অক্টোবর মাসের শেষের দিকে (কিছু অঞ্চলের স্থানীয় ভাষায় আইত্তানি-কাইত্তানি) যে বৃষ্টিপাত হয়, সেই পানি ভালোভাবে সংরক্ষণ করে রাখাটা উপযোগী, যাতে শুষ্ক মৌসুমে অর্থাৎ যখন বৃষ্টিপাত হয় না (নভেম্বর থেকে এপ্রিল) সে সময় সংরক্ষিত পানি ব্যবহার করা যায়। সঠিক নিয়মে সংরক্ষণ করে রাখলে এর মাধ্যমে পরবর্তী বর্ষার আগপর্যন্ত খাওয়ার পানির সংকট দূর করা সম্ভব। তবে মনে রাখতে হবে যে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা গেলেও শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টির পানি হিসাব করে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করা জরুরি।
বৃষ্টির পানি দীর্ঘ সময় সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে শুষ্ক মৌসুমে পানিসংকট মোকাবিলা করা যেতে পারে। স্থানীয় মানুষের মতে, সুপেয় পানির অন্য উৎসসমূহের তুলনায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহার একটি ব্যয়সাশ্রয়ী উপায়।
উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট মোকাবিলায় ২০১৯ সাল থেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছে ব্র্যাক। খানা, কমিউনিটি ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থায় সারা বছর বৃষ্টির পানি নিরাপদভাবে সংরক্ষণ করতে উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ফিল্টারও যুক্ত করা হয়। এ ছাড়া যেসব মানুষের টিনের চালের ঘর নেই, তাঁদের জন্য রয়েছে বাঁশের খুঁটির ওপরে ত্রিপলের মাধ্যমে বিশেষ পদ্ধতিতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের স্থানীয় ব্যবস্থাপনা।
মোংলা উপজেলার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো.
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় বাড়বে, যার প্রভাব পড়বে পানির উৎসসমূহের ওপর। উপকূলের পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা আরও বাড়বে। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে, বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থার মতো পরীক্ষিত অভিযোজন পদ্ধতিই শুষ্ক মৌসুমের জন্য সবচেয়ে উপযোগী ও কার্যকর উপায়।
২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘হিমবাহ সংরক্ষণ’। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে, ফলে পৃথিবীর হিমবাহগুলো আগের চেয়ে দ্রুত গলছে। আমাদের অবশ্যই ভবিষ্যতের জন্য পানিসম্পদ সংরক্ষণে একসঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। মানুষ ও পৃথিবীর কল্যাণে হিমবাহের গলিত পানিসহ প্রকৃতির দান বৃষ্টির পানি আরও টেকসইভাবে সংরক্ষণ করা আবশ্যক।
মো. লিয়াকত আলী পিএইচডি, পরিচালক, জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি, নগর উন্নয়ন কর্মসূচি ও দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি, ব্র্যাক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব ষ ট প ত হয় দ শ র উপক ল ব যবহ র কর র পর ম ণ ঘ র ণ ঝড় বর ষ ক ল উপক ল র লবণ ক ত র জন য ন র পদ এল ক য় উপয গ সবচ য় র ওপর জলব য়
এছাড়াও পড়ুন:
জমানো বৃষ্টির পানি শুষ্ক মৌসুমে বাঁচাতে পারবে উপকূলবাসীকে?
ফাল্গুন শেষে চৈত্র মাস শুরু হতেই চলছে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার। এই হাহাকার দক্ষিণ উপকূলবাসীদের। প্রায় সব পানির উৎসগুলোতে লবণাক্ততা ব্যাপক আকারে বেড়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে উপকূলের নদীগুলোকে লবণাক্ত করে তোলে বঙ্গোপসাগরের নোনাপানি।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে গত ২৫-৩০ বছরে শুষ্ক মৌসুমে পানির উৎসগুলোতে লবণাক্ততা বাড়ার ফলে দেখা দিচ্ছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। যারা বর্ষার মৌসুমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রাখে, তারা কিছুটা স্বস্তিতে থাকে। আর যাদের সেই উপায় থাকে না, তাদের বাধ্য হয়েই খাওয়াসহ অন্যান্য কাজে লোনাপানিই ব্যবহার করতে হয়।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। জনশুমারি ও গৃহগণনা (২০২২) অনুযায়ী, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ১৯টি জেলায় বসবাস করেন প্রায় ৪ কোটি ৩৮ লাখ মানুষ।
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সংকট ও সম্ভাবনাময় এলাকা হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর প্রায় সব মিঠাপানির উৎসগুলোতে লোনাপানি ঢুকে নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষিজমি ও মিঠাপানির উৎসগুলোতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্টি হচ্ছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট এবং ব্যাহত হচ্ছে ফসলের স্বাভাবিক উৎপাদন।
বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন অনুযায়ী, দেশের উপকূলে গত চার দশকে লবণাক্ত জমির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২৭ শতাংশ। ভূগর্ভস্থ পানির লবণাক্ততাও মাত্রাভেদে উপকূল থেকে ৫০ থেকে ৭০ কিলোমিটার উজান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। ফলে ভূগর্ভস্থ স্বাদুপানির উৎসগুলো তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ দিন দিন বাড়ছে, ভূপৃষ্ঠের নিচে স্বাদুপানির মজুতও কমে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, উপকূলীয় এলাকায় লোনাপানি ও ভূগর্ভস্থ মিঠাপানি একটি ভারসাম্য বজায় রাখে। বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে জলাশয়ে স্বাদুপানি জমা হয়। তবে সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার কারণে লোনাপানি ভূমির ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করে। ফলে একটি সাম্যাবস্থা সৃষ্টি হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে লোনাপানি লোকালয়ের মিঠাপানির অঞ্চলে প্রবেশ করায় প্রায় সব পানীয় জলের উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
দেশের দক্ষিণ উপকূলের বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা জেলাতে রয়েছে সুপেয় ও নিরাপদ পানির তীব্র সংকট। উপকূলে যেসব এলাকায় পানি লবণাক্ত, সেখানে নিরাপদ পানির উৎসসমূহের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে মিঠাপানির পুকুর, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা, গভীর নলকূপ, পাইপলাইন সরবরাহ, পন্ড স্যান্ড ফিল্টার বা পিএসএফ, রিভার্স অসমোসিস বা আরও প্ল্যান্ট।
ভূগর্ভস্থ নিরাপদ পানি উত্তোলনের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় গভীর নলকূপ। তবে উপকূলের বেশির ভাগ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এসব নলকূপ দিয়ে পানি ওঠে না, আবার উঠলেও লোনাপানি ওঠে। এ ছাড়া শহর এলাকায় পাইপলাইনের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে অথবা ভূ-উপরিস্থ পানি তুলে শোধন করে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এই পানি সব সময় নিরাপদ হয় না।
গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠী খাওয়ার পানির জন্য মিঠাপানির পুকুর ব্যবহার করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিঠাপানির পুকুরের দূরত্ব বেশি হওয়ায় মানুষকে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হয়। পন্ড স্যান্ড ফিল্টার বা পিএসএফের মাধ্যমে মিঠাপানির পুকুরে জমা বৃষ্টির পানি তুলে বালু ও নুড়িপাথরের ফিল্টার দিয়ে পরিশোধন করে পানের উপযোগী করা হয়। এই পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব ও টেকসই। এ ছাড়া রিভার্স ওসমোসিস বা আর,ও প্ল্যান্টের মাধ্যমে লবণাক্ত পানি খাওয়ার পানিতে রূপান্তর করা যায়। তবে এই পদ্ধতি তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল ও রক্ষণাবেক্ষণ কঠিন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় বাড়বে, যার প্রভাব পড়বে পানির উৎসসমূহের ওপর। উপকূলের পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা আরও বাড়বে। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে, বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থার মতো পরীক্ষিত অভিযোজন পদ্ধতিই শুষ্ক মৌসুমের জন্য সবচেয়ে উপযোগী ও কার্যকর উপায়।প্রাচীনকাল থেকেই বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বহুল প্রচলিত একটি স্থানীয় অভিযোজন ব্যবস্থা। বর্ষা মৌসুমে মানুষজন মাটির বড় পাত্র (মটকা) বা প্লাস্টিকের ড্রামে সাধারণত বৃষ্টির পানি ধরে রাখে। তবে এই পানি খুব বেশি দিন ব্যবহার করা যায় না। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ঘরের চাল/ছাদের ওপর পড়া বৃষ্টির পানি পাইপ দিয়ে ট্যাংক/পাত্রে ধরে রাখার পদ্ধতি, যাকে বলা হয় রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং বা ‘বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা’। এই ব্যবস্থায় খুব সহজেই বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও কয়েক মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য বৃষ্টির পানি একটি কার্যকর পানির উৎস, যেহেতু উপকূলীয় অঞ্চলে গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৩ হাজার মিলিমিটারের বেশি। উপকূলীয় অঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহার করা তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (ন্যাপ, ২০২৩) অনুযায়ী, বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের ধরন অঞ্চলভেদে এবং সময়ের সঙ্গে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়। উপকূলীয় ও পার্বত্য অঞ্চলে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ৩ হাজার মিলিমিটারের বেশি, যেখানে বাংলাদেশের গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত প্রায় ২ হাজার ৪০০ মিলিমিটার। বাংলাদেশের মোট বার্ষিক বৃষ্টিপাতের প্রায় ৭০ শতাংশ হয় বর্ষাকালে।
বাংলাদেশে জুন থেকে আগস্ট (বাংলা আষাঢ়-শ্রাবণ মাস) এই সময়কালকে বর্ষাকাল ধরা হয়। বৃষ্টিপাতের ২০-৩০ বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাধারণত জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। এ সময় ভূপৃষ্ঠের উপরিস্তরের পানির উৎসগুলোতেও লবণাক্ততার পরিমাণও কম থাকে। অন্যদিকে নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত সময়কালকে, যখন বৃষ্টিপাত হয় না, তখন ভূপৃষ্ঠের উপরিস্তরের পানির উৎসগুলোতেও লবণাক্ততার পরিমাণ অনেকাংশে বেড়ে যায়।
অক্টোবর মাসের শেষের দিকে (কিছু অঞ্চলের স্থানীয় ভাষায় আইত্তানি-কাইত্তানি) যে বৃষ্টিপাত হয়, সেই পানি ভালোভাবে সংরক্ষণ করে রাখাটা উপযোগী, যাতে শুষ্ক মৌসুমে অর্থাৎ যখন বৃষ্টিপাত হয় না (নভেম্বর থেকে এপ্রিল) সে সময় সংরক্ষিত পানি ব্যবহার করা যায়। সঠিক নিয়মে সংরক্ষণ করে রাখলে এর মাধ্যমে পরবর্তী বর্ষার আগপর্যন্ত খাওয়ার পানির সংকট দূর করা সম্ভব। তবে মনে রাখতে হবে যে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা গেলেও শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টির পানি হিসাব করে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করা জরুরি।
বৃষ্টির পানি দীর্ঘ সময় সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে শুষ্ক মৌসুমে পানিসংকট মোকাবিলা করা যেতে পারে। স্থানীয় মানুষের মতে, সুপেয় পানির অন্য উৎসসমূহের তুলনায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহার একটি ব্যয়সাশ্রয়ী উপায়।
উপকূলীয় অঞ্চলে সুপেয় পানির সংকট মোকাবিলায় ২০১৯ সাল থেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছে ব্র্যাক। খানা, কমিউনিটি ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থায় সারা বছর বৃষ্টির পানি নিরাপদভাবে সংরক্ষণ করতে উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ফিল্টারও যুক্ত করা হয়। এ ছাড়া যেসব মানুষের টিনের চালের ঘর নেই, তাঁদের জন্য রয়েছে বাঁশের খুঁটির ওপরে ত্রিপলের মাধ্যমে বিশেষ পদ্ধতিতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের স্থানীয় ব্যবস্থাপনা।
মোংলা উপজেলার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আমাদের এলাকায় ২ লাখ ৪০ হাজার লিটার ধারণক্ষমতার একটি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা স্থাপন করেছে ব্র্যাক, যা বাংলাদেশের ভূপৃষ্ঠের ওপরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের সবচেয়ে বড় স্থাপনা। ভাবতে ভালো লাগে যে এর মাধ্যমে প্রায় এক হাজার মানুষের জন্য নিরাপদ খাওয়ার পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়েছে।’
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় বাড়বে, যার প্রভাব পড়বে পানির উৎসসমূহের ওপর। উপকূলের পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা আরও বাড়বে। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে, বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থার মতো পরীক্ষিত অভিযোজন পদ্ধতিই শুষ্ক মৌসুমের জন্য সবচেয়ে উপযোগী ও কার্যকর উপায়।
২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘হিমবাহ সংরক্ষণ’। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে, ফলে পৃথিবীর হিমবাহগুলো আগের চেয়ে দ্রুত গলছে। আমাদের অবশ্যই ভবিষ্যতের জন্য পানিসম্পদ সংরক্ষণে একসঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। মানুষ ও পৃথিবীর কল্যাণে হিমবাহের গলিত পানিসহ প্রকৃতির দান বৃষ্টির পানি আরও টেকসইভাবে সংরক্ষণ করা আবশ্যক।
মো. লিয়াকত আলী পিএইচডি, পরিচালক, জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি, নগর উন্নয়ন কর্মসূচি ও দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি, ব্র্যাক