ইসলামে ধর্মান্তরিত হলেই বন্দীরা হয়ে যান ‘সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী’, বেড়ে যায় কারাদণ্ড
Published: 22nd, March 2025 GMT
রক্ত হিম করা ঠান্ডার মধ্যে ২০২৩ সালের নভেম্বরে যখন সাইবেরিয়ার কারাগারে পাঠানো হয়, তখন রুটি ও জাউ ছাড়া নরিমান ঝেলইয়ালের খাওয়ার মতো কিছু ছিল না।
চশমা পরা, শ্মশ্রুমণ্ডিত ক্রিমীয় তাতার সম্প্রদায়ের এই নেতা একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। তিনি বলেন, কারাগারে তাঁকে যেসব খাবার দেওয়া হতো, সেসবের বেশির ভাগ ছিল শূকরের মাংসের তৈরি। কিন্তু ইসলামি আইনে এটি নিষিদ্ধ।
ঝেলইয়াল আল–জাজিরাকে বলেন, ‘আমি শুধু রুটি খেতাম, তা ভালো মানের ছিল না। এ রুটি চায়ে ভিজিয়ে খেতাম।’ প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের লাইন উড়িয়ে দেওয়া ও বিস্ফোরক চোরাচালানের অভিযোগে তাঁকে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেন বলেছে, এটা মস্কোর পরিকল্পিত ঘটনা।
ঝেলইয়াল তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
কয়েক দিন পর ঝেলইয়ালকে সাইবেরিয়ার কারাগার থেকে মিনুসিনস্ক শহরে স্থানান্তর করা হয়। এখানে এসে তুলনামূলক কিছুটা ভালো খাবার পান তিনি।
মিনুসিনস্কের কারাগারে সকালের নাশতা ছিল স্বাদহীন, মিষ্টি ছাড়া জাউ, রাতের খাবারে থাকত মাছ, দুপুরে শূকরের মাংস।
কিন্তু রাশিয়ার কুখ্যাত কারাব্যবস্থায় হাজার হাজার মুসলিম বন্দীর জন্য খাবারই শুধু বড় সমস্যা নয়, গত শতক ধরেই সোভিয়েত ও বর্তমান রাশিয়ার কারাগারগুলো এক অন্ধকার জগৎ হয়ে রয়েছে। এগুলো পরিচালিত হচ্ছে অলিখিত সব আইনে।
প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের লাইন উড়িয়ে দেওয়া ও বিস্ফোরক চোরাচালানের অভিযোগে ক্রিমীয় তাতার সম্প্রদায়ের নেতা নরিমান ঝেলইয়ালকে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেন বলেছে, এটা মস্কোর পরিকল্পিত ঘটনা।এসব কারাগারে ‘ক্রাউন্ড থিভস’ বা ‘দ্য ব্ল্যাক ক্যাস্ট’ নামে পরিচিত দুর্ধর্ষ অপরাধীদের শরীরে এখনো ট্যাটু দেখা যায়, কথাবার্তায় শোনা যায় অশ্লীল শব্দের ব্যবহার। তাঁরা নিজেরা একটি কঠোর ও নিষ্ঠুর আদেশশৃঙ্খল বজায় রেখে চলেন।
দুর্ধর্ষ এ অপরাধীরা যেসব কারাগার নিয়ন্ত্রণ করেন, সেসব ‘ব্ল্যাক প্রিজনস’ বলে পরিচিত। কারাগারগুলোতে কারা তত্ত্বাবধায়ক ও ‘ক্রাউন্ড থিভস’দের মধ্যে সংঘর্ষ, মাদক চোরাচালান, কার্ড গেম ও বড় ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটে।
তবে ‘রেড প্রিজনস’ কারাগারগুলোতে তত্ত্বাবধায়কেরা বেশ প্রভাবশালী। সেখানকার সাধারণ অপরাধীদের অভিযোগ, কারা তত্ত্বাবধায়কেরা এখানে এক অমানবিক পরিবেশ তৈরি করে রাখেন। এর মধ্যে বন্দীদের ওপর নির্যাতন, নির্জন কারাবাস, তাঁদের অপুষ্টিতে রাখা ও ধর্ষণের ঘটনাও ঘটে।
কিন্তু দুই দশক ধরে রাশিয়ার কারাগারগুলোতে দেখা যাচ্ছে আরেক শ্রেণির বাসিন্দাদের। তাঁরা হলেন মুসলিম। ‘সন্ত্রাসী কাজ’, ‘উগ্র কর্মকাণ্ড’ ও অন্যান্য অভিযোগ এনে কারাগারে ঢোকানো হচ্ছে তাঁদের।
রাশিয়ার ১৪ কোটি ৩০ লাখ অধিবাসীর প্রায় ১৫ শতাংশ মুসলিম। দেশটিতে জনসংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেলেও মুসলিম জনগোষ্ঠীর সদস্যসংখ্যা বাড়ছে।
রাশিয়ার মুফতি আলবির ক্রাগানভ গত নভেম্বরে জানান, কারাগারগুলোতেও মুসলিম বন্দীদের হার একই রকম। ২ লাখ ৬ হাজার বন্দীর মধ্যে মুসলিম ৩১ হাজার।
একজন দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি তাঁর ধর্ম ত্যাগ করে অর্থোডক্স খ্রিষ্টান কিংবা প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান মতাদর্শ গ্রহণ করলে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়। —আনা কারেতনিকোভা, রাশিয়ার ফেডারেল সার্ভিস ফর এক্সিকিউশন অব পানিশমেন্টের সাবেক বিশ্লেষকমস্কো ২০২২ সালে ইউক্রেনে আক্রমণ করার পর থেকে রাশিয়ার কারাগারের কয়েদির অর্ধেকের বেশি কমে গেছে। তবে ক্ষমার বিনিময়ে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশগ্রহণকারী বা তালিকাভুক্ত হওয়া মুসলিম বন্দীদের সংখ্যা অজানাই রয়েছে।
ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেই বেড়ে যায় বিপদবিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠী ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, রাশিয়ার যেসব বন্দী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাঁরা ‘সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী’র তালিকায় ঢুকে যান। কখনো কখনো ‘উগ্রপন্থা’র অভিযোগ এনে তাঁদের কারাদণ্ডের মেয়াদও বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
রাশিয়ার সংশোধনাগারগুলো পরিচালনার দায়িত্বে থাকা দেশটির প্রধান সংগঠন ‘ফেডারেল সার্ভিস ফর এক্সিকিউশন অব পানিশমেন্ট’–এর সাবেক বিশ্লেষক আনা কারেতনিকোভা। আল–জাজিরাকে তিনি বলেছেন, ‘একজন দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি তাঁর ধর্মবিশ্বাস ছেড়ে অর্থোডক্স খ্রিষ্টান কিংবা প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান মতাদর্শ গ্রহণ করলে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়।’
এই বিশ্লেষক আরও বলেন, যদি কেউ নিজ ধর্মবিশ্বাস বদলে ইসলামে দীক্ষিত হন, তবে তিনি এমন একজন হিসেবে তালিকাভুক্ত হবেন, যিনি ‘উগ্রপন্থা’য় ঝুঁকছেন বলে ধরা হয়। তাঁর কারা প্রশাসনকে সাজা দেওয়া হবে এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাঁর দিকে বিশেষ নজর দেবে। কারেতনিকোভা রাশিয়াভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন মেমোরিয়ালেও কাজ করেছেন।
দুই দশক ধরে রাশিয়ার কারাগারগুলোতে দেখা যাচ্ছে আরেক শ্রেণির বাসিন্দাদের। তাঁরা হলেন মুসলিম। ‘সন্ত্রাসী কাজ’, ‘উগ্র কর্মকাণ্ড’ ও অন্যান্য অভিযোগ এনে কারাগারে ঢোকানো হচ্ছে তাঁদের।মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, বিশেষ করে মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে রাশিয়ায় কাজ করতে যাওয়া মুসলিম অভিবাসীরা দেশটিতে ফৌজদারি বিচারের সম্মুখীন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছেন। কেননা, তাঁদের রুশ ভাষা, বিদ্যমান আইন ও স্থানীয় জীবনপ্রণালি সম্পর্কে জানাশোনা কম থাকে।
এই অভিবাসীদের কাউকে কাউকে জোর করে ইউক্রেন যুদ্ধে পাঠানো হয়েছে বলেও খবরে জানা যায়। অন্যরা দাবি করেছেন, ভিন্ন ব্যক্তিদের সংঘটিত অপরাধ নিজেদের কাঁধে চাপিয়ে রাশিয়ার পুলিশ ও কৌঁসুলিরা তাঁদের নিশানা বানাচ্ছেন।
আবদুল আজিজ রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর একজন নির্মাণকর্মী। আল–জাজিরাকে তিনি বলেন, ২০২২ সালে তাঁর ছোট ভাই আবদুল মুমিনকে ‘স্পাইস’ নামের এক সিনথেটিক মাদকে ফাঁসিয়ে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ।
আরও পড়ুনপুতিনের ‘ইসলামপ্রীতির’ কৌশলে আঘাত হানতেই কি মস্কোয় সন্ত্রাসী হামলা?২৫ মার্চ ২০২৪রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একটি গির্জা পরিদর্শনের সময় মস্কোয় সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে মোমবাতি জ্বালান.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক র গ রগ ল ত ইউক র ন ঝ লইয় ল অপর ধ ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
শেখ হাসিনার সন্ধান চেয়ে পাগলা মসজিদের দানবাক্সে চিঠি
কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদের দানসিন্দুকে ২৮ বস্তা টাকার পাশাপাশি প্রায় এক বস্তা চিঠি-চিরকুট পাওয়া গেছে। চিঠিতে কেউ প্রিয় মানুষের ভালোবাসা পেতে, কেউবা নিজের বিয়ের জন্য দোয়া চেয়েছেন। কেউ নিজের সন্তানের রোগমুক্তি কামনা করেছেন। কেউ আবার পছন্দের দল বা ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দেখতে চেয়ে পাগলা বাবার কাছে চিঠি লিখেছেন।
৪ মাস ১২ দিন পর আজ পাগলা মসজিদের ১১টি সিন্দুক খোলা হয়। সিন্দুকে মোট ২৮ বস্তা টাকা, এক বস্তা চিরকুট, বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালংকার ও বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া গেছে। দিনভর গণনার পর এবার রেকর্ড ৯ কোটি ১৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন দানবাক্স খোলা কমিটির আহ্বায়ক ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেসমিন আক্তার।
দানের পাশাপাশি মনোবাসনা পূরণে কেউ কেউ সিন্দুকে চিরকুট বা চিঠি ফেলে যান। মানুষের ধারণা, এখানে চিরকুটের মাধ্যমে কিছু চাইলে, সেটাও পাওয়া যাবে। গতবার চিঠির বিষয়টি গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় এবার বেনামি চিঠির পরিমাণ বেশি ছিল। কিছু চিঠিতে নাম থাকলেও ঠিকানা দেওয়া ছিল কম।
মো. ইমরান নামের এক তরুণ ভালোবাসার মানুষ রাবেয়াকে কাছে পেতে দানবাক্সে একটি চিরকুট রেখে গেছেন। চিঠিতে ইমরান লিখেছেন, ‘ইয়া পাগলা বাবা, আমাদের সালাম গ্রহণ করবেন। আমাদের আরজি কবুল করুন। আমাদের মনের বাসনা আপনি বোঝেন। ইমরান ভালোবাসে রাবেয়া আক্তারকে। রাবেয়ার পরিবার ইমরানকে বিয়ে দেওয়ার জন্য রাজি না। আপনি রাবেয়াকে এনে দেন।’
বেনামি একজন বিয়ের আকুতি জানিয়ে লিখেছেন, ‘আমি খুব অসহায়। আমার বিয়ে বারবার ভেঙে যাচ্ছে। আমার পরিবার আমাকে নিয়ে চিন্তিত। চারপাশের মানুষের কটুকথা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তুমি জানো আমি নির্দোষ ও নিরপরাধ। আমার বিয়েতে যদি কোনো বাধাবিপত্তি থাকলে তুমি সমাধান করে দাও...তুমি আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিও না।’
আরও পড়ুনপাগলা মসজিদের দানসিন্দুকে পাওয়া গেল রেকর্ড ৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা১ ঘণ্টা আগেবেনামি আরেকটি চিরকুটে একজন পাগলা বাবার কাছে শেখ হাসিনার সন্ধান চেয়ে জানতে চেয়েছেন, ‘পাগলা চাচা, শেখ হাসিনা কোথায়?’ আরেকজন ‘সাধারণ জনগণ’ নামে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে ক্ষমতায় দেখতে চেয়ে লিখেছেন, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই। আল্লাহ তুমি সহজ করে দাও।’
রেহানা সারোয়ার নামের একজন সন্তান কামনা করে চিঠি লিখেছেন। তিনি নাম-ঠিকানা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘আমার বিয়ে হয়েছে ১২ বছর চলতাছে। কিন্তু এখনো আমি কোনো সন্তানের মা হতে পারলাম না। অনেক ডাক্তার দেখাইছি, কিন্তু কোনো লাভ হয় নাই। আমি এমন কোনো দিন নাই, এমন কোনো রাত নাই, আমার আল্লাহর কাছে হাত তুলে কাঁদি নাই...আমাকে একটা নেক সন্তানের মা হওয়ার সুযোগ দেন।’
কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদের দানসিন্দুকে পাওয়া টাকা গণনার কাজ করছেন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীসহ অন্যরা