সময়ের অগ্রণী সাংবাদিক কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস
Published: 22nd, March 2025 GMT
দেশ বিভাগের মাধ্যমে ভারতের সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, এই সত্য কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস উপলব্ধি করেন। তিনি সাম্রাজ্যবাদী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ৬ জুন ‘পঙ্গু পাকিস্তান’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে লেখেন, ‘...বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী ও দেশি কায়েমী স্বার্থবাদীরা বাংলার মুসলমানকে ঝাড়েবংশে ধ্বংস করিতে যে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়াছিল, সেই ষড়যন্ত্র সাফল্যমণ্ডিত হইয়াছে।’
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, তিনি পূর্ব বাংলার মুসলমান জনগোষ্ঠীকে ধর্মীয় পরিচয়ের দৃষ্টিতে দেখতেন না, তিনি এই জনগোষ্ঠীকে একটি দরিদ্রপীড়িত, অধিকারবঞ্চিত শ্রেণি হিসেবে বিবেচনা করতেন। তাঁর চিন্তাচেতনা তৎকালীন মুসলিম লীগের উদার ও প্রগতিপন্থী রাজনৈতিক ভাবনার (আবুল হাশিম যার অন্যতম প্রবক্তা) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
১৯৫০ সালে তিনি সপরিবার ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগে সহকারী পরিচালকের চাকরি গ্রহণ করেন। তিনি সেই সময় দৈনিক সংবাদ-এর সঙ্গেও যুক্ত হন। দৈনিক সংবাদ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালের ১৭ মে। এটি শুরুতে দলনিরপেক্ষ পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই তা তৎকালীন শাসক দল মুসলিম লীগের মুখপত্রে পরিণত হয়। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের রাজনৈতিক অস্তিত্ব–সংকট শুরু হয়েছিল। সংবাদ হয়ে পড়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের সমর্থক পত্রিকা।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। সংবাদ কর্তৃপক্ষ পুলিশের এই গুলিবর্ষণের পক্ষে সম্পাদকীয় লিখতে আদেশ দিলে এর প্রতিবাদে কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস পত্রিকাটি থেকে ইস্তফা দেন।বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও সাহিত্য অঙ্গনে কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস একটি উল্লেখযোগ্য নাম। ১৯০৬ সালের ১১ নভেম্বর রংপুর শহরের মুন্সিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করে ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাঁর সাংবাদিকতায় রাজনৈতিক সচেতনতা, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ও মানবিক আদর্শ গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
গত শতাব্দীর ত্রিশ-চল্লিশ দশকে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক কৃষক, দৈনিক নবযুগ, সাপ্তাহিক মিল্লাত, দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় আর পঞ্চাশ-ষাট দশকে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইনসাফ, দৈনিক সংবাদ, পূর্বদেশ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস কাজ করেন। তিনি পরবর্তী সময়ে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ এবং অর্ধ–সাপ্তাহিক ধূমকেতু সম্পাদনা করেন।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকার অবয়বে এ দুটি পত্রিকা যথাক্রমে ১৯৫৪ ও ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয়। পরে তিনি সাপ্তাহিক যুগবাণী সম্পাদনা করেন। ১৯৫৭ সালে ইত্তেহাদ পত্রিকার মালিকানা ও নীতি পরিবর্তন হলে তিনি তাতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। আর ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করার পর অক্টোবর মাসে ধূমেকতু পত্রিকা প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়।
১৯৪৫ সালের ১৬ নভেম্বর প্রাদেশিক মুসলিম লীগের মুখপত্র হিসেবে সাপ্তাহিক মিল্লাত প্রকাশিত হয়। আবুল হাশিম ছিলেন পত্রিকার সম্পাদক। তবে কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস সম্পাদনার মূল দায়িত্বে ছিলেন এবং মিল্লাত-এর সম্পাদক হিসেবেই তিনি পরিচিতি লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৪৬ সালের ১ মার্চ থেকে কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মিল্লাত-এর বৈশিষ্ট্য ছিল আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৪৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ‘দাঙ্গার পর’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে তিনি লেখেন, ‘.
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ঢাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়। কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ভাষা শহীদদের মরদেহের ছবি তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
তিনি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ফটোগ্রাফার আমানুল হকের মাধ্যমে লুকিয়ে ছবি তোলার ব্যবস্থা করেন। পরে সেই ছবি ছাত্রদের প্রচারপত্রে ছাপা হয় এবং পুলিশের হাতে পড়ে বাজেয়াপ্ত হয়। এ ছাড়া ছবিটি আজাদ পত্রিকায় প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ মুহূর্তে তা ছাপা হয়নি। ১৯৭০ সালে বদরুদ্দীন উমরকে ফটোগ্রাফার আমানুল হক মরদেহের দুটি ছবি দেন, একটি শুধু মাথার অংশের, অন্যটি স্ট্রেচারে শোয়ানো অবস্থায়। এর মধ্যে প্রথম ছবিটি ১৯৫২ সালে ও পরে সাধারণভাবে প্রচারিত হয়েছিল।
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। সংবাদ কর্তৃপক্ষ পুলিশের এই গুলিবর্ষণের পক্ষে সম্পাদকীয় লিখতে আদেশ দিলে এর প্রতিবাদে কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস পত্রিকাটি থেকে ইস্তফা দেন।
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে অসাম্প্রদায়িকতা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিসের মানবিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনে তিনি সব সময়ই উন্নত চিন্তা ও উচ্চ চরিত্রের পরিচয় দিয়েছেন। দুই খণ্ডে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লেখনীতে রাজনৈতিক সচেতনতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত প্রবল। তিনি সময়ের চেয়ে অগ্রগামী একজন চিন্তক ছিলেন। তাঁর চিন্তাভাবনা আজও সমাজকে নতুনভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে প্রাসঙ্গিক হয়ে রয়েছে।
সামিও শীশ লেখক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ১৯৫২ স ল র র জন ত ক তৎক ল ন
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের প্রশিক্ষণ-কর্মসংস্থান কার্যক্রম শুরু
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১০ জনকে এই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে।
বুধবার দুপুর ১টায় রাজধানীর বাড্ডা সাঁতারকুল এলাকায় মাল্টিক্রাফট টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে এ কার্যক্রম শুরু হয়।
ইকুয়ালিএবল ও বিদেশ ফাউন্ডেশন ইউএসএ নামের দুটি সংগঠনের আর্থিক সহায়তায় অ্যাসোসিয়েশন ফর ইকোনমিক্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট অব বাংলাদেশ, মাল্টিক্রাফট টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার ও বাংলাদেশ ফিজিক্যাল থেরাপি অ্যাসোসিয়েশন এই কার্যক্রম শুরু করেছে।
আয়োজকরা জানান, এই প্রকল্পের মাধ্যমে আন্দোলনে আহতদের শারীরিক সক্ষমতা বিবেচনায় তাদের জন্য বিনামূল্যে কম্পিউটার প্রশিক্ষন, ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা, থাকা খাওয়ার পাশাপাশি ও প্রশিক্ষণ পরবর্তী তাদের কর্মসংস্থান পেতে সহায়তা দেওয়া হবে।
শুরুতে যে ১০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে তারা হলেন- পাবনার মিরাজুল ইসলাম, নেত্রকোনার আকাশ মিয়া, কিশোরগঞ্জের জুনায়েদ আহমেদ, টাঙ্গাইলের মানিক মিয়া, মাদারীপুরের নেসার উদ্দিন, বরিশালের আবির হোসেন, ঢাকার উত্তরার আশরাফউদ্দিন ইমন, ঢাকার মহাখালীর রানা মিয়া, বরিশালের হানিফ মিয়া ও সিলেটের জুবেল মিয়া। তাদের কেউ পা হারিয়েছেন, কেউ গুলি ও অন্যান্য আঘাতে মারাত্মক আহত হয়েছিলেন।
আহত ব্যক্তিদের মধ্যে নেসার উদ্দিন তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের সহযোগিতা করার জন্য সংগঠনগুলোকে ধন্যবাদ জানান এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
বিদেশ ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি শাহুদ আহমেদ বলেন, প্রাথমিকভাবে ১০ জনকে নিয়ে শুরু পাইলট প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে আরও প্রকল্প হাতে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
অনুষ্ঠানে জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্যসচিব এস এম সাইফ মুস্তাফিজ সরকারকেও এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান।
এ সময় আরও বক্তব্য রাখেন আসিয়াব প্রতিনিধি রিয়াজুল ইসলাম, সন্তান ও অভিভাবক ফোরামের কেন্দ্রীয় সমন্বয় ডা. শাকিল আরিফ চৌধুরি, বাংলাদেশ ফিজিক্যাল থেরাপি অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. ফরিদ উদ্দিন, সিনিয়র সহসভাপতি ডা. ইশরাত জাহান, প্রকল্প সমন্বয়ক ডা. দলিলুর রহমান, মাল্টিক্রাফট টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের প্রিন্সিপাল আব্দুল মান্নান প্রমুখ।