‘পানির মতো সহজ’ কথাটি বাংলাদেশে সুপেয় পানির ক্ষেত্রে খাটছে না। দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলসহ অর্ধেক এলাকায় গত কয়েক বছর মিলছে না নিরাপদ পানি। বছর পাঁচেক আগেও যেসব এলাকায় পানি ছিল সহজলভ্য, এখন সেখানেই তীব্র সংকট। শুধু বরেন্দ্র অঞ্চলেরই এক-তৃতীয়াংশের বেশি এলাকায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট। বরিশাল, পিরোজপুর, বরগুনার মতো অসংখ্য নদনদীবেষ্টিত এলাকায়ও পানির সংকট তীব্র। রাজবাড়ীর মতো পদ্মা তীরের জেলায় শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে যাচ্ছে পুকুর-খাল; পানি উঠছে না নলকূপে। হাওরেও একই সংকট।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষিতে ব্যাপকভাবে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়েছে। অপরিকল্পিতভাবে উত্তোলনের কারণে ক্রমাগত নামছে স্তর। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টি কমে গেছে। ফলে গ্রামের মানুষকেও এখন তৃষ্ণা মেটাতে টাকা খরচ করতে হচ্ছে। লাগামহীন ভূগর্ভস্থ পানি তোলা বন্ধ না হলে সামনে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে বলে আশঙ্কা পরিবেশবিদদের।
এ অবস্থায় আজ শনিবার দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পালন করবে বিশ্ব পানি দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য– ‘মাটির নিচের পানি অশেষ নয়, আপনার সন্তানের স্বার্থে পানি ব্যবহারে যত্নশীল হোন’। দিবসটি উপলক্ষে বেলা ১১টায় রাজধানীর পানি ভবনে আলোচনা সভায় বক্তৃতা করবেন পানিসম্পদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

অবৈধ সেচ পাম্পে সর্বনাশ
নোয়াখালীর উপকূলীয় সুবর্ণচর রবিশস্যের অন্যতম ভান্ডার। গত কয়েক বছরে রবিশস্য ছেড়ে বোরো ধান চাষ করছেন কৃষকরা। শুষ্ক মৌসুমে ধান আবাদই এখন সুবর্ণচরের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। খাল-বিল-ডোবায় ভরপুর মিঠাপানির রাজ্যে এখন হাহাকার। ধান চাষে ভূগর্ভের পানির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে বসতঘরের গভীর নলকূপে উঠছে না পানি। পরিকল্পনা ও অনুমোদন ছাড়াই চাষিরা ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ ফুট গভীর নলকূপ বসিয়ে সেচকাজে ব্যবহার করছেন। এর প্রভাবে উপজেলাজুড়ে পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, সারাদেশে ১০ লাখের বেশি অবৈধ সেচ পাম্প রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্য বলছে, সুবর্ণচরে চাষাবাদের জন্য ২৪৫টি গভীর নলকূপের (সেচ পাম্প) অনুমোদন রয়েছে। চাষিরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিন হাজারের বেশি সেচ পাম্প বসিয়েছেন। একটি গভীর নলকূপে ভূগর্ভ থেকে প্রতি ঘণ্টায় ১ হাজার ৮০০ কিউসেক পানি তোলা হয়।
নাটোরে সেচকাজে সচল প্রায় ৪০ হাজার গভীর-অগভীর নলকূপ, যার ৩৩ হাজারই অবৈধ। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পানি তোলায় নামছে স্তর।
জরিপ ছাড়াই বাণিজ্যিকভাবে গভীর-অগভীর নলকূপ স্থাপনের প্রতিযোগিতা চলছে নওগাঁর বরেন্দ্র মাঠগুলোতে। ভূগর্ভ থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনে দ্রুত নামছে স্তর। বরেন্দ্র জনপদে গত এক দশকে অন্তত ১৫ ফুট নেমেছে পানির স্তর।

নওগাঁয় প্রায় দুই লাখ হেক্টর জমি চাষাবাদে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ৪০ হাজার ৫০টি গভীর নলকূপ এবং পল্লী বিদ্যুতের প্রায় ৬৫ হাজার অগভীর নলকূপ ব্যবহৃত হচ্ছে।
পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা ওয়ারপোর জরিপে দেখা যায়, উত্তরের পাঁচ জেলার বিভিন্ন অংশ নিয়ে গঠিত বরেন্দ্রের ৪০ শতাংশ এলাকায় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বরেন্দ্রর ২১৪ ইউনিয়নের ৮৭টিতেই রয়েছে উচ্চ পানি সংকট। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের গবেষণায়ও বরেন্দ্র এলাকায় পানির গড় নিম্নস্তর নামতে দেখা গেছে। গবেষণা অনুযায়ী, বরেন্দ্র এলাকায় ১৯৯৪ সালে মাটির নিচে পানির গড় নিম্নস্তর ছিল ৩৫ ফুট। ২০০৪ সালে ৫১, ২০১৩ সালে ৬০ এবং ২০২১ সালে তা ৭০ ফুটে পৌঁছেছে। অবশ্য গত বছর কোনো কোনো এলাকায় প্রায় ২০০ ফুট নিচেও পানির স্তর পাওয়া যায়। ফলে অনেক স্থানেই সরকারের গভীর নলকূপ পানির নাগাল না পেয়ে হয়ে গেছে বিকল।

কৃষি গবেষক ড.

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অনেক এলাকায় আগে আমনের পাশাপাশি রবি ফসল চাষ হতো। সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে ব্যাপক হারে পানিনির্ভর বোরো চাষ হচ্ছে। এ চাষাবাদ পুরোটাই ভূগর্ভস্থ পানিনির্ভর। অন্যদিকে ৮০ ও ৯০ দশকের তুলনায় পরের দুই দশকে বরেন্দ্রর পানি সংকটে থাকা এলাকায় গড় বৃষ্টিপাত কমেছে ৪০০ মিলিমিটার। পানি উত্তোলন বেড়েছে। আবার বৃষ্টি কমে যাওয়ায় মাটির নিচে পানির পুনর্ভরণ হচ্ছে না। এ জন্য স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। এটি অব্যাহত থাকলে কোথাও কোথাও শিগগির পানিশূন্য অবস্থা তৈরি হবে।
তিনি প্রচুর গাছপালা লাগানো, নদীনালা, খালবিলের গভীরতার পাশাপাশি সংখ্যা বাড়ানোর পরামর্শ দেন। যেন বৃষ্টির পানি দীর্ঘদিন জমা থাকে ও কৃষিকাজে ব্যবহার করা যায়।
কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, ‘আমরা ধাপে ধাপে ভূগর্ভস্থ পানির নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছি। সুষম ফসল চাষ নিয়ে পরিকল্পনা করছি। ধান অধ্যুষিত এলাকায় ধান চাষ এবং রবি অধ্যুষিত এলাকায় হবে রবি ফসল।’

পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সব পানি সুপেয় নয়। আর্সেনিক, লবণাক্ততার পাশাপাশি অনেক এলাকায় সরবরাহ করা পানি বিশুদ্ধ করতে হচ্ছে। সমস্যাগুলো কীভাবে দ্রুত নিরসন করা যায়, সে বিষয়ে সরকার সচেষ্ট। আশা করছি, ধাপে ধাপে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।’

 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: এল ক য় প ন বর ন দ র ব যবহ র

এছাড়াও পড়ুন:

গাজায় ক্যানসার হাসপাতাল গুঁড়িয়ে দিল ইসরায়েল, আরও এলাকা দখলের নির্দেশ কাৎজের

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় গতকাল শুক্রবার তার্কিশ-প্যালেস্টাইন ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল ও সংলগ্ন একটি মেডিকেল বিদ্যালয় গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এটি গাজায় ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল ছিল।

বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ দেশটির সামরিক বাহিনীকে ‘গাজা উপত্যকায় আরও এলাকা দখল করে নেওয়ার’ নির্দেশ দিয়েছেন। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি হুমকি দেন, হামাস যদি বাকি জিম্মিদের মুক্ত না করে, তবে গাজার কিছু অংশ স্থায়ীভাবে দখল করে নেওয়া হবে।

হাসপাতালে হামলা নিয়ে ইসরায়েলি বাহিনী বলেছে, হাসপাতাল এলাকায় হামাসের সদস্যরা অবস্থান করছিলেন। তাই সেখানে হামলা চালানো হয়েছে।

এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজ অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে। আল-জাজিরাসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ওই ভিডিও প্রকাশ করেছে। আল-জাজিরার প্রতিবেদনের তথ্য, নেতজারিম করিডর সম্প্রসারণ করা এবং আরও বাফার জোর (সংঘাতের প্রভাব এড়াতে বিশেষ অঞ্চল) প্রতিষ্ঠায় হাসপাতালটিতে হামলা চালানো হয়েছে।

এ ছাড়া গতকাল ইসরায়েলি বাহিনী বুলডোজার চালিয়ে আরও আবাসিক ভবন আর কৃষিজমি ধ্বংস করেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে আল-জাজিরা।

আরও পড়ুনইসরায়েলে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে হাজারো মানুষের বিক্ষোভ২২ ঘণ্টা আগে

গাজার একমাত্র ক্যানসার হাসপাতালটিতে হামলার কথা নিশ্চিত করেছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। টাইমস অব ইসরায়েলের প্রতিবেদনে সামরিক বাহিনীর বরাতে বলা হয়েছে, হাসপাতাল ভবনটি এক বছরের বেশি সময় ধরে চিকিৎসার কাজে ব্যবহার হচ্ছিল না। সেখান থেকে হামাসের সদস্যরা কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন।

এ হাসপাতালে ইসরায়েলি হামলার ঘটনায় প্রাথমিকভাবে হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

বিবিসির খবরে গাজায় স্থল অভিযান অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, জীবিত ও মৃত সব জিম্মিকে ফিরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনী গাজায় ‘ক্রমবর্ধমান তীব্রতার সঙ্গে’ স্থল অভিযান চালিয়ে যাবে।

আরও পড়ুনগাজায় কেন আবার হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে ইসরায়েল ২১ মার্চ ২০২৫

ধারণা করা হচ্ছে, গাজায় জিম্মি থাকা ৫৯ জনের মধ্যে এখন ২৪ জন বেঁচে আছেন। যদিও যুদ্ধবিরতি চুক্তির দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর তাঁদের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

গত জানুয়ারিতে গাজায় হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছিল। গত সপ্তাহে নতুন করে গাজায় বোমা হামলা শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। শুরু করা হয় স্থল অভিযান। হামলা-অভিযানে শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হন। আর এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধবিরতি কার্যত ভেস্তে যায়।

ইসরায়েল কাৎজ আরও বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাব দেওয়া গাজার বাসিন্দাদের স্বেচ্ছায় অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে তাঁর দেশ।

আরও পড়ুনযুদ্ধেই জন্ম শিশুর, যুদ্ধেই শহীদ২০ মার্চ ২০২৫আরও পড়ুনইসরায়েলের ক্ষমতায় টিকে থাকতে গাজায় নতুন করে নৃশংসতা চালাচ্ছেন নেতানিয়াহু২০ মার্চ ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ