রাজধানীর গুলশানে বৃহস্পতিবার রাতে ইন্টারনেট ব্যবসায়ী সুমন মিয়া হত্যার পর আলোচনায় এসেছে একে-৪৭ নামের একটি গ্যাং। একসময় এই গ্রুপের নাম ছিল ‘সেভেন স্টার’। দলনেতা একে-৪৭সহ ধরা পড়ার পর থেকে এটি একে-৪৭ নামে পরিচিতি পায়। স্থানীয় বাসিন্দা ও গোয়েন্দা তথ্য বলছে, এ গ্রুপের নিয়ন্ত্রক টিবি গেট এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী রুবেল ও তার বোন জামাই সেন্টু। গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই বিরোধের জেরে একে-৪৭ গ্রুপের হাতে খুন হন সুমন। তিনিও ‘বন্ধু গ্যাং’ নামে একটি গ্রুপ চালাতেন। সেন্টু ওই এলাকায় ‘টিবি গেটের দুলাভাই’ ও ‘টিবি গেটের জামাই’ হিসেবে পরিচিতি। 

একসময় সুমনও একে-৪৭ গ্যাংয়ের হয়ে কাজ করতেন। সেখান থেকে বেরিয়ে পাঁচ-সাত বছর হয়েছে বন্ধু গ্যাং গড়ে তোলেন। এর পর থেকে দুই গ্রুপের ঝামেলা শুরু। মূলত এলাকায় চাঁদাবাজি, আধিপত্য ও ফুটপাত বাণিজ্য নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। ২০২০ সালে রোজায় একবার একে-৪৭ গ্রুপের টার্গেট হন সুমন। হামলার শিকার হলেও তখন ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান।
বৃহস্পতিবার রাতে গুলশান পুলিশ প্লাজার উত্তর পাশের সড়কে সুমন মিয়াকে (৩৫) গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ওই ঘটনায় তাঁর স্ত্রী মৌসুমী আক্তার গতকাল শুক্রবার গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেন। এজাহারে উল্লেখ করা হয়, সেভেন স্টার গ্রুপের রুবেল ও তার সহযোগীরা এর আগেও সুমনের ইন্টারনেটের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং মারধরও করে। ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবসার দ্বন্দ্বের জেরেই সুমনকে হত্যা করা হয়েছে।

মৌসুমী বলেন, মহাখালীর টিবি গেট এলাকায় ‘প্রিয়জন’ ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবসা রয়েছে সুমনের। ২০২০ সালে রুবেলের সহযোগী জামাল, সেন্টু ও আফজাল মারধর করে সুমনের ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ওই ঘটনার পর তৎকালীন গুলশান থানার ওসিকে অনুরোধ করে পুলিশের হস্তক্ষেপে সংযোগ আবার চালু করা হয়। সম্প্রতি আবার ইন্টারনেট সংযোগ নিয়ে ঝামেলা শুরু করে রুবেল গ্রুপ। এতে টিবি হাসপাতাল এলাকার বাসা ছেড়ে দিয়ে ছেলেমেয়েকে নিয়ে ভাসানটেকে ভাড়া বাসায় ওঠেন তারা। তার পরও স্বামীকে বাঁচাতে পারেননি।
গত ৫ আগস্ট তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চাপে পড়েন বন্ধু গ্যাংয়ের বস সুমন মিয়া। এর দু’দিন পর মহাখালী টিবি গেট এলাকায় ডিস ও ফলের দোকান ভাঙচুর করে একে-৪৭ গ্রুপের সদস্যরা। এর পর এলাকা ছেড়ে তারা মিরপুর ভাসানটেকে ভাড়া বাসায় থাকতেন। কিন্তু এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই গ্রুপের রেষারেষি থামেনি। সুমনের নিয়ন্ত্রণে বন্ধু গ্রুপের সদস্য তাঁর শ্যালক বাদশা ওরফে রুবেল, মনিরুল, নুর আলম অনি, আমিনুল ইসলাম কালুসহ ১০-১২ জন। ঘটনার সময় তাঁর সঙ্গেই ছিলেন সহযোগী অনি। 

তবে ঘটনার পর থেকে তিনি নিরুদ্দেশ। সেই অনির খোঁজ করছেন গোয়েন্দারা।
এদিকে একে-৪৭ গ্রুপের বস রুবেল। তার সহযোগী বোন জামাই সেন্টু, আফজাল, বিন্দু, শ্যামল, করিম ও জাহিদ। দীর্ঘদিন এলাকায় থাকে না রুবেল। কিন্তু গ্রুপের সদস্যদের দিয়ে চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে টেন্ডার তার নিয়ন্ত্রণে। স্থানীয় এক ব্যবসায়ী জানান, কয়েক বছর আগে একে-৪৭ অস্ত্রসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন রুবেল। এর পর থেকে তাকে এলাকায় ‘একে-৪৭ রুবেল’ বলেই চেনে সবাই। তিনি সেভেন স্টার গ্রুপের হয়ে এলাকায় ত্রাস হয়ে ওঠেন। ওই গ্রুপের হয়ে কাজ করার সময় রুবেল অস্ত্রসহ আটক হন।
আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘ছোট থেকেই রুবেল, সুমন, সেন্টুসহ বাকিদের টিবি কলোনিতে বড় হতে দেখেছি। তাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এখানেই। কিন্তু এরা হাসপাতালকে কেন্দ্র করে ইন্টারনেট ব্যবসা, টেন্ডার ও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে। গত ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সেন্টুকে অস্ত্রসহ ধরিয়ে দেয় সুমন। দু-তিন দিন আগে সেন্টু জামিনে বেরিয়ে এলাকায় আসে। তার পরই এ হত্যাকাণ্ড। এতে তো বোঝা যায় সুমনের হত্যার পেছনে কারা দায়ী। আমরা এলাকায় শান্তিতে ব্যবসা করতে চাই। কারও রোষানলে পড়তে চাই না।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) মর্গে নিহত সুমনের শ্বশুর মোহাম্মদ আক্তার শেখ আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার আল্লাহ কীভাবে দুই সন্তান রেখে সুমনকে নিয়ে যেতে পারলেন। তার ছেলে-মেয়ে অনেক ছোট। মেয়ে তো বাবার মৃত্যুর বিষয়টি বোঝাও শেখেনি। আর ছেলে বাবার অসুস্থতার কথা শুনে নামাজে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন নাতির সামনে কীভাবে সুমনের লাশ নিয়ে যাব? কী জবাব তাকে দেব?’ তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসী রুবেল এলাকার সব নিয়ন্ত্রণ করছে। তার হাতে হাসপাতালের সব টেন্ডার জমা পড়ে। থানা পুলিশ তার কেনা। এর আগে দুলাভাই সেন্টুকে অস্ত্রসহ পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিল সুমন। তার পর থেকে একে-৪৭ গ্রুপের সদস্যরা তার ওপর ক্ষিপ্ত। রুবেল বাহিনী কয়েকবার সুমনকে মারধর করে। তারা সম্প্রতি সুমনকে হত্যার হুমকি দেয়।’ 
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বন্ধু গ্যাংয়ের এক সদস্য বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে সুমনকে হত্যা করা হলো। ২৪ ঘণ্টা পার না হওয়ার আগেই তার দোকান সরিয়ে নিতে কমিশনারের ছেলে নয়ন ও রতন হুমকি দিয়েছে। নিহতের শ্যালক বাদশা বলেন, ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ। টিবি গেটে একটি জানাজা শেষে রংপুরের মিঠামইনের গ্রামের বাড়িতে তাঁর লাশ দাফন করা হবে।
ডিএমপির মুখপাত্র উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, সুমনের স্ত্রী বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয়দের নামে হত্যা মামলা করেছেন। এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের বিষয়ে কাজ চলছে।

গ্রামের বাড়িতে নির্বাক মা
মিঠাপুকুর (রংপুর) প্রতিনিধি জানান, রংপুরের মিঠাপুকুরে সুমনের গ্রামের বাড়িতে চলছে কান্না। প্রতিবেশী ও স্বজনরা তাঁর নিহত হওয়ার খবরে হতবাক। শুক্রবার বিকেলে উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের শালাইপুর ডোবার পাড়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সুমনের মা  ঘরের বারান্দায় নির্বাক বসে আছেন। বোন ও প্রতিবেশীরা মরদেহ ঢাকা থেকে কখন আসবে– সে অপেক্ষায় আছেন। 
সুমনের মা বলেন, ‘আর কয়েকদিন পর মোর ছইলটা বাড়িত আসিলো হয়। ফোন করি কইল, এবার সবাকে নিয়া বাড়িত ঈদ করিম। মোর বাবা আইসোছে; কিন্তু লাশ হয়ে। এই ভার কী করি সহ্য করিম।’
প্রতিবেশী রহিম মিয়া জানান, সুমনের বাবার নাম মাহফুজার রহমান। সুমন দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড়। নানাবাড়ি ঢাকায়। তাই ছোট থেকে নানাবাড়িতে থাকত। বিয়ে করেছে ঢাকাতেই। ইয়াস (১০) এবং সুমাইয়া (৭) নামে তাঁর ছেলে-মেয়ে রয়েছে।

 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: হত য গ র প র সদস য ৪৭ গ র প র র পর থ ক ব যবস য় এল ক য় স মন র এল ক র স মনক সহয গ

এছাড়াও পড়ুন:

ঘুমানোর আগে রিলস দেখা কতটা ক্ষতিকর?

সামাজিক মাধ্যমে বড় ভিডিও দেখার চেয়ে এখন অনেকেই ছোট ছোট রিলস দেখে বিনোদন খোঁজেন। কারও কারও ক্ষেত্রে রিলস দেখা রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সারাদিন তো বটেই,অনেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা রিলস দেখেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘুমোনোর আগে টানা রিলস দেখা শুধু মানসিক স্বাস্থ্যের উপরই নয়, প্রভাব ফেলে শারীরিক স্বাস্থ্যের উপরও। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাতে ঘুমানোর আগে একটানা রিলস দেখলে হাইপারটেনশনের ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়া অন্যান্য সমস্যা দেখা দেয়। যেমন-


হাইপারটেনশনের ঝুঁকি

সম্প্রতি চীনের এক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বয়সের ৪ হাজার ৩১৮ জনের উপর একটি গবেষণা করা হয়। ঘুমোতে যাওয়ার আগে রিলস্ দেখার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের কোনও সম্পর্ক আছে কি না-তা জানাই ছিল এই গবেষণার লক্ষ্য। ওই গবেষণায় রিলস দেখার সঙ্গে হাইপারটেনশনের ঝুঁকির যোগসূত্র খুঁজে পান গবেষকরা। বিশেষ করে তরুণ এবং মধ্যবয়সীদের মধ্যে এই ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

মানসিক চাপ

গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত রিলস দেখা মনের উপর চাপ ফেলে। পাশাপাশি এর প্রভাবে চিন্তার অভ্যাস কমে যাওয়া, সৃজনশীল চর্চার পরিধি এবং স্থায়ীত্বেরও ব্যাঘাত ঘটে চলেছে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে রিলস দেখার পরিণাম আরও ভয়াবহ।

রিলস দেখার ফলাফল

যেকোন ধরনের স্ক্রিনের দিকে একটানা তাকিয়ে থাকা কারও জন্যই ভালো নয়। এর ফলে শরীর যেটুকু নড়াচড়া করে, সে সবের কোনও অবকাশই থাকে না। ঘুমাতে যাওয়ার আগে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে অনেকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা রিলস দেখলে শরীর আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। ফলে রক্ত চলাচলও স্তিমিত হয়ে পড়ে। এর ফলে শরীরে হাইপারটেনশনের মতো সমস্যা দানা বাঁধে। আবার এই ভাবে দীর্ঘক্ষণ রিলস দেখার সময় শরীরের সিম্পেথেটিক নার্ভাস সিস্টেম আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে ভিডিও দেখার সময় হৃৎস্পন্দন তুলনামূলক বেড়ে যায়। নিয়মিত একই কাজ করলে এর প্রভাব হতে পারে ভয়াবহ।

প্রতিকার

প্রতিকার হিসেবে গবেষকদের পরামর্শ, যতই রিলস দেখুন না কেন, তাতে আসক্ত হওয়া যাবে না। ঘুমাতে যাওয়ার আগে স্ক্রিন টাইম ঠিক করে নিন। প্রয়োজনে স্মার্ট ফোন দূরে রেখে ঘুমাতে যান। এতে ঘুম ভালো হবে, আবার শরীরও পর্যাপ্ত বিশ্রাম পাবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ