Samakal:
2025-03-22@03:09:15 GMT

অমূল্য স্মারক

Published: 21st, March 2025 GMT

অমূল্য স্মারক

একটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং গৌরবের সাক্ষ্য বহন করে সেই দেশের জাদুঘর। জাদুঘরে গেলে শিকড়ের সন্ধান মেলে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তেমনি এক জাদুঘর, সেখানে বাংলাদেশ ভূখণ্ড এবং রাষ্ট্রের গৌরবময় ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী নানা স্মারক, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের ব্যবহৃত সামগ্রী, অস্ত্র, দলিল, চিঠিপত্র, আলোকচিত্রসহ বিভিন্ন জিনিস সংরক্ষিত আছে। ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গমন মানে বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে হেঁটে চলার মতো। জাদুঘর গ্যালারির প্রবেশ পথে আপনি শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাংলার ‘মাৎস্যন্যায়’ সময়কাল যেমন দেখবেন, তেমনি পাল কিংবা সেন বংশের উত্থান-পতনও দেখবেন। মোগল রাজত্বকাল, ব্রিটিশ বিদ্রোহ এবং পরিশেষে বিশাল ক্যানভাসে দেখতে পারবেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। যেখানে ছবি, আলোকচিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে।
সেগুনবাগিচার একটি পুরোনো আমলের ভবন ভাড়া নিয়ে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রারম্ভিক কাজকর্ম। আটজন ট্রাস্টির উদ্যোগে ইতিহাসের স্মারক সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও উপস্থাপনের প্রয়াস চলতে থাকে। সাধারণ মানুষের কাছে আহ্বান জানানো হয় মুক্তিযুদ্ধের কোনো উপাদান সংগ্রহে থাকলে তা জাদুঘরে প্রদান করার জন্য। সবার অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতায় ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ যাত্রা শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের। শুরু থেকে ব্যাপক মানুষের সমর্থন ও সহায়তায় ধন্য হয়েছে জাদুঘর। সেগুনবাগিচার পুরোনো বাড়ি থেকে জাদুঘর স্থানান্তরিত হয়েছে আগারগাঁওয়ের আড়াই বিঘার বিশাল চত্বরে। আধুনিক গ্যালারিসহ পুরাকীর্তি সংরক্ষণের সার্বিক ব্যবস্থা রয়েছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষের। বর্তমানে জাদুঘরের সংগ্রহে জমা আছে ১৫ হাজারেরও বেশি স্মারক। চার বছর বয়সী নির্যাতিত শিশুর ফ্রগ থেকে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহার হওয়া অস্ত্র–সবকিছু আছে এখানে। 
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক জানান, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বস্তুর দুর্লভ সংগ্রহশালা আমাদের জাদুঘর। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের গ্যালারিগুলো মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও ইতিহাস রূপে সাজানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইতিহাসের স্মারক সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে যথাযথভাবে উপস্থাপন। এর বিশেষ লক্ষ্য নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার ইতিহাস বিষয়ে সচেতন করে তোলা, যার ফলে তারা মাতৃভূমির জন্য গর্ব ও দেশাত্মবোধে উদ্দীপ্ত হবে এবং উদার অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হবে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে যেমন সরকারের সাহায্য রয়েছে, তেমনি আছে জনগণের সাহায্য। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সর্বসাধারণের। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে ধারণ করে চলবে জাদুঘরটি।
প্রায় ২১ হাজার বর্গফুট আয়তনের চারটি গ্যালারিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী নানা স্মারক রয়েছে। বিভিন্ন গ্যালারি ভিন্ন ভিন্ন নাম এবং থিম অনুযায়ী সজ্জিত আছে।
‘আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সংগ্রাম’ নামের গ্যালারিতে সংগৃহীত আছে প্রাচীন বঙ্গের মানচিত্র, পোড়ামাটির শিল্প, টেরাকোটা, নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন, ব্রিটিশ আমল ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপট এবং সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের নানা স্মারক।
‘আমাদের যুদ্ধ, আমাদের মিত্র’ নামের গ্যালারিতে যুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জীবনযাত্রা, বিদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের প্রিন্ট, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, রাজাকারদের তৎপরতা, মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধের আশ্রয়স্থল এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সহায়তাকারী দেশে-বিদেশের বিভিন্ন নিদর্শন রয়েছে।  
‘আমাদের অধিকার, আমাদের ত্যাগ’ নামের গ্যালারিতে আছে ৭ মার্চের ভাষণের বিশাল আলোকচিত্র, ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হামলার নানা নিদর্শন।
সর্বশেষ ‘আমাদের জয়, আমাদের মূল্যবোধ’ নামের গ্যালারিতে আছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় লগ্নের ঘটনা এবং বিভিন্ন সনদ।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গ্যালারিতে কর্মরত ‘লিসা’ এবং ‘দ্বীপ’ নামে দু’জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, 
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ৯ তলা ভবনে আরও আছে আর্কাইভ, ল্যাবরেটরি, প্রদর্শন কক্ষ, লাইব্রেরি, অফিস এবং মিলনায়তন। প্রায় আড়াই বিঘা জমির ওপর নির্মিত এই ভবনের ব্যবহারযোগ্য আয়তনের পরিমাণ ১ লাখ ৮৫ হাজার বর্গফুট। মুজিবনগর সরকার গঠন, কুষ্টিয়ার ৪ এপ্রিল যুদ্ধের গণহত্যার বর্বরতা, বাঙালি শরণার্থী হিসেবে ভারতে যাত্রা, সেখানে আশ্রয়, জীবনযাপনের ঘটনাবলি, বাঙালির প্রতিরোধ গড়ে তোলার নিদর্শন রয়েছে বিভিন্ন গ্যালারিতে। মোট সংগ্রহের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রদর্শনী করা হয় এবং বাকি সংগ্রহ সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে জাদুঘর আর্কাইভে। তবে যে কোনো গবেষক চাইলে সব সংগ্রহ দেখতে পারেন এবং গবেষণা করতে পারেন। জাদুঘরের ৯ তলা ভবনের ভূগর্ভে রয়েছে তিনটি তলা। ওপরের ছয়টি তলায় অফিস মিলনায়তন, পাঠাগার, গবেষণাকেন্দ্র, ক্যান্টিন ও প্রদর্শনী কক্ষ। শিখা অনির্বাণ রয়েছে প্রথম তলায়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ এবং চর্চার লক্ষ্যে জাদুঘরের রয়েছে নানা আয়োজন এবং পদক্ষেপ। ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর, বজলুর রহমান স্মৃতি পদক, জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ, আউটরিচ কর্মসূচি ও গণহত্যাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন।
কর্তৃপক্ষের কর্মসূচির আওতায় দারুণ বিষয় হলো– ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর এবং আউটরিচ কর্মসূচি। ভ্রাম্যমাণ জাদুঘরের আওতায় বাসের ভেতরে প্রদর্শনী সাজিয়ে পরিণত করা হয়েছে খুদে জাদুঘরে। বাসটি জেলা-উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রদর্শনীর আয়োজন করে থাকে। ২০০১ সাল থেকে ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর বাসটি বিভিন্ন জেলায় যেতে শুরু করেছে এবং আউটরিচের আওতায় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব গাড়িতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের জাদুঘরে এনে প্রদর্শনী দেখানোসহ নানা আয়োজন করে। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিরপুরে মুসলিম বাজার ও জল্লাদখানা বধ্যভূমি খননের কাজ সম্পন্ন করে এবং পরে ২০০৮ সালে বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিপীঠ নির্মাণ করে কর্তৃপক্ষ। আন্তর্জাতিকমানের সম্মেলনসহ বিভিন্ন দিবসে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে আয়োজিত হয় নানা অনুষ্ঠান।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অর্থায়নে সরকার এবং জনগণের অংশগ্রহণ রয়েছে। তবে দর্শনার্থীদের জন্য প্রবেশ মূল্য ৫০ টাকা, ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী হলে ২০ টাকা, সার্কববহির্ভূত দেশের জন্য ৫০০ টাকা। সপ্তাহের প্রতি রোববার বাদে জাদুঘরটি গ্রীষ্মকালে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এবং শীতকালীন সকাল ১০টা থেকে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। 
রাজধানীর যে কোনো প্রান্ত থেকে বাস বা নিজস্ব পরিবহনে জাদুঘরে আসতে পারবেন। জাদুঘরে এক পাশে শ্যামলী শিশুমেলা, শিশু হাসপাতাল এবং অন্যদিকে আছে আগারগাঁও মেট্রোস্টেশন। স্টেশনে নেমে হেঁটেও আসতে পারেন।  
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বাংলাদেশের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। আমাদের গৌরবের ইতিহাস জানতে এবং জানাতে সপরিবারে আসতে পারেন এখানে। ইতিহাস চর্চার উত্থান-পতন চলবে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কালের সাক্ষী হয়ে সত্য-মিথ্যার বিভেদ চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে যাবে অনন্তকাল।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: জ দ ঘর ম ক ত য দ ধ জ দ ঘর র আম দ র র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

অমূল্য স্মারক

একটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং গৌরবের সাক্ষ্য বহন করে সেই দেশের জাদুঘর। জাদুঘরে গেলে শিকড়ের সন্ধান মেলে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তেমনি এক জাদুঘর, সেখানে বাংলাদেশ ভূখণ্ড এবং রাষ্ট্রের গৌরবময় ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী নানা স্মারক, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের ব্যবহৃত সামগ্রী, অস্ত্র, দলিল, চিঠিপত্র, আলোকচিত্রসহ বিভিন্ন জিনিস সংরক্ষিত আছে। ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গমন মানে বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে হেঁটে চলার মতো। জাদুঘর গ্যালারির প্রবেশ পথে আপনি শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাংলার ‘মাৎস্যন্যায়’ সময়কাল যেমন দেখবেন, তেমনি পাল কিংবা সেন বংশের উত্থান-পতনও দেখবেন। মোগল রাজত্বকাল, ব্রিটিশ বিদ্রোহ এবং পরিশেষে বিশাল ক্যানভাসে দেখতে পারবেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। যেখানে ছবি, আলোকচিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে।
সেগুনবাগিচার একটি পুরোনো আমলের ভবন ভাড়া নিয়ে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রারম্ভিক কাজকর্ম। আটজন ট্রাস্টির উদ্যোগে ইতিহাসের স্মারক সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও উপস্থাপনের প্রয়াস চলতে থাকে। সাধারণ মানুষের কাছে আহ্বান জানানো হয় মুক্তিযুদ্ধের কোনো উপাদান সংগ্রহে থাকলে তা জাদুঘরে প্রদান করার জন্য। সবার অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতায় ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ যাত্রা শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের। শুরু থেকে ব্যাপক মানুষের সমর্থন ও সহায়তায় ধন্য হয়েছে জাদুঘর। সেগুনবাগিচার পুরোনো বাড়ি থেকে জাদুঘর স্থানান্তরিত হয়েছে আগারগাঁওয়ের আড়াই বিঘার বিশাল চত্বরে। আধুনিক গ্যালারিসহ পুরাকীর্তি সংরক্ষণের সার্বিক ব্যবস্থা রয়েছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষের। বর্তমানে জাদুঘরের সংগ্রহে জমা আছে ১৫ হাজারেরও বেশি স্মারক। চার বছর বয়সী নির্যাতিত শিশুর ফ্রগ থেকে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহার হওয়া অস্ত্র–সবকিছু আছে এখানে। 
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক জানান, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বস্তুর দুর্লভ সংগ্রহশালা আমাদের জাদুঘর। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের গ্যালারিগুলো মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও ইতিহাস রূপে সাজানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইতিহাসের স্মারক সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে যথাযথভাবে উপস্থাপন। এর বিশেষ লক্ষ্য নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার ইতিহাস বিষয়ে সচেতন করে তোলা, যার ফলে তারা মাতৃভূমির জন্য গর্ব ও দেশাত্মবোধে উদ্দীপ্ত হবে এবং উদার অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হবে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে যেমন সরকারের সাহায্য রয়েছে, তেমনি আছে জনগণের সাহায্য। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সর্বসাধারণের। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে ধারণ করে চলবে জাদুঘরটি।
প্রায় ২১ হাজার বর্গফুট আয়তনের চারটি গ্যালারিতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী নানা স্মারক রয়েছে। বিভিন্ন গ্যালারি ভিন্ন ভিন্ন নাম এবং থিম অনুযায়ী সজ্জিত আছে।
‘আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সংগ্রাম’ নামের গ্যালারিতে সংগৃহীত আছে প্রাচীন বঙ্গের মানচিত্র, পোড়ামাটির শিল্প, টেরাকোটা, নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন, ব্রিটিশ আমল ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপট এবং সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের নানা স্মারক।
‘আমাদের যুদ্ধ, আমাদের মিত্র’ নামের গ্যালারিতে যুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জীবনযাত্রা, বিদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের প্রিন্ট, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, রাজাকারদের তৎপরতা, মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধের আশ্রয়স্থল এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সহায়তাকারী দেশে-বিদেশের বিভিন্ন নিদর্শন রয়েছে।  
‘আমাদের অধিকার, আমাদের ত্যাগ’ নামের গ্যালারিতে আছে ৭ মার্চের ভাষণের বিশাল আলোকচিত্র, ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত হামলার নানা নিদর্শন।
সর্বশেষ ‘আমাদের জয়, আমাদের মূল্যবোধ’ নামের গ্যালারিতে আছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় লগ্নের ঘটনা এবং বিভিন্ন সনদ।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গ্যালারিতে কর্মরত ‘লিসা’ এবং ‘দ্বীপ’ নামে দু’জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, 
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ৯ তলা ভবনে আরও আছে আর্কাইভ, ল্যাবরেটরি, প্রদর্শন কক্ষ, লাইব্রেরি, অফিস এবং মিলনায়তন। প্রায় আড়াই বিঘা জমির ওপর নির্মিত এই ভবনের ব্যবহারযোগ্য আয়তনের পরিমাণ ১ লাখ ৮৫ হাজার বর্গফুট। মুজিবনগর সরকার গঠন, কুষ্টিয়ার ৪ এপ্রিল যুদ্ধের গণহত্যার বর্বরতা, বাঙালি শরণার্থী হিসেবে ভারতে যাত্রা, সেখানে আশ্রয়, জীবনযাপনের ঘটনাবলি, বাঙালির প্রতিরোধ গড়ে তোলার নিদর্শন রয়েছে বিভিন্ন গ্যালারিতে। মোট সংগ্রহের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রদর্শনী করা হয় এবং বাকি সংগ্রহ সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে জাদুঘর আর্কাইভে। তবে যে কোনো গবেষক চাইলে সব সংগ্রহ দেখতে পারেন এবং গবেষণা করতে পারেন। জাদুঘরের ৯ তলা ভবনের ভূগর্ভে রয়েছে তিনটি তলা। ওপরের ছয়টি তলায় অফিস মিলনায়তন, পাঠাগার, গবেষণাকেন্দ্র, ক্যান্টিন ও প্রদর্শনী কক্ষ। শিখা অনির্বাণ রয়েছে প্রথম তলায়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ এবং চর্চার লক্ষ্যে জাদুঘরের রয়েছে নানা আয়োজন এবং পদক্ষেপ। ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর, বজলুর রহমান স্মৃতি পদক, জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ, আউটরিচ কর্মসূচি ও গণহত্যাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন।
কর্তৃপক্ষের কর্মসূচির আওতায় দারুণ বিষয় হলো– ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর এবং আউটরিচ কর্মসূচি। ভ্রাম্যমাণ জাদুঘরের আওতায় বাসের ভেতরে প্রদর্শনী সাজিয়ে পরিণত করা হয়েছে খুদে জাদুঘরে। বাসটি জেলা-উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রদর্শনীর আয়োজন করে থাকে। ২০০১ সাল থেকে ভ্রাম্যমাণ জাদুঘর বাসটি বিভিন্ন জেলায় যেতে শুরু করেছে এবং আউটরিচের আওতায় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব গাড়িতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের জাদুঘরে এনে প্রদর্শনী দেখানোসহ নানা আয়োজন করে। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিরপুরে মুসলিম বাজার ও জল্লাদখানা বধ্যভূমি খননের কাজ সম্পন্ন করে এবং পরে ২০০৮ সালে বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিপীঠ নির্মাণ করে কর্তৃপক্ষ। আন্তর্জাতিকমানের সম্মেলনসহ বিভিন্ন দিবসে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে আয়োজিত হয় নানা অনুষ্ঠান।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অর্থায়নে সরকার এবং জনগণের অংশগ্রহণ রয়েছে। তবে দর্শনার্থীদের জন্য প্রবেশ মূল্য ৫০ টাকা, ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী হলে ২০ টাকা, সার্কববহির্ভূত দেশের জন্য ৫০০ টাকা। সপ্তাহের প্রতি রোববার বাদে জাদুঘরটি গ্রীষ্মকালে প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এবং শীতকালীন সকাল ১০টা থেকে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। 
রাজধানীর যে কোনো প্রান্ত থেকে বাস বা নিজস্ব পরিবহনে জাদুঘরে আসতে পারবেন। জাদুঘরে এক পাশে শ্যামলী শিশুমেলা, শিশু হাসপাতাল এবং অন্যদিকে আছে আগারগাঁও মেট্রোস্টেশন। স্টেশনে নেমে হেঁটেও আসতে পারেন।  
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বাংলাদেশের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। আমাদের গৌরবের ইতিহাস জানতে এবং জানাতে সপরিবারে আসতে পারেন এখানে। ইতিহাস চর্চার উত্থান-পতন চলবে, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কালের সাক্ষী হয়ে সত্য-মিথ্যার বিভেদ চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে যাবে অনন্তকাল।

সম্পর্কিত নিবন্ধ