মার্কিন-চীন এআই প্রতিযোগিতা এবং বাংলাদেশের ঝুঁকি
Published: 21st, March 2025 GMT
বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান দুই শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এক অবিশ্বাস্য প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতার মুখোমুখি। বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি নিয়ে তাদের সৃষ্ট প্রতিযোগিতা পৃথিবীকে একটি নতুন দিগন্তে নিয়ে যেতে পারে। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বৈশ্বিক প্রভাব বজায় রাখতে চায়; অন্যদিকে চীন বর্তমান বিশ্ব শাসন ব্যবস্থা ভেঙে নতুন পৃথিবী তৈরি করতে চায়। তাই প্রযুক্তির এই সর্বাধুনিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিযোগিতা শুধু প্রযুক্তিগত বা অর্থনৈতিক লড়াইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি বৈশ্বিক রাজনীতির ভারসাম্যেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষত বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই প্রতিযোগিতার মধ্যে ঝুঁকি ও সম্ভাবনার সমন্বয় ঘটছে। তবে এটি নির্ভর করে বাংলাদেশ কীভাবে এই প্রতিযোগিতাকে নিজের উপকারে ব্যবহার এবং কীভাবে সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি প্রতিরোধ করতে পারবে, তার ওপর।
গত ২০ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের পর চীন যখন নজর কাড়ার মতো এক ঘটনা ঘটায়, তখন তা শুধু মার্কিন অর্থনীতির জন্য শঙ্কা তৈরি করেনি; বরং বৈশ্বিক প্রযুক্তি ভারসাম্যে এক নতুন অস্থিরতা সৃষ্টি করে। রিপোর্ট অনুযায়ী, চীনের তৈরি উন্মুক্ত ভাষা মডেল ডিপসিক সক্ষমতায় মার্কিন চ্যাটজিপিটি৪-এর তুলনায় অগ্রসর এবং কম খরচে তৈরি, যা যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার নাসডাকে ৩.
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এমন একটি প্রযুক্তি, যা বিশ্বব্যাপী প্রতিটি খাতে বিপ্লব ঘটানোর ক্ষমতা রাখে এবং এ ক্ষেত্রে যে দেশ প্রথম অবস্থানে থাকবে, তার অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রভাব দীর্ঘকাল স্থায়ী হতে পারে। ২০১৮ সাল থেকে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলতে থাকা বাণিজ্য যুদ্ধ শুধু অর্থনৈতিক না, বরং এটি প্রযুক্তিগত যুদ্ধেও রূপ নেয়। চীন তার প্রযুক্তি খাতকে উৎসাহিত করতে বিনিয়োগ করেছে। যেমন আলিবাবা, টেনসেন্ট ও বাইদুর মতো চীনা কোম্পানি বিশ্বব্যাপী মার্কিন প্রযুক্তির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্রও এই চীনা প্রযুক্তি বৃদ্ধির প্রতি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছে এবং চীনা কোম্পানিগুলোর ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য মার্কিন-চীন এআই প্রতিযোগিতা নানাবিধ ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বাংলাদেশের দুটি প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার। এই দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার সংকুচিত হতে পারে। আর দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষি, তৈরি পোশাক শিল্প ও রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল। এআই প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে অনেক ঐতিহ্যবাহী চাকরি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা তৈরি করতে পারে। তৃতীয়ত, মার্কিন-চীন প্রতিযোগিতার ফলে বাংলাদেশকে কৌশলগতভাবে সতর্ক থাকতে হবে। এ দুই পরাশক্তির মধ্যে উত্তেজনা বাড়লে বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যে কোনো এক দেশের পক্ষ নেওয়া বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। চতুর্থত, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়েই বাংলাদেশে তাদের প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা-বিষয়ক প্রভাব বিস্তার করতে চায়, যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
এটি কিছু সম্ভাবনাও তৈরি করে। প্রথমত, বাংলাদেশ এআই প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পারে। এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশ কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও শিল্প খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করতে পারে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ এআই প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে নতুন নতুন শিল্প ও কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে। তৃতীয়ত, মার্কিন-চীন প্রতিযোগিতার ফলে বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে সুবিধা আদায় করতে পারে। এ দুই পরাশক্তির মধ্যে প্রতিযোগিতার ফলে বাংলাদেশ উভয় পক্ষের কাছ থেকে সহযোগিতা ও বিনিয়োগ পেতে পারে।
মার্কিন-চীন এআই প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, বাংলাদেশকে এআই প্রযুক্তির উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, এআই প্রযুক্তির উন্নয়নে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। তৃতীয়ত, বাংলাদেশকে এআই প্রযুক্তির উন্নয়নে নীতি ও কৌশল প্রণয়ন করতে হবে।
বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন এই প্রতিযোগিতার ঝুঁকি মোকাবিলা করা এবং সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো। এ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পারে, যদি সঠিক কৌশল ও নীতি গ্রহণ করা হয়।
ড. সুজিত কুমার দত্ত: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ল দ শ র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
ইউক্রেনে সুমি শহরে রাশিয়ার হামলায় নিহত ৩৪, ‘ভয়াবহ ঘটনা’ বললেন ট্রাম্প
ইউক্রেনের সুমি শহরে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ৩৪ জন নিহত এবং ১১৭ জন আহত হওয়ার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে কিয়েভের পশ্চিমা মিত্ররা। রাশিয়ার প্রাণঘাতী এই হামলার সমালোচনা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও।
সোমবার (১৪ এপ্রিল) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রবিবার মধ্যরাতে সুমি শহরের কেন্দ্রস্থলে দুটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে, যা স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং কংগ্রেস সেন্টারের কাছে বিস্ফোরিত হয়। রক্তাক্ত মৃতদেহ রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে।
আরো পড়ুন:
রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ভারতীয় ওষুধ কোম্পানির গুদাম ধ্বংস
পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের দূতের ৪ ঘণ্টা বৈঠক
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই হামলাকে ‘ভয়াবহ ঘটনা’ বলে বর্ণনা করেছেন, অন্যদিকে জার্মানির সম্ভাব্য চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্জ রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ করেছেন।
রাশিয়ার পক্ষ থেকে এই হামলার বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য পাওয়া যায়নি। রুশ বাহিনী কাছাকাছি সীমান্তের ওপারে একটি বড় হামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
এই হামলাটি এমন এক সময় ঘটল, যখন ইউক্রেনের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ট্রাম্পের নেতৃত্বে আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটাতে চাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের চতুর্থ বছর চলছে।
ট্রাম্প ওয়াশিংটনে ফিরে যাওয়ার সময় এয়ার ফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকরা রাশিয়ার হামলা সম্পর্কে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি মনে করি, এটি ভয়াবহ ঘটনা এবং আমাকে বলা হয়েছে যে তারা ভুল করেছে।” কিন্তু ট্রাম্প এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলেননি।
রোববার জেলেনস্কি রাশিয়ার আক্রমণের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসযজ্ঞ আরো ভালোভাবে বোঝার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টকে তার দেশ সফর করার আহ্বান জানিয়েছেন।
ইউক্রেনীয় নেতা মার্কিন টেলিভিশন সিবিএসে সম্প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “দয়া করে, যেকোনো ধরনের আলোচনার আগে, যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সামরিক ও বেসামরিক মানুষের ওপর রাশিয়ার হত্যাযজ্ঞ এবং হাসপাতাল ও গির্জায় ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে আসুন।”
ফ্রিডরিখ মের্জ, যিনি আগামী মাসে জার্মানির নতুন চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি জার্মানির সরকারি টেলিভিশন এআরডিকে বলেছেন, ইউক্রেনের সুমি শহরে রাশিয়া যে ধরণের হামলা চালিয়েছে তা একটি ‘গুরুতর যুদ্ধাপরাধ’।
জার্মানির বিদায়ী চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজ বলেছেন, এই হামলাটি ‘শান্তির জন্য রাশিয়ার কথিত প্রস্তুতির আসল রূপ উন্মোচন করেছে’।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ রাশিয়াকে ‘মানবজীবন, আন্তর্জাতিক আইন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার প্রতি স্পষ্ট অবজ্ঞা’ করার জন্য অভিযুক্ত করেছেন।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট বলেন, “রাশিয়াকে যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। ফ্রান্স তার অংশীদারদের সঙ্গে এই লক্ষ্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে।”
আক্রমণটিকে ‘বর্বর’ বলে বর্ণনা করে ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি উরসুলা ভন ডের লেইন বলেছেন, “আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন করে রাশিয়া আগ্রাসী ছিল এবং এখনও আছে।”
তিনি বলেন, “যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। হামলা বন্ধ না হওয়া এবং ইউক্রেনের শর্তাবলী অনুসারে ন্যায়সঙ্গত ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত ইউরোপ অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখবে এবং রাশিয়ার ওপর শক্তিশালী চাপ বজায় রাখবে।”
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ক্ষেপণাস্ত্র হামলার খবর পেয়ে জাতিসংঘ প্রধান ‘গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং হতবাক’।
তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীনে বেসামরিক নাগরিক এবং বেসামরিক বস্তুর ওপর আক্রমণ নিষিদ্ধ।” তিনি আরো বলেন, “এই ধরনের যেকোনো আক্রমণ, যেখানেই ঘটুক না কেন, অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।”
রবিবারের জোড়া ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ছিল চলতি বছরে ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সবচেয়ে মারাত্মক আক্রমণ।
চলতি মাসের শুরুতে ৪ এপ্রিল ইউক্রেনের ক্রিভি রিহ শহরে আরেকটি রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ২০ জন নিহত এবং ৬১ জন আহত হন। সেসময় রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছিল যে, তারা একটি রেস্তোরাঁয় ‘ইউনিট কমান্ডার এবং পশ্চিমা প্রশিক্ষকদের’ একটি সভা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে।
তবে এর স্বপক্ষে রাশিয়া কোনো প্রমাণ সরবরাহ করেনি ।
ঢাকা/ফিরোজ