ব্যবসায়ী ও চিত্রনায়ক স্বামী অনন্ত জলিলের প্রযোজিত ছবি ছাড়া অন্য কারও ছবিতে অভিনয়ে দেখা যায়নি চিত্রনায়িকা বর্ষাকে। হাতে রয়েছে তাঁর কয়েকটি ছবি। এই চিত্রনায়িকা দুই সন্তানের মা। এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে বর্ষা জানিয়েছেন, তিনি নায়িকাজীবন থেকে সরে যাবেন, পরিবারকে সময় দেবেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার স্বামী অনন্ত জলিলের সঙ্গে এক সংবাদ সম্মেলনে এসে গণমাধ্যমের সামনে অভিনয় থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন বর্ষা। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘হাতে কয়েকটি ছবি আছে, এগুলো শেষ করতে করতেই বেশ সময় চলে যাবে। এরপর আমি আর নতুন কোনো ছবি করব না।’

অনন্ত জলিল ও বর্ষা.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

ঢাকার ফুটপাতে চাঁদাবাজি সচল, কুশীলব বদল

গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর শূন্যের ঘরে নেমে এসেছিল রাজধানীর ফুটপাতের চাঁদাবাজি। সুসময় টেকেনি বেশি দিন। আবারও চাঁদাবাজরা ফিরেছে পুরোনো চেহারায়। আগের চেয়ে বরং ফুটপাত-রাজপথে বেড়েছে হকার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেড়েছে চাঁদার অঙ্ক। কোথাও কোথাও এসেছে নতুন চাঁদাবাজ।

অনেক এলাকায় আওয়ামী লীগের বদলে চাঁদাবাজের তালিকায় উঠেছে বিএনপি নেতাকর্মীর নাম। চাঁদাবাজির হোতা হিসেবে রাজধানীর দুয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর নামও সামনে আসছে। কোনো এলাকায় বদল হয়েছে লাইনম্যানের। তবে পুলিশের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ আগের চেয়ে অনেকটাই কম।

রাজধানীর ফুটপাত হকারমুক্ত করতে অতীতে কম চেষ্টা হয়নি। ২০১৬ সালের অক্টোবরে গুলিস্তানকে হকারমুক্ত করার অভিযানে নেমে নিজেই বিপাকে পড়েছিলেন ঢাকা দক্ষিণের তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকন। তখন হকাররা উল্টো নগর ভবন ঘিরে হামলা চালান। এর পরই গতি হারায় হকার উচ্ছেদ কার্যক্রম। পরে ব্যারিস্টার তাপস মেয়র হলে রাস্তায় হকার ঠেকাতে লাল-হলুদ-সবুজ রঙে মার্কিং করে দেন। সেটাও কাজে দেয়নি। সর্বশেষ গণঅভ্যুত্থানের পর যৌথ বাহিনী কয়েক দিন ফুটপাত থেকে অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করলেও এখন আবার রকমারি পণ্যের পসরা নিয়ে বসেছেন হকাররা।  

কত হকার কত চাঁদা
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) ২০১৬ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দুই সিটি করপোরেশনের ৪৩০ কিলোমিটার রাস্তায় ৩ লাখেরও বেশি হকার ব্যবসা করেন। বছরে চাঁদাবাজি হয় প্রায় ১ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার। এসব হকার প্রতিদিন ৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে বাধ্য হন। ২০২০ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রত্যেক হকারকে প্রতিদিন গড়ে ১৯২ টাকা করে চাঁদা গুনতে হয়।

ইমনের ইশারায় চলে নিউমার্কেট
রাজধানীর আজিমপুর, ইডেন কলেজ, নীলক্ষেত, গাউছিয়া, নিউমার্কেট, সায়েন্স ল্যাব, এলিফ্যান্ট রোড, কাঁটাবনসহ আশপাশের এলাকার ফুটপাতের প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার দোকানের নিয়ন্ত্রণ এখন শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের হাতে। ৫ আগস্টের পর ইমন কারাগার থেকে বের হয়ে আড়ালে থেকে সবকিছু দেখভাল করছেন। এসব এলাকার কয়েকটি মার্কেটে নিজের লোকও বসিয়েছে এই সন্ত্রাসী। পুরোনো দোকানি উঠিয়ে নতুন দোকান বসাতে ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ইমনের বিরুদ্ধে। আগে এসব এলাকায় ১৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা ইব্রাহিম ইবু, নুর ইসলাম, সাত্তার মোল্লা, মনির, সৈয়দুর চৈয়্যা, কালা সিরাজ চাঁদা ওঠানোর দায়িত্বে ছিল।

৫ আগস্টের পর তাদের নিয়ন্ত্রকরা পালিয়ে গেলে আগের লাইনম্যানরাই রাজনৈতিক খোলস পাল্টে দায়িত্ব পালন করছে। সায়েন্স ল্যাব, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট ও এলিফ্যান্ট রোডের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন নিউমার্কেট থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক কে এম চঞ্চল। এ ছাড়া কফি হাউসের গলি ও বাটা সিগন্যাল এলাকাও তাঁর নিয়ন্ত্রণে। নিউমার্কেট থানা যুবদল সভাপতি নিজাম বেপারি সায়েন্স ল্যাব ও এলিফ্যান্ট রোড এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেন। ঢাকা কলেজের সামনের ফুটপাত কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাগর, তারেক জামিল ও পারভেজের কবজায়। এ ছাড়া নীলক্ষেতের বই মার্কেট থেকে কাঁটাবনের গাউসুল আজম মার্কেটের সামনে পর্যন্ত জাহাঙ্গীর পাটোয়ারি নামে একজনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে তাদের অধিকাংশই নেতাই ইমনের হয়ে কাজ করছেন। 

ফুটপাতের ফল ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন সমকালকে বলেন, ‘ইমনের ভয় দেখিয়ে প্রথমে দোকানের জন্য আমার কাছে ৩ লাখ টাকা দাবি করা হয়। টাকা দিতে না পারায় আমাকে উঠিয়ে দিয়ে সেখানে নতুন দোকান বসানো হয়েছে।’ 

নীলক্ষেত মোড়ে কাপড়ের দোকানি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আগে আওয়ামী লীগের লোকদের চাঁদা দিতে হতো। এখন বিএনপির লোকদের চাঁদা দিতে হয়।’ কত টাকা দিতে হয় জানতে চাইলে তিনি জানান, তাকে মাসে ২ হাজার টাকা দিতে হয়। অন্যান্য দোকানিকেও ২ থেকে ৩ হাজার টাকা দিতে হয়।
অভিযোগের বিষয়ে নিউমার্কেট থানা যুবদল সভাপতি নিজাম বেপারি বলেন, ‘নিউমার্কেট থানার ওসিসহ আমরা প্রতিটি দোকানে গিয়ে বলেছি, কেউ চাঁদাবাজি করতে এলে ধরিয়ে দিতে।’

যুবদল ও ছাত্রদল নেতা কে এম চঞ্চল, সাগর, তারেক জামিল ও পারভেজের সঙ্গে অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করে সমকাল। তবে তাদের সবার ফোন নম্বর বন্ধ থাকায় কথা বলা যায়নি। 

গুলিস্তানে বিএনপি নেতা
গোলাপ শাহ মাজারের সামনে থেকে ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত লাইনম্যান ছিলেন যুবলীগের হান্নান। এখন নিয়ন্ত্রণ করছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ২০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান। বঙ্গবাজার থেকে সিটি প্লাজা হয়ে গোলাপ শাহ মাজার পর্যন্ত তাঁর কবজায়। নতুন দোকান তুলে ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। আহাদ পুলিশ ফাঁড়ির সামনে ‘লম্বা হারুন’ নামে একজন হকারের কাছ থেকে টাকা তোলেন। কাপ্তানবাজার কমপ্লেক্সের পশ্চিম-উত্তর ফুটপাতে  চাঁদা ওঠান সাবেক কাউন্সিলর আবুল বাশারের অনুসারী কাপ্তানবাজার ইউনিট বিএনপির সভাপতি নুর ইসলাম। সুন্দরবন মার্কেটের সামনে চাঁদা তোলেন মনির। বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে টাকা তোলেন ছিন্নমূল হকার্স লীগের সভাপতি হারুনুর রশিদ, খলিল, পোটন ও জিয়া। পূর্বগেটে স্থানীয় বিএনপি নেতা নবী।

পল্টন মোড়ের দু’পাশে হকার্স ইউনিয়নের সভাপতি কবির আর দৈনিক বাংলা মোড়ে তোলেন কালা নুরা। স্বর্ণ মার্কেটের সামনে জিয়া ও আক্তার চাঁদা তোলেন। গুলিস্তানে জাসদ অফিসের সামনে ফুটপাতের হকার নিয়ন্ত্রক হিসেবে হকার সংগ্রাম পরিষদের কামাল সিদ্দিকী ও ওয়ার্কার্স পার্টির ঢাকা মহানগরীর সভাপতি আবুল হোসাইনের নামও উঠে এসেছে। আগে ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ আওয়ামী লীগের অফিসের সামনের ফুটপাতে দোকান বসত না। ৫ আগস্টের পর জায়গাটিও হকারের দখলে। এখান থেকে চাঁদা তোলেন ইউনিট বিএনপির সভাপতি সেলিম। পূর্বানী হোটেলের সামনের ফুটপাতে ৫ আগস্টের পর থেকে সময় অনুযায়ী তিন বেলা তিনটি গ্রুপ চাঁদা তোলে। সেখানকার নিয়ন্ত্রক স্থানীয় বিএনপি নেতা খোরশেদ ও সেলিম। খদ্দের মার্কেটের সামনের ফুটপাত কাদের ও আলী মিয়ার হাতে। ওয়ার্কার্স পার্টির ঢাকা মহানগরীর সভাপতি আবুল হোসাইন সমকালকে বলেন, ‘এখানে সম্ভবত কোনো ভুল হচ্ছে। আমি আর ওই ব্যক্তি এক না।’

ফুটপাতে চাঁদাবাজির ব্যাপারে ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের ২০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান সমকালকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমার শত্রুরা কুৎসা রটাচ্ছে।’

অভিযুক্ত অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি সমকাল।

ফার্মগেট সুইডেন আসলামের
ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হল থেকে তেজগাঁও কলেজ পর্যন্ত প্রায় তিন থেকে চার হাজার হকার প্রতিদিন বসে। আগে শুধু ফুটপাতে দোকান থাকলেও এখন মূল সড়কেও দু’সারিতে বসেছে দোকান। ফার্মগেটে আগে ডিএনসিসির ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ইরান এ এলাকার চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রক ছিলেন। তাঁর হয়ে ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি নজরুল ও শাহা আলম দৈনিক ২০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত টাকা ওঠাতো। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে এই নিয়ন্ত্রণ এখন সাবেক কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সমন্বয়ক আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার আর শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলামের হাতে।

৫ আগস্টের পর কারাগার থেকে বেরিয়ে ফার্মগেটের মাহবুব প্লাজা, সেজান পয়েন্টসহ আশপাশের মার্কেট দখলে নেন এ সুইডেন আসলাম ওরফে বড় মিয়া। ফার্মগেটের ইরানের আধিপত্য এখন সুইডেনের হাতে। তবে তাঁর বিরুদ্ধে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চান না। ফুটপাত, টেম্পুস্ট্যান্ড ও রিকশা গ্যারেজের থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ কাউন্সিলর আনোয়ারের নেতাকর্মী এবং সুইডেন বাহিনীর দিকে। তাদের হয়ে আশপাশের মার্কেট, স্ট্যান্ড ও ফুটপাতে চাঁদাবাজিতে নেতৃত্ব দেন কিলার মাসুদ, সজীব খান, ইলিয়াস ও রাজ মিয়া। এ ছাড়া তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদলের নাম করে কয়েকজন সড়কের ওপরের দোকান থেকে চাঁদা ওঠায়। হকার কমিটির সভাপতি আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। কাপড় দোকানি তামিম বলেন, ‘আমি নতুন দোকান দিয়েছি। আব্দুল্লাহ ভাই দোকান বসানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।’

এ ব্যাপারে আব্দুল্লাহ বলেন, ‘অভ্যুত্থানের পর আমরা ডিএমপি কমিশনারের কাছ থেকে এই এলাকার ফুটপাতে দোকান বসানোর একটা নকশা নিয়ে আসি। কথা ছিল এখানে শুধু পুরোনো ব্যবসায়ী আর দরিদ্র লোকজন দোকান করবে। তবে সুইডেন আসলাম ও বিএনপির লোকজনের কারণে সেটা সম্ভব হয়নি।’ এ ব্যাপারে আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার বলেন, ‘দখল ও ফুটপাতের বাণিজ্যের সঙ্গে আমি জড়িত নই। আমাকে ফাঁসানোর জন্য কুৎসা রটাচ্ছে প্রতিপক্ষ। আমার কোনো নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায়, ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ অভিযোগের বিষয়ে চেষ্টা করেও সুইডেন আসলামের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি সমকাল।

ফেন্সি নাসিরের মতিঝিল
মতিঝিল ব্যাংকপাড়ার ফুটপাত শীর্ষ সন্ত্রাসী নাসির উদ্দিন ওরফে ফেন্সি নাসিরের কবজায়। ২০২৩ সালে এ সন্ত্রাসী দেশে ফেরার পর থেকেই মতিঝিল ব্যাংকপাড়ার ফুটপাতের চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নেন। গণঅভ্যুত্থানের পর শুধু লাইনম্যানের বদল হয়েছে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে থেকে আরামবাগ হয়ে পীর জঙ্গি মাজার পর্যন্ত ফুটপাত থেকে দোকান ভেদে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলেন সোহেল ও রতন। তাদের দু’জনকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন শ্রমিক দল নেতা সবুজ। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ওয়াসার পানির পাম্প পর্যন্ত দুই সারিতে ৫ শতাধিক দোকানের ১০০ থেকে ২০০ টাকা হারে প্রতিদিন চাঁদা তোলেন হকার্স লীগের সভাপতি হারুন ও আসিফের লোকজন। রূপালী ব্যাংক থেকে বঙ্গভবন পর্যন্ত সহস্রাধিক মাছ, মাংস আর সবজির দোকান থেকে টাকা তোলেন তাইজুল ইসলাম তাজু ও তাঁর ছেলে বাবলু। আগে নিজেদের আওয়ামী লীগ পরিচয় দিলেও এখন বিএনপি কর্মী পরিচয় দেন। পূবালী ব্যাংক থেকে বক চত্বর পর্যন্ত লাইনম্যানের দায়িত্বে নুরুল ইসলাম, মান্নান ও জুয়েল। শাপলা চত্বর থেকে সোনালী ব্যাংক-জনতা ব্যাংক-ইত্তেফাক মোড় পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার দোকানের চাঁদা তোলেন মকবুল।

পূবালী ব্যাংকের সামনের ফুটপাতের কাপড়ের দোকানদার পলাশ বলেন, ‘এখন ফুটপাতে দোকান দিতে অনেক কড়াকড়ি। লাইনম্যান নাই, আমরাই সব। পুলিশকেও ম্যানেজ করতে হয়। ডিএমপি কমিশনারের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোস্তাফিজের মাধ্যমে ফুটপাতে দোকান বসানোর অনুমতি নিয়েছি।’

তবে ডিএমপি কমিশনারের স্টাফ অফিসার জুয়েল ইমরান বলেন, ‘এই নামে ডিএমপি কমিশনারের অফিসে কেউ নেই। আর যে অভিযোগ, সেটাও সত্য নয়।’
তবে পাশের কয়েকজন কাপড় দোকানি বলেন, ‘মতিঝিলের ফুটপাতে নাসির ভাই সব। মাঝখানে শুধু লাইনম্যান বদল হয়েছে। তাঁর লোকজন প্রতি সপ্তাহে এসে টাকা তোলে। শাপলা চত্বরের আশপাশে হারুন, আসিফ, তাইজুলরা টাকা তোলে। তবে টাকার ভাগ পান নাসির।’

মতিঝিল ব্যাংকপাড়ায় তিন দিন ঘুরেও সন্ত্রাসী ফেন্সি নাসিরকে পাওয়া যায়নি। তাঁর মোবাইল ফোন নম্বরেও যোগাযোগ করতে পারেনি সমকাল।

মিরপুরে সমবায় সমিতির নামে চাঁদাবাজি
রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় হকার বহুমুখী সমবায় সমিতির নামে প্রতিদিন ৫০ থেকে ৫০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। হকারের একটি সমিতির বইও দেওয়া হয়েছে ৫ আগস্টের পর। সেখানে দেখা যায়, বইয়ে ঠিকানা হিসেবে সেনপাড়ার শতাব্দী টাওয়ার উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কোনো হোল্ডিং নম্বর নেই, একটি ফোন নম্বর দেওয়া আছে। হকারের অভিযোগ, বিএনপি নেতা তারেক, বাদশাসহ আরও কয়েকজন লাইনম্যানের মাধ্যমে এই চাঁদা তোলা হয়। তারেক সমকালের কাছে দাবি করেন, তিনি চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। এগুলো হকাররা মিথ্যা কথা বলছে। এ ছাড়া মিরপুর ১ নম্বর ফুটপাত থেকে কবির, হান্নান, হানিফ, খলিল, স্টেডিয়াম থেকে শাহ আলিম প্রতিদিন সহস্রাধিক দোকান থেকে ১০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলেন। গাবতলী টার্মিনালের ভেতর-বাইরের ফুটপাতের নিয়ন্ত্রক আক্তার।

সদরঘাটের সাম্রাজ্য ফিরোজের
সদরঘাট থেকে রায়সাহেব বাজার মোড় আর ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে সোহরাওয়ার্দী কলেজ পর্যন্ত সবজি, ফাস্টফুড, জামা-কাপড়, জুতাসহ নিত্যপণ্যের প্রায় তিন হাজার দোকান আছে। এসব দোকান থেকে সর্বনিম্ন ২০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা ওঠে। লাইনম্যান ফিরোজ আগে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের আশ্রয়ে থাকলেও গণঅভ্যুত্থানের পর এখন স্থানীয় বিএনপি ও কলেজ ছাত্রদল নেতাদের প্রশ্রয়ে চাঁদাবাজি করেন। লক্ষ্মীবাজারে ফুটপাতে সবজির দোকানি রিপন মিয়া বলেন, ‘ভাবছিলাম অভ্যুত্থানের পর ফুটপাতে চাঁদাবাজি বন্ধ হবে। এখনও ফিরোজ মিয়ার লোকজন প্রতিদিন টাকা তোলে।’ তবে সমকালকে ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘আমি এখন আর টাকা তুলি না। এখন কে তোলে সেটাও জানি না।’ 

মোহাম্মদপুরের ফুটপাত পিচ্চি হেলালের কবজায়
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালের হাতে মোহাম্মদপুরের ফুটপাত। মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ আর আদাবরে পিচ্চি হেলালের হয়ে চাঁদাবাজি করেন শফিক, টাউন হলের সামনে আলাউদ্দিন, বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ডের সামনে হাবীব, কলেজ গেটে হাসেম, লালমাটিয়ায় আনোয়ার ও দুলাল ফুটপাত থেকে চাঁদার টাকা তোলেন। প্রতিদিন চাঁদার পরিমাণ ১০০ থেকে হাজার টাকা।

এ ছাড়া শেরেবাংলা নগরে হাসপাতালপাড়া থেকে চাঁদা তুলতে লাইনম্যানের কাজ করেন আব্দুস সাত্তার, রফিক ও হাসেম।  মহাখালী কাঁচাবাজারে ছিন্নমূল হকার্স লীগের কেন্দ্রীয় নেতা হাসেম চাঁদা তোলেন। আর কাঁচাবাজারের দক্ষিণ থেকে যক্ষ্মা হাসপাতাল পর্যন্ত সড়কের দু’পাশ থেকে আব্দুল হোসাইন, জুয়েল, আক্তার ও মনির চাঁদা তোলেন। যাত্রাবাড়ী থেকে পোস্তগোলা সেতু পর্যন্ত ২ হাজার দোকানে টাকা তোলেন সোহরাব আলী আর সোনা মিয়া। জুরাইন থেকে যাত্রাবাড়ী কাঁচাবাজার পর্যন্ত চাঁদা তোলেন ফারুক। 

কারা কী বলছেন
বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের সভাপতি এম এ কাশেম সমকালকে বলেন, ‘ফুটপাত মানেই টাকার খেলা। যেখানেই হকার, সেখানেই আছে লাইনম্যান-চাঁদাবাজ। আর লাইনম্যানদের অধিকাংশই পুলিশের সোর্স। গণঅভ্যুত্থানের পরও এই ধারা পাল্টাইনি। লাইনম্যান আগের জনই আছেন, শুধু রাজনৈতিক শক্তির বদল হয়েছে।’
বাংলাদেশ হকার্স ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুল হাসিম কবির সমকালকে বলেন, ‘অভ্যুত্থানের পরও ফুটপাতে যে যার মতো করে নতুন দোকান বসাচ্ছে। আগের চেয়েও দোকানের সংখ্যা বেড়েছে। আর এতে লাখ লাখ টাকা বাণিজ্য করছে আরেকটা পক্ষ।’

এসব বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা কাইজার মোহাম্মদ ফারাবি সমকালকে বলেন, ‘আমাদের দু’জন ম্যাজিস্ট্রেট নিয়মিতই অন্যান্য অভিযানের সঙ্গে ফুটপাত হকারমুক্ত করছে।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ সমকালকে বলেন, ‘ফুটপাতের দোকানের এখন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যে যার মতো করে দোকান বসাচ্ছে। আগে পুলিশের সঙ্গে মিলেমিশে চাঁদাবাজি করলেও এখন পুলিশও ভাগ পায় না। আমরা সড়ক, ফুটপাত দখলমুক্ত করছি। কিন্তু পুলিশের তেমন সহযোগিতা না পেলে কার্যকর করা যাচ্ছে না। ঈদের পর জোরদার অভিযান চালানো হবে।’

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘ফুটপাতে একদিকে উচ্ছেদ করলে তারা আরেকদিকে দোকান বসায়। এ ক্ষেত্রে ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদে পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সবার সমন্বয় প্রয়োজন। ফুটপাতে চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। করপোরেশন পুলিশের সহযোগিতা পাচ্ছে না, বিষয়টি ঠিক নয়। আমরা চাই, সড়ক পরিষ্কার রাখতে ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ হোক।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ