ভারত সরকারের বিরুদ্ধে মাস্কের প্রতিষ্ঠানের মামলা
Published: 21st, March 2025 GMT
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠজন ধনকুবের ইলন মাস্কের মালিকানার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ভারত সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। বৃহস্পতিবার ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় কর্ণাটক রাজ্যের হাইকোর্টে মামলাটি করা হয়। ভারতে বেআইনিভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিষয়বস্তু (কনটেন্ট) নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে এবং ইচ্ছেমতো সেন্সরশিপ চালানো হচ্ছে বলে মামলায় সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।
শুক্রবার দ্য গার্ডিয়ান অনলাইন জানায়, এ মামলা এক্সের সঙ্গে ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের চলমান দ্বন্দ্বের বিষয়টিকে আরও জোরালোভাবে সামনে আনল। ভারতে ইলন মাস্কের স্টারলিংক ও টেসলার যাত্রা শুরুর পরিকল্পনার মধ্যে এ মামলা হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ইলন মাস্ক ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট ইফিসিয়েন্সির প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। গুরুত্বপূর্ণ এ বিভাগ যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বিশ্বের বহু দেশে অনুদানসহ নানা আর্থিক ব্যয়ের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনকে পরামর্শ দেয়।
এজাহারে বলা হয়, অনলাইন কনটেন্ট বাতিল করতে ভারতের তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী অন্যায়ভাবে তাঁর সেন্সরশিপ ক্ষমতা ব্যবহার করছে। এক্সের অভিযোগে বলা হয়, ভারত তার তথ্যপ্রযুক্তি আইনের (আইটি অ্যাক্ট) অপব্যাখ্যা করেছে। বিশেষ করে আইনের ৭৯(৩)(বি) ধারা যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়কে লঙ্ঘন করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশকেও তা ব্যাহত করছে। আইনের ওই ধারা অনুযায়ী, তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ সাধারণ পরিষেবা ব্যবহারকারীরা কী লিখছেন, তার জন্য এক্স বা ওই জাতীয় প্ল্যাটফর্ম দায়ী থাকবে না, যদি তারা নির্দিষ্ট কিছু শর্ত ভঙ্গ না করেন।
ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বলছে, ৭৯(৩)(বি) ধারা অনুযায়ী, আদালতের নির্দেশ বা সরকারের নোটিশের ভিত্তিতে অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে আইনবহির্ভূত বিষয়বস্তু সরাতে হবে। কোনো অনলাইন প্ল্যাটফর্ম যদি ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে এ নির্দেশ (আদালত বা সরকারের) মেনে নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু সরিয়ে না নেয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। ভারতীয় দণ্ডবিধিতেও ওই প্ল্যাটফর্ম বা সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে বলে মনে করছে ভারত সরকার।
এ জায়গাতেই ইলন মাস্কের সংস্থা এক্সের সঙ্গে ভারত সরকারের মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। এক্স মনে করছে, কোনো বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ করতে বা তা সরিয়ে দিতে গেলে আদালতের নির্দেশ প্রয়োজন। সরকারের নির্দেশের ভিত্তিতে এ কাজ করা যাবে না। মামলার পরবর্তী শুনানি ২৭ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে।
সম্প্রতি ভারতে ইলন মাস্কের সংস্থা এক্স কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর চ্যাটবোট ‘গ্রোক-৩’ প্রকাশ করে। আক্ষরিক অর্থে এটি ভারতজুড়ে ঝড় তোলে। গ্রোক এমন সব বিতর্কিত বিষয় নিয়ে কথা বলে, যেগুলো নিয়ে দেশটির ক্ষমতাসীন কট্টরপন্থি বিজেপি সরকারের সরাসরি বিরুদ্ধে যায়। যে বিষয়গুলো নিয়ে বিজেপি-আরএসএসসহ তাদের মিত্র দলগুলো প্রচারণা চালিয়ে আসছে, সেগুলোকে ‘ভুয়া’ প্রমাণ করে দিয়েছে গ্রোক। সেই সঙ্গে আবেগতাড়িত না হয়ে নির্মোহভাবে ইতিহাসের সত্যকে গ্রহণের পরামর্শও দিচ্ছে এটি। এসব কারণে কার্যত বিপাকে পড়ে মোদি সরকার।
দ্য ওয়্যারের প্রতিবেদন জানায়, ইলন মাস্কের সামাজিক মাধ্যম ‘এক্স’ ব্যবহারকারীরা গ্রোক-৩-এর মাধ্যমে নানা প্রশ্নের উত্তর জানতে পারছেন। গ্রোকও বলছে, তাদের জবাব পুরোপুরি তথ্যনির্ভর। এতদিন বিজেপি ও তার সমমনা সংগঠনগুলো দাবি করে আসছিল, সোনিয়া গান্ধী ‘বার ডান্সার’ ছিলেন। গ্রোক বলছে, এটা ভুল তথ্য। তিনি বার অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন; ডান্সার ছিলেন না। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে মোদির ‘অনুপ্রবেশকারী’ মন্তব্যের জবাবে গ্রোক বলছে, এটা তিনি করেছেন ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’ জাগাতে।
ব্রিটিশদের কাছে সবচেয়ে বেশিবার কে ক্ষমা চেয়েছেন এবং কে তাদের কাছ থেকে মাসে ৬০ টাকা পেনশন নিতেন– এমন প্রশ্নে গ্রোক বলছে ভারতের হিন্দুত্ববাদী নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকরের কথা। একজন জানতে চান, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আরএসএসের ভূমিকা কী ছিল। উত্তরে বলা হয়, ‘গবেষণালব্ধ তথ্য অনুসারে আরএসএসের ভূমিকা ন্যূনতম অথবা শূন্য ছিল। এর আগে গ্রোক বিষয়ে ইলন মাস্ক বলেন, এটা বিশ্বের সবচেয়ে মজার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই।’
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইলন ম স ক ইলন ম স ক র স প ল য টফর ম ব যবহ র সরক র র
এছাড়াও পড়ুন:
সবাই ভয়ে পালিয়েছে, ভারতের নন্দনগরে এক মুসলিম পরিবারের টিকে থাকার লড়াই
নন্দাকিনী নদীর তীরে রোজ সকাল আটটায় নিজের ড্রাই ক্লিনিংয়ের দোকানের বাদামি শাটার খুলে কাজ শুরু করেন আহমেদ হাসান। উত্তর ভারতের হিমালয় অঞ্চলের উত্তরাখন্ড রাজ্যের নন্দনগরে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসছেন তিনি।
সকালে দোকান খুলে নিত্যদিনের কাজ শুরু করেন হাসান। শুকনো পদ্ধতিতে পরিষ্কার (ড্রাই ক্লিনড) করা কাপড় নিজের দোকানের গোলাপি দেয়ালের প্লাস্টিক কভারে সুচারুভাবে ঝুলিয়ে রাখেন। এরপর ৪৯ বছর বয়সী এই ব্যক্তি গ্রাহকের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মধ্যাহ্নভোজের আগে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন গ্রাহক হাসানের কাছে আসতেন। শেরওয়ানি, স্যুট, কোট, প্যান্ট এবং শীতকালীন পোশাক তাঁর কাছে পরিষ্কার করতে দিতেন। কোনো কোনো গ্রাহক তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতেন। চা খেতে খেতে রাজনীতি নিয়ে আলাপ ও মজা করতেন, হাসি–আনন্দ ও সুখ-দুঃখ বিনিময় করতেন। গ্রাহকদের বেশির ভাগ ছিলেন হিন্দু, অল্প কিছু ছিলেন মুসলিম।
কিন্তু ১২ এপ্রিল দুপুর পর্যন্ত পাঁচজনেরও কম হিন্দু গ্রাহক হাসানের দোকানে এসেছেন। তিনি জানান, কোনো মুসলিম গ্রাহকের আশায় থাকা বৃথা। এ সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে।
নন্দনগরে এখন হাসানই একমাত্র মুসলিম পুরুষ। অথচ এই শহরে কয়েক মাস আগেও ১৫টি মুসলিম পরিবার ছিল, যারা বংশপরম্পরায় এখানে বসবাস করে আসছিল। হাসানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এখানেই। প্রতিবেশী হিন্দুদের সঙ্গে তাঁর পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল। পূজা-পার্বণে হিন্দুরা তাঁদের নিমন্ত্রণ করতেন। আর ঈদের সময় হিন্দু প্রতিবেশীদের তাঁরা দাওয়াত দিতেন। প্রতিবেশী হিন্দু মারা গেলে শবদাহের জন্য তিনি কাঠ সংগ্রহ করতেন, হিন্দু বন্ধুদের মরদেহ কাঁধে বহন করে শ্মশানে নিয়ে গেছেন।
কিন্তু গত সেপ্টেম্বরে এই এলাকায় মুসলিমবিরোধী সহিংসতা শুরুর পর এ সবকিছু রাতারাতি বদলে গেছে। এক হিন্দু মেয়েকে যৌন হয়রানির অভিযোগে এ সহিংসতা শুরু হয়েছিল। তবে নন্দনগরে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে মন–মানসিকতায় আরও আগে থেকেই বড় পরিবর্তন সূচনা হয়েছিল, যা করোনাকাল থেকে খেয়াল করে আসছিলেন হাসান।
গত সেপ্টেম্বরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে শারীরিক হামলার আগে তাঁদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ঘৃণামূলক স্লোগান দেওয়া হতো। মুসলিমবিরোধী কিছু বিক্ষোভও হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় হিন্দু মেয়েকে যৌন হয়রানির অভিযোগে তাঁদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। দোকানপাট ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রাণভয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মানুষেরা রাতের আঁধারে নন্দনগর ছেড়ে পালিয়ে যান।
হাসানও পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি স্ত্রী, দুই মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে ফিরে আসেন। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই ছোট্ট শহর আবার মুসলিমদের বসবাসের উপযোগী করার ব্যাপারে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কারণ, এটাই তাঁদের জন্মভূমি। কিন্তু হাসানের পরিবারকে সেখানে এখনো ভয়ে ভয়েই থাকতে হচ্ছে।
হিন্দু প্রতিবেশীরা এখন হাসানের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন না। আগে তিনি সন্ধ্যায় নিয়মিত নন্দাকিনী নদীর তীরে হাঁটতে গেলেও এখন যান না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের কারও সঙ্গে দেখা করতে দেন না। তাঁর আশঙ্কা, আবারও সহিংসতা দেখা দিতে পারে।
হাসান বলেন, ‘আমি সোজা দোকানে যাই, দোকান থেকে বাসায় আসি। সারাটি জীবন এই শহরে কাটালেও নিজেকে আমার এখন ভূত বলে মনে হয়। আমি যেন সম্পূর্ণ অদৃশ্য। এমনকি কেউ আমার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলছেন না।’
‘মুসলিমদের জুতা দিয়ে পেটাও’
রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে গাড়িতে করে নন্দনগর যেতে সময় লাগে প্রায় ১০ ঘণ্টা। ভারত-চীন সীমান্তের কাছাকাছি স্থানের এই শহরটি নন্দাকিনীর কয়েকটি উপনদীর সংগমস্থলে অবস্থিত। গঙ্গার ছয়টি উপনদীর একটি হলো নন্দাকিনী, যাকে হিন্দুরা পবিত্র বলে বিশ্বাস করেন। শহরটি জনসংখ্যা প্রায় দুই হাজার।
হাসানের দাদা পার্শ্ববর্তী উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বিজনৌর জেলার নাজিবাবাদ শহর থেকে ১৯৭৫ সালে নন্দনগরে এসেছিলেন। তাঁদের পরিবার সেখানেই বসতি গড়ে। পরের বছর হাসানের জন্ম হয়।
এক মুসলমান নরসুন্দরের যৌন হয়রানির অভিযোগের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ মিছিলে হাসান ও নন্দনগরের অন্য মুসলমানরাও অংশ নিয়েছিলেন