জনগণ আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করার সুযোগ দিলে আমাদের কিছু বলার নেই: রিজভী
Published: 21st, March 2025 GMT
জনগণ যদি আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করার সুযোগ দেন, তাহলে তা নিয়ে কিছু বলার নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
রিজভী বলেন, ‘যে লোক আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসবেন, তিনি যদি অপরাধ না করেন, তিনি যদি ছাত্রহত্যা না করেন, তিনি যদি কোনো অর্থ লোপাট না করেন, টাকা পাচার না করেন; এ রকম লোক যদি নেতৃত্ব আসেন, তাহলে সেই আওয়ামী লীগ কেন রাজনীতি করতে পারবে না। আমার বক্তব্য হচ্ছে এটা।’
রাজধানীর উত্তরার দক্ষিণখানে হাজী শুকুর আলী মাদ্রাসাসংলগ্ন মাঠে আজ শুক্রবার সকালে দুস্থদের মধ্যে ঈদসামগ্রী বিতরণ অনুষ্ঠানে রুহুল কবির রিজভী এ কথা বলেন। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও রশিদ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কফিল উদ্দিন আহমেদ এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘কথা উঠছে যে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে পারবে কি পারবে না? কিন্তু এই কথা উঠছে না, এই যে যারা গণহত্যা চালাল, তাদের বিচার হবে কি না?’ তিনি বলেন, ‘কারা (গণহত্যা) চালিয়েছে? এটা কি মানুষ দেখেনি? কোন পুলিশ, কোন ওসি, কোন ডিসি, কোন এসি এখানে ভূমিকা রেখেছে? এই গণ-আন্দোলন ধ্বংস করার জন্য দমন করা হয়েছিল কার নির্দেশে, আওয়ামী লীগের কোন নেতাদের নির্দেশে?’
‘আপনারা এগুলোর বিচার দ্রুত নিশ্চিত করতে পারলে.
বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, যাঁরা টাকা পাচার করেছেন, যাঁরা শিশু-কিশোরদের হত্যা করেছেন, তাঁদের বিচার হতে হবে। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘শিশু–কিশোর, তরুণ, ছাত্রছাত্রীদের যারা হত্যা করেছে, শ্রমিক, রিকশাচালককে যারা হত্যা করেছে, তাদের বিচারটা আমরা করি না কেন?’
আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে রুহুল কবির রিজভী বলেন, এরা মানুষকে নানা প্রলোভন দিয়ে, মিথ্যা কথা বলে, মিথ্যা অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় এসে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তাঁর (শেখ হাসিনা) বাবা (শেখ মুজিবুর রহমান) সব দল বন্ধ করে দিয়ে বাকশাল করলেন। তাঁর মেয়ে নতুন কায়দায় নতুনভাবে আরও জঘন্যতম বাকশাল তৈরি করেছেন। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ন্যূনতম আওয়াজ করলে তাঁর স্থায়ী ঠিকানা হতো কারাগার। সেই রাজত্ব যাতে ফিরে না আসে, সেগুলো নিশ্চিত করেই গণতন্ত্রে যার যার যায়গা, যার যার রাজনীতি করার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
ন্যায়সঙ্গত বিচার হলে আর ফ্যাসিবাদের জন্ম হবে না উল্লেখ করে রিজভী বলেন, ‘তখন কে রাজনীতি করবেন, কে করবেন না, সেই দায়িত্ব জনগণ নেবেন এবং তাঁকে সেইভাবেই সমর্থন করা হবে।’
বিএনপিকে নিয়ে এখনো অনেক অপপ্রচার হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন রিজভী। তিনি বলেন, তাঁরা ‘মিডিয়া ট্রায়ালের’ মুখোমুখি হচ্ছেন। গণমাধ্যম শুধু মারামারি ও চাঁদাবাজির খবর দেয়, দলীয় ব্যবস্থা নেওয়া এবং ভালো কাজের খবরগুলো সেভাবে তুলে ধরা হয় না। তিনি বলেন, বিএনপি আড়াই থেকে তিন হাজার নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করেছে। তারেক রহমান এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স (শূন্যসহনশীলতা) দেখিয়েছেন।
অনুষ্ঠানে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল হক বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন। এতে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য ও রশিদ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোতালেব হোসেন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অন ষ ঠ ন ব এনপ র র জন ত কর ছ ন আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
বৈশাখের মালিকানা যেন ফিরেছে জনগণের কাছে
বাংলা বছরের প্রথম দিন, পয়লা বৈশাখ, কেবল একটি দিন নয়—এটি একটি জাতিসত্তার প্রকাশ, বাঙালির আত্মপরিচয়ের এক অমোঘ নিদর্শন। বহু শতাব্দী ধরে এই উৎসব বাঙালির জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কালের বিবর্তনে, নানা রাজনৈতিক সংকট আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে এই উৎসবও কখনো সংকুচিত হয়েছে, কখনো হয়ে উঠেছে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রতীক। যেন তা আটকে ছিল কিছু নির্দিষ্ট বলয়ে, একটি দল বা ঘরানার নিজস্ব আয়োজন হিসেবে। এবারের বৈশাখ সেই নীরব অবরোধ ভেঙে দিয়েছে।
মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে উৎসবে মেতে ওঠা এবং শহরের সীমানা পেরিয়ে গ্রাম পর্যন্ত এর ছোঁয়া—সব মিলিয়ে ১৪৩২ বঙ্গাব্দের প্রথম দিনটি যেন ছিল এক সাংস্কৃতিক জাগরণের সূচনা।
বৈশাখের ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে বোঝা যায়, এই উৎসব কখনোই কোনো একক গোষ্ঠীর সম্পত্তি ছিল না। মোগল সম্রাট আকবর কৃষিব্যবস্থাকে সংগঠিত করতে বাংলা সন প্রবর্তন করেছিলেন, যার মাধ্যমে রাজস্ব আদায় সহজ হতো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এই হিসাবের বর্ষপঞ্জি পরিণত হয় উৎসবে। পরিণত হয় বাঙালির মাটির সঙ্গে মিশে থাকা সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশে।
গ্রামীণ বাংলার বৈশাখ তাই ছিল বটতলার মেলা, হালখাতা, ঢাকঢোল, নাচ-গান, আর লাল-সাদা শাড়ি-পাঞ্জাবির আনন্দ। মানুষের মুখে মুখে থাকা পল্লিগীতি, মুরব্বিদের মুখে নতুন বছরের শুভেচ্ছা, আর বাচ্চাদের হাতে বাতাসা-মুড়ির ঠোঙা—এসব ছিল এই উৎসবের বাস্তব রূপ।
এটি কখনোই শহরের চারুকলা বা ছায়ানটের একক সত্তা ছিল না। তবে শহরকেন্দ্রিক আধুনিকতার ছোঁয়ায়, বৈশাখ ধীরে ধীরে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি ও রাজনৈতিক বলয়ের দখলে চলে যেতে থাকে। বিশেষ করে সামরিক শাসনের পরবর্তী সময়ে, যখন জাতীয়তাবাদী চেতনার বিপরীতে দাঁড় করানো হলো বাঙালি সংস্কৃতিকে, তখন আওয়ামী লীগ এবং সংশ্লিষ্ট সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বৈশাখকে তাদের পরিচয় নির্মাণের হাতিয়ার করে তোলে। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা, ছায়ানটের রমনা বটমূলে গান—এসব হয়ে ওঠে বৈশাখের মূল চিত্র। অথচ এতে গ্রামীণ মানুষের উপস্থিতি ছিল না, ছিল না পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী, সাঁওতাল, রাজবংশী, চাকমা কিংবা মারমাদের সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব।
বৈশাখ যদি বাঙালির হয়, তবে তাকে হতে হবে সর্বজনীন। তাতে থাকতে হবে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান; শহরের উচ্চবিত্ত, গ্রামের কৃষক, আদিবাসী গোষ্ঠী এবং প্রান্তিক মানুষের সমান অংশগ্রহণ। সংস্কৃতি কখনোই সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অনুগত নয়, বরং এটি জনমানুষের আত্মা, যা কেবল তখনই সত্যিকারভাবে প্রসারিত হয়, যখন সেটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে।এই একচেটিয়া সংস্কৃতিচর্চা একসময় এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় যে ধর্মীয় রক্ষণশীলদের একটি বড় অংশ এবং রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমতাবলম্বী মানুষদের কাছে পয়লা বৈশাখ হয়ে উঠে বিতর্কিত—যেন এটি একটি ‘লিবারেল’ বা ‘আওয়ামী’ উৎসব। এই মনোভাব সমাজে যে সাংস্কৃতিক বিভাজন তৈরি করেছিল, তা আমাদের জাতিসত্তার বৈচিত্র্যময় রূপকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কিন্তু এবারের বৈশাখ ছিল এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা। শহর আর গ্রাম একসঙ্গে মিশে গেল যেন একসুতোয় বাঁধা উত্সবে। আর এই উৎসব ছিল সবার—কোনো নির্দিষ্ট ঘরানার রাজনৈতিক পরিচয়ে বিশ্বাসীদের নয়, বরং প্রত্যেক সেই মানুষের, যিনি নিজেকে বাঙালি বলে ভাবেন, এমনকি বাঙালি ছাড়া অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরও।
এই বছর রাজপথে ছিল ছায়ানটের গান, স্কুলপড়ুয়া বাচ্চাদের নাচ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী পোশাকে র্যালি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক অরাজনৈতিক সংগঠনের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত লোকজ মেলা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওগুলোতে দেখা গেছে, কোথাও গ্রামের স্কুলমাঠে ব্যানারহীন বৈশাখী অনুষ্ঠান, আবার কোথাও পাহাড়ি অঞ্চলে মারমা বা ত্রিপুরা সংস্কৃতির অংশ নিয়ে বৈশাখ উদ্যাপন। এসব আয়োজন প্রমাণ করেছে—মানুষ নিজের উৎসব নিজের মতো করে ফিরিয়ে নিচ্ছে।
এই অংশগ্রহণ শুধু সাংস্কৃতিক নয়, একধরনের রাজনৈতিক প্রতিবাদও বটে। উৎসবের ওপর একচেটিয়া অধিকার প্রত্যাখ্যান করে মানুষ এবার বলেছে—এটি তাদের দিন, তাদের আনন্দ, তাদের পরিচয়। এটা যেন ছিল নিঃশব্দ এক সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থান, যেখানে না আছে দলীয় পতাকা, না আছে আদর্শগত হম্বিতম্বি। আছে কেবল ভালোবাসা, শিকড়ের টান আর জাতিসত্তার মৃদু অথচ দৃঢ় ঘোষণা।
বৈশাখ যদি বাঙালির হয়, তবে তাকে হতে হবে সর্বজনীন। তাতে থাকতে হবে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান; শহরের উচ্চবিত্ত, গ্রামের কৃষক, আদিবাসী গোষ্ঠী এবং প্রান্তিক মানুষের সমান অংশগ্রহণ। সংস্কৃতি কখনোই সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অনুগত নয়, বরং এটি জনমানুষের আত্মা, যা কেবল তখনই সত্যিকারভাবে প্রসারিত হয়, যখন সেটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে।
সুতরাং এবারের বৈশাখ একটি বার্তা দিয়েছে। বার্তা দিয়েছে যে সাংস্কৃতিক মালিকানা ফিরে যাচ্ছে জনগণের হাতে। এই ধারা যেন অব্যাহত থাকে। বৈশাখ হবে আরও বৈচিত্র্যপূর্ণ, আরও অংশগ্রহণমূলক অর্থাৎ সব ধরনের রুচি, চিন্তা ও সংস্কৃতিকে ধারণক্ষম। এই সমাজচিত্রই হোক আগামীর বাংলাদেশ, যেখানে উৎসব মানে বিভাজন নয়, বরং মিলনের সেতুবন্ধন।
শাহরিয়ার মোহাম্মদ ইয়ামিন যুগ্ম সদস্য সচিব, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়